দৃষ্টির অগোচরে,১৯ তম_পর্ব,২০ তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
১৯তম_পর্ব
নুশরাতরা সেই রেস্টুরেন্টে যায় যেখানে স্নিগ্ধ সে রাতে খেয়েছিলো। রেস্টুরেন্টটি খুব সুন্দর। বেশ পরিপাটি করে সাজানো। একটি দেয়ালে সব কাস্টোমারদের ছবি আটকানো। খাবারও বেশ ভালো। খাবার খাওয়া শেষে তৌহিদ হাত ধোবার জন্য উঠে। ওয়াশরুমে যাবার সময়ই পা আটকে যায় তার। পাশে খেয়াল করে তাকালে তার চোখে পড়ে তার বা পাশের দেয়ালে প্রচুর ছবি পিন দিয়ে আটকানো। তৌহিদ একটা ওয়েটারকে ইশারা করে। ওয়েটারটি তার কাছে আসলে সে হাসির ছলে বলে,
– এই দেয়ালে কাদের ছবি?
– আসলে স্যার আমাদের রেস্টুরেন্টে যারা পার্টি বা কোনো অনুষ্ঠান করেন অথবা কারোর বিশেষ দিন পালন করেন তাদের ই ছবি এখানে পিন করে রাখা হয়। আমাদের রেস্টুরেন্টের মটো, কাস্টোমারদের সুখময় মূহুর্তগুলো একটা ফ্রেমে বেধে রাখা।
– ওহ, এই কাজটা বেশ ভালো।
ওয়েটারটি চলে যাবার পর তৌহিদ সূক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে দেয়ালটির উপর। তার ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয়ে আসে। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়। মনে আশংকা জন্মায়৷ খারাপ কিছুর আভাষ পাচ্ছে সে। তৌহিদ ঘাড় কাত করে তাদের টেবিলের দিকে তাকায়। নুশরাত, রবিন এবং স্নিগ্ধ হেসে হেসে কথা বলছে। হঠাৎ স্নিগ্ধ তৌহিদের দিকে তাকায়। তাদের চোখাচোখি হয়। হঠাৎ ই স্নিগ্ধের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। সে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে এই হাসির দ্বারা। কিন্তু স্নিগ্ধের হাসিটা দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে তৌহিদের। অন্যরকম এই হাসিটা। এই হাসিটা আগেও স্নিগ্ধের ঠোঁটে দেখেছিলো সে, যেদিন প্রথম তাকে এরেস্ট করা হয়। তৌহিদ স্নিগ্ধের হাসির বিপরীতে মলিন হাসি দিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।
নুশরাত, স্নিগ্ধ এবং রবিন কথায় মশগুল।অনেক দিন পর প্রাণ খুলে হাসছে নুশরাত। এই কেসটা তাকে প্রচুর ভুগিয়েছে। শুধু যে কেসের চিন্তা তা নয়, মাহিরের খুনিও তাকে কম দুঃস্বপ্ন দেয় নি। প্রতিনিয়ত তার কাছে নতুন এডভেঞ্চার লাগে। কথায় কথায় এক পর্যায়ে স্নিগ্ধ বলে উঠে,
– ম্যাডাম আপনি বুঝলেন কি করে শামীম সাহেব ই খুন টা করেছিলো?
প্রশ্নটা শুনে মৃদু হাসে নুশরাত, তারপর রবিনের দিকে তাকায়। রবিন ও মিটিমিটি হাসে। এবার রবিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলতে থাকে,
– আসলে নুশরাত যেদিন স্নেহার বাসায় গিয়েছিলো সেদিনই ও আশংকা করেছিলো স্নেহার পরকীয়া চলছে। আলতাফের মৃত্যুতে সে মোটেই শোকাহত নয়। আবার বিল্ডিং ঢোকার সময় সিসিটিভি ক্যামেরা ও লাগানো। তারপর আমি এবং তৌহিদ স্যারের খবরীরা নজর রাখতে লাগলাম স্নেহার উপর। এই নজর রাখতে রাখতে আমরা জানতে পারি শামীম সাহেবের সাথে স্নেহার একটু অন্যরকম সম্পর্ক আছে। এবং প্রতি সময় যখন শামীম সাহেব বাসায় এন্ট্রি করে সেটা স্নেহা দারোয়ানকে ঘুষ খাওয়িয়ে ডিলেট করে দেয়। ব্যাস সেই সুযোগটাই আমরা নিয়েছি। দারোয়ানকে চেপে ধরেছি। দারোয়ান ও চালু লোক, স্নেহার থেকে বেশি টাকা হাতানোর জন্য সে শুধু ফুটেজ গুলো ডিলেট করে কিন্তু রিসাইকল বিনের ফুটেজ ডিলেট করে না। আমরা সেই ফুটেজগুলো রিস্টোর করে যখন শামীম সাহেবকে চেপে ধরি ও গড়গড় করে সব উগড়ে দেয়।
রবিনের কথার মাঝেই নুশরাত বলে উঠে,
– শামীম সাহেব এতো তাড়াতাড়ি স্বীকারোক্তি দিবে এটা স্নেহাও জানতো না হয়তো। অবশ্য আমরাও আশা করি নি। তবে সব কাজ খুব ইজিলিই হয়ে গেলো। এখন শুধু ওই কালো জ্যাকেট পড়া লোকটাকে ধরা বাকি! ওকে ধরতে পারলে কেল্লা ফতে।
নুশরাতের কথার মাঝেই তৌহিদ ফিরে আসে। তৌহিদের দৃষ্টি স্নিগ্ধের দিকে স্থির। স্নিগ্ধ তৌহিদের এরুপ তীর্যক দৃষ্টিকে এড়াতে পারছে না। সবার খাবার খাওয়া শেষ হয়ে গেলে নুশরাত বিলের জন্য ওয়েটারকে ডাকতে নেয়। তখন তৌহিদ বাধা দিয়ে বলে,
– আমি আমাদের জন্য আইসক্রিম ওর্ডার করেছি। আইসক্রিমটা আসতে আসতে কিছুক্ষণ গল্প করা যাক৷
– হ্যা আমার কোনো সমস্যা নেই। আজকে এমনিতেই প্রেসার নেই আমার।
নুশরাতের কথা শুনে রবিন ও তাড়া দেখায় না। তেদের মধ্যে অনেককিছু নিয়েই আলোচনা হতে থাকে। এক পর্যায়ে তৌহিদ কৌতুহলী কন্ঠে স্নিগ্ধকে প্রশ্ন করে উঠে,
– আমি শুনেছিলাম তুমি নাকি অনেকটা জোর করেই নুশরাতকে নিজের উকিল হিসেবে বাছাই করেছিলে? এতো উকিল থাকতে নুশরাতই কেনো স্নিগ্ধ?
– আ…আসলে তেমন কোনো বিশাল কারণ নেই। আমি পত্রিকায় পড়েছিলাম কিভাবে নুশরাত ম্যাডামকে ফাঁসিয়ে মিথ্যে কেসে জড়ানো হয়। ভাবলাম নুশরাত ম্যাডাম আমার যন্ত্রণাটা অনুভব করতে পারবেন তাই আর কি!
– ওহ! আমি ভেবেছিলাম তুমি নুশরাতকে আগ থেকে চিনতে।
– না না আমি উনাকে আগ থেকে চিনতাম না। আচ্ছা ম্যাডাম, ওই খুনের খুনী তো মারা গিয়েছিলো তাই না ম্যাডাম?
স্নিগ্ধ হুট করেই কথাটা বললো। নুশরাত প্রশ্নটার উত্তরটা ঠিক কি দিবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। কারণ সে জানে মাহিরের খুনী বেঁচে আছে। প্রতিনিয়ত সেই ব্যাক্তি তাকে চোখে চোখে রাখছে। এক মূহুর্ত ও চোখের আড়াল করে নি। নুশরাত একটু এগিয়ে আসলো, গলাটা যথাসম্ভব নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
– খুনি মারা যায় নি, সে বেঁচে আছে। আমাকে থ্রেড অবধি দিয়েছে। কারণ আমি তাকে হন্নে হয়ে খুঁজছি।
নুশরাতের এমন কথায় বেশ অবাক হয় তৌহিদ। মাহিরের কেসের ইতি টানার পর নুশরাতের সাথে তার দ্বিতীয়বার মুখোমুখি স্নিগ্ধের কারণেই হয়েছে। তাই নুশরাতের জীবনে কি হচ্ছে সেটা তার অজানা। মাহিরের খুনটা একটা রহস্য যার কোনো সমাধান তৌহিদ পায় নি। যদিও কোথাও না কোথাও একটা খটকা লেগেছিলো, কারণ একটা ছিচকে চোর কখনোই এতোটা প্রফেশনাল ভাবে কাউকে খুন করতে পারে না। এতো নিঁখুত ভাবে আঘাত গুলো করা হয়েছিলো যে মাহিরের মৃত্যু নিশ্চিত ছিলো। নুশরাতের কথায় এবার তৌহিদ নিশ্চিত হলো, মাহিরের খুনী বেঁচে আছে। নুশরাত তখন আবার বলা শুরু করলো,
– যেদিন মাহিরের খুনের রায় হয় সেদিন খুনী আদালতেই ছিলো এবং সে আমার উপর নজর রাখছিলো। তার মনে একটা ভয় ছিলো! রবিন বা তৌহিদ ভাই তার জালটা ভেদ করতে পেরেছে কিনা! কিন্তু তারা পারে নি। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলো কিন্তু আমার পিছু সে ছাড়ে নি। আমি অনেকিবার কথাটা রবিনকে জানিয়েছি, সে বিশ্বাস করে নি। কিন্তু সেই রাতে ওর হুমকিভরা চিঠি এবং আমার উপর অতর্কিতে হামলা আমাকে নিশ্চিত করে দিয়েছে যে মাহিরের খুনী বেঁচে আছে এবং আমার প্রতিটা আন্দাজ ঠিক৷ ও ভেবেছে আমি হুমকিতে ভয় পাবো। কিন্তু ওর ধারণা ভুল৷ আমি ওকে ঠিক খুঁজে বের করবো। ও আমাকে দমাতে যেয়ে নিখুঁত একটা ক্লু দিয়ে দিয়েছে আমাকে।
– আপনি নিশ্চিত কিভাবে? যে আপনাকে হুমকি দিয়েছে সেই মাহিরের খুনি?
– পারফিউম, খুনি একটা পারফিউম ইউজ করে। অদ্ভুত ব্যাপার পারফিউমটা মেল পারফিউম না ব্রান্ডটা বেশ দামী, “Paul sebastian”। আমি পারফিউম এর গন্ধটা খুনের দিন রাতে গেটে ঢোকার সনয় পেয়েছিলাম। তখন খুনি আমার পাশ কাটিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলো। আমি ভেবেছি ফ্লাটের কেউ হবে হয়তো। আবার একইরকম গন্ধ কিন্তু হালকা, খুব মাইল্ড সাধারণত গন্ধটা মিলিয়ে যেমনটা নাকে লাগে ঠিক তেমনটা আমি আমার ফ্লাটে ঢোকার সময় ও পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন মাহিরের ওই অবস্থা দেখে কথাটা আমার মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছিলো। সেই একই তীব্র গন্ধটা আমি কোর্টে পেয়েছিলাম। এরপর থেকে আমি পারফিউমটা পাগলের মতো খুঁজতে থাকি। কিন্তু আশাহত হই। প্রথমে ভেবেছিলাম যেহেতু খুনি পুরুষ তাই পারফিউমটা মেল কালেকশনের। কিন্তু আমাকে পুরোপুরি মিথ্যে প্রমাণিত করে খুনি। পারফিউমটা ফিমেল কালেকশনের ছিলো। বাংলাদেশের খুব কম দোকানে এই কালেকশনটা পাওয়া যায়। খুনি যখন বুঝতে পারলো আমি তাকে খুব দ্রুত ধরে ফেলবো। তখন সে আমাকে থ্রেড দেয়। আমার নতুন বাসায় লুকিয়ে থেকে আমার উপর হামলা করায়। হামলাকারী পালিয়ে যায় কিন্তু বক্স রেখে যায়। তাতে ছয়টা “Paul sebastian” এর মেল কালেকশনের পারফিউম ছিলো। আর একটা হুমকিভরা চিঠিও রেখে গিয়েছিলো। খুনী ভেবেছিলো এবার আমি তার হুমকিতে ভয় পেয়ে তাকে নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করবো না। আর যদি ঘাটাঘাটি করিও তবুও তাকে আমি খুঁজে পাবো না কারণ সেই বক্সের পারফিউমের স্মেল আর খুনীর পারফিউমের স্মেল অনেকটা একই। অনেকটা বলবো না, কারণ প্রথমে আমিও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিলাম। প্রথমবার স্মেল নিলে কেউ বুঝতেই পারবে না স্মেলগুলোর ডিফারেন্স।
নুশরাতের কথার মাঝেই স্নিগ্ধ প্রশ্ন করে উঠে,
– তাহলে আপনি পার্থক্যটা বুঝলেন কি করে? আর কি এমন ক্লু পেয়েছেন আপনি খুনীর সম্পর্কে।
নুশরাত খেয়াল করলো স্নিগ্ধ, রবিন এবং তৌহিদের চোখ চকচক করছে। তারা আগ্রহ নিয়ে বসে রয়েছে তার কথা শোনার জন্য। ততক্ষণে আইসক্রিম চলে আসে। তাই নুশরাত মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
– বলবো, আরেকদিন। আগে তাকে খুঁজে পাই।
আইসক্রিম খাওয়া শেষে তৌহিদ খাবারের বিলটা দিয়ে দেয়। রবিন নুশরাতকে বললো,
– চল তোকে বাসায় পৌছে দেই।
– আরে লাগবে না। আমি তৌহিদ ভাইয়ের সাথে চলে যাবো। তুই সাবধানে যা। আর স্নিগ্ধ আজ আসি। যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে ফোন দিও৷
রবিন দ্বিতীয়বার নুশরাতকে জোর করে না। নুশরাত তৌহিদের বাইকের পেছনে বসে। রবিন সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তৌহিদ এবং নুশরাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাইকটা চলা শুরু করে কিন্তু রবিন এখনো বাইকের যাবার পানে তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে বাইকটা অদূরে মিলিয়ে যায়, কিন্তু রবিনের দৃষ্টি তখনো স্থির থাকে। বুকের এক কোনায় চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে, এ ব্যাথার উৎস তার অজানা_____________
এক সপ্তাহ পর,
সেন্ট্রাল জেলে শামীম সাহেবকে শিফট কর হয়েছে। তার পরণে কয়েদীর জামা। এই এক সপ্তাহে তার সাথে দেখা করতে অনেকে এসেছিলো। কিন্তু আজ দেখা করতে এসেছে তাকে দেখে শামীম ভয়ে কাঁপছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। বারবার ঠোঁটের উপরের ঘাম মুছছে সে। শামীমের সামনে কালো জ্যাকেট পরিহিত একটা লোক বসে রয়েছে। তার চোখের দিকেও তাকাতে ভয় পাচ্ছে শামীম। লোকটি হিনহিনে কন্ঠে বলে,
– মৃত্যুর ভয়ে খুনের শাস্তিও নিজ ঘাড়ে নিয়ে নিলে শামীম ভাই? তুমি কি ভেবেছো আমি তোমাকে জেলের ভেতর ছুঁতে পারবো না?
– আমাকে ক্ষমা করা যায় না? আমি তো খুনের দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিলাম। আমার জন্য বেঁচারি স্নেহাও জেলে পঁচবে৷ এবার আমাকে ক্ষমা করে দে!
– শামীম ভাই, সব দোষের কি ক্ষমা হয়? এভাবে ক্ষমা চেয়ে আমাকে ছোট করো নাতো। তুমি হলে আমার গুরুজন। আমার একমাত্র চাচাতো ভাই এর কাছের ব্যাক্তি। আমরা এক সাথে কত চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়েছি। আমার কাছে তুমি কেনো ক্ষমা চাইছো?
লোকটা বিদ্রুপের স্বরে কথাগুলো বলে। শামীম তখন শুকবো ঢোক গিলে বলে,
– আমাকে বাঁচতে দে, আমি কিছু করি নি। আমি সত্যি কিছু করি। স্নিগ্ধ বিশ্বাস কর…………
চলবে
দৃষ্টির অগোচরে
২০ তম_পর্ব
– শামীম ভাই, সব দোষের কি ক্ষমা হয়? এভাবে ক্ষমা চেয়ে আমাকে ছোট করো নাতো। তুমি হলে আমার গুরুজন। আমার একমাত্র চাচাতো ভাই এর কাছের ব্যাক্তি। আমরা এক সাথে কত চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়েছি। আমার কাছে তুমি কেনো ক্ষমা চাইছো?
লোকটা বিদ্রুপের স্বরে কথাগুলো বলে। শামীম তখন শুকবো ঢোক গিলে বলে,
– আমাকে বাঁচতে দে, আমি কিছু করি নি। আমি সত্যি কিছু করি। স্নিগ্ধ বিশ্বাস কর আমার কোনো দোষ ছিলো না। তুই যা বলেছিস আমি ও তো তাই করেছি।
শামীমের চোখে মুখে ভয়ে ছাপ। যে সে ভয় নয় মৃত্যু ভয়! শামীমের সামনের ব্যাক্তিটি অন্য কেউ নয় বরং স্নিগ্ধ স্বয়ং বসে রয়েছে। তার ঠোঁটের কোনায় পৈশাচিক হাসি। চোখে ঘৃণা ছলকে উঠছে। তার কাছে শামীম একটা নর্দমার কীট ব্যতীত আর কিছুই নয়। বিদ্রুপের কন্ঠে সে বলে,
– তা আমার জন্য কি করেছো শুনি?
– তুই বলেছিলি তোর বয়সের আন্দাজ যাতে কেউ না করতে পারে আমি তাই করেছি। তোর বয়স কমিয়ে সার্টিফিকেটে ছাব্বিশ বছর করে দিয়েছি। তোকে আমি মাস্টার্সে ভর্তি অবধি করিয়ে দিয়েছি প্রিন্সিপালকে টাকা খাওয়িয়ে। তুই আলতাফ ভাই, ইশান, রাজীবের বর্তমান ঠিকানা চেয়েছিস আমি তাও জোগাড় করিয়ে দিয়েছি। তুই যখন যা করতে বলেছিস আমি তাই করেছি। তোর উপর থেকে সন্দেহ সরানোর জন্য আমি তোর ঘরে চোরের মতো কালো জ্যাকেট পড়ে এন্ট্রি পর্যন্ত নিয়েছিলাম, ওসি স্যারের ধাওয়া পর্যন্ত খেয়েছি। এবার আমাকে বাঁচতে দে ভাই আমার।
আকুতির কন্ঠে শামীম কথাগুলো বলছে। স্নিগ্ধ তার দিকে বাঁকা হাসি দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। সে যেনো হিংস্র প্রাণীর মতো নিজের শিকারের সাথে খেলা করতে ব্যস্ত। যেমন বাঘ তার কাবু শিকারকে বাঁচার সুযোগ দিয়ে পরীক্ষা করে শিকার কতদূর দৌড়াতে পারে। শিকার ও ভাবে এই বুঝি বাঁচতে পারছি। আর অমনি অতর্কিতে খোঁপ করে হামলা করে বাঘ। আর শিকারকে ছিড়েখুঁড়ে একাকার করে দেয়। স্নিগ্ধ শামীমের সাথে এতোদিন একই কাজটা করেছে। শামীমকে ব্যবহার করে নিজের সকল কাজ সিদ্ধহস্তে উশুল করে নিয়েছে। স্নিগ্ধের প্রকৃত বয়স উনত্রিশ অথচ নকল সার্টিফিকেট অনুযায়ী ছাব্বিশ। স্নিগ্ধের কলেজ হতে শুরু করে সব কিছু শামীম ই ম্যানেজ করিয়ে দিয়েছে। আজ শামীমের কাজ শেষ তাই আজকের পর থেকে স্নিগ্ধের শামীমের প্রয়োজন নেই। এখন শামীমকে মেরে ফেললেও কিচ্ছু যায় আসবে না। স্নিগ্ধ বিদ্রুপের স্বরে বললো,
– আমি দেখতেই এতো সুন্দর যে আমার বয়স আন্দাজ করা যায় না। তবে শামীম ভাই তুমি একটা ছোট্ট ভুল করে ফেলেছো যে। আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছো তুমি। সেটা না করলে হয়তো আমি তোমাকে ছেড়ে দিতাম।
– আ…আসলে
– তুমি আমার আইডি কার্ডটা এজন্যই ইচ্ছে করে চুরি করেছিলে, যাতে আমাকে আলতাফ ভাইয়ের খুনে ফাসাতে পারো আর করেছিলেও তাই। আমিতো ভেবেছিলাম আমার প্লান তোমার জন্য ভেস্তে যাবে। কিন্তু অবশেষে পার পেয়ে গেলাম। তুমি ভেবেছিলে আমি জেলে চলে গেলে তোমরা বেঁচে যাবে। কিন্তু সব পাশা উলটে গেলো। রাজীব বাসা থেকে গায়েব হয়ে গেলো। তার তোমার জানে মৃত্যু ভয় ঢুকে গেলো। তুমি এগুলো আমার জন্য করো নি শামীম ভাই, নিজেকে বাঁচানোর জন্য করেছো। মাহির ভাই এর মনে আছে? তুমি তো তার খোঁজ আমাকে দাও নি। তবুও কেমন পগারপার হয়ে গেলো সে।
– দে…..দেখ স্নিগ্ধ রাজীব কিন্তু রাজনীতির বেশ বড় মাপের পোস্টে আছে। ওকে খুন করলে তুই পার পাবি না।
শামীমের কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে স্নিগ্ধ। তার হাসিতে বিদ্রুপের ছাপ রয়েছে। হিংস্র হায়েনার মতো পৈশাচিক হাসি তার। শামীমের লোম যেনো খাঁড়া হয়ে এসেছে। তার পা কাঁপছে। হাসি থামিয়ে ভয়ংকর দৃষ্টিতে থাকায় স্নিগ্ধ। তার চোখ জোড়া লাল হয়ে এসেছে। মাথার রগ ফুলে উঠেছে। কন্ঠে রোশ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– এই ক্ষমাতার জোর আর কত দেখাবে শামীম ভাই! তুমি আসলে সেকালেই পড়ে রইলে গো। আচ্ছা বলোতো, রাজীব ভাই গায়েব হয়ে গেছে অথচ একটা পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল খবরটা ছড়িয়েছে? না তো! ছড়াবে তো কাল সকালে! যখন জানা যাবে পলিটিশিয়াল রাজীবুল ইসলাম আত্নহত্যা করেছে, নিজের পাপের ভার আর সইতে না পেরে নিজের জীবন নিজেই নিয়েছে। শামীম ভাই, শামীম ভাই! এবার ক্ষমতাও তোমাদের পাপ ঢাকতে পারবে না। থাকো কেমন! আর একটা কথা! এতো তাড়াতাড়ি তোমাকে মারবো না! চিন্তা করো না।
বলেই উঠে দাঁড়ালো স্নিগ্ধ। শামীম মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো৷ চোখ ছলছল করছে তার। মৃত্যু ভয় তাকে ভেতর থেকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। স্নিগ্ধ মানুষটা কতোটা ধূর্ত এবং ভয়ংকর সেটা শামীম ভালো করেই জানে! শামীম বাঁচতে চায়! বাঁচার জন্য সে হাসফাস করছে! তাই তো বাহিরে থাকার থেকে জেলে পঁচে মরাটাই বেঁছে নিয়েছে সে! তবে স্নিগ্ধ পারে না এমন কোনো কাজ নেই! স্নিগ্ধের ভয় তাকে জীবিত অবস্থায় নরক যন্ত্রণা দিচ্ছে! নিজেকে কাঠের পুতুলের মতো লাগছে, তার জীবনের সুতো স্নিগ্ধের হাতে। যেমন করে নাচাচ্ছে, শামীম তেমন করে নাচছে। যখন মন ভরে যাবে তখন ই এই সুতোটা কেটে দিবে স্নিগ্ধ। শামীমের মনে শংকা বাসা বেঁধেছে। জেলে আসলেও আদৌও কি স্নিগ্ধের হাত থেকে শেষ রক্ষা হবে তার!!
জেল থেকে বেরিয়ে গেলো স্নিগ্ধ। ঝুম করে বৃষ্টি শুরু হলো৷ এই জুন মাসে হুটহাট করেই বৃষ্টি হয়। কোনো পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। কিছুক্ষণ আগেও এতোটা রোদ ছিলো যে চামড়া পুড়ে যাবার জোগাড়। অথচ এখন শীতল বৃষ্টি৷ ভেজা মাটির মিষ্টি গন্ধ নাকে আসছে স্নিগ্ধের। কালোজ্যাকেটটা খুলে পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিলো সে। এখন এই জ্যাকেটের প্রয়োজন নেই। ভেতরের সাদা টিশার্ট টা ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে তাতে কিছু যায় আসে না স্নিগ্ধের। আজ তার মুখে প্রশান্তির হাসি। সে বাহু ছেড়ে বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করছে। যেনো এই বৃষ্টির মাঝে কারোর অস্তিত্ব অনুভব হচ্ছে তার। গুনগুন করে গাইতে লাগলো,
“আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম
আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম
শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যা টুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম
আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম
হৃদয়ের জানালায় চোখ মেলে রাখি
বাতাসের বাশিতে কান পেতে থাকি
হৃদয়ের জানালায় চোখ মেলে রাখি
বাতাসের বাশিতে কান পেতে থাকি
তাতেই কাছে ডেকে মনের আঙ্গিনা থেকে
বৃষ্টি তোমাকে তবু ফিরিয়ে দিলাম
আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম
তোমার হাতেই হোক রাত্রি রচনা
এ আমার স্বপ্ন সুখের ভাবনা
তোমার হাতেই হোক রাত্রি রচনা
এ আমার স্বপ্ন সুখের ভাবনা
চেয়েছি পেতে যাকে চাইনা হারাতে তাকে
বৃষ্টি তোমাকে তাই ফিরে চাইনা
আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম
শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যা টুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম
আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম”
পরদিন
সকাল ৯টা,
মতিজিলের “এশিয়া হোটেল এন্ড রিসোর্ট” এ বিশিষ্ট রাজনৈতিক যুবনেতা রাজীবুল ইসলামের লাশ পাওয়া গেছে। মিডিয়া এবং পুলিশের ভিড় জমেছে হোটেল রুমের সামনে। তৌহিদ ও সেখানে উপস্থিত। হোটেলটি তার থানার আন্ডারে পড়েছে। ফোরেন্সিক ডাক্তার, শহীদুল সাহেব এসে পৌছিয়েছেন মাত্র। পুলিশের উপর প্রচন্ড চাপ। এটা খুন নাকি আত্মহত্যা বুঝা যাচ্ছে না। লাশটির পাশে বেশ কিছু স্লিপিং পিলস, ব্লেড রয়েছে। বা হাতটি বেশ বাজে ভাবে কাঁটা হয়েছে। নির্দয়ের মতো শিরা, ধমনী কাঁটা লাশটির। রাজীবের লাশটি বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে শহীদুল সাহেব তৌহিদকে ভেতরে ডাকে। তৌহিদ তখন মিডিয়াকে থামাতে ব্যাস্ত। তৌহিদ এলে শহীদুল সাহেব চিন্তিত কন্ঠে বলে,
– তৌহিদ, লাশটি কে মর্গে পাঠানোর ব্যাবস্তা করো। ময়না তদন্ত করতে হবে। র এখানের একটি জিনিস এও যেনো কেউ হাত না দেয়। আমার যা যা সন্দেহ লাগছে সব কিছু থেকে স্যাম্পল নিয়েছি।
– স্যার কি আশংকা করছেন?
– এটা আত্মহত্যা না খুন বুঝতে পারছি না। নরমালি যদি আমি দেখি, এটাকে আত্মহত্যার ফ্রেমে ফেলা হয়েছে। ময়নাতদন্তের পর ই এই রহস্য উদ্ধার হবে। তুমি লাশটা পাঠাও। আমি আসছি।
শহীদুল সাহেব বেরিয়ে গেলেন। তৌহিদ তীর্যক দৃষ্টি প্রয়োগ করলো রাজীবের নিথর লাশটির উপর। শরীরে কোথাও কোনো আচর নেই। শুধু বা হাতের শিরা, ধমনী কাটা। এতোটা নির্দয় ভাবে কোনো মানুষ আত্মহত্যা করার সাহস রাখে না। তৌহিদের দৃঢ় বিশ্বাস এটা খুন।
” জনদরদী যুবনেতা রাজীবুল ইসলামের লাশ আজ সকাল ৯টা ঘটিকাতে মতিজিলের এশিয়া হোটেল এবং রিসোর্টে উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য এটি আত্মহত্যা নাকি খুন তারা এখনো নিশ্চিত নন। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসলেই তারা………”
টিভিতে যেকোনো চ্যানেল পাল্টালেই একই খবর দেখা যাচ্ছে। শাহীন হোটেলের টিভিতে ও একই সংবাদ দেখা যাচ্ছে। স্নিগ্ধ কানে হেয়ারফোন লাগিয়ে নিলো। সে এখন রিপোর্টার মহিলার ক্যানকেনে কন্ঠ শুনতে মোটেও রাজি নয়। আয়েশ করে পরোটা এবং ডিম পোচ খাচ্ছে সে। শাহীন হোটেলের পরোটা আর ঝাল ডিম পোঁচের জবাব নেই। তার মুখে প্রশান্তির ছাপ। গতরাতটা বেশ ধকল গিয়েছিলো তার। স্নিগ্ধের ঠোঁটের কোনে হাসি একে মুখে পরোটার প্রথম টুকরোটা পুড়ে দিলো। আহা! এ যেনো অমৃত!!!!
“ইউরস মাই লাভ” নামক একটি ছোট দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নুশরাত। অনেক কষ্টে দোকানটি খুঁজে পেয়েছে সে। দোকানটি গুলশান-২ এ অবস্থিত। ছোট একটি দোকান, ঘরের বসার ঘরের মতো এরিয়াটা। তবে সব বড় লোকের আনাগোনা দোকানটিতে। দোকানে ঢুকতেই চোখ বড় বড় হয়ে যায় নুশরাতের। তার মনে হচ্ছে দামী কোনো হোটেলে এসেছে সে। বেশ জাকজমকপূর্ণ ইন্টেরিয়র। এক পাশে পারফিউমের বিশাল কালেকশন। পারফিউম গুলোর সর্বোনিন্ম দাম ৩০০০ টাকা। নুশরাত কাউন্টারের মেয়েটিকে বিনয়ী কন্ঠে বলে,
– Paul Sebastian এর কালেকশন আছে?
– জ্বী ম্যাডাম আমাদের প্রায় প্রতিটি কালেকশন ই আছে
– আমাকে ফিমেল কালেকশন গুলো একটু দেখাবেন প্লিজ
– জ্বী
মেয়েটি একের পর এক মোট পাঁচ ধরনের পারফিউম দেখালো নুশরাতকে। নুশরাত একে একে প্রতিটা গন্ধ নাকে নিলো। কিন্তু একটা গন্ধ ও সেই গন্ধটার মিলছে না। তখন বাধ্য হয়ে নুশরাত ব্যাগ থেকে পারফিউমটা বের করে বললো,
– এই পারফিউমটার পেয়ার যে ফিমেল পারফিউমটা সেটা কি আছে।
মেয়েটার মুখের রঙ পালটে গেলো। সে কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
– আপু, আপনি চাইলে আমরা এনে দিতে পারবো। আসলে এই কালেকশন টা সবাই পছন্দ করে না। আমাদের এখানে মাত্র তিনজন কাস্টোমার এই কালেকশনটা প্রি ওর্ডার করে আনান।
– ওই তিনজনের নাম এবং ঠিকানা কি পাওয়া যাবে?
– সরি ম্যাম, আমাদের কাস্টোমারের ইনফোরমেশন আমরা শেয়ার করি না। এটা কনফিডেনসিয়াল।
এমন কিছুই আশা করছিলো নুশরাত। কিন্তু হাল ছেড়ে দিলে যে হবে না। তাই দুটো হাজার টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বললো,
– এবার কি পাওয়া যাবে?
মেয়েটির চোখ চকচক করছে। সে আশেপাশে তাকিয়ে নোট দুটো খপ করে নিয়ে নিলো। তারপর ভেতরে চলে গেলো। বিশ মিনিট পর একটা কাগজ আস্তে করে নুশরাতের হাতে গুজে দিলো। নুশরাত কাগজটি খুলতেই দেখলো…….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি