দৃষ্টির অগোচরে,২য় পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
বসার ঘরটা পার হতেই পা এর একটি ভারী জিনিস বাধে নুশরাতের। অন্ধকারে টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে। হাতের মোবাইলটা খানা হাত থেকে পড়ে যায়। কোনো মতে হাতড়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে মেঝেতে আলো মারতে দেখে তার সামনে মাহির অচেতন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তার কাপড় রক্তে ভেজা। সাদা টাইলসটা রক্তে লাল হয়ে রয়েছে। মাহিরের চোখ জোড়া উলটে রয়েছে। নুশরাতের হাতের থেকে মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে যায়। সে চিৎকার করে উঠে। ভয়ে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। গলা শুকিয়ে যায়। তখনই ঘরের লাইটটা জ্বলে উঠে। বিদ্যুৎ এসে পড়েছে, অন্ধকার ঘরটা নিমিষেই আলোকিত হয়ে উঠে। নুশরাত নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। হামাগুড়ি দিয়ে মাহিরের কাছে আসে। মাহিরেরর শ্বাস চলছে কিনা পরীক্ষা করে। মাহিরকে পাগলের মতো ডাকতে থাকে,
– মাহির, মাহির শুনতে পাচ্ছো! মাহির
মাহিরের হাত-পা বরফ ঠান্ডা। রক্তে ভেজা নিথর শরীরটা ফ্লোরে পড়ে রয়েছে। নুশরাত কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। মাথা যেনো বন্ধ হয়ে আসছে। তার হাত মাহিরের রক্তে লাল হয়ে গেছে। নুশরাত জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো। তার এখন সাহায্যের প্রয়োজন। খুব কষ্টে উঠে দাঁড়ালো সে, ছুটে বাসার বাহিরে গেলো। পাশের ফ্লাটের দরজা পাগলের মতো ধাক্কাতে লাগলো। সিড়িঘর থেকে দারোয়ানকে ডাকার অদম্য চেষ্টা করলো। নুশরাতের চিৎকারে পাশের ফ্লাট থেকে এক দম্পতি এলো। নুশরাত তাদের কাছে অনুনয় বিনয় করতে লাগলো,
– আমাকে একটু সাহায্য করুন, প্লিজ। মাহিরকে হাসপাতালে নিতে হবে প্লিজ।
ধীরে ধীরে ফ্লাটের সামনে লোক জড়ো হচ্ছে। তাদের ভীত চোখ ফ্লোরে পড়ে থাকা মাহিরের নিথর শরীরটিকে দেখছে। কতোটা নিষ্ঠুর ভাবে তার বুকে ছুরি মারা হয়েছে! কতটা নির্মম এই দৃশ্যটি!
রাত বারোটা,
হাসপাতালের করিডোরে বেঞ্চিতে বসে রয়েছে নুশরাত। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে রয়েছে। হাতের তাজা রক্ত শুকিয়ে কালচে রুপ নিয়েছে। ঘাড়ে ঘামের রেখা গড়িয়ে পড়ছে। চোখজোড়া ফ্যালফ্যালিয়ে মেঝেতে তাকিয়ে রয়েছে৷ মাহিরের প্রতি ভালোবাসাটা ক্ষীন হয়ে আসলেও তার এরুপ মর্মান্তিক পরিণতি কখনো কল্পনাতেও কামনা করে নি নুশরাত। চোখজোড়া বারংবার ভিজে আসছে। মানুষের এই অশ্রু খুব অদ্ভুত একটা তরল, মানুষ অতিরিক্ত দুঃখ পেলে কাঁদে, বেদনায় কাঁদে, সুখের বহিঃপ্রকাশ করতেও কাঁদে; আবার অহেতুক কারণে কারণে। আজ নুশরাতও কাঁদছে, কারণটা তার জানা নেই। মাহিরের ছলনা নুশরাতের মনে ঘৃণা, ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিলো। তার প্রতি ভালোবাসার শেষ রেখাটুকুও মিলিয়ে গেছে। অথচ আজ সেই মানুষটার এই পরিণতি দেখে তার কান্না পাচ্ছে, অনুশোচনা হচ্ছে কেনো সে আর কিছু সময় পূর্বে বাসায় ফিরলো না। মঈনুদ্দিন সাহেব থমথমে মুখ নিয়ে পায়চারী করছেন। তার চোখ লাল হয়ে রয়েছে। একমাত্র ছেলে অপারেশন থিয়েটারে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। যখন হাসপাতালে পৌছেছে নুশরাত তখন মাহিরের পালস চলছিলো। শরীর থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে। ছুরিঘাতটি হার্টের পাশ থেকে গিয়েছে। তাই ডাক্তার দেরি না করে ওটিতে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ নুশরাত ফোন করে মঈনুদ্দিন সাহেবকে হাসপাতালে আসতে বলে। হেনা বেগম আসামাত্র নুশরাতের গালে চড় বসিয়ে দেন। গলা টিপে ধরে হিনহিনে কন্ঠে বলেন,
– রাক্ষসী আমার ছেলেটাকে এভাবে গিলে খেলি তুই? তোকে আমি মেরেই ফেলবো। রাক্ষসী মেয়ে
নুশরাতের শ্বাস আটকে আসছে। তার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু নুশরাত কোনো প্রতিবাদ করে নি, কারণ এই সময়টা মোটেও প্রতিবাদ করার নয়। মা জাতিটা এমনই হয়। তাদের কাছে সারা পৃথিবী একদিকে থাকে তাদের সন্তান একদিকে থাকে। যে সন্তানকে নিজের গর্ভে এতো কষ্ট করে এতোগুলো মাস আগলে রেখেছে, নিজের শত কষ্ট সহ্য করে যে সন্তানকে বড় করেছে আজ সেই ন্তানকে মৃত্যুর সাথে লড়তে দেখাটা কোনো মায়ের ই কাম্য নয়। তিনি পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছেন। মঈনুদ্দিন সাহেব হেনা বেগমের থেকে নুশরাতকে ছাড়ান। হেনা বেগম হাউমাউ করে কাঁদছেন। তিনি মঈনুদ্দিন সাহেবকে আকুতির স্বরে বলতে লাগলেন,
– আমার মাহিরকে বাঁচান মাহিরের বাবা। আমার ছেলেটাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেন। আপনার তো অনেক পরিচিতি, মাহিরের বাবা আমার ছেলেটাকে বাঁচান।
– হেনা শান্ত হও। শান্ত হও। আমাদের ছেলের কিছু হবে না। তুমি শান্ত হও।
মঈনুদ্দিন সাহেব শক্ত কন্ঠে হেনা বেগমকে কথা গুলো বলেন। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করেন নুশরাতের দিকে। নুশরাত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু। ঘন্টা খানেক বাদে উত্তরা থানার সাব-ইন্সপেক্টর হাবীবুর রহমান আসে হাসপাতালে। যেহেতু এটা পুলিশ কেস, তাই রিসেপশন থেকেই থানায় ফোন যায়। হাবীবের সাথে নুশরাতের সম্পর্কটা খুব একটা ভালো নয়। নুশরাতের জন্য হাবীব একবার ছয়মাসের জন্য সাসপেন্ড পর্যন্ত হয়েছিলো। কারণ সে রিমান্ডে অমানবিক আচারণ করে ক্রিমিনালদের সাথে। একটি চৌদ্দ বছরের বাচ্চাকে রিমান্ডে নিয়ে এতো মার মেরেছিলো যে বাচ্চাটি প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিলো। সেই কেসটি নুশরাত হ্যান্ডেল করেছিলো। সেই ঘটনার পর চাকরি ফেরত পেতে কম ঘুষের সাহায্য নিতে হয় নি হাবীবের। তবে তার প্রোমোশনটা যেনো আটকে গিয়েছে। হাবীব নুশরাতের সামনে এসে দাঁড়ায়। হিনহিনে কন্ঠে বলে,
– উকিল ম্যাডাম, আমাদের সাথে যে একটু কো-অপারেট করতে হয়! আপনার স্বামীকে কেউ খুন করার চেষ্টা করেছে, জানি আপনার অবস্থাটা মোটেই সুবিধার নয়। তবুও আপনি সেই ঘটনার যেহেতু প্রথম সাক্ষী। তাই আমাদেরকে পুরো ঘটনাটি খুলে বলবেন প্লিজ?
নুশরাত মাথা নাড়ায়। কাঁপা কন্ঠে পুরো ঘটনাটি হাবীবকে বলে সে। হাবীব সব বেশ মনোযোগের সাথে শুনে। তার চোখ চকচক করছে। তারপর উঠে গিয়ে মঈনুদ্দিন সাহেবকে স্যালুট করে, বাঁকা হাসি দিয়ে বলে,
– দোষীকে আমরা ঠিক খুঁজে নিবো। চিন্তা করবেন না স্যার।
তারপর হাবীব হাসপাতাল থেকে চলে যায়। সময়ের কাঁটা এগোচ্ছে কিন্তু ওটি থেকে কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। মঈনুদ্দিন সাহেবের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গছে। হেনা বেগম শুধু আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছেন। নিজের ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চাচ্ছেন তিনি। মিনিট বিশেক বাদে ডাক্তার ওটি থেকে বের হন। তার মুখখানা থমথমে। ডাক্তার বের হতেই মঈনুদ্দিন সাহেব ছুটে যান তার কাছে। আকুল কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
– ডাক্তার সাহেব আমার ছেলে?
– সরি মঈনুদ্দিন সাহেব, অনেক চেষ্টা করার পর ও তাকে বাঁচাতে পারলাম না। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। আর কিছু সময় আগে আনলে হয়তো বাঁচানো যেতো।
ডাক্তারের কথা শোনামাত্র হেনা বেগম জ্ঞান হারালেন। মঈনুদ্দিন সাহেব সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বেঁচে থেকেও যেনো মৃত্যুস্বাদ তিনি গ্রহণ করছেন। তার একমাত্র ছেলেটি আজ নেই। না ফেরার দেশে হারিয়ে গেছে সে। বুক ফেটে কান্না আসছে তার কিন্তু কাঁদতে পারছেন না। এদিকে নুশরাত স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে, বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। শ্বাস নিতেও খুব কষ্ট হচ্ছে। গলার কাছে কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে রয়েছে যেনো। চিৎকার করে কাঁদলে হয়তো এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতো_____________
সময় বহমান, দেখতে দেখতে তিনদিন কেঁটে গিয়েছে মাহিরের মৃত্যুর। নুশরাত মায়ের বাসায় রয়েছে। ফ্লাটটি পুলিশ সিল করে দিয়েছে। কেসের ইনভেস্টিগেশন হচ্ছে। মঈনুদ্দিন সাহেব গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের একজন তাই মাহিরের মৃত্যুর খবরটি বেশ কটা টিভি চ্যানেল এবং সংবাদপত্রিকায় দেখা যাচ্ছে। হ্যাডলাইনটা খানিকটা এরুপ,
” যুগ্ম জেলা বিচারক মঈনুদ্দিন চৌধুরীর একমাত্র ছেলে মাহির চৌধুরী নৃশংসভাবে খুন”
নুশরাত এক সপ্তাহ নিজের চেম্বার বন্ধ রেখেছে। সামনের সোমবার তার একটি কেসের ডেট রয়েছে, আদালতে যেতে হবে। কিন্তু কাজ করতে যেনো মন চাচ্ছে না। বারবার মাহিরের রক্তমাখা নিথর শরীরের চিত্র চোখে ভাসছে। পারভীন বেগম এক কাপ চা এগিয়ে দিলেন নুশরাতের দিকে। নিজের মেয়ে জামাই এর এরুপ মৃত্যু মানতে তার ও কষ্ট হচ্ছে। ধীর কন্ঠে নুশরাতকে বললেন,
– থানা থেকে কি কোনো খবর পেয়েছিস?
– না মা, আমি খোঁজ নেই নি। আমার এখনো মানতে কষ্ট হচ্ছে মাহির আর নেই।
– আচ্ছা, মাহির বাসায় কেনো এসেছিলো? ও তো ওখানে থাকতো না।
– জানি না মা, আমি সত্যি কিচ্ছু জানি না।
নুশরাতের কথা শুনে আর প্রশ্ন করলেন না পারভীন বেগম। মেয়ের মনোস্থিতির খবর তার ভালোই জানা আছে। হঠাৎ কলিংবেলটা বেজে উঠলো। চায়ের কাপটা রেখে দরজা খুললেন পারভীন বেগম। দরজা খুলতেই একজন পুলিশ ইউনিফর্ম পরিহিত যুবক এবং দুজন মেয়ে কন্সটেবলকে দেখতে পেলেন তিনি। ছেলেটা তার পরিচিত। তিনি হাসিমুখে বললেন,
– তৌহিদ, তুমি? কি হয়েছে?
– আন্টি নুশরাত কি বাসায়?
– হ্যা বসার ঘরেই আছে। কিন্তু কি হয়েছে?
– ভেতরে আসি আন্টি?
পারভীন বেগম সরে দাঁড়ালেন। তার চোখে মুখে কৌতুহল। তৌহিদ সোজা নুশরাতের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নুশরাত কিছু করার আগেই তৌহিদ বললো,
– মিসেস নুশরাত চৌধুরী আপনাকে নিজের স্বামীকে নৃশংসভাবে হত্যা করার দায়ে গ্রেফতার করা হলো…………
চলবে