দৃষ্টির অগোচরে,৩য় পর্ব,৪র্থ পর্ব

দৃষ্টির অগোচরে,৩য় পর্ব,৪র্থ পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

পারভীন বেগম সরে দাঁড়ালেন। তার চোখে মুখে কৌতুহল। তৌহিদ সোজা নুশরাতের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নুশরাত কিছু বলার আগেই তৌহিদ বললো,
– মিসেস নুশরাত চৌধুরী আপনাকে নিজের স্বামীকে নৃশংসভাবে হত্যা করার দায়ে গ্রেফতার করা হলো। প্লিজ আমাদের সাথে কো-অপারেট করুন

নুশরাতের ভ্রু-যুগল কুঞ্চিত হয়ে এলো৷ সে সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে যাচ্ছে। আজ লোকটি তার সামনে তার শুভাকাঙ্ক্ষী, প্রতিবেশী, বন্ধু তৌহিদ ভাই হিসেবে নয় বরং একজন নিষ্ঠাবান পুলিশ ইন্সপেক্টর তৌহিদুর রহমান হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নুশরাত স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– তৌহিদ ভাই, আমার এরেস্ট ওয়ারেন্ট কি দেখতে পারি?
– অবশ্যই।

তৌহিদ পকেট থেকে এরেস্ট ওয়ারেন্টটি বের করে নুশরাতের হাতে দিলো। এরপর জড়তাবিহীন কন্ঠে বললো,
– যে ছুরি দিয়ে মাহিরকে খুন করা হয়েছিলো সেটা পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, সেটায় আপনার এবং কেবল মাত্র আপনার ফিংগার প্রিন্ট পাওয়া গেছে। এবার হয়তো আপনি আমাদের সাথে এতে রাজি?

নুশরাত কিছু বললো না। মাথায় কিছুই আসছে না। যে দোষ সে করেই নি সেই দোষে আজ সে দোষী। এখন চিৎকার চেঁচামেচি করে কোনোই লাভ নেই। তাকে স্বাভাবিক থাকতে হবে। পারভীন বেগম তৌহিদের হাত ধরে বসলেন, আকুতির স্বরে বললেন,
– তৌহিদ, নুশরাত কিছু করে নি। বাবা, ওকে ফাসানো হচ্ছে। ওকে নিয়ে যেও না বাবা। তুমি তো ওকে চেনো। ও খুন করে নি।
– আন্টি, আইনের কাছে আমাদের হাত বাঁধা। আমাকে ক্ষমা করবেন।

পারভীন বেগম নুশরাত কে আগলে ধরে বলেন,
– আমার মেয়েকে আমি যেতে দিবো না। তোমরা আমার মেয়েকে কোথাও নিয়ে যাবে না।

পারভীন বেগম কাঁদছেন। তার মেয়েকে আজ মিথ্যে দোষে দোষী করে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাও কোনো ছোটখাটো দোষ নয়, খুনের আসামী হিসেবে। সে জানে তার মেয়ে কখনোই এমন কোনো কাজ করবে না। নুশরাত তার মার চোখের দিকে তাকায়। ধীর কন্ঠে আশ্বাস দেয়,
– মা, চিন্তা করো না। আমার কিছু হবে না।

পারভীন বেগম না চাইতেও ছেড়ে দেন নুশরাতকে। তার চোখ থেকে নোনাজল গড়াচ্ছে। নুশরাতকে লেডি কন্সটেবলরা হাতকড়া পড়ায়। তারপর জীপগাড়িতে তোলা হয় তাকে। পারভীন বেগম অশ্রুশিক্ত চোখে তাকে দেখে যাচ্ছেন। তার কিছুই করার নেই। নিজের মেয়েকে নির্দোষ প্রমাণ করার কোনো পথ তার সামনে খোলা নেই______

রাত ১১টা,
ইন্টারোগেশন রুমে বসে রয়েছে নুশরাত। ২২০ ভোল্টের হলুদ লাইটটি তার মাথার উপর ঝুলছে। নুশরাতের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। লাইটের উত্তাপে বেশ গরম লাগছে। চুলের পেছনতার সামনে একগ্লাস পানি রয়েছে। নুশরাতকে তীর্যক দৃষ্টিতে অবলোকন করছে তৌহিদ। নুশরাতের সাথে বিগত দুই ঘন্টা যাবৎ প্রশ্ন উত্তর খেলা খেলছে সে। কিন্তু এখনো কোনো মনের মতো উত্তর পায় নি। এই কেসটা তাকে বিগত তিনদিন যাবৎ পাগলের মতো তাড়া করছে। সরকারী চাকুরীজীবিদের এটা একটা খুব বড় সমস্যা, সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কোনো ঝামেলা হলে তাদের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তিনটি দিন পাগলের মতো ছুটেছে তৌহিদ। ঘুমানোর সময় অবধি পায় নি। তিন দিন মিলে মোট চার ঘন্টাও ঘুমিয়েছে কিনা সন্দেহ। তৌহিদের লাল চোখ নুশরাতকে দেখে যাচ্ছে। ফোঁস করে একটা ভারী নিঃশ্বাস ছাড়লো তৌহিদ। তারপর ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
– সেদিন রাতে খুনের সময় তুমি কোথায় ছিলে?
– বাহিরে, আমি কোক কিনতে গিয়েছিলাম।
– কোথায়?
– আমাদের রোডের একটি দোকানে, “রাসেল স্টোর” নাম।
– আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, দোকানের মালিক বলেছে ওই রাতে তুমি নাকি কোক কিনতে যাও নি।
– রাসেল ভাই ছিলেন না দোকানে। তার ছোট ছেলেটা ছিলো দোকানে। তখন ব্লাকআউট হয়েছিলো। ছেলেটার বয়স বারো, অন্ধকারে আমার মুখ দেখতে পায় নি সে। আর আমার কন্ঠ মনে রাখার বয়স তার এখনো হয় নি৷
– হাহাহা, কি অদ্ভুত এলিবাই এমন একজন যে কিনা তোমার নির্দোষিতা প্রমাণ ই করতে পারবে না। বেশ, তাহলে এই ছুরিতে তোমার ছাপ পাওয়া গেছে। এটার কি ব্যাখ্যা?
– আমি আবারো বলছি, খুন আমি করি নি তৌহিদ ভাই। বারবার এক প্রশ্ন করলে উত্তর বদলে যাবে না।

এবার তৌহিদ টেবিলে সজোরে একটা থাবা দিয়ে বসে। তার চোখ রক্তবর্ণ রুপ নিয়েছে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
– আমি আপনার বাসার ড্রয়িংরুমে বসে নেই মিসেস নুশরাত।
– বেশ, ইন্সপেক্টর তৌহিদ সাহেব আমি আবারো বলছি আমি খুন করি নি। হ্যা, এই ছুরিটা আমার কিচেনের। স্বাভাবিক এখানে আমার হাতের ছাপ থাকবে। কিন্তু এই ছুরি দিয়েই যে খুন হয়েছে তার প্রমাণ কি?
– ফরেন্সিক ডাক্তার বলেছেন এই ছুরির গড়ণ এবং মাহিরের শরীরের ক্ষতের গড়ণ একই। ৯০% সম্ভাবনা রয়েছে এই ছুরি দিয়ে খুন হবার। আর ছুরিটি সোফার নিচে পাওয়া গেছে। মাহিরের বডির পাশের সোফার নিচে।

নুশরাত অট্টহাসি হাসলো। নুশরাতের হাসির কারণটা বুঝতে পারলো না তৌহিদ৷ চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নুশরাত হাসি থামিয়ে বললো,
– তৌহিদ ভাই, ছুরিটায় মাহিরের রক্ত লেগে আছে মানেই এই ছুরি দিয়ে খুন হয়েছে? একটু ধার পরীক্ষা করে দেখবেন না? এই ছুরি দিয়ে আপেল অবধি কাটে না। আর আমি এই ছুরি দিয়ে অনেক আঘাতে মাহিরকে মেরে ফেললাম? আর মাহিরকে খুন করার মোটিভ কি আমার?
– মঈনুদ্দিন স্যার বলেছেন আপনার এবং মাহিরের সম্পর্ক ভালো নয়৷ আপনি তার থেকে ডিভোর্স চেয়েছেন, শুধু তাই নয় আপনি একটা মোটা অংকের এ্যালুমনিও চেয়েছেন। সেদিন রাতে আপনি ই মাহিরকে বাসায় আসতে বলেছেন।
– মিথ্যে বলেছে তারা। আমি মাহিরকে মোটেই বাসায় আসতে বলি নি। আর এটা ঠিক আমাদের ডিভোর্স হবার কথা ছিলো৷ পেপার সাইন হয়ে গিয়েছিলো। আমি এ্যালুমনি হিসেবে শুধু উত্তরার ফ্লাটটি চেয়েছি। এবং তারা এগ্রি পর্যন্ত হয়েছেন। তাহলে আমি কেনো মাহিরকে মারবো। আমার লাভ কি এতে? আমি যেহেতু ডিভোর্স ই নিয়ে নিচ্ছি তাহলে মাহিরকে মেরে আমার তো লাভ নেই।

নুশরাত একটু থামলো। তৌহিদ এখনো তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ তার চোখে সত্য খোঁজার চেষ্টা করছে। নুশরাত এবার আকুল কন্ঠে বললো,
– তৌহিদ ভাই, প্লিজ বিশ্বাস করুন। আমি খুন করি নি। সত্যি আমি খুন করি নি৷ আমি ক্রিমিনাল লয়ার। খুন করার হলে এতো কাঁচা কাজ আমি করবো? সোফার নিয়ে ছুরি রেখে দিবো? সেটা ইজিলি পাওয়া যাবে?

পুলিশের চাকরি কম দিন করছে না তৌহিদ। ছত্রিশ বছরের জীবনে কম ক্রিমিনাল সে দেখে নি। ক্রিমিনালদের চোখ পড়া এতোটাও কঠিন নয় তার কাছে। বিগত দুঘন্টা যাবৎ সে নুশরাতের চোখ ই কেবল দেখে যাচ্ছিলো। মেয়েটির চোখ স্বচ্ছ, নির্ভীক। এই চোখে কোনো কালিমার ছোয়া নেই। তৌহিদ কিছুক্ষণ মাথা চুলকালো। তারপর সাব-ইন্সপেক্টর হাবীবকে ডেকে বললো,
– হাবীব সাহেব উনার উকিলকে ইনফর্ম করুন। দেখুন কেউ আসে কি না।

বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো তৌহিদ। নুশরাত পানির গ্লাসটা হাতে নিলো। এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু শেষ করলো৷ রবিনকে ফোন দিতে হবে। রবিন ই একমাত্র মানুষ যে তার উকিল হতে রাজী হবে৷

নিজের রুমের স্মোকিং এরিয়াতে দাঁড়িয়ে আছে তৌহিদ। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সে জানে নুশরাত খুনটি করে নি। মেয়েটিকে এই নতুন দেখছে না সে। তৌহিদের যখন বয়স সাত তখন থেকে এই মেয়েটি তাদের বাসার পাশ থাকে। একই সাথে তারা বড় হয়েছে। সুতরাং মেয়েটি এমন ঔদ্ধত্য কাজ করতে পারে না, এই বিশ্বাস তৌহিদের মনে জীবন্ত। কিন্তু যখন মঈনুদ্দিন সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো,
– স্যার মাহিরের কি কারোর সাথে ঝামেলা ছিলো? শত্রুতা?
– নাহ! তবে নুশরাত মেয়েটি সুবিধার নয়। আর আমি বুঝছি না। তাকে এখনো গ্রেফতার করা কেনো হলো না?
– স্যার, কিসের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করবো আমরা? তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। মাহির কে যে ছুরিটি দিয়ে খুন করা হয়েছে সেটাও আমাদের কাছে নেই।

মঈনুদ্দিন সাহেব সেদিন চুপ করে গিয়েছিলেন। তার ঠিক দুদিন পর ই সোফার নিচ থেকে ছুরিটি পাওয়া যায়। তৌহিদের কাছে এই অংকটি মেলানো খুব কঠিন নয়। কিন্তু সে এটা প্রমাণ করতে পারবে না। অন্তত ছুরিটা পাওয়া গেলে হয়তো নুশরাতকে নির্দোষ প্রমাণ করা যেতো। হুট করেই তৌহিদের মাথায় একটা চিন্তা হানা দিতে থাকে। এক মূহুর্ত দেরি না করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তৌহিদ। মিনিট বিশেক পর উত্তরা চৌদ্দ নাম্বারের সেই বিল্ডিং এর সামনে এসে দাঁড়ায় তৌহিদ। তন্নতন্ন করে বিল্ডিং এর সব ফাঁকা অংশ খুজতে থাকে সে। এক পর্যায়ে গ্যারেজের রুমের পাশের ফাঁকা অংশে নজর যায় তৌহিদের। সেখানে ময়লা স্তুপ আকারে জড়ো হয়ে রয়েছে৷ বিল্ডিং এর সকল পুরানো জিনিস এখানে জড়ো হয় তারপর ফেরিওয়ালার কাছে বিক্রি হয়ে যায়। তৌহিদ কিছু একটা ভেবে সেই জায়গাটা খুঁজতে শুরু করে। মিনিট বিশেক বাদে হঠাৎ করেই একটা পলিথিন তার হাতে বাধে। পলিথিনটি খুলতেই………….

চলবে

দৃষ্টির অগোচরে
৪র্থ_পর্ব

মিনিট বিশেক পর উত্তরা চৌদ্দ নাম্বারের সেই বিল্ডিং এর সামনে এসে দাঁড়ায় তৌহিদ। তন্নতন্ন করে বিল্ডিং এর সব ফাঁকা অংশ খুজতে থাকে সে। এক পর্যায়ে গ্যারেজের রুমের পাশের ফাঁকা অংশে নজর যায় তৌহিদের। সেখানে ময়লা স্তুপ আকারে জড়ো হয়ে রয়েছে৷ বিল্ডিং এর সকল পুরানো জিনিস এখানে জড়ো হয় তারপর ফেরিওয়ালার কাছে বিক্রি হয়ে যায়। তৌহিদ কিছু একটা ভেবে সেই জায়গাটা খুঁজতে শুরু করে। মিনিট বিশেক বাদে হঠাৎ করেই একটা পলিথিন তার হাতে বাধে। পলিথিনটি খুলতেই ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে উঠলো তৌহিদের। তার চোখ চকচক করছে। পলিথিনটি হাতে নিয়ে নিলো তৌহিদ। তারপর জোরালো কন্ঠে বিল্ডিং এর দারোয়ানকে ডাক দিলো সে। তৌহিদের ডাক কর্ণপাত হতেই বিল্ডিং দারোয়ান লালমিয়া ছুটে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। লালমিয়া এই বিল্ডিং তৈরি হবার পর থেকেই এখানের দারোয়ান হিসেবে রয়েছে৷ তৌহিদ তীর্যক দৃষ্টিতে লালমিয়ার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে। খুব লিকলিকে শরীরের একজন মানুষ, বয়স চল্লিশের উপর হবে, মাথার একটা চুলও কাঁচা নয়, পান খেয়ে ঠোঁট, দাঁত লাল করে রাখতে ভালোবাসে সে। সে তৌহিদের দিকে ভীত নজরে তাকিয়ে রয়েছে। লালমিয়া পুলিশকে খুব ভয় পায়। পুলিশের নাম শুনলেই তার হাত পা কাঁপতে থাকে। ঢাকা শহরে আসার পূর্বে গ্রামের ছ্যাচড়া চোর হিসেবে বেশ প্রসিদ্ধ ছিলো লালমিয়া৷ বেশ ভালো কামাই ও হয়ে যেতো, কিন্তু একবার পুলিশের হাতে ধরা পরে যে পিটুনীটা খেয়েছিলো সেই দৃশ্য মনে পড়লে এখনো তার গায়ে কাঁটা দেয়। লালমিয়ার ঘাড়ে হাত রাখে তৌহিদ। লালমিয়া একটু কেঁপে উঠে। লালমিয়ার অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসে তৌহিদ। তারপর ধীর কন্ঠে বললো,
– খুনের রাতে কোথায় জানে ছিলে বলেছিলে?
– স্যার একটু বিড়ি কিনতে গেছিলাম

ভীত কন্ঠে উত্তর দেয় লালমিয়া। তৌহিদ তার ঘাড়টা একটু চাপ দিয়ে ধরে। তারপর হিনহিনে কন্ঠে বলে,
– বিল্ডিং এর কাজ ছেড়ে বাইরে বিড়ি কিনতে যাওয়ার জন্য বুঝি টাকা দেওয়া হয় তোমাকে?
– মাফ কইরে দেন স্যার। আমি ক্যামনে জানুম, এই সময়ে এতোকিছু হয়ে যাইবো?
– এই ময়লার স্তুপে শেষ কবে হাত দেওয়া হয়েছিলো?
– বছরখানেক হইবো। আসলে বেশি জিনিসপত্র না জমলে হাত দিয়ে লাভ হয় না। টাকা পাওন যায় না।
– এই কয়দিনে কেউ হাত দিয়েছিলো? ভালো করে মনে করে বলো? নয়তো
– না না স্যার, কেউ হাত দেয় নি। সত্যি কইতাছি।

তৌহিদ লালমিয়াকে ছেড়ে দিলো। তার আন্দাজ সঠিক ছিলো। এই পলিথিনটা খুনি ই ফেলে গিয়েছে এবং পলিথিনের ভেতরে জিনিসপত্রগুলোই এই কেসের নতুন মোড়ের সূত্রপাত করবে। তৌহিদ বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে গেলো। তার গন্তব্য ফরেন্সিক ডাক্তার শহীদুল হকের অফিস__________

কেসের ফাইল পড়তে পড়তে আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে রবিনের। সোমবারের কেসটা নিয়ে খুব চিন্তায় রয়েছে সে। পুলিশের ভাষ্য মতে কেসের অন্যতম সাক্ষী রুপা একজন মানসিক বিপর্যস্ত মানুষ। তার বয়ানের উপর ভিত্তি করা মানে বোকামী। কিন্তু রুপা মানসিক বিপর্যস্ত নয়, তাকে প্রতিনিয়ত অমানবিক নির্যাতন করা হতো। শুধু শারীরিক নয় বরং মানসিক। মেয়েটা অনেক সাহস করে মুখ খুলেছে। কেসের কথা ভাবতে ভাবতেই চোখ লেগে আসে রবিনের। তখনই ফোনটা উচ্চস্বরে বেজে উঠে। কাঁচা ঘুম নষ্ট হওয়াতে মেজাজ বিগড়ে যায় রবিনের। কপালের শিরা দপদপ করছে। বিরক্তির সাথে ফোনটা হাতে নেয় সে। অচেনা একটা নাম্বার থেকে ক্রমাগত ফোন আসছে। উপায়ন্তর না পেয়ে ফোনটি রিসিভ করে রবিন। বিরক্তির সাথে বলে,
– হ্যালো, কে?
– নুশরাত বলছি, ঘুমাচ্ছিলি?

নুশরাতের কন্ঠ শুনে বেশ অবাক হয় রবিন। কৌতুহলী কন্ঠে প্রশ্ন করে,
– চোখ লেগে গিয়েছিলো আর কি! তুই এতো রাতে? আর এটা কার নাম্বার?
– একটু থানায় আসতে পারবি?
– কেনো?
– আমাকে ধরে নিয়ে আসছে আর কি!
– হাবীবকে থাপ্পড় মারার জন্য?
– নাহ!
– তাহলে কি সালেহার বরকে হুমকি দেওয়ার জন্য?
– নাহ!
– সালেহার বাসায় চোরের মতো ঢোকার জন্য?
– নাহ!
– তাহলে কি জন্য তোকে ধরছে?
– মাহিরকে খুন করার জন্য
– কিহ!

নুশরাতের কথা শোনামাত্র লাফিয়ে উঠলো রবিন। কয়েক মূহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো সে। নিজেকে শান্ত রাখার অদম্য চেষ্টা করলেও ব্যার্থ হল সে। বেশ চিৎকার করে বললো,
– এই রাতে তুই কি মশকরা করতেছিস আমার সাথে?
– দোস্ত উত্তরা থানায় আয়। আমি এখানেই আছি। প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি আয়।

বলেই ফোন রেখে দেয় নুশরাত। তার সামনে হাবীব তার আঠাশ খানা হলুদ দাঁত বের করে বসে রয়েছে। হাবীবের হাসিটা দেখলে গা গুলোয় নুশরাতের। এতো পৈশাচিক হাসি কোনো মানুষের হতে পারে সেটা হাবীবকে না দেখলে জানতো না সে। হাবীবের আনন্দ যেনো ধরছে না। নুশরাতকে এই পরিস্থিতিতে দেখে বেশ শান্তি অনুভব হচ্ছে তার। হিনহিনে কন্ঠে টিটকারির সুরে বললো,
– কি ম্যাডাম, আপনার নাগর আসতেছে তো?
– মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ।
– এই শুনুন, এইসব ইংরেজি আমার সামনে মারাবেন না তো। খুন করে আবার বড় বড় কথা! মেয়েদের আদর্শ হইতে গেছিলেন। কি হলো সেটার! এবার এই জেলের কাল কুঠুরিতে পঁচে মরতে হবে। এতো কেবল শুরু, একবার রিমান্ডের ওর্ডার পাই। সব ঝাল তুলবো।
– সেটা নাহয় সময় বলে দিবে! এখন এককাপ চা দিতে বলুন৷ মাথাটা ধরে গেছে এই প্রশ্ন উত্তর খেলতে খেলতে।
– ওই এটা কি তোর হোটেল?

টেবিলে থাবা দিয়ে চিৎকার করে উঠে হাবীব। রাগে গা রি রি করছে। কিন্তু নুশরাত অনড়, তার দৃষ্টি স্থির। সে মানসিক ভাবে প্রস্তুত হাবীবের এসব আচারণে। নুশরাতের ঠান্ডা দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করার সাধ্য নেই হাবীবের। নুশরাত মানু্ষটি কেমন বেশ ভালো করেই জানা আছে হাবীবের। ওকালতির সাত বছরে শুধু নাম কামিয়েছে তাই নয়, মিডিয়াতে তার নাম বেশ প্রসিদ্ধ। বধু নির্যাতন, রেপ, যৌতুকের জন্য খুন এমন অনেক কেস সে জিতে এসেছে। শুধু তাই নয়, কোনো রাজনৈতিক নেতা হোক কিংবা উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তা কাউকে ভয় পায় না সে। তাই নুশরাতকে “লেডি রবিনহুড” ও বলা হয়। হাবীব বিরক্তির সাথে কন্সটেবল আলমকে ডাক দেয়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– ম্যাডামের জন্য এক কাপ চা আনো তো।
– একটু কড়া লিগাড়

হাবীবের কথার মাঝে নুশরাত কথাটা বলে উঠে। কড়া লিকারের চাটা এখন তার ভীষণভাবে প্রয়োজন। মাথাটা জ্যাম ধরে গেছে। হাবীব চোখ মুখ খিঁচে তাকিয়ে থাকে নুশরাতের দিকে। নুশরাত বাঁকা হাসি হাসে। হাবীবকে রাগাতে মন্দ লাগছে না তার৷ এতো ঝামেলার মাঝে হাবীবের রাগান্বিত, বিরক্ত মুখটা নুশরাতের কাছে প্রশান্তির উৎস__________

ঘন্টা খানেক বাদে রবিন সেখানে উপস্থিত হয়। নুশরাত তখন চায়ের কাপে শেষ চুমুকটি দিচ্ছিলো। নুশরাতের ঠিক বিপরীতে হাবীব বসে রয়েছে। রবিন হাবীবের কাছ থেকে পারমিশন নেয় নুশরাতের সাথে কথা বলার জন্য। রবিন আসতেই প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে নুশরাত৷ রবিন নুশরাতের সামনে বসতে বসতে বলে,
– কাহিনী কি? কি ভিত্তিতে তোকে গ্রেফতার করেছে?

নুশরাত পুরো ঘটনা বিস্তারিতভাবে খুলে বলে রবিনকে। রবিন কিছুক্ষন চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে,
– শালা বুইড়া নিজেই খুন করেছে। আর দোষ দিছে তোর উপরে। আমি শিওর।
– উহু, ভুল। মঈনুদ্দিন সাহেব খুন করেন নি। কারণ………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here