চাঁহাত ১৫ পর্ব শেষ
আরশিয়া জান্নাত
চাঁহাত ফাস্ট এইড বক্স এনে আয়াজের হাত থেকে কাঁচের টুকরো ক্লিন করে ব্যান্ডেজ করে দিলো।আয়াজ একদৃষ্টিতে চাঁহাতের দিকে তাকিয়ে রইলো পুরোটা সময়।তারপর বলতে শুরু করলো,
সেদিন তিয়াশা ফোন করে বললো সে খুব বিপদে আছে আমি যেন শীঘ্রই সেখানে যাই।তারপর ফোন কেটে যায়।অনেকবার ট্রাই করা সত্ত্বেও কানেক্ট হয়নি।তিয়াশা আমার খুব ভালো ফ্রেন্ড সে এভাবে ফোন করে হেল্প চাওয়াটা আমার কাছে মোটেও স্বাভাবিক লাগেনি।তাই আমি কাউকে কিছু না বলেই ছুটে গিয়েছিলাম সিঙ্গাপুরে।
সেখানে গিয়ে দেখি তিয়াশা পাগলপ্রায় হয়ে আছে।চোখের নীচে কালসিটে ভাব,সারাদিনরাত কান্নাকাটি করে করে উদভ্রান্তের মতো এককোণে পড়ে আছে।এতোবছরের বন্ধুত্বে আমি তিয়াশার এই রূপ কখনোই দেখিনি।আমাকে দেখেই তিয়াশার পাগলামি বেড়ে গেল।সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,তোকে আমি অনেক ভালোবাসি আয়াজ।তোর অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আমি মানতেই পারছিনা।তোর পাশে অন্য কাউকে আমি কল্পনাই করতে পারছিনা।
:কি বলছিস তুই এসব?আমি কি কখনো তোকে বলেছি আমি তোকে ভালোবাসি? তুই তো শুরু থেকেই জানতি আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।তবে এই প্রত্যাশার মানে কি??
:আমি তো ভাবিনি তুই সত্যিই তাকে পেয়ে যাবি।
:তুই এসব বলার জন্য আমাকে ডেকেছিস??
:হ্যাঁ।শুধু তাই নয় আজ আমি যা চাইবো তা যদি না পাই এখন এইখানে আমি সুইসাইড করবো।আর আমার মৃত্যুর জন্য তুই দায়ী থাকবি।
:এসব পাগলামির মানে কি তিয়াশা??তুই এসব করে আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করা ছাড়া কিছুই করছিস না।
তিয়াশা পাগলের মতো হাসতে লাগলো।তারপর চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।
:সব হয়েছে ঐ চাঁহাতের জন্য।আমি ওকেই শেষ করে দেবো।তারপর তুই শুধু আমার হবি।যে আমার হবেনা সে আর কারো হতে পারবেনা।তোকে তো আমি কিছু করতে পারবোনা তবে চাঁহাতকে পারবো।হাহা
আমি বিরক্ত হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে চলে আসছিলাম তখন তিয়াশা আমার মাথায় খুব জোরে আঘাত করলো।এরপর আমার কিছু মনে নেই।
জ্ঞান ফিরতেই দেখি তিয়াশা খুব স্বাভাবিক আছে।যেন কিছুই হয়নি।সে আমাকে বললো,কেমন ফিল করছো আয়াজ?
ওর এমন আচারণে আমার খুব অবাক লাগলো।
সে হেসে বললো,তুমি এখন নিশ্চিন্তে দেশে ব্যাক করতে পারো।কোনো সমস্যা নেই।
আমি অবাকের পর অবাক হচ্ছি।তারপর তিয়াশা বললো,তোমাকে কাছে পাওয়ার তীব্র ইচ্ছে ছিল।সেটা পূরণ হয়ে গেছে।এখন আর তোমাকে লাগবেনা।তুমি গিয়ে রিল্যাক্সে চাঁহাতকে বিয়ে করো।I’ve no problem.
সে নিজেই আমার পাসপোর্ট আর টিকিট দিয়ে এয়ারপোর্টে ছাড়তে আসলো।আমার ঐখানে দমবন্ধ লাগছিল আমিও অতশত না ভেবে দেশে ব্যাক করলাম।এয়ারপোর্টে এসে ফোন অন করতেই দেখি তিয়াশা দুইটা ভিডিও আর ছবি পাঠিয়েছে।একটা ভিডিও ছিল আমার আর তাঁর আরেকেটা ছিল ওর একার।আর ছবিটা ছিল আমার ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট।
তিয়াশা:ডিয়ার আয়াজ।তুমি আমার ভালোবাসাকে রিজেক্ট করে ভুল করেছ।যে ভুলের কোনো ক্ষমা নেই।উপরের ভিডিওটা খুব সুনিপুণভাবে এডিট করা।তুমি চাইলেও তোমার ফ্যানদের বোঝাতে পারবেনা এটা তুমি না।তাছাড়া এতোদিনে এই ভিডিওতে এক মিলিয়ন ভিউজ হয়ে গেছে।কয়জনকে তুমি সাফাই দিবে??কিন্তু আমি জানি চাঁহাত এসবে বিশ্বাস করবেনা।ও ঠিকই তোমাকে বিয়ে করবে।কারণ তোমার মতো ছেলেকে কেউ অবিশ্বাস করতে পারেনা।তাই আমি তোমার শরীরে এইচআইভি ভাইরাস পুশ করেছি।হাহাহাহা ….
তুমি এখন জেনেশুনে নিশ্চয়ই তোমার প্রেয়সীকে হুমকির মুখে ফেলবেনা!!এখন না তুমি আমার হবে, না অন্য কারো।তোমার মনে হতে পারে আমি মিথ্যে বলছি তোমার হাতে ইনজেকশনের দাগটা টা দেখো আর রিপোর্টটা চেক করো।আশা করি এইটুকুই এনাফ ।বেস্ট অফ লাক,,,,,,
সবটা বলার শেষে আয়াজ চাঁহাতের দিকে তাকিয়ে বললো,আমি কি করে আপনাকেও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতাম বলুন?বাসায় ফিরে আমি এক সপ্তাহ নিজেকে বন্দী করে রেখেছিলাম।মিডিয়া প্রেস ফ্যান ফলোয়ার্স সবাই আমার কাছে জবাবদিহি চাইছিল।তবে ভালো ব্যাপার ছিল আমার 80% ফলোয়ার্স এটাকে ফেইক ভেবে আমার সাপোর্টে ছিল।আমি জানতাম আপনাকে কোনভাবেই বিশ্বাস করানো যাবেনা ভিডিওটা সত্যি ছিল।তাই আমি বাধ্য হয়ে সেসব বলেছিলাম।আমার থেকে দূরে থাকলেই আপনার ভালো হবে এই ভেবেই আমি দূরে সরে গেছি।
চাঁহাত চোখ মুছে বললো,আপনি পরবর্তীতে ডক্টর দেখিয়েছিলেন।এমনোতো হতে পারে তিয়াশা আসলেই মিথ্যে বলেছিল?
আয়াজ হেসে বললো,মিথ্যে না হলে কি আপনাকে কাছে টানতাম?যাকে সেইফ রাখার জন্য এতো বড় স্টেপ নিয়েছি কেবল কামনার বশে তাঁকে নিজের করে নিতাম ??
:তাহলে এতোদিন ব্যাক করেননি কেন?
:সাহসে কূলোয়নি!আপনাদের ফেইস করার সাহস হয়নি।তাছাড়া নিজের হয়ে সাফাই গাইতেও লজ্জা হচ্ছিল।কি বলবো আর!বাবা-মা আর আপনাকে আমি সেদিন কিসব বলেছি!!
চাঁহাত ফাস্ট এইড বক্স রেখে বললো,আম্মু আর বাবা জানে এসব?উনাদের পর্যন্ত বলেননি আপনি?
:মা জানেন।কিছুদিন আগে হয়তো জেনেছেন।আমার মা খুব ন্যায়বান মানুষ।ছেলের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে তাঁর আদরের চাঁহাতকে আর যাই হোক নিজের চরিত্রহীন ছেলের জন্য চাইতেন না!সে প্রয়োজনে ভালো ছেলে দেখে নিজে বিয়ে দিতেন আপনার।
:আমি যদি রাজী না হতাম?
:মৃত্যুশয্যায়ী মায়ের ইচ্ছে চাঁহাত ফেলতে পারবেনা সবাই ভালোই জানে!
:হুহ ঢং!
আয়াজ উঠে এসে চাঁহাতকে বললো,আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।শরীরের কি হাল করেছেন দেখেছেন?জানেন আপনাকে প্রথমদিন হসপিটালে দেখে আমার কত কষ্ট হয়েছিল।নিজেকে প্রচুর অপরাধী মনে হয়েছে।আমাকে ক্ষমা করে দিন চাঁহাত!আমি আর কখনওই আপনাকে কষ্ট পেতে দিবোনা।
:আরেকবার কষ্ট দেওয়ার সাহস করে তো দেখুন খুন করে ফেলবো।
আয়াজ হেসে বললো,আপনি অলরেডি আমাকে বেশ কয়েকবার খুন করে ফেলেছেন!মরাকে আর কত মারবেন?
:সিনেম্যাটিক ডায়লগ।
আয়াজ গাঢ় গলায় বললো,এবারতো কাছে টেনে নিন।আর কত সহস্র বছর অপেক্ষা করাবেন?
চাঁহাত লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেললো।আয়াজ মুচকি হেসে তাঁকে কোলে তুলে বেডে শুইয়ে দিয়ে বললো,আপনাকে লজ্জা পেলে আরো আকর্ষণীয় লাগে জানেন সেটা?
তারপর কপালে গভীর চুমু এঁকে দিয়ে বললো,
আজ পুরো রাত আপনাকে লজ্জা পেতে হবে মিসেস আহমেদ!
🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁
সকালে ডাইনিং এ চাঁহাতের লজ্জামাখা মুখ দেখে আয়েশা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।এখন মনে হচ্ছে চাঁহাত আসলেই নতুন বৌ!
ব্রেকফাস্টের পর সবাই সোফায় বসে আয়াজদের হানিমুন কোথায় হবে তা নিয়ে আলোচনা করছিলো আয়াজ একটু পরপর মুগ্ধ দৃষ্টিতে চাঁহাতের দিকে তাকাচ্ছে আর চাঁহাত গাল লাল করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।ইশ এতো লজ্জা কেন লাগছে তাঁর!!
এমন সময় বাসায় ঢুকলো তিয়াশা আর রেহান।তিয়াশাকে দেখে আয়াজের মাথা গরম হয়ে গেল।সে রেগে উঠতে নিলেই আয়েশা ইশারায় থাকে বসতে বললো।তিয়াশা চাঁহাতের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসি দিলো।তারপর আয়েশার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।আয়েশা তখন বললো,তুমি নিজে বলবে নাকি আমি বলবো?
তিয়াশা দম নিয়ে সবটা বললো।সুপ্তি সবটা শুনে উঠে গিয়ে তিয়াশাকে সজোরে থাপ্পড় দিলো।
:তোমাকে আমি ছোট বোনের মতো স্নেহ করতাম আর তুমি কি না আমার ভাইয়ের সাথে এসব করলে।ছিঃ তিয়াশা! তোমার জন্য এতোগুলো মানুষ বছরের পর বছর কষ্ট পেয়েছে।তুমি কি না এতোদিনে এসেছ সবটা স্বীকার করতে?
তখন রেহান বললো,আপু কাকে কি বলছো?তিয়াশা এখনো নিজ থেকে আসে নি।ওর মধ্যে না এ নিয়ে কোনো অনুতাপ আছে।আন্টি যদি ওর ইউনিভার্সিটিতে ওর নামে কমপ্লেইন না পাঠাতো হয়তো এখনো আসতো না।ওর মতো স্বার্থপর মেয়ে আর যাই হোক নিজের ক্যারিয়ার ভেস্তে যেতে দিতোনা!!
সাদেক সাহেব বললেন,তুমি সব জানতে আয়েশা?
আয়েশা বললো,হ্যাঁ আমি সব জানতাম।রেহান আমাকে সব বলেছে।ও না বললে হয়তো কখনওই জানতাম না অজু প্যারিসে কেমন নরকীয় জীবন অতিবাহিত করছে!রেহান তোমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবোনা বাবা।তুমি আসলেই অজুর সত্যিকারের বন্ধু।
:কি যে বলেন আন্টি!আয়াজকে প্যারিসে ঐ অবস্থায় দেখে আমি তো নিজেকে সামলাতে পারিনি।ও তো কিছুই বলতে রাজী হয়নি।অনেক জোর করে সবটা জেনেছি।তারপর তিয়াশাকে খুঁজে বের করেছি।ও তো সিঙ্গাপুর থেকে শিফট করে অস্ট্রেলিয়া চলে গিয়েছিল।সেজন্যই এতো সময় লেগেছে।
রেহান চাঁহাতের দিকে তাকিয়ে বললো,বুঝলে চাঁহাত আমরা সবাই জানি আয়াজ এক অপরিচিতাকে ভালোবাসে।যে ছেলের পিছে ভার্সিটিতে দুনিয়ার মেয়ের লাইন ছিল সে ঐসব পাত্তা না দিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করেছে।ওর মতো পাগলা আমরা আর একটাও দেখিনি।ওকে যত্নে আগলে রেখো সবসময়।
তিয়াশা বিরক্ত হয়ে চলে গেল।কেউ ওর দিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না।
সাদেক সাহেব বললো,যাক সব ভুল বোঝাবুঝি ভেঙেছে এতেই আমি খুশি।বলেছিলাম না আমার ঘরের রাজরাণী এসেছে সব ঠিক হয়ে যাবে।দেখলি তো বৌমা সব ঠিক হয়ে গেছে!!
মেরাজ বললো,স্যার এবার তো মুভির জন্য হ্যাঁ বলে দেন??
সবাই হোহো করে হাসতে লাগলো।
পরিশিষ্টঃ আয়াজ সেই কখন থেকে অপেক্ষা করে বসে আছে।চাঁহাত কিসব লেখালেখিতে ব্যস্ত।
“টিচার মেয়ে বিয়ে করার শাস্তি ভোগ কর ব্যাটা!”
চাঁহাত বললো,কিছু বললেন?
আয়াজ চোখ ছোট করে বললো,ছেলেটাকে এতো কষ্ট করে ঘুম পাড়ালাম আপনার সাথে রোমান্স করবো বলে।অথচ আপনি খাতা দেখায় ব্যস্ত!এতোদিন পর শুটিং থেকে ফিরেছি কোথায় একটু আদর করবেন তা না!!!
চাঁহাত মাথা তুলে বললো,কেন মুভিতে এতো রোমান্স করে সাধ মেটেনা?আমার স্টুডেন্টরা কি বলে জানেন আপনি নাকি অ্যাকশন হিরোর চেয়ে রোমান্টিক হিরো হিসেবে কিউট!
আয়াজ বিড়বিড় করে বললো,তাঁরা তো জানেনা এই রোমান্টিক হিরোটার বৌ সবচেয়ে আনরোমান্টিক।
চাঁহাত উঠে এসে আয়াজের গলা জড়িয়ে বললো,তাই বুঝি?
:হু ঠিক তাই।
:তাহলে আর কি যান গিয়ে রোমান্টিক কাউকে খুঁজে আনুন।
চাঁহাতকে হেচকা টানে কাছে এনে কোমড় জড়িয়ে বললো,কি করবো বলুন আপনার নেশায় মাতাল হয়ে আছি তো।অন্য কারো দিকে তাকানোর সময়ই পাইনা।
তারপর যেইনা ঠোঁটজোড়া দখল করবে অমনি আয়ান ঘুম থেকে উঠে কান্না করতে লাগলো।আয়াজ দৌড়ে গিয়ে তাঁকে কোলে তুলে আদর করতে করতে বললো,বাপরে তুই কান্না করার আর সময় পেলিনা!তোর মাকে বশে আনা কত কষ্ট তা যদি তুই জানতি এরকম হুটহাট ডিস্টার্ব করতিনা।
আয়ান কান্না থামিয়ে ড্যাব ড্যাব করে আয়াজের দিকে তাকিয়ে রইলো।
চাঁহাত বাপ-বেটার কাহিনী দেখে জোরে জোরে হাসতে লাগলো।
সমাপ্ত