চাঁহাত,১১তম পর্ব,১২তম পর্ব

চাঁহাত,১১তম পর্ব,১২তম পর্ব
আরশিয়া জান্নাত
১১তম পর্ব

রিসিপশনে দাঁড়িয়ে মেরাজ আর চাঁহাত সিস্টারের কাছ থেকে মেডিসিনগুলো বুঝে নিচ্ছিল তখন আয়াজ হসপিটালে ঢুকলো।দূর থেকে চাঁহাতকে দেখে ওর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।ঝাপসা চোখে চাঁহাতকে মনভরে দেখছে, পড়নে কালো সুতি শাড়ি, চুলগুলো কোনোরকমে হাত খোঁপা করে তাতে ক্লিপ আটকে দিয়েছে।আগের থেকে অনেক শুকিয়ে গেছে নাকি!চেহারায় আগের জেল্লা না থাকলেও বেশ মায়াময় এক আভা আছে।চাঁহাতের এমন পরিপাটি রূপ দেখে বুকের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে তাঁর।যে চাঁহাতকে ও ভালোবেসেছে সে তো এমন না।তবে কি সেজন্যই ও নিজেকে এমন বদলে নিয়েছে, এতো ঘৃণা আমার প্রতি ?
চাঁহাত কথাবার্তা বলে লিফটে উঠে গেল।তখন মেরাজ আয়াজ কে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলো।
স্যার আপনি এসেছেন!আমি জানতাম আপনি আসবেন।স্যার তাড়াতাড়ি চলেন স্যার আমার বিশ্বাস আপনি গিয়ে দাঁড়ালেই বড় মেডাম অর্ধেক সুস্থ হয়ে যাবে।
আয়াজ টলতে টলতে আয়েশার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।মেরাজ তাকে ওখানে রেখে মেডিসিন আনতে চলে গেল।মাকে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখার ক্ষমতা কোনো সন্তানের নেই।আয়াজ ও ব্যতিক্রম নয় সে ওখানে দাঁড়িয়েই চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো।আজ তাঁর জন্য তাঁর মায়ের এই অবস্থা।
সিস্টার দৌড়ে এসে বললো,আহা আইসিউর সামনে কান্নাকাটি করবেন না প্লিজ।নিজেকে সামলান।
:সিস্টার আমার মা আমার মা ঠিক আছে তো?
:চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে কিছু বলা যাচ্ছেনা। আল্লাহকে ডাকুন।
চাঁহাত জোর করে সাদেক সাহেবকে খাইয়ে দিতে লাগলো।
:গলা দিয়ে নামছে না রে মা।অযথাই কষ্ট করছিস
:প্লিজ আঙ্কেল আমাকে নিষেধ করবেন না আমি কিন্তু খুব রাগ করবো।কাল দুপুর থেকে না খেয়ে আছেন।এখনো যদি না খান অসুস্থ হয়ে পড়বেন।দেখি হা করুন।
সাদেক আর কিছু না বলে খেতে লাগলো।সুপ্তি তানহাজ কে বললো,চাঁহাত কেন আমার ভাইয়ের বৌ হলো না তানহাজ?ও ই পারতো আমার মা বাবাকে আগলে রাখতে।
তানহাজ সুপ্তির কাঁধে হাত রেখে বললো,যা হয় ভালোর জন্য হয়।ভরসা হারিও না।
চাঁহাতঃআপু আপনারা বরং আঙ্কেলকে নিয়ে বাসায় চলে যান।উনার রেস্ট দরকার তাছাড়া আপনারাও জার্নি করে এসেছেন।
সুপ্তিঃ না না আমরা ঠিক আছি চাঁহাত তুমি বরং বাসায় যাও।রাতভর এখানে ছিলে রেস্ট করে আসো।
তানহাজঃ হ্যাঁ চাঁহাত তুমি বরং বাবাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও।আমরা থাকি এখানে।
চাঁহাতঃআচ্ছা আমি তানহাকেও নিয়ে যাচ্ছি।কোনো সমস্যা হলে আমাকে অবশ্যই ফোন করবেন।
সাদেক সাহেব যেতে না চাইতেও বাধ্য হয়ে যেতে রাজী হলেন।ওরা উঠবার সময় আয়াজ রুমে ঢুকলো।আয়াজ কে দেখে চাঁহাত থমকে গেল!
তানহা মামা মামা বলে দৌড়ে গিয়ে আয়াজকে জড়িয়ে ধরলো।আয়াজ তানহাকে কোলে নিয়ে আদর করলো।তারপর নামিয়ে দিয়ে সাদেক সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সাদেক সাহেব অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিতেই আয়াজ তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।ছেলের কান্নায় তাঁর মন গলে গেল।শত হোক তাঁর বড় আদরের সন্তান আয়াজ আর সুপ্তি।চাঁহাত কি করবে বুঝতে পারছেনা।তাঁর শরীর থরথর করে কাঁপছে,মাথা কেমন ভনভন করছে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে যেন।নিজেকে শক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে।ও কি কাউকে না বলে চলে যাবে?? নিঃশ্বাস নিতে এতো কষ্ট হচ্ছে কেন এখানে কি এক ফোঁটা অক্সিজেন নেই?
চাঁহাত চেয়ারে বসে পড়লো চোখ বন্ধ দম নিলো।তারপর উঠে শক্ত গলায় বললো,আঙ্কেল আপনি কি যাবেন?নাকি আমি একাই চলে যাবো?
আয়াজ চাঁহাতের দিকে তাকিয়ে রইলো।সুপ্তি বললো,হ্যাঁ বাবা তুমি বরং একটু রেস্ট করে আসো।তানহা মামণি একদম দুষ্টুমি করবেনা কেমন?
তানহা:মম আমি যাবোনা।আমি মামার সাথে থাকবো।
সুপ্তিঃ মামাতো চলে যাচ্ছেনা।এখানে থেকে কি করবে সোনা তুমি বরং চাঁহাতের সাথে যাও ভালো লাগবে।
তানহাঃচাঁহাত মামানী আমাকে মামানী ডাকতে মানা করেছে।তাই আমি উনার সাথে যাবো না।
সুপ্তি অপরাধীর মতো মুখ করে চাঁহাতের দিকে তাকিয়ে বলল,কিছু মনে করোনা চাঁহাত আমিই ওকে ….
চাঁহাতঃ আপু তানহা বরং থাকুক।আমরা যাই।আপনাদের জন্য লাঞ্চ রেখে যাচ্ছি খেয়ে নেবেন প্লিজ।আর কিছু লাগলে ফোন করবেন।আমি ফ্রেশ হয়েই চলে আসবো বেশি দেরী করবোনা।
চাঁহাত সাদেক সাহেবকে নিয়ে বেড়িয়ে গেল।
আয়াজ মাথা নীচু করে চোখের পানি মুছলো।
সুপ্তি গিয়ে ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বললো,মন খারাপ করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।

চাঁহাত বাসায় ফিরে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে রইলো।বাঁধ ভাঙা চোখের পানি শাওয়ারের পানিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।চোখের পানি থামার নামই নিচ্ছে না।এতো কেন কষ্ট তাঁর?এতোবছরেও কেন নিজেকে শক্ত করতে পারলাম না ,কেন তাঁকে দেখে এমন দূর্বল হয়ে পড়েছি।কেন!!
আয়েশার জ্ঞান ফেরার পর সে সবার দিকে তাকিয়ে রইলো।চাঁহাতের দিকে চোখ পড়তেই তাঁর চোখের কিনারায় পানি গড়িয়ে পড়লো।ইশারায় চাঁহাতকে কাছে ডাকতেই চাঁহাত গিয়ে তাঁর পাশে বসলো।
আয়েশা খুব ক্ষীণ গলায় বললো,
আমার শেষ ইচ্ছে পূরণ করবি মা?আমি জানি সেটা অন্যায় কিন্তু মা হিসেবে আমি এই অন্যায় করতে রাজী।
চাঁহাত বললো,আন্টি এখন অন্য কথা বাদ আপনি আগে সুস্থ হয়ে উঠুন।
:আমাকে বলতে দাও চাঁহাত।যদি আর বলার সুযোগ না পাই?
:আল্লাহ না করুক আন্টি।কিসব বলছেন।
আয়েশা অনেক আস্তে আস্তে বললো,চাঁহাত আমার ছেলেকে বিয়ে করো।আমার সংসারের হাল ধরো।এই বুড়ো মেয়ের শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করো মা!
চাঁহাত বিস্ফোরিত চোখে ওমর ফারুকের দিকে তাকালো সে কি উত্তর দেবে!!
সাদেক সুপ্তি তানহাজ অসহায়ের মতো চাঁহাতের দিকে তাকিয়ে আছে।
চাঁহাত বেশকিছুক্ষণ ভেবে বললো,আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন আন্টি তবেই আমি আপনার পুত্রবধু হবো।
(ডাক্তার বলেছে আয়েশা বেঁচে থাকার সব আশা ছেড়ে দিয়েছে।চাঁহাত চেয়েছে এই আশায় যদি আয়েশা বেঁচে থাকার নতুন উদ্যম পায় তবে সে এইটুকু সেক্রিফাইজ করতেই পারে!)
আয়াজ চমকে চাঁহাতের দিকে তাকিয়ে রইলো।দিলারা ওমর ফারুক মেয়েকে হাসিমুখে সাপোর্ট করলো।একজন মুর্মূর্ষ মায়ের কথা রাখার সিদ্ধান্তে তাঁরা একটুও হতাশ হয়নি বরং চাঁহাতের সিদ্ধান্তে তাঁর মা-বাবা হিসেবে গর্ববোধ করছে।
আয়েশা চোখ বন্ধ করে চাঁহাতের হাত ধরে বললেন, তুমি এই শর্ত জুড়ে দিয়ে আমার জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে নতুন হাতিয়ার দিলে চাঁহাত!
তারপর চোখে খুলে হাসিমুখে বললো,
কোনো মা-ই সন্তানের সুখকে নিলামে ফেলে রেখে মরতে পারেনা!আমি আমার সবটুকু দিয়ে এই লড়াই করবো আল্লাহ যা ভাগ্যে রেখেছেন তাই হবে।
🌿🌿🌿
রকিং চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে চাঁহাত সেই দিনগুলোর কথা ভাবতে লাগলো,
সকালে ঘুম থেকে জেগেই ফোনে আয়াজের টেক্সট পেলো। “I’ll be back very soon.Take care”
চাঁহাত ভাবলো শুটিং এ বা কোনোকাজে কোথাও গেছে হয়তো।চাঁহাত অতশত না ভেবে ক্লাসে চলে গেল।এভাবেই বেশকিছুদিন কেটে গেল অথচ আয়াজের কোনো খবর নেই,না ফোনকল না টেক্সট।ক্যাম্পাসে ঢুকতেই একজন এসে বললো,আপু আপনি না আয়াজ আহমেদ এর ফিয়ান্সে?
:হ্যাঁ কেন?
:আপু আপনি আজকের নিউজ দেখেননি? আয়াজ আহমেদ এর স্ক্যান্ডাল ভাইরাল হয়ে গেছে।
:কি যা তা বলছো তুমি।পাগল হয়ে গেছ?
:না আপু সত্যি বলছি দেখুন আপনি।
তারপর চাঁহাত যা দেখলো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা।সাথে সাথে সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেল।
হসপিটালে জ্ঞান ফেরার পর চাঁহাত সবাইকে উপেক্ষা করে পাগলের মতো আয়াজের বাড়িতে গেল।আয়েশা চাঁহাতকে দেখে বললো,
ওমা আমার বৌমা এলো দেখি।কেমন আছ মা?
এই কে কোথায় আছিস চাঁহাতের জন্য নাস্তা নিয়ে আয়।
:আন্টি আয়াজ কোথায়?
:ও তো সিঙ্গাপুর গেছে।
:সিঙ্গাপুর কিজন্য গেছে?
:চাঁহাত কি হয়েছে তোমার চেহারা এমন লাগছে কেন?
:আন্টি আয়াজ সিঙ্গাপুর কেন গেছে তাও মেরাজ সাহেবকে ছাড়া? প্লিজ আমাকে বলুন।
আয়েশা মেরাজ কে ডেকে বললো,আয়াজ সিঙ্গাপুর কেন গেছে মেরাজ?
:আমাকে বলেনি মেডাম শুধু জানি উনি তিয়াশা মেডামের কাছে গেছেন।
:আপনি এখুনি আপনার স্যারকে ফোন করুন।উনাকে বলুন দেশে ফিরতে।
:কিন্তু স্যারের ফোন আনরিচেবল।গত কিছুদিন কনট্যাক্ট করতে পারছিনা।
:আপনি কি বলছেন মেরাজ সাহেব! যে হিরো কোথাও বডিগার্ড ছাড়া যায় না সে একা একা সিঙ্গাপুর চলে গেছে আবার ফোন ও কানেক্টেড না।এসব কি গ্রহণযোগ্য??
চাঁহাত খুব জোরেই কথাগুলো বললো।
চাঁহাতের চিৎকার শুনে সাদেক সাহেব ও নীচে চলে এলো।
:মেডাম আমি স্যারকে বলেছিলাম কিন্তু উনি বললেন খুব আর্জেন্ট তাই …
:তুমি এসব আমাকে বলোনি কেন মেরাজ?
:আপনারা টেনশন করবেন বলে স্যার নিষেধ করেছিল।
সাদেক সাহেব তিয়াশাকে কল করলে ফোন সুইচড অফ বলে।তারপর বাধ্য হয়ে ওখানকার পুলিশ স্টেশনে কল করে।
চাঁহাতকে শান্ত করে আয়েশা বললো,মামণি তুমি কি কোনো কারণে ডিস্টার্ব?কিছু হয়েছে?
চাঁহাত আয়েশাকে জড়িয়ে ধরে বললো,আয়াজকে ট্র্যাপে ফেলা হয়েছে আন্টি।ইন্টারনেটে উনার স্ক্যান্ডাল ভাইরাল করেছে…..
আয়াজ ফিরলো ঠিক এক সপ্তাহ পর।চাঁহাত এর সঙ্গে নিজ থেকে দেখা করলোনা, না ফোন করেছে।চাঁহাত নিজেই আয়াজের কাছে গেল।
:আমি জানি আপনি এমন কিছুই করেননি যাতে আমাদের বিশ্বাস ভঙ্গ হবে।এখন এডিট করে অনেক কিছুই করা যায়।আপনি একদম হতাশ হবেন না।
আয়াজ চাঁহাতের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত গলায় বললো,আমি মোটেও হতাশ নই মিস চাঁহাত!আর না ভিডিওটা এডিট করা ছিল।যা দেখেছেন সবটা সত্যি।
আয়েশা এসে ছেলের গালে থাপ্পড় দিয়ে বললো,এসবের মানে কি অজু? আর কিছুদিন পর তোর বিয়ে আর তুই কিনা ছিঃ এই আমার শিক্ষা?
আয়াজ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,ভিডিওটা ভাইরাল হয়ে যাবে ভাবিনি।সমস্যা নেই মিডিয়াকে আমি কভার আপ করতে পারবো।এসব নিয়ে এতো সিন ক্রিয়েট করোনা।
চাঁহাত হতভম্ব হয়ে আয়াজের দিকে তাকিয়ে রইলো,এই আয়াজকে সে চিনতে পারছেনা।
:আপনি মিথ্যে বলছেন আয়াজ?আপনি কেন এমন করছেন প্লিজ বলুন,আমার মনে হচ্ছে এখানে অন্য কোনো ঘটনা আছে।প্লিজ আয়াজ খুলে বলুন।
আয়াজ বললো,মিস চাঁহাত আপনি কি এটাকে ফিল্ম ভাবছেন নাকি গল্প উপন্যাস?হিরোরা বাধ্য হয়ে সব করে, সবকিছুতে ষড়যন্ত্র?Come to the reality,তিয়াশা আমার ফ্রেন্ড আমাদের প্রায়ই গেট টুগেদার হয় ফরেনে থাকাকালীন বেড শেয়ার ….
সাদেক সাহেব সজোরে এক চড় দিলেন।
“লজ্জা করে না এসব কথা বলতে?এতো বড় স্পর্ধা তোমার?”
চাঁহাত আর কিছু বললো না।চুপচাপ ওখান থেকে চলে গেল।মাথায় ভনভন করা যন্ত্রণা সেই থেকেই শুরু।সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো। চোখের সামনে সবকিছু গাঢ় অন্ধকার চাঁহাত গার্ডেনে ই জ্ঞান হারালো।
আয়াজ কাউকে কিছু না বলে প্যারিস চলে যায়।আর চাঁহাতের জীবনটা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়।
🌿🌿🌿
চাঁহাত চোখ খুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত তিনটা বাজে।নিশ্চুপ নগরীর সবাই খুব শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে অথচ ঘুমকাতুরে সেই চাঁহাত নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ভোরে উঠে!এই জীবনে আপনাকে আর চাইনা আয়াজ অথচ পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় দাঁড় করালো সিদ্ধান্ত নিতেই হলো আপনার সঙ্গে ভাগ্য জোড়ার!! জানিনা কি হবে….

চলবে

চাঁহাত ১২তম পর্ব
আরশিয়া জান্নাত

দিলারা চাঁহাতের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।বুঝতে পারছেনা ঢুকবে কি ঢুকবে না।
চাঁহাত দরজা খুলে বললো,দাঁড়িয়ে থাকলে তো হবেনা দরজা নক করতে হবে।ভেতরে এসো
দিলারা চমকে গেল।তারপর ভেতরে ঢুকে বললো,পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে আয়াজকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছ।কিছু বলিনি অসুস্থ মায়ের অবস্থা বুঝে,কিন্তু তুমি কি পারবে ওকে মেনে নিয়ে সংসার করতে?বিয়ে কোনো ছেলেখেলা না,আর এক দুই দিনের ব্যাপারও না।
:আন্টিকে আমি অনেক ভালোবাসি মা! উনার স্নেহ মমতার উপেক্ষা করার শক্তি আমার নেই।তাছাড়া ঐ মুহূর্তে এটা ছাড়া আর কিই বা বলতাম বল?
আয়াজ আমাকে ধোঁকা দিয়েছে ওর ফ্যামিলি তো দেয় নি।তবে আমি তাঁকে ক্ষমা করবোনা।আন্টি সুস্থ হয়ে উঠলেই আমি চলে আসবো,এই বিয়েটা আমার কাছে আন্টির সুস্থতার মেডিসিন ছাড়া কিছুই না।
:এমন হয় না চাঁহাত! বিয়ের পর সব বদলে যায়,সমাজ আগের মতো গ্রহণ করেনা।সামির তোমাকে অনেক আগে থেকে পছন্দ করে।ও কতবার তোমার কাছে এসেছে তুমি ওকে বারবার ফিরিয়ে দিয়েছ।আয়াজের চেয়ে সামির কি বেটার অপশন ছিল না?তুমি বিয়ে করে নিলে তো আজ এই পরিস্থিতি হতো না…
চাঁহাত মিষ্টি করে হেসে বললো,মা হিসেবে মেয়ের বিয়েতে আপত্তি করতেই পারো।তুমি বরং বিয়েটা ভেঙে দাও।বলবে আমার একমাত্র মেয়ের সাথে এই বদ ছেলের বিয়ে আমি মানবোনা।প্রয়োজনে আমি অনশনে বসবো..
দিলারা হেসে দিলো।কতদিন পর চাঁহাত আগের মতো করে কথা বলছে!

ডক্টর সুশান্ত আয়েশার রিপোর্ট চেক করে বললেন,ভেরি গুড মিসেস আহমেদ।আপনার ইম্প্রুভমেন্ট দেখে আমি সত্যিই অবাক হচ্ছি।শুনুন একদম টেনশন করবেন না সবসময় হাসিখুশি থাকবেন।ব্রেইনে কোনো প্রেশার দিবেন না।
সুপ্তিঃ আঙ্কেল আমরা কি মাকে বাসায় শিফট করতে পারি?
:উনার আরো এক মাস বেড রেস্টে থাকা উচিত।হসপিটালে থাকলেই ভালো হয় তবে তোমরা যদি প্রপার কেয়ার করতে পারো তবে বাসায় নিতেই পারো।।অনেকসময় পেশেন্ট ফ্যামিলিতে থেকেই বেশি স্বস্তিবোধ করে।
:তাহলে আমরা কালই মা কে শিফট করবো।
:ওকে।
ডক্টর চলে যাওয়ার পর আয়েশা সুপ্তি কে বললো,
তুই একটা জিনিস খেয়াল করেছিস খুকি?
:কি মা?
:চাঁহাত ওর অ্যাঙ্গেজমেন্ট এর রিংটা ফেলে দেয়নি।ওর বা হাতের অনামিকাতে এখনো সেটা আছে।
:মা চাঁহাত তো ভাইকে ইচ্ছে করে ছেড়ে যায়নি।ও তো নিজেই ভাইয়ের হয়ে সাফাই গেয়েছিল।সবাই যখন ভিডিও দেখে বিভ্রান্ত হয়েছিল ও ই বলেছিল সব ষড়যন্ত্র , কম্পিউটারে সব সম্ভব।কিন্তু ভাই….
আয়েশা দম ছেড়ে বললো,চাঁহাতের ধারণাই সত্যি ছিল খুকি।আর সেজন্যই আমি ওকে বিয়ের কথাটা বলেছি।তোর কি ধারণা তোর মা ছেলের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে অন্য মেয়ের জীবন নষ্ট করবে?জেনেশুনে চাঁহাতকে ভুল মানুষের সঙ্গে বিয়ে করতে বাধ্য করতাম না নিশ্চয়ই!
:কি বলছো এসব?
:হ্যাঁ।চাঁহাতকে আমি অনেক স্নেহ করি খুকি।ওর মতো সোনার টুকরো মেয়েকে যে কেউ নিজের পুত্রবধূ করতে চাইবে।অজুর ব্যাপারে আমি সন্দিহান ছিলাম।তাছাড়া সঠিক তথ্য ছিল না আমার কাছে।
:এখন আছে?
আয়েশা হেসে বললো,আমার বৌমাকেই সব বলবো।হ্যাঁ রে খুকি ও আসবেনা আজকে?এতোক্ষণে তো চলে আসার কথা।
:রাস্তায় আছে হয়তো।ক্লাস শেষ করে সোজা হসপিটালে আসে মেয়েটা।খাওয়া দাওয়ার যে ছিরি শরীরে কি হাল করেছে দেখেছ?
:আমার কাছে আসুক খাইয়ে পড়িয়ে আবার আগের মতো করে ফেলবো দেখিস।
সুপ্তি খুব গোপনে চোখের কোণ মুছে মনে মনে বললো,তোমার সব ইচ্ছে যেন পূরণ হয় মা।ভাই আর চাঁহাতকে নিয়ে সোনার সংসার গড়ে উঠুক।
🌿🌿🌿
আয়াজের দেশে ফেরার খবর মিডিয়াতে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো।সবাই আয়াজের বাড়ির সামনে ভীড় জমিয়েছে।সিকিউরিটি গার্ড ভীড় সামলাতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে যাচ্ছে।মেরাজ আয়াজের সামনে দাঁড়িয়ে হাত কচলাচ্ছে।
আয়াজঃ কি হয়েছে মেরাজ?কিছু বলবে?
:স্যার আপনার আসার খবর মিডিয়া জেনে গেছে।তাঁরা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।হাজার বারণ সত্ত্বেও কেউ নড়ছেনা।
:তুমি তাদের বলো আগামীকাল সন্ধ্যায় আমি প্রেস কনফারেন্স এটেন্ড করবো।এখন আমি তাদের ফেইস করার মুডে নেই।
:ঠিক আছে স্যার।
আয়াজ জানলায় দাঁড়িয়ে গেইটের ভীড় দেখতে লাগলো।”এক সময় এই ফ্যান ফলোয়ার্স মিডিয়া কতো সহজে হ্যান্ডেল করতাম।আর এখন তাঁদের দেখে ভয় হচ্ছে।অতশত প্রশ্নের উত্তর আগের মতো বলার ক্ষমতা কি আমার আছে??”
সাদেক সাহেব বসে চা খাচ্ছেন এমন সময় আয়াজ এসে বললো,ডেকেছিলে বাবা?
:হু আয় বস।চা খাবি?
:না।
সাদেক সাহেব চায়ের কাপ রেখে বললো,আয়েশার আশা আমি ছেড়েই দিয়েছিলাম জানিস?ও যে বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারবে আমিই কল্পনাই করিনি।আল্লাহর দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া।
ওর সংকটময় অবস্থায় শেষ ইচ্ছে হিসেবে যা চেয়েছে তাতে আমি দোষ দেখিনা।তবে আমার মনে হয় চাঁহাতের উপর সেটা জুলুম হবে!
আয়াজ মাথা নীচু করে ফেললো।সাদেক সাহেব বলতে লাগলেন,তোমার প্রতি মেয়েটা অগাধ ভরসা রেখেছিল তুমি তার প্রতিদান খুব খারাপ দিয়েছ।আমি জানিনা এখানে আসল ঘটনা কি।তোমার মা হয়তো বাসায় ফিরেই বিয়ের জন্য তোড়জোড় করবে।তাঁর সুস্থতার খাতিরে আমি কেন কেউই কিছু বলবেনা।কিন্তু সংসার তো আর আমরা করবোনা করবে তুমি আর চাঁহাত।তোমাদের মধ্যে সব ঠিক না হলে চলবেনা।মেয়েটাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ আর দিও না।যে তোমার মায়ের জন্য সব মেনে নিয়েছে তাঁর প্রতি কতোটা ডেডিকেটেড হতে হবে তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবেনা?
আয়াজ কিছু বললো না।সাদেক সাহেব ছেলের নিরবতায় হতাশ হয়ে গেলেন।

সামির অনেকক্ষণ ধরে চাঁহাতের অপেক্ষা করছে।নিধির কাছে খবর পেয়েছে কাল চাঁহাতের বিয়ে।তাও আবার আয়াজের সাথে!সামিরের মাথায় কিছুই আসছেনা।এদিকে চাঁহাত এখনো আসছেনা।
আয়াজ দিলারার সাথে দেখা করতে তাদের বাড়িতে এলো।সামির আয়াজকে দেখে সামনে এগিয়ে গেল।
:হ্যালো মিস্টার আয়াজ!আপনার নাম অনেক শুনেছি আজ ফাইনালি দেখা হলো।
:আপনাকে চিনলাম না?
:চিনবার কথাও না।আমি সামির চাঁহাতের শুভাকাঙ্ক্ষী।আপনারা যখন মন ভেঙে চলে যান আমরা শুভাকাঙ্ক্ষীরা খুব যত্ন করে মন জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করি।অথচ ভাগ্য দেখুন মন ভাঙা মানুষগুলোই শেষ পর্যন্ত মন পায়!
:ওহো আপনার দেখি মিস চাঁহাতের প্রতি অনেক কনসার্ন?তা মিস চাঁহাত জানে তো আপনার মনের খবর?একসেপ্ট করেনি বুঝি?
সামিরের কান লাল হয়ে গেল।সে হাসিমুখে বললো,ভালোমেয়েরা সবসময় ভুল মানুষকে ভালোবাসে।জানেন তো?
আয়াজ সামিরের কলার ঠিক করে দিতে দিতে বললো,আঙুর ফল টক ।😊
এমন সময় চাঁহাত ঢুকলো।সামিরকে দেখে হেসে বললো,I’m extremely sorry.অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়েছি না?আসলে আজকে ল্যাবে ডিউটি ছিল,,,
:না না সমস্যা নেই।তুমি ফ্রেস হয়ে আসো বরং।
: সমস্যা নেই চলুন লনে গিয়ে বসি।
চাঁহাত আয়াজকে যেন দেখেই নি এমন ভাব নিয়ে সামিরের সঙ্গে চলে গেল লনে।আয়াজ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে।
:চাঁহাত তোমার নাকি কাল বিয়ে?আমাকে একটাবার বলার প্রয়োজনবোধ করলেনা?
:খুব ব্যস্ত আছি আসলে।কাউকেই স্পেশালি বলা হয়নি।তাছাড়া কোনো অনুষ্ঠান করা হচ্ছেনা।ঘরোয়াভাবেই বিয়েটা হবে।
:যাকে ভালোবাসোনা তাঁর সঙ্গেই যখন বিয়ে করছো আমার বেলা না করছিলে কেন চাঁহাত?নাকি আমি এতোটাই অযোগ্য যে আমার বদলে আয়াজ বেটার মনে হলো তোমার?
চাঁহাত কিছুক্ষণ সামিরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললো,কাউকে একবার ভালোবাসলে ঘৃণা করা যায় না সামির।মানুষটা না থাকলেও ভালোবাসা আজীবন থেকে যায়!আমি কাকে বিয়ে করবো আর কাকে করবো না এটা আমার চয়েজ।আপনি এখানে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেন না তাই না??
সামির অবজ্ঞার হাসি হেসে বললো,আয়াজ খুব লাকি জানো তো?বেঈমানী করেও পিওর মানুষ পাচ্ছে।তোমরা মেয়েরা অপাত্রে গুরুদান করো।
সামির আর কিছু না বলে চলে গেল।
আয়াজ আড়ালে থেকে সব শুনে মুচকি হাসলো।”আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা কমেনি মিস চাঁহাত!আপনি এখনো আমাকেই ভালোবাসেন।আমাদের ভাগ্য নিশ্চয়ই একসঙ্গে গাঁথা নাহয় এতোকিছুর পর ও আমরা কেন এক হতে যাচ্ছি??”
🌿🌿🌿
আজ চাঁহাতের বিয়ে,
ইরা নীলয় নুশু দিপু সবাই সকালেই চলে এসেছে।চাঁহাতের বিয়ে মিস করার প্রশ্নই আসে না পরিস্থিতিই যাই হোক।সিয়াম আর তাঁর স্ত্রী লারা গতকাল রাতেই বাংলাদেশে এসেছে।ঘরোয়া ভাবে বললেও আত্মীয়স্বজন সবাই কমবেশ এসেছে।হলুদ ফাংশন স্পেশালি না হলেও দুপুরে হলুদ দিয়ে চাঁহাতকে গোসল করানো হয়েছে।চাঁহাতকে ব্রাইডাল মেকআপ করানো হবে কিনা তা নিয়ে টেনশনে চাঁহাতের কাজিনরা ভয়ে চুপসে গেল।
আঁখি:না বাবা সাজানো তে আমি নেই।গতবার যে হাল হয়েছিল আমি তো ভুলেও সাজাবো না।
চৈতি:চাঁহাত আপু তো এখন অনেক চেইঞ্জ হয়েছে।দেখোনা কি সুন্দর শাড়ি সামলে চলাফেরা করে।আপু এখনো কি স্কিনে সমস্যা আছে?
চাঁহাতঃ হু।মেকাপ লাগবেনা।তাছাড়া উনারা সবাই জানেন আমার সমস্যার কথা।টেনশনের কিছু নেই।
চাঁহাত বিয়ের মেরুন কালার লেহেঙ্গার দিকে তাকিয়ে অতীতে হারিয়ে গেল,
সুপ্তিঃ দেখো তো চাঁহাত লেহেঙ্গাটা কেমন?
দিলারাঃ কাকে জিজ্ঞাসা করছো সুপ্তি?ড্রেস সম্পর্কে চাঁহাতের আইডিয়া খুব জঘন্য।
সুপ্তিঃ সমস্যা নেই আন্টি চাঁহাতের সব তো ভাই ই পছন্দ করবে।বিয়ের সব ভাই নিজে পছন্দ করেছে ওর চয়েজ অনেক ভালো।
দিলারাঃ আসলেই অনেক সুন্দর।মেয়ের আফসোস আমার মেয়ের জামাইয়ে মিটলো।হাহাহা
সুপ্তিও হাসতে লাগলো।
আয়াজ তখন চাঁহাতের কানে ফিসফিস করে বললো,আপনার চয়েজও কিন্তু মোটেও খারাপ না মিস চাঁহাত! খারাপ হলে কি আমাকে চুজ করতেন??
চাঁহাত ভেংচি কেটে বললো,হুহ ঢং।

আমাদের বিয়ে নিয়ে কত প্ল্যান ছিল,ঠিকই বিয়ে হচ্ছে অথচ সেই উচ্ছাস নেই। সব আপনার জন্য হয়েছে মিঃ হিরো!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here