স্কুল জীবনের প্রেম,পর্ব_৬ (শেষ পার্ট)
লেখা_জান্নাতুল নাঈমা
ভার্সিটি এডমিশন নেওয়ার পর থেকে আমার আর তাসমিয়ার মাঝে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি হলো। কারন আমি কম্পানি জব নিয়ে নেই যার কারনে আমি আমার এলাকার ডিগ্রি কলেজে এডমিশন নেই। আর তাসিময়া কে ওর বাবা ভালো একটা ভার্সিটিতে ভর্তি করায়।আমি অবুঝের মতো বায়না ধরেছিলাম যাতে তাসমিয়াও আমার সাথে ডিগ্রি কলেজে এডমিশন নেয়। আমার নাগালের ভিতরেই যেনো থাকে। তাসমিয়া রাজি হয়নি। রাগ করে অভিমান করে ঝগরা করে রাজি করিয়েছিলাম। আমাকে গুরুত্ব দিয়ে ও ওর বাবার কাছে বলেছিলো সেই কথা। কিন্তু ওর বাবা রাজি হয়নি। এক প্রকার জোর করেই ওকে ভালো ভার্সিটিতে এডমিশন নিয়ে দেয়। আর আমার মাথায় আগুন ধরে যায়। সে সময় আমার উচিত ছিলো জবের দিকে মন দেওয়া পড়াশোনায় মন দেওয়া। ভালো কিছু করতে চেষ্টা করা। কিন্তু তাসমিয়া আলাদা ভার্সিটিতে এডমিশন নেওয়ায় আমার সব এলো মেলো হয়ে গেলো। প্রথম দিকে মন কে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কয়েকমাস গেলে পাগল হয়ে যাই। ছটফট করতে থাকি। ফোন করে মেসেজ করে নানারকম ঝগরা করি। সব সময় মনে হতে থাকে তাসমিয়া আমাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না,তাসমিয়া আমাকে কেয়ার করছে না। তাসমিয়া আমাকে অবহেলা করছে তাসমিয়া পালটে যাচ্ছে।
এসব ধারনা থেকেই নানারকম ভাবে ঝগরা করতাম।
ও যতোই আমার সাথে ভালো আচরন করুক না কেনো যতোই আমার কেয়ার করুক না কেনো ঐ যে মন, মন বুঝেছে সে আমায় অবহেলা করে মন বুঝেছে সে আমায় গুরুত্ব দেয় না ব্যাস সেটাই বুঝতাম। নিজে যা বুঝতাম তাই, তাঁর বোঝানোগুলো কখনোই বুঝতাম না বরং ভুল বুঝতাম প্রচন্ড।
সে আমাকে বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত হয়ে যেতো।
কান্নাকাটি করতো অকুলান হয়ে বলতো,বিজয় তুমি আমায় বিয়ে করে নাও৷ বিজয় আসো পালিয়ে যাই। এই মানসিক যন্ত্রণা আমি সহ্য করতে পারছিনা৷ এর থেকে লোকের বদনাম কুড়িয়ে পালিয়েই যাই চলো।
আমি এতো পরিমাণ ত্যাড়া ছিলাম যে তাঁর সেই কথা নিয়েও ঝগরা শুরু করে দেই, “আমার সাথে পালালে তুই লোকের বদনাম কুড়াবি?? তাহলে যার সাথে পালালে সুনাম কুড়াবি তাঁর সাথেই পালা”
কথাটি শুনে তাসমিয়া বললো,”বিজয় এতো বড় আঘাত তুমি আমায় দিতে পারলে। এভাবে কেনো কথা বলো বিজয়৷ ভালোবাসার মানুষ কে এভাবে কথার আঘাত দিতে তোমার মন একটুও আঘাত পায় না?? কেমন ভালোবাসো তুমি আমায় যে আমার আঘাতে তোমার মন কাঁদে না। তুমি যেভাবে কথা বলো বিজয় ইচ্ছে করে সুইসাইড করি। এতোটা ভালোবাসার পরও এসব তীক্ত কথা শুনতে আমার ভালো লাগে না। কেনো বুঝোনা তুমি আমায় ভালোবাসি আমি তোমায়”
তাঁর সে কথা গুলো শুনেও আমার মন নরম হয় নি। আমি আমার অর্থহীন রাগ জেদ নিয়ে পড়ে ছিলাম।
ভালোবাসতাম তাঁকে অবুঝ ভালোবাসা যাকে বলে। সেই অবুঝ ভালোবাসাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
দিনের পর দিন আমার ঝগরা চলতেই থাকতো। রাগ ঝগরা করে করে সম্পর্কটাকে বিষিয়ে তুলেছিলাম।
ভার্সিটিতে এডমিশন নেওয়ার পর থেকে তাঁর সাথে আমার শতবার ব্রেকআপ হয়েছে। আমিই করেছি আর শতবার সে কান্নাকাটি করে না খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ফোন করে হাতে পায়ে ধরে মাফ চেয়ে সম্পর্ক সেই ঠিক করেছে৷ আর আমি তৃপ্তি পেয়েছি। সে যখন কাঁদতো আমার জন্য না খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তো আমি খুশি হতাম এই ভেবে যে সে আমায় গুরুত্ব দিচ্ছে। সে আমায় ভালোবাসে সে আমার থেকে দূরে যাচ্ছে না। অথচ বিবেকহীন এই আমি একটা বারও তাঁর কষ্ট তাঁর যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারিনি।
তাসমিয়া সব বুঝতো মনে মনে অভিমান পুষে ডিপ্রেশনে থাকতো। কিন্তু আমি বুঝতাম না বুঝার চেষ্টাও করতাম না। তাসমিয়া আমায় এসব কথা অনেক বলতো শেষের দিকে আর বলেনি। কারন বলে তো লাভ হবে না বুঝে গেছিলো ও। কারন প্রত্যেকবার রাগ, ঝগরা শেষে ও যখন কেঁদে কেঁদে সব ঠিক করতো দুদিন ঠিক থাকতো। তারপর আবার আমি ওটা সেটা সন্দেহ করে, ওটা সেটা ভুল ধরে ব্রেকআপ করতাম। আসলে আমি যাচাই করতাম। পড়নের কাপড় টা যদি প্রতিদিন পাঁচ বার করে সাবান পানি দিয়ে ধুতে থাকেন দেখবেন একমাস বাদে কাপড়টা কেমন হয়ে যায়। ঠিক তেমনি দিনের পর দিন তাসমিয়ার মন যাচাই করতে গিয়ে আমি ওর মনটাকে মেরে ফেলছিলাম,মেরে ফেলছিলাম ওর সব আবেগ কে ওর সব অনুভূতি কে। মানুষের মন যদি তুলোর মতো নরম হয়ে থাকে তাহলে মেয়ে মানুষের মন মাখনের মতো নরম হয়।
আর সেই নরম মনে আঘাত করতে করতে একসময় কারো মন পাথর হয়ে যায় তো কারো মন মরে যায়,সব কিছু থেকে বিদায় নেয়। দেহ পড়ে থাকলেও মন চলে যায় বহুদূরে।
.
তাসমিয়ার কাজিনের বিয়ে ছিলো। তাঁর শশুড় বাড়িই ঘুরতে গিয়েছিলো পরিবারের সকলের সাথে।
আমি ওকে নিষেধ করেছিলাম বিয়ে টিয়ের অনুষ্ঠানে না যেতে। কিন্তু ও বলেছিলো,পরিবারের সকলের বিরুদ্ধে যেতে পারবে না৷ অন্যকারো বিয়ে হলে সে যায় না আমার নিষেধ মানে কিন্তু নিজের আপনজনদের সাথে যাওয়া নিয়ে আমার নিষেধ সে মানবে না। শুরু হয়ে যায় ঝগরা,রাগারাগি। রাগ করে ফোন বন্ধ করে রাখি৷ পরেদিন ফোন খোলার পর যখন সে ফোন দেয় তাঁকে খুব অপমান করি। মা বাবা তুলে এমনভাবে অপমান করি যে শান্ত স্বভাবের তাসিময়াও সেদিন বাঘিনীর মতো গর্জন তুলে বলে,
“ব্যাস অনেক বলেছিস তুই আর বলবিনা। আমার বাবা মা কে অসম্মান করার জন্য আমি পাল্টা তোকেও অসম্মান করতে পারি অনেক ভাবে। কিন্তু করবো না কারন আমার পরিবার আমাকে সেই শিক্ষা দেয়নি৷ কুকুর কামড় দিলে মানুষ হয়ে তাঁকে পাল্টা কামড় আমি দিতে পারিনা৷ তোর সাথে সমস্ত সম্পর্ক শেষ আমার কোন দিন আর যোগাযোগ এর চেষ্টা করবি না”
ওর কথা শুনে আমি ওকে পঁচা ভাষায় গালি দেই। যেমন- তুই একটা চরিএহীনা নারী, বিয়েতে গিয়েছিস ছেলেদের নিজের রূপ, শরীর দেখাতে।
তোর মতো মেয়েকে আমি ঘৃনা করি। কোনদিন তোর মুখ ও দেখতে চাইনা৷
তাসমিয়া বলেছিলো,”বিজয় যদি আমি খারাপ হয়ে থাকি, আমি ভুল হয়ে থাকি আমি চরিএহীন হয়ে থাকি তাঁর শাস্তি অবশ্যই মহান আল্লাহ তায়ালা আমাকে দেবে। আর যদি তুমি বিনা কারনে আমাকে এসব অভিযোগ করে থাকো। আমার চরিএে প্রশ্ন তুলে থাকো তাহলে তাঁর ফল তোমাকেও ভুগতে হবে।তোমাকে অভিশাপ দিবো না এতটা ভালোবেসে অভিশাপ আসবে না। শুধু উপরওয়ালার কাছে চাইবো তুমি যেনো কোনদিন নিজের ভুল বুঝতে না পারো। তুমি যেনো কোনদিন এই তাসমিয়াকে না খোঁজো। কোনদিন তাসমিয়ার ভালোবাসা অনুভব করতে না পারো ”
যেই মেয়েটা পাঁচ টা বছর আমাকে তাঁর ভালোবাসা অনুভব করার জন্য পাগলের মতো বুঝিয়েছে সেই মেয়েটাই সেদিন বলেছিলো আমি যেনো কোনদিন তাঁর ভালোবাসা অনুভব করতে না পারি। তখনও আমি বুঝিনি তাঁকে।
সেদিনের পরও আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে।
প্রায় পনেরোদিন পর হঠাৎ আমার ফেসবুক আইডিতে মেসেজ আসে। তাসমিয়া আফরিন আইডি থেকে হ্যাঁ আমার তাসমিয়া ছিলো আর মেসেজটা ছিলো এমন ” একটা গাছের গোড়ায় প্রতিদিন একবার করে কুড়ালের আঘাত করতে থাকলে দীর্ঘদিন পর ঠিক গাছটিকে উপড়ে ফেলা যাবে। গাছটা যতোই বড়, মোটা,মজবুত থাকুক না কেনো দিনের পর দিন বছরের পর বছর যদি প্রতিদিন এক কোপ করেও দেওয়া হয় তাহলেও সেই গাছটা কেটে ফেলতে উপড়ে ফেলায় মানুষ সক্ষম হবে। ঠিক তেমনি তুমিও সক্ষম হয়েছো বিজয়। আমাদের এতো বছরের ভালোবাসা, এতো বছরের সম্পর্ক, এতো বছরের জমানো সব স্বপ্ন কে ধ্বংস করে দিতে তুমি সক্ষম হয়েছো। তুমি সক্ষম হয়েছো তাসমিয়াকে জীবিত দাফন করতে তুমি সক্ষম হয়েছো তাসমিয়ার কলিজাকে টুকরো টুকরো করে দিতে। তুমি সক্ষম হয়েছো আমাদের স্কুল জীবনের প্রেমের বিচ্ছেদ ঘটাতে। “ছেলে মেয়েদের বিয়ের আগে প্রেমের সম্পর্ক তৈরী হওয়াটা যতোটা লজ্জার তাঁর থেকেও বেশী লজ্জার সেই সম্পর্কের বিচ্ছেদ ”
এই লজ্জা মানুষের কাছে নয় এই লজ্জা নিজের কাছে নিজের। ঘৃনা তোমায় করতে পারিনা ঘৃনা করি নিজেকে কারন আমি আমার ভালোবাসা বোঝাতে পারলামনা তোমাকে। আমার সারাজীবনের একটাই আফসোস এতোটা ভালোবাসার পরও তোমায় বোঝাতে পারলাম না আমি তোমাকে ভালোবাসি।
পৃথিবীতে সবথেকে যন্ত্রণাদায়ক বিষয় কি জানো??
ভালোবাসার মানুষের চোখে নিজেকে চরিএহীন দেখা।
সেদিনও আমি আমার জেদ নিয়ে বসে থাকি। কারন তাসমিয়া অভিমানের কথাগুলো জানিয়ে নিজের আইডি বন্ধ করে ফেলে।ফোন করে দেখি ফোন বন্ধ যোগাযোগের কোন মাধ্যমই রাখেনি সে। আমিও রাগে,অভিমানে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি।
.
দিন যায় দিনের মতো, মাস ও হয়ে যায়। তাসিময়া আমায় ফোন করে না। দিনের পর দিন একাকিত্ব গ্রাস করে আমাকে। হিসেব করি জীবনের৷ ভাবতে থাকি এ সময়টা তো এমন হওয়ার কথা ছিলো না।
এসময় তো আমাদের প্রণয়ের পরিণয় ঘটানোর সময়। এতো বছরের সম্পর্ক, আমাদের স্কুল জীবনের এতো গভীর প্রেম ভালোবাসার পরিণতি তো বিচ্ছেদ হতে পারেনা। ধীরে ধীরে নিজের ভুল বের করতে থাকি তাঁর ভুল আমার ভুলের হিসেব করতে থাকি। তারপর সিদ্ধান্ত নেই পরিবার কে জানিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো তাঁর আগে তাসমিয়া যে ভার্সিটিতে পড়ে সেখানে গিয়ে দেখা করে আসবো। ওর বান্ধবী দের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে আসবো। পাগলীটার অভিমানের পাল্লাটা বুঝি খুব বেশীই ভারী হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই খাওয়া, দাওয়া ছেড়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এবার দেখা করে খুব শাসন করবো,খুব যত্ন করবো, খুব ভালোবাসবো। আগের মতো রাত জেগে অনেক সময় কথা বলবো।
আবারো রাতে ভয় পেলে আমায় ফোন করতে বলবো। যাতে ওর সব ভয় দূর হয়ে যায়৷ সব রাগ, অভিমান দূরে ঠেলে আবারো আপন করে নিবো তাঁকে আর সে আমাকে৷ একবার তার সামনে গিয়ে কান ধরলে আর রেগে থাকবে না আমি নিশ্চিত।
.
ভার্সিটিতে গিয়ে যা শুনি তাঁতে আমার পুরো দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়। আমার বুকে চাপ দেয় খুব।
আমার তাসমিয়া তিনমাস যাবৎ ভার্সিটিতে যায় না। কোন বান্ধবী দের সাথে যোগাযোগ রাখেনি।
তিনমাসে তাসমিয়ার কোন খবড়ই কেউ জানতে পারেনি আর না দেখা হয়েছে। মাথা খারাপ হয়ে যায় আমার পাগল পাগল লাগে। পড়াশোনা নিয়ে যেই সম্পর্কের বিচ্ছেদ হলো,ভালোবাসার মাঝে সন্দেহ, তিক্ততা এলো সেই পড়াশোনা কেনো বাদ দেবে তাসমিয়া??ফাইনাল পরীক্ষাও দেয় নি??
গলা শুকিয়ে যায় আমার৷ বুকে,পিঠে চাপ দেয় বন্ধু রা ধরে নিয়ে এক দোকানে বসিয়ে পানি খাওয়ায়।
আমি তাসমিয়ার বান্ধবী খাদিজার হাতে পায়ে ধরে বিকালে তাসমিয়ার বাড়ি পাঠাই। খাদিজা পনেরো মিনিট পরই ফিরে আসে। আমি আর বন্ধু রা তখন তাসমিয়াদের মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। খাদিজা আসতেই হাঁটা শুরু করলাম অন্যপথে। কিছু জিগ্যেস করার আগেই বললো,”বিজয় তাসমিয়ারা বাড়ি নেই ওর নানা বাড়ি গেছে তাসমিয়ার অবস্থা খুব খারাপ গতমাসে মানসিক হসপিটালে ভর্তি করিয়ে এসেছে।ঠিক না হলে হয়তো আর ফিরিয়ে আনবে না”
কথাটা শোনা মাএই আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
বিশ্বাস হচ্ছিল না কথাটা আবারো জিগ্যেস করলাম কিহ??
খাদিজা এক ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে বললো,তাসমিয়া মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে গেছে। কি থেকে কি হয়েছে ওর বাড়ির কেউ জানে না। তাসমিয়া নাকি শারীরিক ভাবে আগে থেকেই দূর্বল ছিলো। ডাক্তার বলেছে অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে এই অবস্থা হয়েছে। ওকে কেউ মানসিকভাবে ভীষণ টর্চার করেছে। কিন্তু তাসমিয়া বাবা মায়ের খুব আদরের মেয়ে । মানসিক টর্চার এর কথা তাঁরা ভাবতেও পারেনা। ওর বাবা মা সন্দেহ করে প্রেমঘটিত ব্যাপার। মেয়েকে প্রশ্ন করলে শুধু আঙুল তুলে চুপ করতে বলে আর বলে “আমি চরিএহীনা না আমি চরিএহীনা না” তাসমিয়ার কাকি এটাই বললো।
একটা কথা বলি বিজয় মেয়েটার এই অবস্থার জন্য বোধ হয় তুমিই দায়ী। বলেই খাদিজা ঘৃনার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আমার দিকে। ওল্টোপথে হেঁটে চলে গেলো সে। আর আমি দুহাতে নিজের চোখের পানি মুছে পাশে থাকা বন্ধু কে বললাম। তাসমিয়ার বাবার নাম্বার যোগার করে দিতে পারবি??
.
শরীর কাঁপুনি, গলা কাঁপুনি, মাথা কাঁপুনি, বুক কাঁপুনি ক্রমাগত চলতেই থাকলো। নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে মাটি খামচে ধরে চিৎকার করে কাঁদলাম খুব৷ নাওয়া,খাওয়া ছেড়ে পাগলের মতো তাসমিয়ার বাবার খোজ করতে থাকি। পেয়েও যাই।
পরেরদিন তাঁর পায়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদি। চিৎকার করে কাঁদি নিজের ভুল স্বিকার করি। মেয়ের বাবা হয়ে মেয়ের খুনিকে কি করে মেনে নেয় বলুন তো??
আমি যে তাঁর মেয়েকে জীবিত লাশ বানিয়ে দিয়েছি।
ফাঁকা রুমে নিয়ে গিয়ে পরপর চারটা থাপ্পড় দেয় আমার গালে৷ তবুও আমি তাঁর পায়ে জরিয়ে ধরে কাঁদি।সন্তানের বাবা তো, আমার বয়সটাও সে দেখেছে। তাসমিয়া আর আমি সমবয়সী ছিলাম৷ কেউ যে প্রাপ্ত বয়স্ক ছিলাম না। তাই ওনি আমাদের দুজনের পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছিলো৷ কেঁদে ফেলেছিলো আমাকে জরিয়ে। বলেছিলো তাসমিয়ার সাথে দেখা করাবে। যদি কোন আশার আলো খুঁজে পাওয়া যায়।
পরেরদিনই তাসমিয়ার কাছে নিয়ে যায়। পৌঁছাতে রাত এগারোটা বেজে যায়। তাসমিয়াকে ঘুমের ওষুধ দেওয়াতে আটটায় ঘুমিয়ে গেছে। সারারাত ওর বিধ্বস্ত মায়াবি মুখটার দিকে চেয়েছিলাম আমি।
সেদিন থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম আমার প্রতি ওর ভালোবাসা, আমার প্রতি ওর শ্রদ্ধা,আমার প্রতি ওর আতঙ্ক। কিন্তু কি লাভ এই উপলব্ধি তে??
লাভ ক্ষতির বিচার সেদিন করলে হয়তো মানুষের কাতারেই পড়তাম না আমি৷
ঘুম থেকে ওঠে যখন তাসমিয়া আমাকে দেখলো। কেমন করে যেন কেঁদে ওঠলো। যেনো ও কাঁদছে না ওর আত্মা কাঁদছে। ওর সেই কান্না আমার ভিতরটা ছাড়খাড় করে দিচ্ছিলো। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। কিছুক্ষণ কাঁদলো আমার দিক চেয়ে। তারপর হঠাৎ কি হলো ওর কি জানি চিৎকার করতে শুরু করলো আর বললো,”ওকে নিয়ে যাও নিয়ে যাও ওকে। চলে যাও তুমি চলে যাও আমার কাছে এসো না,আমার পাশে থেকো না।ক্ষমা করো আমায় তোমায় ভালোবাসার জন্য ক্ষমা করো”
আমি ওর কাছে এগিয়ে বললাম,” ও তাসমিয়া এমন করো না দেখো আমি, তোমার বিজয় এসেছে তোমাকে নিতে”
সাথে সাথে তাসমিয়া ছিটকে সরে গেলো। পাশের টেবিল থেকে গ্লাস ছুঁড়ে মারলো যা আমার কপালে এসে লাগলো। হাত দিয়ে বার বার চলে যেতে বলছিলো। নিজের উষ্কখুষ্ক চুল গুলো টানছিলো, নিজের হাতে নিজেই কামড় দিচ্ছিলো। চোখ দুটো কেমন সাদা সাদা, মুখ ফ্যাকাশে হয়ে ছিলো। পড়নের কাপড়টাও ঠিকভাবে রাখেনি। খেয়াল করলাম আমার অতিসুন্দরী তাসমিয়া আর সুন্দরী নেই। ভালোবাসা নামক বিষাক্ত অনুভূতির কাছে হেরে গেছে তাঁর সব কিছু।শুকিয়ে কেমন হয়ে গেছে চোখ গুলো ডেবে গেছে। লম্বা চুল গুলো জট লেগে আছে। সময়ের পরিবর্তনে মানুষের পরিবর্তন হয় কিন্তু এ কি পরিবর্তন?? এই পরিবর্তন তো কারো কল্পনাতেও আসেনি কখনো?? ফুলের মতো মেয়েটার জীবনটাতো এমন হওয়ার কথা ছিলো না?? অপরাধী আমি হ্যাঁ আমি অপরাধী আমার অনেক বড় শাস্তি হওয়া উচিত। ফাঁসি হওয়া উচিত আমার৷
.
ডাক্তার এসে বললো,তাসমিয়া আমাকে সহ্য করতে পারছেনা। আমার জন্য আরো বেশী সমস্যা হতে পারে৷ তাসমিয়ার বাবা এসব শুনে আমাকে আর এক মিনিটও দাঁড়াতে দিলো না।
হায়! পাগলের মতো ভালোবেসে সেই ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে নিজেকে সত্যিকারের পাগল বানাতে শুধু একটা মেয়েই পারে।
আমার তাসমিয়া আমায় এতোটা কেনো ভালোবাসলো। যেই আমি ওর অনেক ভালোবাসা অনেক কেয়ার চেয়েছিলাম। যেই আমি ওকে হারানোর ভয়ে অমানুষের মতো আচরন করতাম। সবসময় চাইতাম তাসমিয়া আমায় খুব খুব ভালোবাসুক সেই আমি সেদিন আল্লাহ কে বলেছিলাম কেনো এতো ভালো একটা মেয়েকে আমার জীবনে নিয়ে এলে?? এতো ভালো কেনো আমাকে বাসলো ও??একটু কম ভালো কি বাসা যেতো না?? তাসমিয়া কে খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো এই পাগলী এতো ভালো বাসতে হয় কাউকে??সত্যি তুই পাগলী রে ভীষণ পাগলী তুই কিন্তু তোর পাগলের কি হবে এবার??
.
এক বুক যন্ত্রনা,এক বুক দীর্ঘশ্বাস,সীমাহীন আফসোস নিয়ে শূন্য বুকে ফিরে এলাম আমি। বুঝতে পেরে গেলাম আমি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দেউলিয়া। এমন অমূল্য রতন কি করে হারালাম আমি।
এরপর আর কখনো তাঁর সাথে দেখা করার সুযোগ করে দেয়নি কেউ। নিয়ম করে প্রত্যেক বছর আমাদের ভালোবাসা শুরুর তারিখ ২২ সেপ্টেম্বর আমি তাঁর কাছে যাই। ভিতরে প্রবেশ করতে দেয় না তবুও আমি যাই দূর থেকে তাঁকে কোন বছর এক পলক দেখতে পাই কোন বছর পাই না৷ এভাবেই কেটে গেছে সাতটা বছর।
ভালোবাসি তাঁকে ভীষণ ভালোবাসি। অনুভব করি তাঁকে খুব করে অনুভব করি। মিস করি তাঁকে ভীষণ মিস করি।
কতোটা ভালোবাসলে একটা মেয়ে বিচ্ছেদ সহ্য করতে না পেরে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যায় বলতে পারেন?
তাঁর এই ভালোবাসার মূল্য আমি কোনদিন দিতে পরিনি আর পারবোও না। তাঁর ঋন শোধ করার ক্ষমতা আমার নেই৷
তাঁর সব কথা আমি শুনেছি তাঁর সব নিয়ম আমি মেনেছি।আফসোস সঠিক সময় কিছুই করতে পারিনি। হাজারবার পুরোনো মেসেজ পড়ে পড়ে নিজের মনকে স্বান্তনা দিয়ে যাচ্ছি। পুরনো স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছি। এ বাঁচা যে খুব কঠিন বাঁচা।
প্রথম ভালোবাসা অনেক কিছু শেখায়। আমার ভালোবাসা আমাকে শিখিয়ে গেছে ভালোবাসার মানুষ কে অসম্মান করার শাস্তি কতোটা তীব্র হতে পারে।
আমার তাসমিয়া আমাকে ভালোবাসা শিখিয়ে গেছে। সত্যিকারের ভালোবাসায় সন্দেহ, অসম্মান নিয়ে এসে যে মারাত্মক ভুল করেছি আমি তাঁর প্রমাণ দিয়ে দিয়েছে সে। আমাকে ভালোবাসার আসল মানে শিখিয়ে গেছে আমার তাসমিয়া। আমাকে শিখিয়ে গেছে ভালোবাসায় শুধু ভালোবাসাই জরুরি অন্য কিছু নয়।
আমার প্রতিরাতের ছটফট যদি একটা বার তাসমিয়া কে বোঝাতে পারতাম। আমার বুকের ভিতর ক্ষতবিক্ষত হওয়ার খবড় যদি একটা বার তাঁর কানে পৌঁছাতে পারতাম। একটা বার যদি সুযোগ পেতাম তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়ার। একটা বার যদি তাঁকে আমার এই বুকে চেপে ধরে বোঝাতে পারতাম ভালোবাসি। এসবের কিছুই আমি পারবোনা। আর এর জন্য দায়ী শুধু আমি।
অপরিণত বয়সের প্রেমের ভয়াবহতা আমি যেভাবে উপলব্ধি করেছি সেভাবে যেনো আর কেউ করে না।
বয়সের দোষে অনেক কিছুই ঘটে। এমন নির্মম ঘটনা ইতিহাসে হয়তো কারো জীবনেই ঘটেনি। খুব ইচ্ছে করে আবারো ফিরে যেতে সেই দিনটায়। আমার লাজুক তাসমিয়ার লাজুকলতায় ডুব দিতে। খুব ইচ্ছে করে তাসমিয়ার ভালোবাসামাখা শাসনে নিজের জীবন জরাতে। খুব ইচ্ছে করে তাসমিয়ার হাতটা শক্ত করে নিজের বুকের বা পাশে চেপে ধরে হৃদস্পন্দন অনুভব করাতে। খুব ইচ্ছে করে বলতে,
“তাসমিয়া বিজয় বদলে গেছে। তুমি ঠিক যেমনটা চাইতে তোমার বিজয় ঠিক তেমনটাই হয়ে গেছে। আর কোন অভিযোগ করার সুযোগ পাবে না তাসমিয়া একটি বার ফিরে এসো একটি বার আমায় ডাকো তুমি। শুধু একটি বার। আমাদের স্কুল জীবনের প্রেমের পরিণতি দিতে একটি বার ফিরে এসো আমার কাছে” বাস্তবতা কেনো এতো কঠিন? বাস্তবতা কেনো এতো নির্মম? বাস্তব জীবনে বিচ্ছেদ টাই কেনো পরিণতি হয়?বাস্তবতা কেনো গল্পের মতো হয় না ?
.
ভালোবাসি তোমায় তাসমিয়া। ভীষণ ভালোবাসি। তোমার বিজয় আর চেঁচায় না,তোমার বিজয় ভুলেও কখনো বাজে ভাষা উচ্চারণ করে না। তোমার বিজয়ের সমস্ত রাগ পড়ে গেছে। তোমার বিজয়ের এই পরিবর্তনের শাক্ষি সবাই হলো কিন্তু যার জন্য এই পরিবর্তন সেই তুমিই অজানা রয়ে গেলে?
আফসোস জিনিসটা খুব খারাপ তাসমিয়া। তোমার আফসোস তোমায় ভিন্ন জগতে নিয়ে গেছে। আমার আফসোস আমার জীবনটা তীলে তীলে শেষ করে দিচ্ছে।
তুমিতো মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনুভূতিহীন হয়ে গেছো। তোমার সব অনুভূতি মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমার সব অনুভূতি যে জাগ্রত হয়ে গেছে। এই যন্ত্রনা যে কোন দিন শেষ হওয়ার নয়!
ভালোবাসি তাসমিয়া,ভালোবাসি তোমায়।।
স্কুল জীবনের প্রেম -১
ডায়রির শেষ পাতা পড়ে অঝড়ে কেঁদে চলেছে বন্যা।
সমাপ্ত
বাস্তব থেকে নেওয়া। জানিনা কেমন হয়েছে তবুও যারা পড়েছে তাদের জন্য ভালোবাসা রইলো অফুরান।