হৃদপিন্ড_২,পার্ট_১৬ ১ম অংশ শেষ

হৃদপিন্ড_২,পার্ট_১৬ ১ম অংশ শেষ
জান্নাতুল নাঈম

ইমন মুরাদের তর্কবিতর্ক চলছিলো। মুসকান দুহাতে মুখ চেপে দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। মরিয়ম আক্তার গর্জন তুলে মুরাদকে বললো,

—- মুরাদ! তোর জন্য আমার মেয়েটার যদি কোন ক্ষতি হয় সকলের সম্মুখে গলায় দড়ি দিব আমি। বলেই তিনিও দৌড়ে মুসকানের রুমের দিকে ছুটলেন।

মুরাদের চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। গায়ের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে ইমনের হাত ছাড়িয়ে নিচে ফেলে পেটের ওপর বসে কলার চেপে ধরে হুংকার ছাড়লো,

—- বিয়ে করবি আমার বোনকে? আমার বোনকে তোর চাই? তাহলে যা গিয়ে নিজের পরিবার কে নিয়ে আমার বাড়িতে আয় দুদিন সময় দিলাম এই দুদিনের মধ্যে তোর পরিবার কে আমার বাড়িতে দেখতে চাই। মনে রাখিস যা কথা তাই কাজ এর বাইরে কিছু হলে যতোই বাবাগিরি দেখাস কাজ হবে না। বাবাকে ছাড়া বাবাগিরির মূল্য নেই।

মুরাদের শেষ বাক্যটুকুই যথেষ্ট ছিলো গভীর কিছু উপলব্ধি করার জন্য। এই একটা কথায় কিছু একটা ছিলো যা ইমনের জ্বলজ্বল করে ওঠা রাগটা দপ করে নিভিয়ে দিলো। শান্ত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো,

—- সত্যি করে বল মুরাদ কি হয়েছে? কি লুকাচ্ছিস তুই আমার কাছে?

ধরা পড়ে গিয়ে দুহাত নরম হয়ে এলো মুরাদের। অশান্ত দৃষ্টি ফেললো চারপাশে ইমনের থেকে সড়ে গিয়ে। শার্টের কলার ঠিক করে হাতা গুটিয়ে ময়লা ঝেড়ে পিছন মুখী হয়ে দাঁড়িয়ে বারকয়েক শ্বাস নিলো। ইমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে গায়ে পরিহিত শার্টের কয়েকটা বোতাম লাগাতে লাগাতে বাঁকা হাসি দিয়ে শান্ত গলায়ই বললো,

—- তাহলে এই ব্যাপার অথচ আমি কি ভুল ধারণা নিয়েই না ছিলাম। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো। আমার বন্ধুর প্রতি বিশ্বাস এবং ভরসা রাখাও উচিত ছিলো। সরি দোস্ত!

—- নেকামো না করে বাড়ি থেকে বিদায় হো। তোর মুখও আমি দেখতে চাইনা। বলেই পিছন ঘুরে আবারো কলার চেপে ধরলো বললো,

—- আমার বোনের কিছু হলে খুন করে ফেলবো তোকে আমি।

—- কিচ্ছু হবে না বর রাজি,বউ রাজি, বন্ধুও রাজি আর কি চাই? বলেই শক্ত করে জরিয়ে ধরলো মুরাদ কে।

মুরাদ তাচ্ছিল্য সুরে বললো,

—- যা যা এতো দরদ দেখাতে হবে না। বের হো বাড়ি থেকে।

ইমন মাথা চুলকে অমায়িক এক হাসি দিয়ে বললো,

—- পাগলীটাকে দেখে রাখিস আর বোঝাস আমি শিঘ্রই আসবো।
______________
আকরাম চৌধুরী সুবিবেচক মানুষ। তাঁর বিচার-বিবেচনা সর্বদাই প্রশংসনীয় এবং সম্মানীও। ছেলে যতোই উচ্চশিক্ষিত হয়ে উচ্চ পদে কর্মরত থাকুক। ছেলে তো ছেলেই। যে বাবা,মা ছেলেকে আম গাছ, জাম গাছ চিনতে শিখিয়েছে। আকাশ, মাটির পার্থক্য বুঝতে শিখিয়েছে। আগুনে স্পর্শ করলে হাত পুরে ছাই হয়ে যাবে বুঝিয়েছে। বুঝিয়েছে আগুন, পানির বিভেদ। সেই বাবা-মা কি ছেলের অমঙ্গল চাইতে পারে? বা ছেলের জীবনে আকস্মিক ভাবে কোন দূর্ঘটনা ঘটে যাক এই প্রত্যাশা করতে পারে? সন্তানরা শিশু বয়সে ভুল ভ্রান্তি করলে যেমন বাবা-মা শুধরে দেয় তেমনি প্রাপ্ত বয়স্ক হয়েও যদি কোন ভুল করতে যায় বাবা-মায়ের উচিত সঠিক পথ দেখানোর। সন্তান বড় হয়েছে বলে তাঁরা কখনো ভুল করবে না এমন ধারণা কখনোই মনে পুষিয়ে রাখা উচিত নয়। ভুল শুধু শিশুরাই করে না। ভুল প্রাপ্ত বয়স্করাও করতে পারে। বাচ্চাদের ভুল শোধরানো যায় কিন্তু প্রাপ্ত বয়স্কদের করা ভুল শোধরানো যায় না। তাদের করা ভুলের মাশুল আজীবন দিতে হয় পস্তাতে হয় পুরো জীবন।

ড্রয়িং রুমে সোফায় পাশাপাশি বসে আছে আকরাম চৌধুরী এবং ইমন চৌধুরী। ইরাবতী উত্তেজনায় ছটফট করছে। ছেলের উৎসুক চাহনী আর স্বামীর গম্ভীর মুখশ্রী তাঁর উত্তেজনাকে ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে। দৃষ্টি নিভে গেলো ইমনের ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে দৃষ্টি স্থির রাখলো। ডান পায়ের বুড়ো আঙুল মেঝেতে ঘষছে অনবরত এই বুঝি নখটা ঘষায় ঘষায় উঠে গিয়ে চামড়া ভেদ করে রক্ত বেরিয়ে আসে। আকরাম চৌধুরী সেই যে চুপ হয়েছে না কোন কথা বলছে আর না আশেপাশে চেয়ে দেখছে। তাঁর আটাশ বছর বয়সী প্রাপ্তবয়স্ক এবং উচ্চপদে কর্মরত ছেলেটা আজ তাঁর কাছে অবিশ্বাসী এক আবদার করে বসেছে। এতোদিন আড়াল থেকে সব বুঝলেও টু শব্দ টি করেনি। আবেগের বসে ভুল করছে সময় পাস করছে একসময় ঠিক হয়ে যাবে ভেবেই এ বিষয় নিয়ে প্রথমে মাথা ঘামায়নি। কিন্তু যতোদিন বাড়তে লাগলো বিষয়টা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যাচ্ছিলো। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো ছেলের বিয়ে দেবে। সেটাও ভেঙে দিলো ইমন। এবার সরাসরি এসে আবদার করছে তাঁর মুসকান কে চাই। বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতেও বলছে ভাবতেই কপালের রগ দপদপ করছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের বাচ্চা একটা মেয়ে। পারিবারিক অবস্থা না হয় দাঁত কামড়ে হজম করা যেতো কিন্তু বয়স? সমাজে মুখ দেখাবে কি করে সে? আইনি লোক হয়ে এমন কাজ করাও তো অপরাধ। তাঁর ছেলের যেখানে ছোট,ছোট ছেলেমেয়ের বাবা হয়ে তাঁদের সাথে হামাগুড়ি দিয়ে পুরো বাড়িময় উচ্ছাস করে বেড়ানো উচিত সেখানে কিনা হামাগুড়ি দেওয়া এক মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে বিয়ে করার চিন্তা করছে? মান সম্মান আর রাখবেনা এই ছেলে। সেই সাথে আইনের চোখেও অপরাধী করে ছাড়বে। যে করেই হোক এই সমস্যার সমাধান করতেই হবে ভেবেই মুখ খুললেন আকরাম চৌধুরী।

—- তুমি যা বলছো ভেবে বলছো না কিন্তু আমি যা বলছি খুব নিখুঁত ভাবে ভেবে সন্তর্পণে বিবেচনা করেই বলছি। ঐ মেয়ের চিন্তা মাথায় থেকে ঝেড়ে ফেলো। আগামীকাল আমার বন্ধু আর বন্ধুর মেয়েকে ইনভাইট করেছি। এনগেজমেন্ট সেড়ে ফেলবো।

চটে গেলো ইমন। বসা থেকে ওঠে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

—- আমি মুসকান ব্যাতিত অন্যকাউকে বিয়ে করবো না। তোমরা যদি মুরাদের বাসায় যেতে না চাও জোর করবো না। আমার টা আমি বুঝে নিতে জানি। বেশ দাম্ভিকতার সাথে কথাগুলো বলে ইমন চলে যেতে নিলো।

আকরাম চৌধুরীও ফুঁসে ওঠলো। ইমনের হাতটা চেপে ধরে নিজের পাশে বসালো। ইমন বেশ জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। প্রচন্ড রেগে গেছে সে। বুঝতেই আকরাম চৌধুরী তাঁর মাথায় নিজের ডানহাতটা চেপে ধরে অত্যন্ত স্নেহময় গলায় বললেন,

—- রিল্যাক্স মাই বয়৷ তুমি নিজেরটা বুঝে নিতো জানো এটা সবাই জানে আমিও এই জানার বাইরে নেই। তুমি আমার একমাএ সন্তান একমাএ অবলম্বন। তোমার জীবনে মঙ্গল ব্যাতিত অমঙ্গল চাইনা আমি।

বলেই ইরাবতীর দিকে তাকালো। ইরাবতী স্বস্তির এক নিশ্বাস ছেড়ে বাবা, ছেলের জন্য কফি বানাতে চলে গেলো। আকরাম চৌধুরীও স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে ইমনের একটি হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলেন। বললেন,

—- মেয়েটা পারিবারিক দিক দিয়ে আমাদের সাথে জায় না। তাছাড়া মেয়েটাকে তোমার পাশে একেবারেই বেমানান লাগে গায়ের রংটাও,।

বাকিটুকু শেষ করতে দিলো না ইমন। গর্জে ওঠে বললো,

—- প্লিজ বাবা এবার অন্তত এটা বলো না মুসু কালো হ্যান ত্যান।

—- তা না তোর জন্য আরেকটু চড়া কালার প্রয়োজন।

—- এই অহেতুক কথা প্লিজ বাদ দাও। আমি শপিং মলে গিয়ে শার্ট-প্যান্ট কিনছি না যে গাড় রঙ হালকা রঙ বিবেচনা করবো।

—- বয়সটা নিশ্চয়ই বিবেচনা করা উচিত?

থমকে গেলো ইমন৷ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে ওঠলো,

—- যেখানে দুটো হৃদয়ের মিল রয়েছে সেখানে বয়সটা কোন ফ্যাক্টই না।

—- এই মিল কতোদিন থাকবে একদিন,দুদিন,এক বছর,দশবছর তারপর কি হবে ভেবে দেখছিস?

ইমন বিরক্তি প্রকাশ করে তাকালো বাবার দিকে। আকরাম চৌধুরী ইমনের দিকে আরেকটু ঝুঁকে বললেন,

—- বাবা পুরো একটা জেনারেশনের গ্যাপ ভাবতে পারছিস? যে সময়ে তোর দু, একটা বাচ্চা থাকা উচিত সে সময় ঐ মেয়েটা বিয়ের উপযুক্তই হয়নি। আজ মেয়েটা পরিপূর্ণ আবেগবশত তোকে চায় কাল যখন পরিপূর্ণ বয়সে আসবে আবেগটা কি সেই অপিরণত বয়সেই থেমে থাকবে? কখনোই না। তাছাড়া আইনের চোখেও তুই অপরাধী হয়ে যাবি বাল্য বিবাহ হয়ে যাবে এটা।

ইমন আবারো ওঠে দাঁড়ালো। কঠিন স্বরে বললো,

—- মেনে নেবে না ভালো কথা এসব অহেতুক কথা খরচ করতে কে বলেছে?

আকরাম চৌধুরী আবারো টেনে বসালেন। বেশ রাগি কন্ঠে বলে ওঠলেন,

—- এসব অহেতুক মনে হচ্ছে তোর কাছে? নাকি অহেতুক জেদ তুই করছিস ইমন? জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পেয়ে গেছে তোর। এইসব মিডেল ক্লার ফ্যামিলির সন্তান দের সাথে চলাফেরা করতে দেওয়াই উচিত হয়নি তোকে। মেন্টালিটি পুরো বিগরে দিয়েছে এরা তোর। আজ আমার কথা অহেতুক মনে হচ্ছে তাইনা? কাল যখন বউ পরোকিয়ায় জরাবে তখন এই বাবাকে স্মরণ হবে ঠিকই আফসোস করেও লাভ হবে না।

বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকালো ইমন। বাবার দুকাধ বেশ শক্ত করে চেপে ধরে বললো,

—- পাগল হয়ে গেছো বাবা তুমি এসব কি বলছো?

ইরাবতী এসে চমকিত হয়ে প্রশ্ন করলো,

—- হচ্ছে টা কি বাপ ছেলে মারামারি করবে এখন? কি এতো সমস্যা তোমাদের? আর তুমি এতো জেদ করছো কেনো? ছেলে যেভাবে খুশি থাকে সেভাবেই খুশি করো।

ইমনের হাত ঝাড়া দিয়ে সড়িয়ে ইরাবতীর দিকে তেড়ে গেলো আকরাম চৌধুরী। চিৎকার করে বলতে থাকলো,

—- মা ছেলে পাগল হয়ে গেছো তোমরা। আশেপাশের খবর রাখো তোমরা? অন্ধ হয়ে দুনিয়ায় বাস করো? অন্ধত্বকে বরণ করে সমাজে টিকে আছো? ঘরে ঘরে এতো ডিভোর্স, পরোকিয়া এসব দেখেও তোমাদের বিবেক নাড়া দেয়না? ছেলের সাথে মূর্খের মতো তাল মেলাবেনা ইরা। তোমার ছেলের বয়স যখন এিশ ক্রস করবে ঐ মেয়ে সবে আঠারোতে পা দেওয়া যুবতী থাকবে। তোমার ছেলের প্রতি তাঁর মন বসবে তো? তোমার ছেলে যখন চল্লিশ ক্রস করবে ঐ মেয়ের তখন পঁচিশ, ছাব্বিশে পদার্পণ করবে তাঁরও একটা মন আছে তাঁরও একটা চাহিদা থাকবে। আমাদের কারো অধিকার নেই কারো কৈশোর নষ্ট করার কারো যৌবন নষ্ট করার। আমাদের সমাজে অহরহ ডিভোর্স, পরোকিয়া কেনো হচ্ছে জানো এইসবের জন্যই হচ্ছে। বাবা-মা মেয়ের জন্য তাঁর থেকে দ্বিগুন বয়সী ছেলেকে বাছাই করে। দাম্পত্য জীবনে ছেলেমেয়েদের মধ্যে পুরো একটা জেনারেশনের গ্যাপ কতোটা ভয়াবহ আকার ধারণ করে তুমি বুঝতে পারো? ছেলের ভালো লাগবে আকাশ মেয়ের ভালো লাগবে মাটি, ছেলের ভালো লাগবে পাহাড় মেয়ের ভালো লাগবে সমুদ্র। সম্পর্কের অবনতি টা ঠিক এখান থেকেই শুরু হবে। মেয়েটার যে সময়টা ঘুরে,ফিরে আনন্দ, উচ্ছাস করে বেড়ানোর কথা থাকবে ছেলেটার সে সময় সংসার, কাজ,ব্যাস্ততাকে ভালো লাগবে। সন্তানের মুখ দেখার জন্য চাতক পাখির মতো বসে থাকবে। সে সময়টা যে মেয়েটার সন্তান ধারণ করার বয়স না এটা যখন মেয়েটা বোঝাতে চাইবে লেগে যাবে গন্ডগোল। পারিবারিক অশান্তি থেকে মেয়েরা যখন একটু শান্তির খোঁজ করবে জরিয়ে যাবে পরোকিয়ায় তখনি সংসারে ভাঙ্গন ধরবে। অপরাধী হয়ে যাবে মেয়েটা। নিঃশ্ব হয়ে যাবে ছেলেটা। গাছ বিষ ফল দিলে আমরা গাছের দিকে আঙুল তুলি কিন্তু গোড়ায় বিষ মিশ্রিত পানি যে আমরাই দিয়েছি এটা কজন মনে রাখি?

—- সবাইকি এমন হয়? সত্যিকারের ভালোবাসায় এমন কিছু হয়না কখনোই না। বললো ইরাবতী।

—- হ্যাঁ কিন্তু ভালোবাসা সত্যি এটা কি করে বুঝবে ইরা? পনেরো বয়স বছর মেয়েটার জীবনের আসল মানেটাই বুঝতে দিলে না। দুনিয়াটাকেই চিনতে দিলেনা। তাঁর আগেই চোখে রঙিন চশমা পড়িয়ে দিলে? জগৎ টাকে রঙিন ভাবে উপভোগ কখন করে মানুষ জানো? যখন গোটা দুনিয়াকে সে চিনে ফেলে বুঝে ফেলে। গোটা দুনিয়ার মানুষ সম্পর্কে পুরোটা না জানলেও অর্ধেকাংশ জেনে ফেলে পরেই না রঙিনভাবে সব উপলব্ধি করতে পারে। চিনলাম না জানলাম না রঙিন চশমা পড়িয়ে দিলাম। ঘুরতে ঘুরতে বিরক্ত হয়ে চশমা খুলে একবার প্রকৃত দৃশ্য তাঁর অবশ্যই দেখতে ইচ্ছে করবে।

ইরাবতী নিশ্চুপ হয়ে ইমনের পাশে বসলো। আকরাম চৌধুরী আর কিছু বললো না ছেলের নিরবতা, ভয়ংকর রক্তিম চোখ দুটো দেখে লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে গেলেন। ইরাবতী ছেলের মাথায় হাত রেখে বললো,

—- ইমন তোর বাবার কথাগুলো কিন্তু ফেলে দেওয়া যায় না৷ তুই আমার ছেলে তোর প্রতি আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে কিন্তু মুসুর ওপর নেই। বাচ্চা একটা মেয়ে ভালোবাসার কি বোঝে বলতো? ওর বয়সে আমি ভালোবাসার ভ ও উচ্চারণ করতাম না। মানলাম যুগ পাল্টেছে ছেলেমেয়ে রা এডভান্স হয়ে গেছে। কিন্তু এটাও তো মানতে হবে ছেলেমেয়েদের এই অকালে পেঁকে যাওয়ার কুফলও রয়েছে অনেক।

মাকে আর কিছু বলতে দিলো না ইমন। হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে উপরে ওঠে গেলো। কিন্তু ইরাবতী পিছু ডেকে বললো,

—- বাবা তুমি চাইলে আমরা কালই যাবো মুরাদের বাসায় কিন্তু আমার মনে হয় তোমারও সময় নেওয়া উচিত এবং মুসুকেও সময় দেওয়া উচিত এতে তোমাদেরই মঙ্গল।

মায়ের বলা শেষ কথাটাকে ইমন সমর্থন জানালো। এবং সিদ্ধান্ত নিলো এদেশ ছেড়েই চলে যাবে সে। অনেক দূরে। যেখানে মুসকান নামক পোকাটা তাঁর মাথায় আর কিলবিল করবেনা করলেও সেটা সয়ে নেবে। কিন্তু এদেশে থাকলে মুসকান থেকে দূরে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। কিন্তু দূরে গেলে মুসকান তাঁকে ভুলে যাবে না তো? বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠলো ইমনের। নিজেকে খুব কষ্টে সামলে নিয়ে দিহান কে ফোন করলো।
_____________
তিনমাস বাড়ি ছাড়া, শহড় ছাড়া থাকার পর পিএইচডি করার জন্য জার্মানির উদ্দেশ্য পারি জমালো ইমন চৌধুরী। সেদিন বাবা-মায়ের সাথে হওয়া কথোপকথন সে আর মুরাদ ছাড়া কেউ জানতেও পারলো না। তবে তাঁর দেশ ছাড়ার ব্যাপারটা চাপা থাকলো না। তিনমাস মুরাদ মুসকানকে ওটা, সেটা বুঝিয়ে সামলালেও দিহানের সাথে গোপন বৈঠকের এক পর্যায়ে ইমনের জার্মানিতে যাওয়ার কথাটা শুনে ফেলে মুসকান। বাড়িতে শুরু হয় তাণ্ডব। যে তাণ্ডব শেষ মূহুর্তে জঘন্য এক রূপ নেয়। নিজের হাতের শিড়া কেটে ফেলে মুসকান। পুরো সাতদিন হসপিটালের বেডে মরার মতো পরে থাকে সে। মরিয়ম আক্তার বিশ্বাস করতে পারেনা ইমনের এই বিশ্বাসঘাতকতা। তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছিল বিশ্বাস করতে সেই সাথে চোখের সামনে নিজের বাচ্চা মেয়েটাকে আধমরা দেখে প্রচন্ড ভেঙে পড়েছিলো। মুরাদ নিজের বোনকে সত্যিটা বলতে পারবেনা। বোঝাতে পারবেনা কিন্তু মা কে পারবে তবুও চুপ রইলো সে। কি লাভ বলে কি লাভ বুঝিয়ে? যা বোঝাপড়া সঠিক সময় এলেই করবেনি ইমন। সম্পূর্ণ দায়ভার ইমনের। তাঁর জন্য মুসকানের আজ কতো বড় ক্ষতি হতে যাচ্ছিলো এই দায়ভারও একদিন তাঁকে ঠিক নিতে হবে। মুরাদ মনে মনে অসংখ্য কথা আওড়িয়ে চুপ রইলো। হসপিটাল থেকে ফিরেও স্বাভাবিক হতে পারলো না মুসকান। দিন যায়,সপ্তাহ কেটে মাস যায় মেয়েটা কেমন মিইয়ে যায়। জীবনটা বিষাদে ছেঁয়ে গেছে মেয়েটার। হারিয়ে গেছে সুখ, হাসি,কান্না,আনন্দ,উচ্ছাস। দিনের পর দিন ধ্বংস হতে থাকলো তাঁর কৈশোর। নিভে যেতে থাকলো বুকের ভিতর সন্তর্পণে জমিয়ে রাখা আবেগে মাখামাখি হওয়া ভালোবাসার আগুনটা। অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেলো জীবনটা। আলোর দিকে যতোই টানাটানি করা হোক আপনমন না চাইলে কি আলোর প্রতি ঝোঁক আসবে? তাঁর যে বদ্ধ চোখ খুলতে ইচ্ছে করেনা। তাঁর যে বদ্ধ ঘরের চার দেয়ালেই নিজেকে নিমজ্জিত রাখতে ভালো লাগে। মা, ভাই, যখন বলে ‘সকাল হয়েছে ব্রাশ করে নে মুসু ‘ সে তখন তাচ্ছিল্য হেসে ভাবে ‘সকাল হয় কি করে? রাতের পর সকাল আসে। রাতের অবসান তো ঘটেনি সকাল কি করে হয়? কোথায় সকাল চারদিকে অন্ধকার বই আর কিছু তো তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়না, হয়না তো ‘ বলেই চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। অবাক হয়ে যায় মুরাদ,অবাক হয়ে যায় রিমি,মরিয়ম আক্তার। সকলেই রাতদিন এক করে বোঝায় মুসকান কে। কিন্তু বোঝাবুঝির অবস্থা কি তাঁর আছে? নেই তো!
.
দুমাস পর-

এলোমেলো হয়ে উষ্কখুষ্ক চুলে বসে এক ধ্যানে মেঝেতে চেয়ে আছে মুসকান। মরিয়ম আক্তার খাবার নিয়ে রুমে ঢুকলেন। মেয়েকে দেখে বুকটা হুহু করে ওঠলো তাঁর। চোখে পানি বাঁধ মানলো না। মুরাদ যখন মুসকানের অবস্থার কথা ইমনকে জানায়। ইমন ভেঙে পড়ে সিদ্ধান্ত নেয় ফোনে যোগাযোগ করে মেয়েটাকে স্বাভাবিক রাখবে কিন্তু না। মুসকান এক সেকেন্ড এর জন্যও কথা বলেনি এক পলক দেখা অবদি দেয়নি ভিডিও কলে। জোর করে রিমি ইমনের সম্মুখে নেওয়াতে ফোনটা এক আছাড়ে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে,

—- এই স্বার্থপর বেঈমান টাকে আমার সামনে এরপর কেউ নিয়ে আসার কথা ভাবলে নিজেকেই খুন করে দেবো আমি।

ভয়ে আঁতকে ওঠে সকলেই। মুসকানের ঐরূপ সকলের হৃদয়ে নাড়া দিয়ে ওঠে। ঐ মূহুর্তে মুসকানকে একদমই পনেরো বছর বয়সী বাচ্চা মনে হয়নি। বরং জীবনের কাছে ভালোবাসার কাছে হেরে যাওয়া পরিপূর্ণ এক যুবতী মনে হয়েছে।
.
চোখের পানি মুছে মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন মরিয়ম আক্তার। খাবারের প্লেট মেঝেতে রেখে দুহাত জোর করে বললেন,

—- হয় নিজে স্বাভাবিক হো নয়তো আমাকে গলা টিপে মেরে ফেল। দিনের পর দিন সন্তান কে শেষ হতে দেখা মৃত্যু যন্ত্রণার সমতুল্য। মেরে ফেল আমায় মা মেরে ফেল। তোর বাবার কাছে পাঠিয়ে দে আমি আর নিতে পারছিনা রে মুসু নিতে পারছিনা। তোরা দুজন ছাড়া আমার আর কে আছে বল তো?

মায়ের করুণ আর্তনাদ বোধ হয় মুসকানের মন গলাতে পারলো। মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো সে। মা মেয়ে জরাজরি করে অনেকটা সময় কেঁদে কেঁদে নিজেদের হালকা করে নিলো। এবং অন্তিম পর্যায়ে ভাঙা আওয়াজে মুসকান বলে ওঠলো,

—- আমি স্বাভাবিক হবো আম্মু একদম স্বাভাবিক হয়ে যাবো। সবাই যদি স্বার্থপর হতে পারে আমি কেনো পারবো না? সবাই যদি নিজের ক্যারিয়ার কে গুরুত্ব দিয়ে নিজের সুন্দর ভবিষ্যতকে গুরুত্ব দিয়ে ভালোবাসা কে তুচ্ছ করতে পারে আমি কেনো পারবো না? মনে রেখো আম্মু মুসকান যদি একবার সোজা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তাঁকে আর কেউ বাঁকাতে পারবেনা এক উপরওয়ালা ছাড়া। আজকের পর থেকে মুসকান নিজেকে তৈরী করবে। নিজের মতো করে বাঁচতে শিখবে। অতিতের যে মুসকানকে চিনতে সেই মুসকানকে মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছি আম্মু নতুনভাবে মেয়েকে বাঁচতে দেখে তোমার কোন আপত্তি হবে না নিশ্চয়ই? তোমার মেয়ে বাচ্চা বাচ্চা বলে আর মুখে ফেনা তুলবে না তোমার মেয়ে কিন্তু বড় হয়ে গেছে। সামনে না আমার পরীক্ষা দাও খাওয়িয়ে দাও। ভালো রেজাল্ট করে ভালো একটা কলেজে চান্স পেতে হবে তো নাকি?

খুশিতে আবারো কেঁদে ফেললো মরিয়ম আক্তার। মুসকান মায়ের কপালে চুমু খেলো। মরিয়ম আক্তার ও মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বললেন,

—- সন্তান রা মায়ের চোখে সবসময় বাচ্চাই থাকে রে পাগলী।

মুসকান রেগে গেলো পাগলী কথাটা শুনে এই ডাকটা তো ইমন দিতো আদর করে তাই রেগে গিয়ে বললো,

—- তোমার মেয়ে বড় হয়ে গেছে আম্মু বড় হতে বয়স লাগে না মন লাগে। আর এই পাগলী ডাকটা আমায় আর ডাকবে না আম্মু আমি পাগলী নই। আমি একদম ঠিক আর স্বাভাবিক আছি। ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও থাকবো। এবং এতো দিন অস্বাভাবিক জীবন কাটানোর জন্য উপরওয়ালার নিকট ক্ষমাও চাইবো। নেক্সট যেনো এই অস্বাভাবিক ভাইরাস আমাকে আক্রমণ তো দূরে থাক আমার আঙিনায়ও না আসতে পারে সেদিকেও পুরোপুরি সচেতন থাকবো।

সমাপ্ত।

২য় খন্ড লিখলে দেয়া হবে।

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here