হৃদপিন্ড_২,পার্ট_১০,১১
জান্নাতুল নাঈমা
পার্ট_১০
সেদিন ইমনের সাথে মুসকানের প্রায় পঁচিশ মিনিট কথা হয়। এই পঁচিশ মিনিটে ইমন মুসকান কে নতুন ভাবে আবিষ্কার করেছে৷ তাঁর ছোট্ট, কোমল হৃদয়ের অনেকখানি জায়গা জুরে রয়েছে শুধুই ইমন। এটুকু বুঝতে তাঁর খুব একটা সময় লাগেনি। নিজেকে ভীষণ সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। বালিকার প্রথম প্রেম হওয়া,প্রথম অনুভূতি তে থাকাটা প্রত্যেকটা পুরুষের জন্যই ভাগ্যের ব্যাপার। সে যথেষ্ট ম্যাচিওর, এডিউকেটেড এবং ভীষণ সিরিয়াস টাইপ ছেলে। আর মুসকানের বয়স খুবই কম ১৪ রানিং। মেয়েটার বয়স যেমন কম তেমনি প্রচন্ড আল্হাদী টাইপের৷ ভাইসহ ভাইয়ের সকল বন্ধু-বান্ধবদেরও কলিজা সে৷ সেও কখনো মুসকানকে আলাদা চোখে দেখেনি। কে জানতো এমন দিন তাঁর আসবে? যে দিনে তাঁর প্রিয় বন্ধুর একমাএ আদরের ছোট বোনকে অন্য নজরে দেখতে হবে তাঁকে। তাঁর এই নজরকে কি সবাই শোভনীয় চোখে দেখবে? নাকি সকলের চোখে স্পেশালি বন্ধু দের চোখে ইমন নামটাই হয়ে যাবে অশোভনীয়? যদি অনুভূতি টা এক তরফা হতো নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতো সে। কিন্তু যেখানে ঐ বাচ্চা মেয়েটা তাঁর প্রতি এতো দূর্বল সেখানে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা৷ মুসকান তাঁর কাছে খুবই নিষ্পাপ, পবিএ, এবং স্বচ্ছ। তাঁর কিশোরী মনের স্বচ্ছ আবদারকে ফেলে দেওয়ার শক্তি ইমনের নেই। প্রেম কি? ভালোবাসা কি? এগুলোর মানে সত্যি মেয়েটা বুঝেনা মেয়েটা শুধু বুঝে তাঁর এই মানুষ টা শুধুই তাঁর। অবুঝ মনের অবুঝ ভাবনায় শুধুই ইমনের বিচরণ রয়েছে। ভবিষ্যতবানী করতে গেলে ফলাফল এই দাঁড়ায় যে, অবুঝ মনের এই অনুভূতি যদি স্থায়ী হয় তাহলে সে ভালোবাসাময় এক নারীকে পাবে নিজের জীবনসঙ্গিনী হিসেবে। বউয়ের নিঃস্বার্থ,গভীর ভালোবাসা পাওয়ার লোভ কার না আছে? কিন্তু বয়স নিতান্তই কম মেয়েটার সময়ের সাথে যদি তাঁর অনুভূতিরও পরিবর্তন ঘটে যায় ? সহ্য করতে পারবে তো? কম বয়সী মেয়েদের প্রতি ছেলেদের আলাদা একটা আকর্ষণ থাকেই। এটা যেনো চন্দ্র, সূর্যের মতোনই চিরন্তন সত্য৷ কিন্তু তাঁর কি শুধুই আকর্ষণ? শুধু আকর্ষণের ওপর নির্ভর করে এতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া কি ঠিক হবে? তাঁর সিদ্ধান্ত কতোটা গ্রহণযোগ্য হবে? তাঁর পরিবার, মুরাদের পরিবার বিষয়টা কতোটা সহজ বা কতোটা কঠিনভাবে হজম করবে?
_____________________
মুরাদের মামা ফোন করে জানালো তাঁর মা আর নেই৷ এটুকু বলেই সে ফোন কেটে দিয়েছে৷ মরিয়ম আক্তার কথাটা শোনামাএই জ্ঞান হারিয়েছে। বেশ কয়েকমাস ছুটি কাটিয়েছে মুরাদ। এক্সিডেন্ট করার পর তিনমাস ছুটিতে ছিলো সে৷ ছুটি কাটানোর পর আজই প্রথম স্কুলে গিয়েছে। মুসকান রুমে বসে ইংরেজি দ্বিতীয় পএ পড়ছিলো। হঠাৎ মায়ের চিৎকার শুনে ছুটে যায় বসার ঘরে৷ মাকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে সেও আম্মু বলে দেয় এক চিৎকার। তাঁর চাচি নিলুফা বেগম আর রিমি ছুটে এসে দেখে মুসকান মাকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। নিলুফা বেগম রিমিকে পানি আনতে বলতেই সে ছোট বালতি আর মগে করে পানি নিয়ে আসে। মাথা উঁচু করে ধরতেই রিমি নিচে বালতি রাখে আর নিলুফা বেগম পানি দিতে থাকে। জ্ঞান ফিরতেই মরিয়ম আক্তার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। আম্মা আম্মা বলে চিৎকার করতে থাকে। “আমার আম্মা আমার আত্নাটা আর নাই গো। আমার আব্বার মতো ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো আমার আম্মা ও ভাবি আমি কারে আম্মা ডাক দিব ভাবি। ও ভাবি আম্মা কাল রাতেই ফোন দিয়ে বললো ‘মরিয়ম রে তোর ছেলের বউয়ের মুখ দেখার ভাগ্য বুঝি আমার আর হবো না’ ও ভাবি আমার আম্মা নাই, নাই গো ভাবি নাই আমার আম্মা নাই ” মায়ের কান্না দেখে মুসকানও হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো৷ রিমি তাঁর বাবাকে ফোন করে জানিয়ে মুরাদকে ফোন করে জানালো।
.
পুরো বাড়ির মেইন দরজায় তালা ঝুলিয়ে বাড়ির গেটে বড় একটা তালা ঝুলিয়ে সবাই চলে গেলো নানাবাড়ি৷ জানাজার টাইমে মুরাদের সকল বন্ধু গিয়ে হাজির হলো৷ জানাজা পড়ে মাটি দিয়ে এক একে সবাই বিদায় নিলো। শুধু দিহান আর ইমন বাদে। সায়রী মুসকান কে জরিয়ে ধরে তাঁর মামার রুমে বসে আছে৷ রিমি মুসকানের মামাতো বোনদের সামলাচ্ছে। মরিয়ম আক্তার আর তাঁর বড় বোন মাজেদা বেগম একে অপরকে জরিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে চলেছে।
সন্ধ্যা সাতটা বাজে। বাড়ির বড় ওঠানে চেয়ার বসে আছে মুরব্বিরা। মুরাদ সহ মুরাদে মামাতো,খালাতো চারভাইও রয়েছে। মহিলারা সব ঘরের ভিতরে। সকলের মাঝে থেকে ওঠে গিয়ে ইমনকে ফোন দিলো মুরাদ। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দিহান আর ইমন চলে এলো৷ তাঁরা আশেপাশেই ছিলো। মুরাদ দিহানকে বাড়ির চাবি দিয়ে বললো,
—- মুসুকে নিয়ে তোরা ফিরে যা৷ আমাদের বাড়ি গিয়ে ওর বই আর এক সেট কাপড় নিয়ে ইমনদের বাড়ি যাবি৷ যেহেতু ইমনের বাড়িটাই আগে পড়ে।পরশু ওর পরীক্ষা। পরীক্ষা মিস দিলেই এক বছর গ্যাপ পড়ে যাবে। আর এখানে এতো কান্নাকাটির মাঝে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে পড়া তো হবেই না পরীক্ষাও খারাপ হবে। ইংরেজিতে খুব কাঁচা মুসু।
—- মুসু কি যেতে চাইবে? মলিন গলায় প্রশ্ন দিহানের৷
—- কেনো যেতে চাইবেনা? এখানে থেকে কান্নাকাটি ছাড়া আর কি করবে? কাকি মা’কে সারাক্ষণ কান্নাকাটি করতে দেখলে মুসুও ভেঙে পড়বে এর থেকে মুরাদ যা বলছে তাই হোক। একদমে কথাগুলো বললো ইমন।
—- হ্যাঁ সায়রীকে বলে দিয়েছি বাড়ি নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে৷ কাল সকালে সায়রীর সাথে দিহানদের বাড়ি চলে যাবে। পড়ায় কোন ক্ষতি হোক চাইনা৷ বললো মুরাদ।
—- দিহানদের বাড়ি কেনো? আমার বাড়ি কি পড়তে অসুবিধা নাকি? কোথাও যেতে হবেনা আমার ওখানেই থাকবে পরীক্ষা শেষ অবদি।
—- তাহলে সায়রীকেও রেখে দিস৷ আশা করি দিহানের সমস্যা নেই?
দিহান কিছু বলার আগেই ইমন বললো,
—- ওর সমস্যা থাকুক বা না থাকুক এতে আমাদের কি? সায়রী, মুসু দুজনই থাকবে, চাইলে দিহানও থেকে যাবে।
.
আটটার দিকে সকলেই ডালভাত খেয়ে নিলো। মুসকান কিছু খেতে পারলো না৷ সারাদিন না খেয়ে পেটে গ্যাস হয়ে গেছে, মুখেও রুচি নেই তাই সে কিছুই খেলো না। মুরাদ ইমনকে বলে দিলো, যাওয়ার সময় ফার্মেসী থেকে গ্যাসট্রিকের ট্যাবলেট কিনে মুসুকে খাওয়িয়ে দিতে৷ আর বাড়ি গিয়ে কিছু খাবার খাওয়াতে।
ইমনের গাড়িতেই ওঠে পড়লো সকলে। ইমন বসলো সামনে। পিছনের ছিটে মাঝখানে বসলো সায়রী ডানপাশে মুসকান আর বামপাশে দিহান। রাস্তায়ই গ্যাসট্রিকের ট্যাবলেট কিনে খাওয়িয়ে দেওয়া হলো মুসকান কে। বাড়ি ফিরতেই ইরাবতী সাদা ভাত আর পাঁচ মিশালী সবজি দিয়ে ভাত মেখে জোর করে মুসকান কে অল্প খাওয়িয়ে দিলো। পুরোটা সময়ই ইমন সোফায় বসে এক ধ্যানে চেয়ে ছিলো মুসকানের দিকে। সারাদিন মেয়েটা তাঁর সামনে কেঁদেছে। তাঁর বিধ্বস্ত মুখপানে তাকাতেই বুকের ভিতরটা ব্যাথায় টনটন করে ওঠছিলো বারবার। ইচ্ছে করছিলো খুব একটি বার বুকের ভিতর চেপে ধরে বলতে ‘এই পাগলী এভাবে কেনো কাঁদছিস দেখ এখানটায় খুব পুড়ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে কেনো এভাবে আমার ভিতরের যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিচ্ছিস ‘?
মাথা চেপে ধরে বসে রইলো মুসকান। ইমন ঘোরে থেকে ওঠে তাঁর দিকে এগিয়ে বললো,
—- এই মাথা ব্যাথা করছে? খুব কষ্ট হচ্ছে? চল উপরে গিয়ে এখুনি ঘুমাবি দেখবি সকালেই সব ব্যাথা সেড়ে গেছে৷
টলমল চোখে তাকালো মুসকান বসা অবস্থায়ই ইমনের পেট জরিয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠলো। আচমকাই এমন কিছু হবে ভাবতে পারেনি ইমন। সেখানে উপস্থিত কারোই বোধগম্য ছিলোনা এটা। ইরাবতী ভাবলো বাচ্চা মানুষ এভাবে নিজের নানুর মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি। চোখের সামনে সেই ছোটবেলায় বাবার লাশ দেখেছে এখন নানুর লাশ। মেয়েটার মনের অবস্থা বড়ই করুন। কিন্তু সায়রী আর দিহান বিষয়টা ঠিকভাবে নিলোনা। তাঁরা একেঅপরের দিকে কেমন দৃষ্টিতে যেনো তাকালো। কিন্তু ইমন বা মুসকানের কারোরি সেদিকে খেয়াল নেই। যেখানে মুসকান এভাবে ভেঙে পড়ে তাঁকে আঁকড়ে ধরেছে সেখানে অন্যকোন বিষয় কে বেশী গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা ইমন৷ মুসকানের প্রতিটা ফুঁপানি যেনো ইমনের হৃদপিন্ডে আঘাত করছিলো।
____________________
সারারাত ঘুম হয়নি ইমনের। ভোরের দিকে দিহানকে তুলে সিরিয়াস ভাবে বললো,
—- তুই সায়রীকে এখুনি ফোন করবি আর বলবি তোর শরীর খারাপ লাগছে।
—- কি বলস? আমি তো দিব্বি আছি।
—- না তুই দিব্বি নাই তুই ফোন করে যা বলতে বললাম তাই বল। আমার মুসকান কে একা চাই।
দিহান আর কিছু বললো না সে মনে মনে ইমনকে বেশ ভালোই সাপোর্ট করে। যদি মুসকান ইমন দুজন দুজনকে চায় তাহলে অন্যদের এতো বাড়াবাড়ি না করাই ভালো। কে কাকে ভালোবাসবে কে কাকে জীবনে নিয়ে আসবে তা আউটসাইট মানুষ দের ডিসাইড করার থেকে যারা সারাজীবন একসাথে থাকবে, যারা একে অপরকে মন থেকে চাইবে,ভালোবাসবে তাঁরা ডিসাইড করাই ভালো।
.
দিহানের অসুস্থতার কথা শুনে সায়রী ছুটে যায় ইমনের রুমে৷ দিহান মাথা ব্যাথায় আহ, উহ করে অভিনয় করতে থাকে। সায়রী তাঁর পাশে বসে মাথা টিপে দেয়৷ মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ব্যাস্ত হয়ে পড়ে তাকে নিয়ে৷ আশেপাশের আর কোন কিছুতে তাঁর খেয়াল নেই। এদিকে ইমন সোজা মুসকান যে ঘরে আছে সে ঘরে চলে যায়৷ মুসকানের সে নিষ্পাপ ঘুমন্ত মুখটা দেখে তাঁর বুকের ভিতর টা যেনো শান্ত হয় অনেকটাই। অবাধ্য ইচ্ছে রা ঢেউ খেলে যায় বুকজুরে। শ্বাসপ্রশ্বাসে আসে ঘন থেকে ঘনতা। কপালে ছুঁয়িয়ে দেয় ভালোবাসার গভীর স্পর্শ। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় অনেকটা সময়। বেহায়া চোখ দুটি চলে যায় মুসকানের পাতলা মসৃন ঠোঁট জোরায়। নিচের ঠোঁটের গাঢ় তিলটা যেনো তাঁর হৃদপিন্ড চেপে ধরে। বেহায়া মন চায় একটু খানি শীতল স্পর্শ সেখানে ছুঁয়িয়ে দিতে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সে আকর্ষণকারী ওষ্ঠদ্বয়ের দিকে। তাঁর ওষ্ঠদ্বয় যখন মুসকানের ওষ্ঠদ্বয় প্রায় ছুঁই ছুঁই তখনি বেজে ওঠে তাঁর ফোন। চমকে ওঠে ইমন বুকের ভিতরটায় ধুকপুকানি বেড়ে যায় খুব। নড়েচড়ে ওঠে মুসকানও। ইমন প্যান্টের পকেটে চেপে ধরে সড়ে যায়। বেলকনিতে গিয়ে ফোন বের করে রিসিভ করে। এলোমেলো নিঃশ্বাসে এক ঢোক গিলে বলে,
—- হ্যালো।
—- ঘুম থেকে ওঠেছিস? স্পষ্ট গলায় বললো মুরাদ।
—- হ্যাঁ এইমাএ। তুই এতো সকালে ফোন দিয়েছিস এনি প্রবলেম?
—- আর বলিস না। কি বাজে পরিস্থিতিটাই না ঘটলো। আমার মামার বড় মেয়ে আছেনা? ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। নাম মারিয়া ওর বড় ভাইয়ের বন্ধুর সাথে রিলেশনশিপে আছে। তুই ভাব কতো বড় সাহস কেমন দস্যি মেয়ে ভাব এ বয়সেই প্রেম, রিলেশনের কি বুঝে এই মেয়ে?
ইমন নিশ্চুপ।
মুরাদ বলতেই থাকলো,
—- আর ছেলের কতো বড় কলিজা ভাব বন্ধুর বোনের সাথে সম্পর্ক গড়ে৷ মারিয়ার বয়স কম। নিশ্চিত ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রিলেশন করেছে।
—- তুই কিভাবে জানলি? চাপা কন্ঠে প্রশ্নটি করলো ইমন।
—- আর বলিস না। মারুফ নামাজ পড়ার জন্য ওঠেছে। ওঠে দেখে পাশে বন্ধু সাজিদ নাই। ভাবলো হয়তো বাথরুম গিয়েছে। মামাদের বাথরুম তো ওঠান পরে জানিসই। মারুফ ফোনের ফ্লাশ অন করে বের হয়েছিলো। তখনি নারিকেল গাছের পিছন দিক ফিসফিস আওয়াজ শুনতে পায়৷ ভ্রু কুঁচকে গিয়ে লাইট ধরতেই দেখে মারিয়াকে জরিয়ে ধরে আছে সাজিদ৷ কুত্তার বাচ্চার কতো বড় বুকের পাটা ভাবছিস তুই?
মারুফের তো মাথায় আগুন ধরে যায়৷ গতকাল নানী মারা গেছে সকলের মনের অবস্থা এমনিতেই খারাপ তারওপর ছোট বোনের এমন কীর্তি তাও নিজের বেষ্ট ফ্রেন্ডের সাথে কার মাথা ঠিক থাকে? সাজিদকে ইচ্ছে রকম মাইর লাগাইছে৷ আমাকে ফোন দিতেই বের হয়ে এসব দেখে শালারে একদম পিটাইছি ইচ্ছে রকম। তারপর মারিয়াকে থাপড়াইছি কতোক্ষন। এই খবর আমি মারুফ আর মামি ছাড়া কেউ জানেনা। মামা জানলে মারিয়ার গলা কেটে নদীতে ভাসাই দিবো।
ইমন নিশ্চুপ হয়ে সবটা শুনছে। এতোক্ষণ যা শুনলো এতে তাঁর কোন অনুভূতি কাজ করলো না। মনে হলো সব স্বাভাবিক। আর যাইহোক সাজিদ ছেলেটার মতো অবস্থা তাঁর হবেনা৷ সে এতোটা দূর্বল নয়৷ কিন্তু এরপর মুরাদ যা বললো এতে পায়ের নিচ থেকে যেনো মাটি সড়ে গেলো তাঁর বুকের ভিতরটা যেনো দুমড়ে মুচড়ে যেতে শুরু করলো। মুরাদ বললো,
—- আমি মারুফ কেও ইচ্ছে রকম বকা দিলাম একটু আগে। কেমন ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব করে যে তাঁরা বন্ধুত্বের মান রাখতে পারেনা৷ বন্ধুর বোনের দিকে কুনজর দিতে যেসব ছেলের বুক কাঁপেনা সেসব ছেলে বন্ধু কেনো শত্রু হবারও যোগ্যতা রাখেনা৷ মানুষ নামে পশু এরা। তারপর বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে বললাম,আমার বন্ধু দের দেখ সেই কোন বয়স থেকে চলাফেরা তাদের সাথে। আমার বাড়িও তিনটা বোন ছিলো এখন দুজন রয়েছে জীবনে অন্যরকম দৃষ্টি ফেলা তো দূরের কথা কল্পনাও করতে পারেনা৷ বন্ধুত্ব যদি করতেই হয় ইমন,দিহান এদের মতো ব্যাক্তিত্বের লোকদের সাথেই করা উচিত৷ যাদের চোখ বুজে বিশ্বাস করা যায়,ভরসা করা যায়। যারা মনের ভুলেও কখনো বিশ্বাসঘাতকতা বা বেঈমানি করার কথা ভাবতেও পারেনা।
চলবে।
হৃদপিন্ড_২
জান্নাতুল নাঈমা
পার্ট_১১
সকালে ব্রেকফাস্ট করার পর মুসকানকে পড়তে বসিয়েছে সায়রী৷ মুসকান বিছানায় বসে পড়ছে। সায়রী তাঁর পাশে বসে কফি খাচ্ছে আর ফোন ঘাটাঘাটি করছে৷ পড়ার ফাঁকে মুসকান একটু পর পর দরজার দিকে তাকাচ্ছে। মনটা তাঁর ভীষণ খচখচ করছে। ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে এখন অবদি ইমনকে সে দেখতে পায়নি৷ খাওয়ার সময়ও ইমন ছিলো না। ইরাবতী কথার ফাঁকে বলেছে, ইমন কি একটা কাজে বাইরে গেছে ব্যাস এটুকুই। মুসকানের ছটফট করাটা সায়রীর চোখ এড়ায়নি। সে বেশ বুঝতে পারছে মুসকানের মনে এখন কি চলছে। সায়রী ভাবলো “মুসকানের সাথে কথা বলতে হবে। ওকে বোঝাতে হবে এসব আবেগ থেকে বেরিয়ে আসতে। ভালো, মন্দ বোঝার বয়স মুসকানের হয়নি তাই তাঁকে ভালো মন্দ বোঝানোটা আমার কর্তব্য”।
.
দিহান রুমে এসে মুসকানকে এক ব্যাগ চকোলেট দিলো৷ তারপর সায়রীর সাথে পায়ে পা বাজিয়ে ঝগরা করতে লাগলো। মুসকান মুখটা গোমড়া করে বসে আছে। মনে মনে অসংখ্য অভিযোগ করতে থাকলো তাঁর নানাভাইকে নিয়ে৷ সে কেনো একটিবারও তাঁর সাথে দেখা করছেনা? এ বাড়িতে সে আছে অথচ তাঁর নানাভাইয়ের সাথে তাঁর একটুও দেখা হচ্ছেনা তা কি মানা যায়?
দুপুর অবদি বাইরে ছিলো ইমন৷ নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে৷ নিজের সব অনুভূতিগুলো কে গলা টিপে হত্যা করেছে । এবং নিজের মা কে জানিয়েছে তাঁর জন্য মেয়ে দেখতে। যতো তারাতাড়ি সম্ভব বিয়ে করবে সে। মুসকান নামক যে ভয়ংকর অনুভূতি আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে আছে তাঁকে সেই অনুভূতি ছাড়াতে নিজের লাইফে কাউকে আনা খুব প্রয়োজন। কিছুদিনের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিয়ে এতো বছরের বন্ধুত্ব সে ধ্বংস করতে পারবেনা ৷ বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার মধ্যে বন্ধুত্বকে বেছে নিয়েছে সে। মুরাদের বলা কথাগুলো তাঁকে খুব কড়াভাবেই আঘাত করেছে।
বেলকনিতে বসে সিগারেট খাচ্ছে আর নানারকম চিন্তা করে যাচ্ছে ইমন৷ সচরাচর সে সিগারেট খায় না। মাঝে, সাঝে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে খাওয়া হতো। অথচ আজ মুরাদের বলা কথা গুলো শোনার পর বাড়ি থেকে বের হয়ে সিগারেটের উপরেই আছে ৷ বাড়ি ফিরেও একি অবস্থা তাঁর মা এতো বার খাওয়ার জন্য আকুতি, মিনতি করলো অথচ সে বাইরে খেয়েছে বলে মিথ্যা স্বান্তনা দিয়ে পাঠিয়ে দিলো মা কে।
ইমন বাড়ি ফিরেছে প্রায় এিশ মিনিট হয়ে এলো। এতোক্ষণ মুসকান অপেক্ষা করছিলো তাঁর জন্য। ভেবেছিলো একবার হলেও দেখা করতে আসবে। কিন্তু না ইমন একবারের জন্যও আসেনি। বুকের ভিতর খুব অস্থির করছে তাঁর। ফাঁপর লাগছে খুব৷ কেনো আসছে না? একবার দেখা করলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে? সেদিন তো খুব বললো ‘মুসু তোকে একটা দিন না দেখে থাকাও যেন দায়, মুসু তোর এই মুখটা তে কি আছে বল তো? উপরওয়ালা কি পৃথিবীর সব মায়া তোর এই মুখটায় ঢেলে দিয়েছে? আমি খুব বেহায়া হয়ে গেছিরে। আমি খুব বেহায়াপনা করছি তোর সাথে৷ তুই কি আমার এই বেহায়া মনের চাওয়াতে সাড়া দিবিনা’? উত্তরে মুসকান কিছু বলতে পারেনি। লজ্জায় মিইয়ে গিয়েছিলো সে। হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল ঝড়ের বেগে৷ কাঁপা গলায় শুধু বলেছিলো ‘রাখছি’।
অথচ আজ এক দুপুর না দেখেই দিব্বি কাটিয়ে দিলো। রাগে,দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করলো তাঁর। তাঁর বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড যখন তাঁর বান্ধবীর সাথে মিট না করে,কথা না বলে তখন বান্ধবী হাত কাটে। ঘুমের টেবলেট খায়। ইমনকেও তো সে ভালোবাসে খুব ভালোবাসে। ইমনও তো তাঁর বয়ফ্রেন্ড তাহলে ইমন যে সকাল থেকে দুপুর অবদি তাঁর সাথে কথা বলেনি,দেখা করেনি তাহলে তাঁরও তো উচিত হাত কাটা,বা ঘুমের টেবলেট খেয়ে বিছানায় পড়ে থাকা। তাহলে কি সেটাই করবে? কিন্তু হাত কাটার জন্য ব্লেট কোথায় পাবে? এ বাড়ির কোথায় ব্লেট থাকে সে তো জানেনা। পরোক্ষণেই ভাবলো হাত কাটলে কাল পরীক্ষা দেবে কি করে? তাছাড়া সে যদি খুব ব্যাথা পায়? তাহলে কি ঘুমের টেবলেট খাবে? হ্যাঁ এটা করা যায়। এখন খাবে কাল সকাল অবদি ঠিক ঘুম ছেড়ে যাবে। পরীক্ষা তো দুপুর দুটায় শুরু। কিন্তু ঘুমের টেবলেট কোথায় পাবে? বাথরুমে দরজার দিকে চেয়ে রইলো কতোক্ষন। সায়রী বাথরুমে তাই পুরো রুম খোঁজে দেখলো কোন ওষুধ আছে কিনা? কিন্তু ঘুমের ওষুধ সে চিনবেই বা কি করে? কে হেল্প করবে এখন তাঁকে? রুম ছেড়ে বেরিয়ে নিচে ওকি দিলো। কাজের মেয়ে পারুল দুপুরের খাবার রেডি করছে। ইরাবতীর রুমে গিয়ে দেখলো সে ঘুমাচ্ছে। তাই ভাবলো ইমনের রুমে যাবে। ইমনের ড্রয়ারে একদিন বিভিন্ন ধরনের ওষুধ দেখেছিলো। ঘুমের ওষুধ না পেলে সামনে যা পাবে সব খাবে৷ ইমন তো বাড়ি নেই রুম নিশ্চয়ই ফাঁকা?
ইমনের রুমে গিয়ে ড্রয়ার ঘাটাঘাটি করে বেশ কিছু ওষুধ পেলো৷ কয়েকটা পরিচিত কয়েকটা অপরিচিত। গ্যাস্ট্রিক এর ওষুধ খেলে ক্ষুধা লাগবে বেশী বেশী তাই সেটা বাদ রেখে ঠান্ডার ওষুধ মোনাস আর নাপা এক্সট্রা হাতে নিলো। খুব মনোযোগ সহকারে প্রতিটি টেবলেট গুলো এক এক করে হাতের মুঠোয় নিতে লাগলো। এগারোটা হয়ে গেছে তাই আর নিলো না। টেবিলে চেয়ে দেখলো গ্লাসে পানি ভরাই আছে তাই পানির গ্লাস নিতে যাবে তখনি ইমন গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,
—- এসব দিয়ে কি করবি?
—- এগুলো খাবো৷ ঘোরের মধ্যে থেকে কথাটা বলেই চমকে পিছনে তাকালো। ইমনকে দেখে আরো দ্বিগুণ চমকে গেলো। পা থেকে শুরু করে মাথা অবদি কেমন করে যেনো কেঁপে ওঠলো।
—- খাবি মানে? এসব কি পাগলামি মুসু তুই এতোগুলো ওষুধ খাবি? কি ওষুধ নিয়েছিস দেখি মাথা ঠিক আছে তোর?
কাঁধে চেপে ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো ইমন। মুসকান কয়েকবার চোখের পলক ফেললো। কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
—- তুমি কোথায় ছিলে নানাভাই?
—- চুপপ। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে? এসব কি করছিলি তুই?
ধমক খেয়ে কেঁদে দিলো মুসকান। ভয়ে ভয়ে বললো,
—- তুমি আমার সাথে সকাল থেকে দেখা করোনি। কথা বলোনি তাই হাত কাটতে চেয়েছিলাম কিন্তু এখানে ব্লেট পাবো কোথায়? তাই ঘুমের টেবলেট খুঁজছিলাম কোনটা কি জানিনা তাই এগুলোই নিলাম।
বিস্ময় চোখে চেয়ে ধমকে ওঠলো ইমন।
—- কিহ! এসব কি কথা ? এগুলো কার থেকে শিখেছিস? আমি দেখা করছিনা, কথা বলছিনা তাঁর সাথে এটার কি সম্পর্ক?
—- বয়ফ্রেন্ড যদি গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা না করে কথা না বলে তাহলে গার্লফ্রেন্ড রা তো হাত কাটেই। ঘুমের টেবলেটও খায় এটাই তো ভালোবাসা।
—- কে বলেছে এগুলো?
—- আমার বান্ধবী দের থেকে শুনেছি৷
মেজাজ চরম পর্যায়ে খারাপ হয়ে গেলো ইমনের। ইচ্ছে করলো থাপড়িয়ে সবকয়টা দাঁত ফেলে দিতে। কিন্তু পারলোনা শুধু হাত থেকে সবগুলো টেবলেট নিয়ে মুসকান কে শাসিয়ে বললো,
—- চুপ করে এখানে বসে থাক আমি আসছি।
ওষুধ গুলো ফেলে দিয়ে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো ইমন৷ হাসবে না কাঁদবে না রাগবে বুঝে ওঠতে পারছেনা৷ তবে এটুকু বুঝেছে সায়রী ঠিক বলেছে। আর যাইহোক তাঁর মতো অনুভূতি মুসকানের হয়নি। হবে কি করে? এটুকু বয়সে এরা সত্যি প্রেম কি?ভালোবাসা কি? বোঝে? এসব বোঝার জন্য হলেও তো নির্দিষ্ট একটা বয়সের প্রয়োজন। সে বয়সে আসতেও তো অনেক দেরী। এ বয়সে এদের যা অনুভূতি এগুলো না প্রেমের পর্যায়ে পড়ে না ভালোবাসার পর্যায়ে পড়ে৷ বয়ফ্রেন্ড কথা না বললে দেখা না করলেই হাত কাটতে হবে এক গাদা ওষুধ খেয়ে মরতে হবে বাহরে বাহ। কি যুগ এলো রে। হাঁটুর বয়সি পোলাপান প্রেমের নতুন নিয়ম, ভালোবাসার আজগুবি নিয়ম তৈরী করছে। এরা তাহলে স্কুলে গিয়ে এসব অপকর্ম শেখে? ইচ্ছে করলো আজ থেকেই মুসকানের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে৷ স্কুল যেতে হবেনা তাঁর বাসায় রেখে নিজে পড়াবে। কিন্তু তাঁর তো সে অধিকার নেই। তাহলে কি হবে? সায়রীকে বলে স্কুলের মেয়েদের কি শাসন করা উচিত? নাকি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে? কিন্তু মুসকানকে তো শাসন করা উচিত। কি করে করবে? ধমক দিলেই তো কান্না করে দেয়। মেয়েটা এই বিশ্রি জিনিসটা না শিখলেই কি হতো না? ধমক দিলে কাঁদতে হয় এটা ওকে কে শেখালো? কে বোঝালো? তাঁকে এ মূহুর্তে সামনে পেলে গর্দান নেওয়া হতো বোধহয়।
.
মুসকানের পাশে গিয়ে বসলো ইমন। মুসকান জড়োসড়ো হয়ে নিজের ওড়না চেপে ধরে বসে রইলো। ইমনের দম বন্ধ লাগছে। নিজের অনুভূতি কে তো গলা টিপে হত্যা করেছে তাহলে সেই অনুভূতি আবারো তাঁকে নাড়াচাড়া কেনো করছে? এই মেয়েটা কেনো তাঁর পৃথিবী উলটপালট করে দিচ্ছে? সকাল থেকে দেখা করেনি কথা বলেনি তাই বলে বোকার মতো কি কান্ড টাই না করতে যাচ্ছিলো। ভাগ্যিস সে ছিলো নয়তো কি হতো? বড় বড় করে মুসকানের দিকে তাকালো ইমন। বললো,
—- আর কখনো এমন পাগলামি করবি না মুসু।
—- তাহলে তুমিও আর কখনো আমাকে ছেড়ে দূরে থাকবেনা বলো?
বড়সড় ধাক্কা খেলো ইমন। আচমকাই খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরলো মুসকান কে। মুসকান চমকে গেলো ভীষণ। জড়োসড়ো হয়ে রইলো সে।
—- দূরে গেলে তোর কষ্ট হয়?
—- হুম আমার বুকের ভিতরটা শুকিয়ে যায়, ফাঁপর লাগে। নিঃশ্বাস নিতে পারিনা। বুকের ভিতর গরম বাতাস বইতে থাকে। মন চায় বুকের মাঝখানে ব্লেট দিয়ে কেটে এক গ্লাস পানি ঢেলে ঠান্ডা করি।
কথাটা শুনতেই ইমন চমকে গেলো। কারণ তাঁরও তো একি অনুভূতি হয়। তাহলে কি মুসকানের ভিতর সত্যি তাঁর জন্য স্ট্রং একটা অনুভূতি রয়েছে?
সবকিছু ভুলে গিয়ে ইমন কথা দিলো কখনো দূরে যাবেনা সে৷ খুশিতে মুসকানও ইমনকে জরিয়ে ধরলো। ঘোরের মধ্যে রয়েছে ইমন সেই ঘোর থেকেই সে একটা ভুল করে ফেললো। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে মুসকানের৷ মনের সব অনুভূতি বিলীন হয়ে একরাশ ভয় আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে ধরলো তাঁকে। কোনভাবেই ইমনের থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছেনা৷ ইমনের দুটো রূপের সাথে সে পরিচিত ছিলো আজ যেনো আরেকটা রূপ যোগ হলো৷
মুসকান যখন শব্দ করে কেঁদে ওঠে চমকে ছেড়ে দেয় ইমন৷ পুরো শরীর,মাথা ঝিম ধরে গেছে তাঁর। মূহুর্তেই মুরাদের বলা কথাগুলো কানে বাজতে থাকে ঢোলের মতো। তাঁর মানে কি সত্যি ইমন চৌধুরী বেঈমান হয়ে গেলো? ইমন চৌধুরীর ব্যাক্তিত্বে বেঈমান,বিশ্বাসঘাতক উপাধি কি যোগ হয়ে যাবে? চরিএেও কি দাগ পড়ে গেলো তাঁর?
.
চোখ বুজে ইমনের দু পিঠ খামচে ধরে বুকে মাথা রেখে কাঁপছে মুসকান। ইমন মুসকানের মাথাটা একহাতে চেপে ধরে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে৷ মাথা কাজ করছে না তাঁর। ইচ্ছে করছে নিজের মাথায় গুলি করে মরে যেতে। ইচ্ছে করছে বুকের ভিতর শত ছুড়ির আঘাত করতে৷ কি থেকে কি হয়ে গেলো৷ এই বাচ্চা মেয়েটার থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে কেনো রাখতে পারেনা সে? ছিঃ।
_________________________
সেদিনের পর দুমাস কেটে যায়। ইমন আর মুসকানের কাছাকাছি যায়নি৷ মুসকানও ভয়ে একা তাঁর কাছে যাওয়ার সাহস পায়নি। তবে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়েছে তাঁদের। ইমনের মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিল আবেগের বশে মুসকান যদি নিজের ক্ষতি করে ফেলে?
.
কোর্ট থেকে ফিরেছে সবেমাএ। তখনি ইরাবতী কয়েকটা মেয়ের ছবি সামনে ধরলো। ইমন শার্ট খুলে তয়ালে গলায় ঝুলিয়ে বাথরুম যাচ্ছিলো। তখনি তাঁর মা সামনে এসে পড়ে।
—- বাবা এবার কিন্তু চোখ, মুখ খিচবা না৷ এবারের সবগুলা মেয়ে যথেষ্ট সুন্দরী এবং শিক্ষিত। এর মধ্যে দুজন এডভোকেটও।
ইমন মাকে দেখানোর জন্য খপ করে ছবিগুলো নিয়ে এক পলক দেখে বললো,
—- ইশ মা সবগুলো দেখেই ময়দা সুন্দরী লাগছে। ঠোঁটের লিপস্টিক দেখেছো মনে হচ্ছে মানুষের রক্ত খেয়ে ঠোঁট লাল করেছে। এসব চলবে না।
ইরাবতী আহত গলায় বলে,
—- বাবা তোমার ঠিক কেমন মেয়ে চাই একবার মুখ ফুটে বলে আমাকে ধন্য করবা?
ইমন করুণ চোখে তাকায় মায়ের দিকে। ‘তোমাদের চোখের সামনেই তো আছে মা। যার শরীরের দুটো তিল তীরের মতো আমার হৃদপিন্ডে আঘাত করেছে, যাকে দেখার জন্য আমার মনটা সর্বক্ষণ ব্যাকুলতায় ভোগে, যার চোখে,মুখে উপরওয়ালা দুনিয়ার সব মায়া ঢেলে দিয়েছেন, আমার বন্ধু নামক চরম শত্রু, গোপন শত্রুর একমাএ আদরের বোন আমার মুসুরানী’। মনের কথা মনে রেখেই বললো,
—- ক্ষুধা লাগছে খাবার বাড়ো গিয়ে এসব নিয়ে পরে কথা বলবো।
.
মুরাদের চাচার শরীরটা বেশী ভালো না। সবাই আতঙ্কে থাকে মুরাদের বাবার মতো হুট করে যদি ওনিও দুনিয়া ছেড়ে বিদায় নেন? বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে যতো চিন্তা ছোট মেয়েকে নিয়েই। এবার ছোট মেয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। এ কথা বড় মেয়ে রুমার হাজব্যান্ড রাতুল শুনতেই বলে,
—- আব্বা আপনার এক মেয়েকে দূরে বিয়ে দিয়েছেন। এবার রিমি চলে গেলে আপনি আর আম্মা একদমই একা হয়ে পড়বেন। আমি বলছিলাম ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকুক৷ আপনি মরিয়ম চাচির সাথে কথা বলেন। মুরাদের জন্যও তো মেয়ে খোঁজা হচ্ছে শুনলাম।
মেয়ে জামাই তাঁর খুবই জ্ঞানী, বুদ্ধিমান তাঁর এই সিদ্ধান্তে খুশি না হয়ে পারলো না। নিজের ভাইয়ের ছেলেকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেন তিনি।
বাড়ির সকলের মধ্যে আলোচনা চললো পুরো এক দুপুর। এবং সিদ্ধান্ত হলো সামনে সপ্তাহে মুরাদ আর রিমির বিয়ে৷ মায়ের মুখের ওপর কথা কোনদিনই বলেনি মুরাদ। চাচাকেও সে যথেষ্ট সম্মান করে। বিয়ে নিয়ে কথা ওঠার পরই মুরাদের মনে যে প্রশ্নটা জাগে তা হলো ‘রিমি কারো সাথে রিলেশনশীপে নেই তো’?
রিমির সাথে একা কথা বলে মুরাদ। নিজের বাড়ির মেয়েদের যথেষ্ট ভালো করেই চিনে সে। তবুও মনের ভিতর তো আর ঢুকতে পারেনা তাই সিওর হয়ে নেয়।
এবং বিয়ের ডেট ফিক্সড করে ফেলে।
.
ইমনকেও ফোন করে জানিয়ে দেয়। বিয়ের তিনদিন আগে থেকে যেনো তাঁদের বাড়িতে উপস্থিত থাকে সে। প্রিয় বন্ধুর বিয়ে নিয়ে কতশত প্ল্যান ইমনের। সব থেকে বেশি আশ্চর্য হয়েছে রিমির সাথে বিয়ে শুনে তাঁর মানে এক হিসেবে মুসকান মুরাদের শালিকাও তো হবে। যাক হাসি তামাসার ছলে মুরাদের কাছে তাঁর শালিকাকে চাওয়া যাবে। মুরাদের রিয়্যাকশনও বোঝা যাবে।তৎক্ষনাৎ অনেক প্ল্যান করে ফেললো ইমন। প্রতিটা সেকেন্ড কল্পনা করতে লাগলো সে কি করবে না করবে। কিভাবে পটাবে মুরাদকে। সেই সাথে মুসকান কেও দেখে নেবে। সেদিনের পর মুসকান ইমনের থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে। যা একদম ভালো ঠেকছে না তাঁর কাছে। একবার একা পেলে সেদিনেরটা রিটার্ন হবে ভেবেই মুচকি হাসলো।
এতো খুশি এতো আনন্দ আগাম পরিকল্পনা সব ঠিক থাকবে তো? কোন কিছু নিয়ে অতিরিক্ত খুশি হলে সেই খুশি নাকি কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়ায়? মুরাদের নতুন জীবনে পা দেওয়াতে ইমনের জীবনও কি নতুন মোড় নেবে? যদি তাই হয় সে জীবনে মুসকান থাকবে তো?
চলবে।