মায়াজাল (ভৌতিক গল্প),পর্ব-১০(শেষ পর্ব)
লামিয়া আক্তার রিয়া
সবাই ইদ্রিস মিয়ার ঘরে বসে আছে।ইমু আদ্র দুজনের মুখেই চিন্তার ছাপ।ইদ্রিস মিয়া বসেবসে কিছু বিরবির করছে।হুট করেই বাতাস শুরু হলো।একটা পোরা গন্ধ বাতাসে ভেসে আসছে।
ইদ্রিস: আইতাছে ও।তৈরি থাকো সবাই।
দরজা বাতাসে খুলে গেলো।ইমু শক্ত করে আদ্রের হাত চেপে ধরলো।আদ্র ইমুর হাত ধরে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বললো।ওরা সামনে তাকিয়ে দেখলো কেউ ঢুকছে।
ইমু: স্যার!!
দরজা দিয়ে হেডস্যারকে ঢুকতে দেখে ইমু আর আদ্র অবাক হয়ে গেলো।
জমিল: কেমন আছো মৃন্ময়ি?
ইমু: আপনিই তাসমির?
জমিল: হ্যা।
ইমু: তাহলে মিস্টার জমিল?
তাসমির এবার জোরে হেসে উঠলো।
তাসমির: সত্যিই মৃন্ময়ি তুমি এসব কি বোকা বোকা প্রশ্ন করছো বলোতো?আরে ওই জমিলকেতো আমি কবেই উপরে পাঠিয়ে দিয়েছি।এতদিনতো ওর শরীরটা ব্যবহার করেছি তোমার কাছে থাকার জন্য।যাকগে সেসব কথা।এটা কি ঠিক বলো?তোমাকে বললাম আজ হবে আমাদের মিলনের রাত তাও এ কি অবস্থা তোমার?যাও একটা পাতলা শাড়ি পরে নাও।
আদ্র: তোর মনে হয় তুই ওকে নিজের করতে পারবি?
তাসমির: দেখ ভাই গতবার অকারনেই ঝামেলা করে নিজের প্রান দিয়েছিস।এবার এই ভুল করিস না।আমার মৃন্ময়িকে আমার কাছে দিয়ে দে।আমার আর অন্যের শরীরে থাকতে ভালোলাগছেনা।যাও মৃন্ময়ি।
ইমু: কিছুতেই না।তোর এই ইচ্ছে আমি কিছুতেই পূরন হতে দিবোনা।
তাসমির: আহা রূপসী,একবার আমি নিজের শরীর পাই তারপর দেখবে তোমাকে কত সুখ দেই।আমার রাজ্যের রানী করে রাখবো তোমাকে।
ইমু: না।আমি কক্ষনো তোর হবোনা।
তাসমির: আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিওনা মৃন্ময়ি।
আদ্র: ওকে পেতে গেলে আগে আমার মোকাবিলা করতে হবে তোকে।গতবারতো কাপুরুষের মতো পেছন থেকে আঘাত করেছিলি।এবার সামনাসামনি লড়াই হোক?
তাসমির: তুই এখন সামান্য মানুষ আর আমি এক শক্তিশালী আত্মা।তুই পারবিনা আমার সাথে।
আদ্র: তুই ভুলে যাচ্ছিস মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব।
তাসমির: হাহ্,,যাকগে ইদ্রিস চাচা?আপনার কি খবর?আপনি মাঝে ঝামেলাটা না লাগালেইতো আমি মৃন্ময়িকে অনায়াসেই নিজের করে নিতাম।
ইদ্রিস: ভুইলস যাইবেন না বড়সাহেব পাপের বিনাশ একদিন হইবোই।মৃন্ময়ি মা আর অনুভব বাবার পৃণর্জন্ম হইছে আপনার করা পাপের বিনাশ করতে।আর আমি ন্যায়ের জয়ের পথ প্রদর্শনের জন্য আছি।
ইমু: তাসমির?আমি আপনার শর্তে রাজি।
আদ্র: কি!!কিসব বলছো ইমু?
ইমু: হ্যা ঠিকই বলেছি।তবে আমায় কথা দিতে হবে যে আমিই আপনার একমাত্র রানী হবো।অন্যকাউকে আপনি রানীর আসনে বসাতে পারবেন না।আর আপনার সাথে সাথে আমাকেও অমর করতে হবে।
তাসমির: সে আর বলতে?তোমার রূপ যৌবন দিয়ে তুমি আমায় খুশি রাখবে আর আমিও তোমায় রানী করে রাখবো।তবে আমাদের প্রথম সন্তানকে বলি দিতে হবে শয়তানের নামে।
ইমু: রাজি আমি।
আদ্র: মৃন্ময়ি?কি বলছো তুমি?ততুমি সত্যিই?না না তুমি তো আমায় ভালোবাসো।মৃন্ময়ি আমরা তাসমিরকে মারার জন্য আবার জন্মেছি।আমাদের ভালোবাসার পূর্ণতার জন্য আমরা আবার জন্মেছি।
ইমু: ক্ষমা করবেন আদ্র।আমি তাসমিরকেই বিয়ে করে ওর রানী হবো।সারাজীবন অমর হয়ে থাকবো।আপনার সাথে থাকলে আমার লাভ কি?
আদ্র: আমাদের ভালোবাসা মৃন্ময়ি?
তাসমির: ক্ষমতার কাছে এসব ভালোবাসা টালোবাসা কিচ্ছুনা।
আদ্র: কিন্তু মিনি?ও তোমার প্রথম সন্তানকে বলি দিবে।
ইমু: তাতে কি?পরে আরো সময় আছে।তাসমির?আপনি আমায় সন্তান দিবেন না?
তাসমির: হ্যা হ্যা কেন দিবোনা?তোমার ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে।শুধু অমরত্ব আর পুরো পৃথিবীর অধিকার আমার হাতে এলেই হবে।
ইমু: চলুন তবে(হাত বারিয়ে) আমরা আমাদের অপূর্ণ চাহিদা পূরন করি।
তাসমির: (ইমুর হাত ধরে) চলো চলো।আহা সব যে এত সহজে মিটবে বুঝিইনি।জলদি চলো মৃন্ময়ি।আমিযে তৃষ্ণার্ত।
ইমু: চলুন আপনার তৃষ্ণা নিবারন করি।
ইমু তাসমিরকে সেই রুমে নিয়ে গেলো যে রুমে ওরা পুরে মারা গিয়েছিলো।রুমটা সুন্দর করে সাজানো।ইমু তাসমিরের চোখ বেধে দিলো।
ইমু: আপনি একটু অপেক্ষা করুন ।আমি শাড়ি পাল্টে আসছি।
ইমু শাড়ি পাল্টে এসে তাসমিরের চোখের কাপড় খুলে দিলো।তাসমির ইমুর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।
তাসমির: এতো সেই শাড়ি যেটা সেদিন পরেছিলে।
ইমু: কোনদিন?
তাসমির: যেদিন সবাই আগুনে-
ইমু: ইস্ আপনি এত সুন্দর পরিবেশটা পুরোনো কথা তুলে নষ্ট করছেন।এটা আমার প্রিয় শাড়ি।বলুনতো কেমন দেখাচ্ছে আমায়?
তাসমির ইমুর সামনে এসে ঝুকে ওর শরীরের ঘ্রান নিলো।
তাসমির: আহ্ আগের সেই মিষ্টি গন্ধ।এসো মৃন্ময়ি আমার হয়ে যাও।আমার ছোয়ায় রাঙিয়ে দেবো তোমায়।
ইমু: হবো তো।আজ আমি সম্পূর্নভাবে আপনার হবো।এজন্যইতো এতোকিছু।তবে আপনার এই পোষাকটা আমার মোটেও ভালোলাগছেনা।আর না এই চেহারা।
তাসমির: তবে?
ইমু: আমি আপনাকে সেই পূরোনো তাসমির রূপে দেখতে চাই।সেই সুদর্শন স্বপ্নপুরুষের কাছে নিজেকে সপে দিতে চাই।তার ছোয়ায় নিজেকে সম্পূর্ন করতে চাই।
তাসমির: কিন্তু এ যে অসম্ভব।
ইমু: আপনিতো মহান।পারবেন না নিজের মৃন্ময়ির জন্য এটা করতে?আমি যে আমার সেই তাসমিরকে ছুয়ে ভালোবাসতে চাই।আদরে মুরে দিতে চাই।বলুন না মির?আমার জন্যও তুমি নিজের রুপে আসতে পারবেনা মির?নয়তো কিন্তু আমি তোমায় আদর করবোনা।বলোনাগো মির নিজের রূপে আমায় ভালোবাসায় রাঙাবেনা?
ইমু তাসমিরের কাছে এসে দুহাতে তাসমিরের ঘাড় জড়িয়ে ধরলো।এমনিতেই ইমুর ঘ্রানে তাসমির পাগলপ্রায় তারউপরে এতো কাছে আসায় সে পাগল হয়ে যাচ্ছে।
তাসমির: কিন্তু আমার শরীরযে ভষ্ম হয়ে গিয়েছে।
ইমু: তুমি কেমন ভালোবাসো আমায়?আমার জন্য নিজের শরীরকে পুনরায় ঠিক করতে পারবেনা?
তাসমির: পারবো।তবে সন্তান বলি দেয়ার আগে শরীরে প্রবেশ করলে যদি শরীরের ক্ষতি হয় তাহলে তা চিরস্থায়ী হয়ে যাবে।
ইমু: হবেনা কিছু।কিন্তু অন্যকোনো পুরুষের শরীর দ্বারা আমি তোমার সাথে মিলিত হতে পারবোনা।কিচ্ছু জানিনা আমি।তোমায় নিজের শরীর নিয়েই আমার কাছে আসতে হবে।নয়তো আমি এবারও নিজেকে শেষ করে দিবো।(মন খারাপ করে)
তাসমির: না না আমি নিজের আসল রূপে আসছি।
তাসমির চোখ বন্ধ করে দুহাত দুদিকে মেলে দিয়ে কিছু বিরবির করলো।সাথেসাথেই ও আসল তাসমিরের রুপ ধারন করলো।এবার ইমু খুশি হয়ে তাসমিরের গালে হাত বুলিয়ে একটা পোষাক ওর হাতে দিয়ে সেটা পরে আসতে বললো।ইমুর কথামতো তাসমির পোষাক পাল্টে এসে দেখলো ইমু বিছানায় বসে আছে।তাসমিরকে সে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো।তাসমির পাশে বসতেই ইমু ওর হাতে গ্লাসে রাখা পানিয় তুলে দিলো।
তাসমির: কি এটা?
ইমু: দুধ।খেয়ে নাও।
তাসমির মুচকি হেসে ইমুর হাত থেকে দুধের গ্লাস নিয়ে সবটা খেয়ে নিলো।তাসমির তাকিয়ে দেখলো ইমু হাসছে।
তাসমির: আজ আমাদের মিলনের রাত।এখন আমার হয়ে যাও মৃন্ময়ি।
ইমু: হবোতো।তবে পুরোনো হিসেবগুলো যে না মেটালেই নয়।
তাসমির: ম মানে?
তাসমির নিজের মাথায় হাত দিলো।মাথা ঘুড়ছে।তাসমির স্থির হয়ে বসতে পারছেনা।
তাসমির: আ আমার মাথা ঘুরছে কেন?আহ্।ম মৃন ময়ি?
ইমু: এবার তোমায় আমার ভালোবাসায় রাঙিয়ে দেবো মির।
আর কিছু শুনলোনা তাসমির।অজ্ঞান হয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো।ইমু দরজা খুলতেই আদ্র ইমুকে জড়িয়ে ধরলো।
ইমু: আরে কি করছেন?ছাড়ুন।
আদ্র: ছাড়বোনা।তুমি জানো আমি কত ভয় পেয়ে গিয়েছি?ওই তাসমির যদি সত্যিই তোমার ক্ষতি করে আমিও শেষ হয়ে যাবো মিনি।
ইমু: আমি মিনি নই ইমু।ছাড়ুন।আমার এখনো বিয়ে হয়নি।এভাবে জড়িয়ে ধরছেন কেন?
আদ্র: সত্যি ছেড়ে দিবো?
ইমু: হুম।
আদ্র: সত্যিই?
ইমু: উহু।
ইমু এবার শক্ত করে আদ্রকে জড়িয়ে ধরলো।আদ্রই মুচকি হেসে ইমুকে জড়িয়ে ধরলো।
ইমু: এবার চলুন তাসমিরকে চেয়ারে বেধে ওই গোলের মধ্যে বসাতে হবে।তারপর আপনি চাচাকে ডেকে আনুন।
–
–
–
তাসমির চোখ খুলতেই নিজেকে চেয়ারে বাধা অবস্থায় পেলো।চারপাশে তাকাতেই দেখলো ইদ্রিসমিয়া আগুনের সামনে বসে আছে।ইমু আর আদ্র পাশেই দাড়িয়ে আছে।তাসমির রেগে চিৎকার করে উঠলো।
তাসমির: আমায় আটকে রেখেছো কেন?বাধন খোলো।মৃন্ময়ি তুমি আমায় ঠকালে?
ইমু: আমি?নাতো।
তাসমির: ধোকা,ধোকা দিলি তোরা?
আদ্র: আসলে কি বলতো ভাই,,এই বুদ্ধিটা আমার।তুই আগেরবার আমাদের ধোকা দিয়েছিলি।তোর জন্য আমাদের পরিবারের সবাই বিনাদোষে আগুনে পুরে মরেছে।(তাসমিরের সামনে এসে) কি দোষ ছিলোরে ওদের?তুই নাহয় দাদা বা আমাকে সহ্য করতে পারতিনা।দাদি,বাবা বা মাকেও বাদ দিলাম কিন্তু তোর মা বাবা?তোর নোংরামির জন্য ওরাও প্রান দিলো।
তাসমির: আমার দোষ ছিলোনা।তোর বউ সেদিন নিজের গায়ে আগুন দিয়েছিলো বলেই সবাই মারা গিয়েছে।
আদ্র: বাহ্ এখন সব দোষ আমার মিনির?তুই যদি নোংরামোর জন্য না আসতি তাহলে এসব হোতোনা।তুই নিজের হাতে আমায় খুন করলি।তারপর তো মিনি নিজেকে না শেষ করলে ওর উপরেও ঝাপিয়ে পরতি।ও নিজের সতিত্ব হারালে এমনেই মরে যেতো।আর বাকিরা তোর নোংরামো সহ্য করতে না পেরে মরে যেতো।আমি মারা যাওয়ার পরে জমিদারী তোর হাতে চলে যেতো।এরপর যে তোর বিরুদ্ধে কথা বলতো তাকেই তুই মৃত্যুদন্ড দিতি।ভুল বললাম আমি?
তাসমির: এসব তুই কিভাবে জানলি?( অবাক হয়ে)
আদ্র: তোর পরিকল্পনা অনুযায়ি তুই প্রথমে মারতি দাদুকে।তখন দাদি বাধা দিলে তাকেও শেষ করতি।তারপরের শিকার আমার বাবা-মা।এদের সরিয়ে দিতে পারলেই জমিদারি তোর হাতের মুঠোয়।
ইদ্রিস: শুধু তাই না।ওর পরিকল্পনা অনুযায়ি যদি ওর বাবা ওর কাজে বাধা দেয় তাহলে তারেও খুন করার নির্দেশ ছিলো।আর কাবিল চৌধুরিরে মারলে বড় সাহেবা এমনেই মইরা যাইবো। মোট কথা ওনার পথ পরিষ্কার।
তাসমির: নাআআ,,, এইসব মিথ্যে।সবকিছু মিথ্যে।
আদ্র: কিচ্ছু মিথ্যে না।ছিহ্,তোকে ভাই বলতেও ঘৃণা করে।শুধুমাত্র লোভের জন্য একটা পরিবারকে শেষ করার কথা ভাবলি তুই?এত নিপুনভাবে ঠান্ডা মাথায় নিজের পরিবারের লোকদের খুন করার পরিকল্পনা কিভাবে করলি তুই?
ইমু: আমি নিজেকে অপরাধি ভাবছিলাম কারন আমার শরীরে আগুন দেয়ার জন্য পুরো জমিদারবাড়ি শ্মশান হয়ে গিয়েছে।কিন্তু তুই সবাইকে শেষ করার ব্যবস্থা করেই আমাদের ঘরে এসেছিলি।তুই বাড়ির রান্নাঘরে,তোর ঘরে আর ছাদে কেরোসিনের বোতল রেখে দিয়েছিলি।আমাকে ভোগ করার পর তুই অনুভব,দাদা-দাদি আর মা-বাবার লাশ একসাথে পুরিয়ে দিতি।আর যদি বড় আব্বু বা বড়মা বাধা দিতো তাহলে তাদেরও খুন করে একসাথেই পুরে দিতি।সব পরিকল্পনা করাই ছিলো তোর।তবে তাতে পানি ফেলে দিলাম আমি।বাকিরাতো এমনিতেই সেদিন আগুনে পুরেই মারা যেতো।তবে কি জানিস,আল্লাহ্ যা করে ভালোর জন্য করে।তাই আমি নিজেই আগুন লাগাই যাতে তুইও পুরে শেষ হয়ে গেলি।
তাসমির: কিন্তু আজ তুই বাঁচবিনা।আমায় ধোকা দিয়ে খুব বড় ভুল করলি।ছাড় আমায়।
আদ্র: কেন করলি ভাই এমন?একটুও খারাপ লাগছেনা তোর?
তাসমির: না না না।লাগছেনা খারাপ।শুনেছিস?আমার খারাপ লাগছেনা।আমি সব চাই।সব সব সব চাই।আরাম আয়েসে দিন কাটাতে চাই।কেউ আটকাতে পারবেনা আমায়।ছাড় বলছি।
আদ্র: মিনি ঠিকই বলেছে।তুই মানুষ না,জানোয়ার হয়ে গিয়েছিস তুই।মিনি?তুমি যা করতে চাও করো।
তাসমির: মানে?কি করবে ও? হাহাহা।আরেকটা সুযোগ দিচ্ছি মৃন্ময়ি।আমার হয়ে যাও।তোমার রূপের সুধা আমায় পান করতে দাও।রানী করে রাখবো।নয়তো তোমায় তরপে তরপে মারবো।
ইমু: সেজন্য তুই আর থাকবিনা।চাচা?
ইদ্রিস মিয়া একটা পিতলের ঘটিতে করে পানি এনে ইমুর হাতে দিলো।ইমু পানি তাসমিরের দিকে ছেটাতেই তাসমির যন্ত্রনায় চিৎকার করতে লাগলো।চেয়ারের বাধন ছিরে গেলো।তাসমির সামনে থাকা মৃন্ময়ির দিকে ছুটে আসতে চাইলেই চারপাশে থাকা বৃত্তের জন্য বের হতে পারলোনা।
ইমু: এই বৃত্ত মন্ত্রযুক্ত হারের গুড়া দিয়ে দেয়া যা ভেদ করে বাইরে আসার সাধ্য তোর মতো শয়তানের নেই।
তাসমির: ছেড়ে দাও মৃন্ময়ি।দয়া করো।
আদ্র: না মিনি।এই চালবাজকে বিশ্বাস করবেনা।চাচা?আগুনটা নিয়ে আসেন।
তাসমির: অনু ভাই আমার,আমি তোর বড়ভাই।তোকে কত আদর করতাম বল।তুই আমায় মারবি?
আদ্র: তুই যদি সত্যিই আমার ভাই হতি আমায় ভালোবাসতি তাহলে নিজের হাতে আমার বুকে তলোয়ার ঢুকাতে পারতিনা।আজ আমি তোকে শেষ করবো।এই জমিদারবাড়িকে কলঙ্কমুক্ত করবো।
ইমু বৃত্তের ভেতরে কেরোসিন ঢেলে দিলো আর আদ্র হাতের মশাল বৃত্তের ভেতর ছুরে দিলো।চারপাশ তাসমিরের আর্তচিৎকারে কেপে উঠলো।ধিরেধিরে চিৎকার কমতে লাগলো।ওদের চোখের সামনে পুরে ছাই হয়ে গেলো তাসমির।আদ্র ইমুকে জড়িয়ে ধরে কাদঁতে লাগলো।
আদ্র: আমি আমার ভাইকে খুন করলাম মিনি।আমিও খুনি।
ইমু: না অনি।ও ওর পাপের শাস্তি পেয়েছে।এটাই ওর প্রাপ্য ছিলো।এজন্যই আমাদের পূনর্জন্ম হয়েছে।
ইদ্রিস: আমার কাজ শেষ বাবা।এবার যে আমারেও যাইতে হইবো।
আদ্র এগিয়ে যেয়ে ইদ্রিস মিয়াকে জড়িয়ে ধরলো।
আদ্র: ধন্যবাদ চাচা।তুমি না থাকলে হয়তো সবটা এতটা সহজ হতোনা।আমার সব মনে পরে গিয়েছে চাচা।তুমি তো এখন চলে যাবে।ওপারে যেয়ে সবাইকে বলো আমি আমার অসম্পূর্ন কাজ শেষ করেছি।
ইদ্রিস: কমু বাবা।আমার মৃন্ময়ি মারে দেইখা রাইখো।আল্লাহ্ তোমগো সুখি করুক।অনেক ভালা থাকো তোমরা।
ইমুও এগিয়ে এসে ইদ্রিস মিয়ার হাত ধরলো।
ইমু: সারাজীবন মনে থাকবে আপনার কথা চাচা।আপনার উপকার ভুলবোনা।
ইদ্রিস: এটা আমার দায়িত্ব ছিলো মা।তোমরা ভালো থাইকো।আর (একটা পাত্র দিয়ে) এই ছাই নদীর পানিতে ভাসাইয়া দিও।তাসমিরের ছায়াও আর তোমগো উপরে পরবোনা।সুখে থাইকো তোমরা।বিদায়।
আদ্র,ইমু: বিদায় চাচা।
ইদ্রিস মিয়া হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।আদ্র আর ইমুও বেরিয়ে গেলো নদীর উদ্দেশ্যে।
–
–
–
চারদিকে সকালের আলো ফুটেছে।আলো ফুটতেই হন্তদন্ত হয়ে জমিদারবাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে লিয়া আর সামু।কিন্তু জমিদারবাড়িতে ঢুকেই ওরা ভয় পেয়ে গেলো।চারপাশ এতটাই নিস্তব্ধ যে ওদের শরীর হিম হয়ে গেলো।
সামু: এই লিয়া,ওরা ঠিক আছেতো?কোনো সারাশব্দ নেই কেন?
লিয়া: বুঝতে পারছিনা।
সামু: চল ওদের ডাকি।
লিয়া: হুম।ইমু?ইদ্রিস চাচা?আদ্র?কোথায় তোমরা?এই ইমু?(জোরেজোরে)
সামু: কেউ নেই?চল খুজি।
লিয়া: চল।
লিয়া আর সামু সারাবাড়ি খু্জেও কাউকে পেলোনা।ওরা হতাশ হয়ে নিচে নেমে এলো।
সামু: লিয়া?সবতো খুজলাম।কোথায়রে ওরা?উমার মতো কি ওদেরও?(ডুকরে কেঁদে উঠলো)
লিয়া: না না ওরা ঠিক আছে।আচ্ছা আমরাতো ওই পুবের দিকের ঘর খুজিনি।
সামু: কিন্তু ওখানেতো ওই তাসমিরের ভুত আছে।
পেছন থেকে: কেউ নেই।এখন এই বাড়ি তোর তথাকথিতো ভুত মুক্ত।
সামু লিয়া পেছনে ফিরে দেখলো ইমু আর আদ্র হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে।ওরা দুজন দৌড়ে যেয়ে ইমুকে জড়িয়ে ধরলো।ইমু পরে যেতে যেতে সামলে নিলো।
আদ্র: আরে আরে শালিসাহেবারা কি করছো?আমার বউটাতো এখনি পরে যেতো।
লিয়া আর সামু এবার ইমুকে ছেড়ে আদ্রের দিকে সন্দেহর দৃষ্টিতে তাকিয়েই ইমুর দিকে জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে তাকালো।
ইমু: এই এই মিথ্যে বলবেন না।আপনাকে আমি বিয়ে করিনি।
আদ্র: তওবা তওবা।তুমি এমন বলতে পারলে মিনি?
সামু: মিনিটা কে?
আদ্র: কেন?আমার বউ।তোমাদের বান্ধবী।(লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গি করে)
ইমু: ওই ওই আমাদের বিয়ে হয়নি।
আদ্র: এজন্মে না হোক আগের জন্মেতো হয়েছে।তুমি সব এভাবে অস্বীকার করতে পারোনা মিনি।
ইমু: এই দেখুন-
আদ্র: এমা না না এভাবে সবার সামনে কি বলছো?লজ্জা লাগেতো।
ইমু: লজ্জা তাইনা?তোর লজ্জা আমি-
আদ্র: ছি ছি মিনি আবারো তুই করে বলছো?স্বামী আমি তোমার।একটুতো সম্মান করো।জানো আমার মতো হ্যান্ডসাম,ড্যাসিং ছেলে তুমি আর পাবেনা।আদ্র এই একপিসই আছে।বুঝলে?
ইমু: তোরে তো আমি….
আদ্রকে আর পায় কে?আদ্র দৌড়।আদ্রের পেছনে পেছনে ইমুও দৌড়াচ্ছে।ওদের দেখে লিয়া আর সামুও অবাক।এরমধ্যে লাবিব এসেও হা করে দাড়িয়ে রইলো।লিয়া এবার বিরক্ত হয়ে গেলো।
লিয়া: থামোওওও(জোরে)।এই দুজনেই এখানে বসো।এখনি।এবার বলো কি হয়েছে কালকে।আর কিসব বউ বউ হচ্ছে?
লিয়ার কথায় হালকা হেসে আদ্র সবটা ওদের খুলে বললো।লিয়া,সামু আর লাবিব আরেকদফা অবাক হলো।
লাবিব: মানে আপনিই জমিদার অনুভব!!!পূনর্জন্ম?স্যার স্যার আমাকে কেন এসব আগে বললেন না?ইস্ তাহলে আমিও কালকে থাকতাম।দুয়েকটা দিতাম ওই ব্যাটা তাসমিরকে।
লিয়া: এহ্ এমন ভাব করছে যেন কত সাহসী😏
লাবিব: এইযে মিস ললিপপ,আপনি জানেননা আমি কত সাহসী।
লিয়া: হোয়াট?আমি? আমি ললিপপ?
লাবিব: স্যার?বিয়ে খাবো।
আদ্র: খাও।না কে করেছে?
লাবিব: আপনাদের বিয়ে।ম্যাম?বিয়ে কবে করছেন?
ইমু: ম মানে আসলে এসব আপনার স্যারকে জিজ্ঞাসা করুন।আমি চা নাস্তা বানিয়ে আনি।
সামু: চল আমিও যাই।চাচাতো এখন নেই।ইস্ চাচাকে কত খারাপ কথা বলেছি।অথচ এখন বুঝতে পারছি এই কদিনে উনি আমাদের জন্য কি হয়েছেন।
ইমু: হুম চল।
লিয়া: আমিও যাই। আদ্র ভাইয়া? আপনার এই লালবাঁদর ভাইকে বলবেন যেন আমার পেছনে না লাগে।
লাবিব: আমিতো সামনেই আছি।পেছনে কোথায় লাগলাম?
লিয়া: তারমানে স্বীকার করলেন আপনিই লালবাঁদর?(বাঁকা হেসে)
লাবিব: আভ মানে ইয়ে-
লিয়া: চল চল আজকের খাবার রেডি করি।গার্লস ফলো মি।
লিয়া,ইমু আর সামু চলে গেলো ।লাবিব এখনো ভেবলার মতোই তাকিয়ে আছে।
আদ্র: তা লাবিব?লিয়াকে কেমন লাগে?বিয়ে করা যায়?
লাবিব: আস্ত একটা ফাজিল মেয়ে।ললিপপ কোথাকার।জীবনেও এরে বিয়ে করবোনা।
আদ্র: ওওও,,মানে ভেবেছিলে করবে?
লাবিবা: হ্যা।এ্যা?না না স্যার।ধুর মানে আসলে-
আদ্র: থাক থাক যা বোঝার বুঝে গিয়েছি।মেয়েটা খুব ভালো।তোমার সাথে একটু ঝগড়া করে মজা করে।
লাবিব: আচ্ছা স্যার থাক ওসব।আপনার বিয়ে কবে হচ্ছে তাই বলুন।
আদ্র: বাবা-মাকে বলতে হবে।মায়ের ডক্টর দেখানো হলেই বলবো আসতে।ভাবছি এখানেই বিয়ে করবো।
লাবিব: হ্যা স্যার দারুন হবে।আর এখনতো কোনো সমস্যাও নেই।
আদ্র: হুম।তবে কাউকে জানানো যাবেনা আমরাই অনুভব আর মৃন্ময়ি।ছোট্ট একটা নাটক করতে হবে।
লাবিব: কি নাটক?
আদ্র: কাউকে বড় দরবেশের মতো সাজিয়র এনে গ্রামের সবাইকে বিশ্বাস করাতে হবে সে ওসব আত্মা দূর করে দিয়েছে।তারপর বিয়ে।বুঝেছো?
লাবিব: হয়ে যাবে।আজকেই একটাকে ধরে আনছি।নিশ্চিন্ত থাকুন।
আদ্র: আচ্ছা।মায়ের সাথে কথা বলি এখন বসো।
আদ্র: ওর মা বাবাকে কল করে সবটা বললো।তারাও খুশিমনে রাজি হয়েগেলো।প্ল্যানমতো গ্রামের সবাইকে জমিদারবাড়িরে জরো করে ছোটখাটো একটা ভুত তাড়ানোর নাটক হলো।সবাই খুব খুশি।গ্রামের সহজসরল মানুষগুলো আদ্র আর ইমুর বিয়ের কথা শুনে নাচতে লাগলো।তারা সব দায়িত্ব নিজেদের কাধে তুলে নিলো।দুইদিন পরে আদ্রর মা-বাবাও চলে এলো।তারাও ছেলের বউকে দেখে খুব খুশি।সবার মত নিয়ে জমজমাটভাবেই বিয়ে হলো।সবাই জমিদােবাড়ি ঘিরে থাকা ভয় ভুলে আনন্দে মেতে উঠলো।
–
–
–
আগের মতোই ইমু বিছানায় বসে আছে।আদ্র রুমে ঢুকতেই ইমু নেমে ওকে সালাম করলো।আদ্রও ইমুকে জড়িয়ে নিলো নিজের বুকে।
আদ্র: সব বাধা ভেঙে আমরা আজ এক হলাম।আমাদের ভালোবাসা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হলো।
ইমু: আমি ভাবিইনি এসব হবে।সবটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
আদ্র: ভালোবাসি মিনি।আর হারাতে চাইনা তোমায়।
ইমু: আমিও আর হারাতে চাইনা তোমায় অনি।খুব বেশি ভালোবাসি।
…..
সারাবাড়ি দৌড়ে বেরাচ্ছে ইমু।হাতে খাবারের বাটি।সামনে ৪ বছরের ছোট্ট আরাফ।
ইমু: বাবা একটু দাড়া।এটুকু খেয়ে নে।
আরাফ: না না পাপা আসলে খাইয়ে দিবে।
ইমু: পাপা এসে পরবে।সাথে দাদা,দাদিও আসবে।কিন্তু আগেতো খাবারটা শেষ কর।দাড়া বলছি।
আরাফ কথা না শুনে দৌড়ে দরজার সামনে যেতেই আদ্র ওকে কোলে তুলে নিলো।
আদ্র: কি ব্যাপার চ্যাম্প?এভাবে দৌড়াচ্ছো কেন?
আরাফ: পাপা আমি তোমার কাছে খাবো।মামুনিকে বলে দাও।আচ্ছা দাদাভাই আর দাদুমনি কোথায়?
সানভির: এইতো আমি।কেউতো আমাকে ভুলেই গিয়েছে।
আরাফ পাপার কোল থেকে নেমেই সানভিরের কোলে উঠে গালে চুমু দিলো।
আরাফ : তোমাকে ভুলিনিতো।প্রতিদিনইতো মামুনির মোবাইল থেকে কথা বলেছি।
আ : হুম তোমার দাদাভাই হিংসুটে।
আরাফ: ঠিকঠিক।
সানভির: তবেরে?আমার কোলে উঠে আমাকেই হিংসুটে বলা?
আরাফ: আআআআ,,,দাদুমনি দাদাভাই মারছে।
সানভির: এ্যা!!কোথায় মারলাম?
ইমু: এই ছেলেটা ভীষন পাজি বাবা।
আরাফ: তোমারইতো ছেলে মামুনি।😁
ইমু: হয়েছিসতো বাবার মতো পাজি।
আদ্র: তাই?আমি পাজি তাইনা?আচ্ছা মনে থাকবে।দেখাচ্ছি আজ তোমায় পাজি কি করতে পারে।
ইমু আদ্রের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিললো।
ইমু: আভ মা? বাবা? তোমরা ফ্রেশ হয়ে নাও।আরাফ বাবা?নামো।ওনারা জার্নি করে এসেছে।পরে আবার খেলবে।আমি খাবার দিচ্ছি তোমরা ফ্রেশ হয়ে খেতে আসো।
–
–
–
রাতে আদ্র রুমে এসেই দেখলো ইমু অন্যদিকে ফিরে শুয়ে আছে।আদ্র মুচকি হেসে ইমুর পাশে শুয়ে ওকে নিজের দিকে ফিরালো।
আদ্র: তুমি এখনো ভালো অভিনয় করতে পারোনা মিনি।ঘুমাওনি তা জানি।
ইমু: উমম,ঘুমাতে দাও।
ইমুর অভিনয় করা ঘুমুঘুমু কন্ঠ শুনে আদ্র হেসে ইমুকে সুরসুরি দেয়া শুরু করলো।ইমুও খিলখিল করে হেসে উঠলো।
ইমু: আরে আরে ছাড়ো।আচ্ছা আচ্ছা ঘুমাইনিতো।আরে ধুর।হিহি ছাড়ো।
আদ্র ইমুকে জড়িয়ে ধরলো।
আদ্র: মিনি?
ইমু: বলো।
আদ্র: ভালোবাসি।
ইমু: আমিও ভালোবাসি।
আদ্র: এভাবেই যেন সারাজীবন একসাথে থাকতে পারি।আমাদের ভালোবাসায় যেন কখোনো ফাটল না ধরে।
ইমু: ইনশাআল্লাহ্ আমরা সারাজীবন এভাবেই ভালোবাসে একসাথে থাকবো।
আদ্র: আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেলো।আমাদের অসম্পূর্ন ভালোবাসাকে আল্লাহ্ সম্পূর্ন করলো।সব অন্ধকারের মায়াজাল থেকে আমরা মুক্তি পেলাম।এভাবেই ভালোবাসতে চাই তোমাকে।
ইমু কিছু না বলে মুচকি হেসে আদ্রকে জড়িয়ে ধরলো।হারিয়ে গেলো ভালোবাসার রাজ্যে।যেখানে কোনো অন্ধকারের মায়াজাল নেই।আছে শুধু ভালোবাসা।
_________সমাপ্ত_________
গল্পটা খুব সুন্দর ছিল😍😍😍