স্বপ্নফড়িং|ছোট গল্প

স্বপ্নফড়িং|ছোট গল্প
লামিয়া আক্তার রিয়া

: মুগ্ধ,তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।একবার আসবে?

: এখন?এতরাতে কিভাবে?

: তাহলে কালকে?

: কাজের প্রচুর চাপ মেধা।তুমিতো জানোই‌ সব।নতুন প্রজেক্টের জন্য অনেক প্রেশারে আছি।এই প্রজেক্টটা ভালোভাবে শেষ করলেই প্রমোশন হবে।তখন তোমাকে বিয়ে করতে কোনো বাধাই থাকবেনা।

: জানি।

: হুম আর ২ সপ্তাহ আগেই তো দেখা করলাম।

: হুম।তাও কেন ইচ্ছে করছে জানিনা।

: কি হয়েছে তোমার?কন্ঠ এমন লাগছে কেন?

: কিছুনা।কেমন আছো তুমি?

: প্রশ্নটা ইগনোর করছো?আচ্ছা কথা দিচ্ছি যদি সুস্থ থাকি তাহলে আগামি সপ্তাহেই দেখা করবো।আসতেও তো অনেকটা সময় লাগবে।

: আচ্ছা।ঘুমাও এখন।অনেক ধকল গিয়েছে সারাদিন। ক্লান্ত তুমি।

: হুম তা একটু ক্লান্ত।কিন্তু তুমি কি করবে?

: ঘুমাবো।

: এখনি?পড়বেনা?

: নাহ্।

: মাথায় আবার ব্যথা করছে তাইনা?

: ………

: গত দুইটা বছর ধরে ডাক্তার দেখাতে বলছি দেখাওনি।প্রত্যেকবার অযুহাত।কোনো কথাই‌ কি শুনবেনা তুমি?

: রাগ করছো কেন?

: তাহলে কি আদর করবো?এবার এসে আমিই নিয়ে যাবো।ছুটি নিয়ে আসবো।তোমার কোনো কথা আর শুনবোনা।

: আচ্ছা আচ্ছা।এবার ঘুমাওতো।কালকে আবার সকালে অফিসে যাবেতো।

: হুম যাবো।মেজাজটাই খারাপ করে দিলে।

: হুম বকলেও আমাকে।

: সরি।ঘুমিয়ে পরো।শুভরাত্রি।

: শুভরাত্রি।

কল কেটে ছেলেটা ঘুমিয়ে পরলো।এদিকে মেয়েটার মুখেও হাসি।তবে চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পরছে।ডাক্তার যা বলেছে তা সত্যি হলে ছেলেটা মানতে পারবেতো?প্রতিদিনের মতো নিজের অতিত ভাবতে লাগলো।

প্রতিদিনের মতো আজও টিউশনি শেষে বাসার উদ্দেশ্যে হাটতে লাগলো মেধা।রিকশায় যেতে ৫০ টাকা লাগবে।এটা ওর কাছে অনেক টাকা।বাসও পাচ্ছেনা তাই হেটেই রওনা দিলো।

মা-বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে ছিলো মেধা।বাবা কারখানার সামান্য শ্রমিক হলেও ভালোবাসার অভাব ছিলোনা তাদের ছোট্ট ঘরে।বাবা মেধার কাছে হিরো।ভিষন ভালোবাসে সে বাবাকে।

হঠাৎ একদিন খবর এলো বাবা আর নেই।কাজ করতে যেয়ে কারেন্টে শক খেয়ে বাবা চলে যায় না ফেরার দেশে।তখন মেধার বয়স ১৬। ক্লাস নাইনের মেধাবি মেয়েটাও বুঝতে পারছিলোনা কি হচ্ছে।সামনে বাবা শুয়ে,পাশেই মা কাতরাচ্ছে।আর মেধা?সে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে বাবার দিকে তাকিয়ে।

হঠাৎ কেউ বলে উঠলো মেধার মাকে হাসপাতালে নিতে হবে।তাতেও মেধার নরচর নেই।তাই প্রতিবেশিরাই মাকে নিয়ে গেলো।কি হয়েছে মায়ের?সবাই যখন বাবাকে তুলে নিলো তখনও শুন্য দৃষ্টিতে খাটিয়ার দিকে তাকিয়ে মেধা।বাবাকি আর বলবেনা,”মেধা মা অনেক বড় হবে।আমাদের নাম উজ্জল করবে।”আর কি বাবা জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাবেনা?

মেধা প্রায় এক সপ্তাহ নিজেকে গৃহবন্ধি রাখলো।অনেক কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করেছে।বাবা মারা যাওয়ার পরে সবার আসল রূপ দেখেছে মেধা।মায়ের নাকি হার্ট এ্যাটাক হয়েছে।একপাশ প্যারালাইস্ড হয়ে গেছে।ঘরের কাজ,নিজের পড়াশুনা,বাবার স্বপ্ন আর অর্থ উপার্জন সবই মেধার উপরে।মেধা সব হাসিমুখে মেনে নিলো।ভালো ছাত্রী হওয়ার সুবাদে কয়েকটা টিউশনিও পেয়ে গেলো।

রহিমা বেগম আর নিতে পারছেন না।স্বামী মারুফ মারা যাওয়ার পর থেকে আদরের মেয়েটার এত কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারছেন না।নিজেকে বোঝা মনে হচ্ছে।মনে ভেসে আসছে সে মারা গেলে মেয়েটার কি হবে?কিন্তু পরক্ষনেই ভাবছে মেয়েটা বড় হয়ে গেছে।নিজের দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে।উনি প্রানপনে নিজের মৃত্যু কামনা করেন।৪ বছর পরে আল্লাহ্ তার ইচ্ছে পূরন করলেন।

অন্যান্যদিন রাত ৮টা বাজে টিউশনি শেষে বাসায় ফিরতে।পাশের বাড়ির ময়না চাচি দুপুরে মাকে খাবার দেয়।মেধা সব রেডি করে রেখে আসে।আজ মনটা কেমন খচখচ করছে তাই সন্ধ্যা ৬টায়ই বাসায় আসে মেধা।বাসার সামনে ভিড় দেখে বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো।ভিড় ঠেলে ভেতরে এলো ‌মেধা।সবাই কেমন করে যেন তাকাচ্ছে।মা নিচে শুয়ে কেন?ঘুমাচ্ছে?আজকে মাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছে কেন?

মেধা কাধের কলেজ ব্যাগটা রেখে ধিরপায়ে মায়ের দিকে এগিয়ে এলো।মায়ের পাশে বসেই মেধা মায়ের হাত ধরে আৎকে উঠলো।

মেধা: মা?এই ঠান্ডায় নিচে ঘুমাচ্ছো?ইস্ হাত কি ঠান্ডা হয়ে গেছে।তোমার ঠান্ডা লাগলে আমি কি করবো বলোতো। এই সন্ধ্যায় ঘুমাচ্ছো কেন?তুমিই তো বলো সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে থাকতে হয়না।এই‌ মা ওঠো।এখনি আজান দিবে।অজু করিয়ে দেবো নামাজ পরবেনা মা?

আজ অনেক ক্লান্ত লাগছে।তুমিতো জানোই আজ আমার পরীক্ষা শেষ।খুব ভালো হয়েছে পরীক্ষা।দেখো আমি এ+ পাবো।তোমার আর বাবার স্বপ্ন পূরনের পথে আরো একধাপ এগিয়ে গেলাম মা।

মাগো ওঠো?তোমার ডানহাত তো ঠিক আছে।আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেনা মা?মাথাটা যে বড্ড ধরেছে।ওঠো মা।

আচ্ছা মা আজ তোমায় এতো সুন্দর লাগছে কেন?মনে আছে মা বাবা থাকতে যখন তুমি ভালোকিছু রান্না করতে তখন রান্না শেষে গোসল করে কি সুন্দর করে চোখে কাজল দিতে।খোলাচুলে তোমায় কিযে সুন্দর লাগতো।বাবা তোমায় কাজললতা বলতো।তোমার মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে যেতো।কিন্তু আজকে তোমায় তার থেকেও বেশি সুন্দর লাগছে।মনে হচ্ছে আল্লাহ্ যেন তাঁর সব নূরের আলো তোমার উপরে ঢেলে দিয়েছে।আজ আমার ভিষন হিংসা হচ্ছে মা।শুনছো মা?সবটা শোনোনা মা।উঠে পরো।

ধুর বাবা আমার ক্ষুধা লেগেছেতো।আজকে এক ছাত্রের মা বেতন দিয়েছে।তোমার প্রিয় হালিম আর নানরুটি এনেছি।সাথে কাচ্চিও এনেছি।আজ রাতে জমিয়ে খাবো দুই মা মেয়ে।তুমি কিন্তু আজ খাইয়ে দিবে আমায়।খাবেনা মা?এই মা?মাগো?ওঠোনা মা।আমার ক্ষুধা লেগেছেতো।তোমাকে রেখে খাবো কিভাবে মা?ওঠোনা মা।বাবার মতো তুমিও আমায় ছেড়ে দিওনা মা।ওঠো মা।ওঠো।মা…….

না,মা আর ওঠেনি।বাবার মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে গেলেও মায়ের মৃত্যুতে চিৎকার করে কেঁদেছে মেধা।মা হারা মেয়ের কান্নায় সেদিন চারপাশ থমথমে হয়ে গেছে।উপস্থিত সবার চোখে পানি।

কয়েকমাস পরে মেধার রেজাল্ট দেয়।বরাবরের মতোই মেধা ফার্স্ট।ততদিনে নিজেকে শক্ত করে নিয়েছে মেধা।ভেঙে পরলে হবেনা।বাবা‌ মায়ের স্বপ্নতো পূরন করতে হবে।

ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েও নিজের স্বপ্ন পূরনের পথে এগিয়ে গেলো।টিউশনি করে নিজের খরচ চালায়।মুগ্ধর সাথেও টিউশনির মাধ্যমেই দেখা।মুগ্ধর এক বন্ধুর ছোটবোনকে পড়াতো মেধা।দেখে পছন্দ হয়।মেধা অনেকবার না করলেও মুগ্ধ হাল ছাড়েনি।অবশেষে মেধাও ভালোবেসে ফেলে মুগ্ধকে।মুগ্ধ একটা প্রাইভেট কম্পানিতে চাকরি করে।মা সাথেই থাকে।মায়েরও মেধাকে পছন্দ।ভিষন মিষ্টি আর নম্র স্বভাবের।মেধার মা বাবা নেই শুনে তিনিও কষ্ট পান।

মেধা গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হলেই বিয়ে করবে বলেছে কিন্তু মুগ্ধ এতদিন মেধাকে আলাদা রাখবেনা।মেয়েটা স্বপ্নের পিছে ছুটে নিজের যত্ন নেয়না।তাই নিজের প্রমোশন হলেই মেধাকে বিয়ে করে নিজের কাছে নিয়ে আসবে।

একসপ্তাহ চলে গেলো।গত দুইদিন আগেই প্রজেক্টের কাজ শেষ হয়েছে।মুগ্ধর প্রমোশনও হয়েছে।মাকে নিয়েই বেরিয়ে গেলো মুগ্ধ।উদ্দেশ্য তার ভালোবাসার সাথে দেখা করা।কালকে থেকেই পাগলিটা ফোন বন্ধ করে রেখেছে।পরশু কান্না করছিলো আর কিসব উল্টোপাল্টা কথা বলছিলো।মুগ্ধর খুব কষ্ট হয়েছে মেধার মুখে মারা যাওয়ার কথা শুনে।কিন্তু মাও অসুস্থ তাই রাতে না বেরিয়ে খুব সকালেই বেরিয়ে পরলো।

মুগ্ধ এখন দাড়িয়ে মেধার বাসার সামনে এখানেই মেধা তার বান্ধবিদের সাথে ভাড়া থাকে।দরজা নক করতেই তানিসা বেরিয়ে এলো।মুগ্ধকে দেখেই ওর চোখ বড়বড় হয়ে গেলো।

তানিসা: ভাইয়া!!আপনি এখন এসেছেন?আপনি জানেননা মেধার অবস্থা?আপনি ব্যস্ত মানছি তাই ‌বলে এই ‌অবস্থায়ও মেয়েটার পাশে থাকবেন না?

তানিসা মুখ চেপে কেঁদে ফেললো।মুগ্ধ আর তার মা অবাক হয়ে তাকিয়ে।

মুগ্ধ: কি হয়েছে তানিসা?মেধা কোথায়?ওকে বলো আমি এসেছি।দেখো আমার মাও এসেছেন।মাকে তোমাদের বাসায় রাখো।আর ওকে বলো রেডি হতে।আজই ডাক্তার দেখাবো।

তানিসা: ভেতরে আসুন।

মুগ্ধ তার মাকে নিয়ে ভেতরে বসলো।তানিসা এখনো মুখে ওরনা চেপে রেখেছে।মুগ্ধর বিরক্ত লাগছে।মেধা কোথায়?তানিসা একটা কাগজ মুগ্ধর হাতে দিলো।

মুগ্ধ: কি এটা?

তানিসা: মেধার চিঠি।ও জানতো আপনি আসবেন।আপনার জন্য রেখে গেছে।

এই মেয়েটার কাজও উল্টোপাল্টা।কোথায় আছে কে জানে।তানিসাও কিছু বলছেনা।বিরক্তি নিয়ে চিঠি খুললো মুগ্ধ।ভেসে উঠলো মেধার হাতের লেখা।

প্রিয় মুগ্ধ,

জানি বিরক্ত হচ্ছো।তানিসা কিছু বলেনি তাইনা?জানোইতো ও একটু এমনি।আমি জানতাম তুমি ঠিকই আসবে।আমায় ভালোবাসোতো।এই তুমি কি সত্যিই মাকে নিয়ে এসেছো?ইস্ মানুষটার কত কষ্ট হবে এত জার্নিতে।তবে ভালোই হলো।মা তোমাকে সামলাতে পারবে।

আজ লিখতে খুব কষ্ট হচ্ছে।মাথা ব্যথায় ছিড়ে যাচ্ছে।চোখ খুলে রাখতে পারছিনা।তোমার স্বপ্ন ছিলো এই প্রজেক্টটা।আমি খুব খুশি তোমার প্রমোশন হয়েছে তাই।কিন্তু মিষ্টিটা খেতে পারলামনা। এটাই হয়তো আমার লেখা শেষ চিঠি।তোমার কথা শুনেছিলাম আমি।শেষবার যখন দেখা হয়েছিলো তখন আমায় বকেছিলে ডাক্তার দেখাইনি বলে।তারপর আমি গিয়েছিলাম ডাক্তার দেখাতে।কিন্তু টেস্ট করে যা জেনেছি তা তোমাকে জানালে তোমার স্বপ্ন পূরন হতোনা।আমার ব্রেন টিউমার হয়েছে মুগ্ধ।শেষ পর্যায়ে আছি আমি।এমন অবস্থা যে অপারেশন বা ঔষধে কাজ হবেনা।ডাক্তার বলেছে আমার হাতে আর দুই বা আড়াই সপ্তাহ আছে।যখন জানিই আমি বাঁচবোনা তখন তোমার স্বপ্নের পথে বাধা দেয়ার কোনো মানে হয় বলো?

এই‌এই একদম চোখের পানি ফেলবেনা।তুমি দেখতে পাবেতো আমায়।আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।তুমি নিজের হাতে আমায় কবরে নামাবে।
আজ খুব কষ্ট হচ্ছে জানো,আমি আমার‌ মাবাবার স্বপ্ন পূরন করতে পারলাম না।কিন্তু আমার স্বপ্ন তুমি।কখোনো এমন কিছু করবেনা যাতে নিজের বা মায়ের কষ্ট হয়।তাহলে আমারো কষ্ট হবে।তুমি আমাকে কষ্ট দেবে বলো?জানি দেবেনা।আমার কথা রেখো প্লিজ।

এই‌চিঠি যখন তুমি হাতে পাবে তখন আমি বেঁচে থাকবো কিনা জানিনা।তবে বিশ্বাস করো তোমাকে আর মাকে আর পাবোনা জেনে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।ভালোবাসি মুগ্ধ।ভিষন ভালোবাসি তোমাদের।ভালো থাকো।আল্লাহ হাফেজ।

ইতি
তোমার মেধা।

চিঠি পড়ে মুগ্ধ কাঁদতে লাগলো।মা মুগ্ধকে ধরে রেখেছি।তিনিও পড়েছেন চিঠি।কিছুক্ষন পর মুগ্ধ কান্না থামালো।

মুগ্ধ: কোথায় ও?

তানিসা মুগ্ধকে একটা হাসপাতালের মর্গে নিয়ে এলো।শুয়ে আছে মেধা।মুখে হাসি ঝুলে আছে।

মুগ্ধ: বাহ্ আমায় এভাবে কষ্ট দিয়ে নিজে হাসতে হাসতে চলে গেলে?কেন এমন হলো মেধা?ভালোবেসেও কেন হারিয়ে ফেললাম তোমায়?

মুগ্ধ সব ফর্মালিটি শেষ করে মেধাকে কবরে শুইয়ে দিলো।সুখের ঘুম ঘুমাচ্ছে মেধা।শেষবার নিজের ভালোবাসাকে প্রানভরে দেখে নিলো মুগ্ধ।নিজের মনে সারাজিবনের জন্য মেধার মায়াভরা মুখটা গেথে নিলো।

……..সমাপ্ত……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here