হৃদয়ের_কোনো_ঠিকানা_থাকেনা
পর্বঃ০২
জাহান আরা
রাত ৯টা।
খাওয়াদাওয়া সেরে ড্রয়িংরুমে লম্বা হয়ে শুয়ে আছি আমি।মাথায় এলোমেলো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।
বাসায় এসে দেখি আপার রুম ফুল দিয়ে সাজানো,পাশাপাশি বাসাভর্তি আপার শ্বশুর বাড়ির মেহমান।
এতো কিছু হয়ে গেছে অথচ আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাই নি।আমার ইচ্ছে করছে আমার মা কে গিয়ে একটা স্যালুট করি।
কি বুদ্ধিমতী আমার মা!
মায়ের ভাগ্য ভালো মা মুক্তিযুদ্ধকালীন ছিলো না।তা না হলে ৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর অন্যসব বুদ্ধিজীবীদের সাথে আমার মা কেও শহীদ হতে হতো এতো বেশি বুদ্ধিমতী হওয়ায়।
কে জানে,হানাদার বাহিনীর ফার্স্ট টার্গেট হয়তো আমার মা হতো।
আচ্ছা কি এমন ক্ষতি হতো যদি মা একটু বড় খালাকে বুঝাতো?
বড় আপার মতো এরকম একটা শান্ত মেয়ের কপালে এতোবড় কষ্ট কেনো হবে আমি সেটাই মানতে পারছি না।
না পারছি মানতে সজল ভাইয়ের সাথে এই অবিচার।
আপা খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে,ভিতরে হাজার ও যন্ত্রণা বয়ে বেড়াবে তবুও কাউকে বুঝতে দিবে না।সজল ভাই ছিলো একমাত্র ব্যক্তি যাকে না বললেও তিনি বুঝে যেতেন আপার কি চাই।
এখন কে বুঝবে আপাকে?
আমার বোন নেই,বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে আমি,আপার থেকে আমি বোনের আদর পেয়েছি।
টিফিনের টাকা জমিয়ে আপা আমার জন্য কতোকিছুই না কিনে আনতো।অথচ আমি পারি নি আপার একটা উপকার করতে।
নিজেকে ভীষণ অপদার্থ মনে হচ্ছে আজ।আচ্ছা আমার কি উচিৎ সজল ভাইকে বলে দেওয়া?
যদি মা জানতে পারে আমাকে আস্ত গিলে খাবে,এতোটা সাহস হয় নি আমার।
নিজের দুরবস্থা ভেবে নিজেরই হাসি পাচ্ছে।
ভাবতে ভাবতে কখন যেনো সোফায় ঘুমিয়ে গেলাম।
ঘুম ভাঙলো পরের দিন সকাল ৮ টায়।
উঠে দেখি সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে,কিচেনে মা,খালা,মামীরা সহ রান্না করছে।
আমি উঠে গেলাম বড় আপার খোঁজে।
পুরো বাসা খুঁজে ও আপাকে পেলাম না।অবশেষে খুঁজে পেলাম আপাকে ছাদে গিয়ে।
কামিনী গাছটির নিচে আপা বসে আছে হেলান দিয়ে।
আপার গলার দিকে তাকাতেই আমি শিউরে উঠলাম,নিজের অজান্তেই বলে দিয়ে উঠলাম,”শালা জানোয়ারের বাচ্চা!”
চমকে উঠে আপা ওড়না মাথায় তুলে দিলো,ঢেকে নিলো গলা।আপার গলায় কামড়ের দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে,যেনো কেউ কামড়ে মাংস তুলে নিয়েছে।
এটাকেই রোমাঞ্চ বলে?
এরকম নৃশংসভাবে!
কামিনী গাছটি ডালপালা ছড়িয়েছে অনেক।ছোট ছোট সবুজ পাতা গাছে,এখন ফুল নেই।বর্ষায় ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় এই গাছ।কি ভীষণ মিষ্টি ঘ্রাণ এই ফুলের।আপা মালা বানিয়ে খোঁপায় পরে,খোঁপায় মালা পরার একটা শখ আপার আছে।
আমার মনে পড়ে গেলো গতকালের মালার কথা।
হতভাগা সজল ভাই জানেও না,পরম ভালোবেসে আপার জন্য কেনা বেলী ফুলের মালা হাসপাতালের ময়লার ঝুঁড়িতে পড়ে আছে।
এই গাছটা সজল ভাই কিনে দিয়েছিলো আপাকে।আপার বাগান করার ভীষণ শখ,বাগানের জন্য গাছ কেনার দায়িত্ব ছিলো সজল ভাইয়ের।আপাকে প্রথমবার সজল ভাই প্রপোজ করেছিলো একসাথে অনেকগুলো ফুল ফল গাছে দিয়ে।তার মধ্যে একটি এই কামিনী গাছ।
সেদিন আমরা সবাই খুব হেসেছিলাম।হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়েছি কাজিনরা সবাই মিলে।এরকম অদ্ভুত প্রপোজ দেখে।
কিন্তু আপা কনভিন্স হয়ে গেছিলো এতেই।
ক্লান্তস্বরে আপা আমাকে জিজ্ঞেস করলো,”এভাবে কি বেঁচে থাকা যায় রে পরী?”
কি জবাব দিবো আমি এই প্রশ্নের?
পৃথিবীর সব উত্তর থেমে গেছিলো যেনো আপার এই প্রশ্ন শুনে।
দুচোখ ছাপিয়ে জল এলো আমার,আপা যেনো মূর্তি।
আমি কেঁদে উঠে বললাম,”আপা তুমি চলে যাও,পালিয়ে যাও আপা সজল ভাইয়ের সাথে,সজল ভাই মরে যাবে তোমাকে ছাড়া,আর না বাঁচবে তুমি ভালোভাবে। ”
শুষ্ক ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে জবাব দিলো আপা,”না রে পরী,তা হয় না।অনেক দেরি হয়ে গেছে যে”
তারপর উঠে চলে গেলো আপা।আমি আপার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
১১টায় আমার ক্লাস আছে,মা’কে বলে বড়খালার বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। টিএসসি তে আসতেই দেখি সজল ভাই বসে আছে।
আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো,ভয়ে কেঁপে উঠলাম আমি।গলা শুকিয়ে কাঁঠ হয়ে গেলো।
কি বলবো যদি আমাকে আপার কথা জিজ্ঞেস করে এখন?
মুচকি হেসে সজল ভাই জিজ্ঞেস করলো আমাকে,”পরী,তোমার ডানা গজাবে কবে বলো তো?ডানা থাকলে তো তোমার ডানা নিয়ে তোমার আপাকে নিয়ে আমি উড়ে চলে যেতাম অনেক দূরে।”
অথচ সজল ভাই জানেই না আজকের রাতটা পার হলে আপা-ই চলে যাবে অনেক দূরে।
পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে সজল ভাই আমার হাতে দিলো।
তারপর চলে গেলো বাইক নিয়ে।বাকীটা সময় আমার কাটল ভীষণ অস্থিরতায়।ক্লাসে বসে আমি কিছুতে মনোযোগ দিতে পারলাম না আর।
একটা ক্লাস শেষ করেই ছুটলাম বড় খালার বাসার দিকে।
আপা সোফায় বসে টিভি দেখছে।খুব মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছে।অথচ টিভির দিকে তাকিয়ে দেখি টিভি বন্ধ।কারেন্ট চলে গিয়ে টিভি বন্ধ হয়ে গিয়েছে অথচ আপার সেই খেয়াল নেই।
“আপা” বলে আপাকে ধরে ঝাঁকি দিতেই আপা হকচকিয়ে গেলো।
“কি,কি,কি হয়েছে?” বলে উঠলো।
আপার দিকে তাকালাম আমি,একরাতেই আপার চোখের নিচে কালি পড়েছে,টুকুটুকে দুই ঠোঁট কালশিটে হয়ে আছে।গোলগাল ফর্সা মুখটি শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গিয়েছে।
চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।
আমার বুকের ভিতর কিসের ঝড় উঠলো আমি জানি না।শুধু জানি আমি আমার পরিবারের সবাইকে ভীষণ ঘৃণা করি।
পার্স খুলে চিঠি বের করে আপার হাতে দিয়ে বললাম,”সজল ভাই দিয়েছে এটা তোমার জন্য”
কেঁপে উঠলো আপা সজল ভাইয়ের নাম শুনে,তারপর চিঠি আমার হাতে দিয়ে বললো,”না পরী,আমি এ চিঠি দেখবো না,পড়বো না,তুই ফেলে দে।”
এটুকু বলে কাঁদতে কাঁদতে আপা দৌড়ে চলে গেলো নিজের রুমে।
চিঠি নিয়ে আমি ছাদে চলে এলাম।কামিনী গাছের নিচে বসে কাঁপাকাঁপা হাতে বের করলাম চিঠি।
“ওহে,কি করিলে বলো পাইবো তোমারে,রাখিবো আঁখিতে,আঁখিতে।”
এক লাইনের ছোট্ট চিঠি,অথচ আমার কলিজা যেনো কেঁপে উঠলো।
হায় রে অভাগা!
তুই জানিস ও না,তাকে যে আর কিছুতেই পাবি না।
কি জানি কেনো,সজল ভাইয়ের জন্য আমার প্রচণ্ড কষ্ট হতে লাগলো।আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে,চৈত্র মাস শেষের দিকে।যেকোনো সময় কালবৈশাখী ঝড় হতে পারে।
আচ্ছা,এরকম একটা ঝড় কেনো হয় না,যেই ঝড় উড়িয়ে নিয়ে যাবে এই সমাজ থেকে বর্ণবাদ,বডি শেমিং?
সবার ভালোবাসাকে যেই ঝড় মিলিয়ে দিবে।
চলবে…..