#কোথাও_কেউ_নেই
হুমায়ুন আহমেদ
২৪.
ঝড় মাথায় করে মামুন জাহানারাদের বাসায় এসে উঠল। হলুস্থূল কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। চোখের সামনে একটা ইলেকট্রিসিটির পিলার ভেঙে পড়ল। এত পলকা ধরনের পিলার বানায় নাকি আজকাল? ধরক করে আগুন বেবী হয়ে বিকট শব্দ। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জাহানারাদের বাড়ির সামনের কাঠাল গাছের একটা ডাল ভেঙে টিনের চালে পড়ল। আগের বারের চেয়ে ও বিকট শব্দ হল। তারপর শুরু হল শিলাবৃষ্টি। গত পাঁচ বছরে ঢাকা শহরে এ রকম শিল পড়েনি।
জাহানারাদের ঘরে দরজা-জানালা সব বন্ধ। অনেকক্ষণ দরজায ধাক্কাধাব্ধি করার পর ভেতর থেকে জাহানারা ভীতিগলা শোনা গেল কে?
আমি। আমি মামুন।
বিস্মিত জাহানারা দরজা খুলতে খুলতে বলল, আপনি এখানে কী করছেন? আসবার আর সময় পেলেন না?
এ রকম ঝড় হলে বুঝতে পারিনি। টর্নেডো-ফার্নেডো কিনা কে জানে।
টর্নেডো নয় কালবোশেখি। ভেতরে আসুন। দরজা বন্ধ করে দেব।
জাহানারাদের বাড়ির একটা অংশ টিনের চাল। শিলা বৃষ্টির কারণে প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছে। একটা ঘরের জানালা খুলে গেছে। সেই জানালা আছড়ে পড়ছে বারবার। জাহানারা বলল, অন্ধকার বাদে থাকুন। আমি আগে ঘর সামলাই। মামুন কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে কী যেন বলল, শব্দের কারণে কিছু বোঝা গেল না। ভেতর থেকে জাহানারার মা চেঁচাচ্ছেন–কে এসেছে–কার সঙ্গে কথা বলছিস?
জাহানারা জবাব না দিয়ে ভেতরে চলে গেল। মামুন এই রকম সময়ে চলে আসায় তার একটু লজ্জা লজা করছে। আবার ভালও লাগছে। ঘরে শুধু সে আর মা। অন্যরা ফুপুর বাসায় বেড়াতে গেছে। রাতে থেকে যাবে। এতক্ষণ ভয় ভয় করছিল এখন ভয়ট কমেছে।
জাহানারা কিছুক্ষণ পর আবার এসে ঢুকল। হাসিমুখে বলল, আমাদের ছাদে প্রচুর শিল পড়েছে। শিল কুড়াবেন?
মামুন অবাক হয়ে বলল, শিল কুড়াব কেন? শিল কি আম নাকি?
আমি শিল কুড়াতে যাচ্ছি। আপনি আমার সঙ্গে আসুন তো! একা একা ভয় ভয় লাগছে।
শিল দিয়ে কি করবেন?
কিছু করব না। ছোটবেলায় কুড়াতাম এখন আবার ইচ্ছা করছে।
ঝড় কমুক।
ঝড় কমেছে। শুধু বাতাস দিচ্ছে। আসুন তাড়াতাড়ি, এত অনুরোধ করতে পারব না।
মামুন উঠে দাঁড়াল। আশ্চর্যাকাণ্ড উঠে দাঁড়ানোমাত্র জাহানারা বলল, থাক থাক এমনি বলছিলাম। ঠাট্ট করছিলাম। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ঠাট্টা করতে ভাল লাগে।
তাই নাকি? আমি অবশ্যি জানতাম না। আমি ভেবেছি আপনি বুঝি সত্যি সত্যি.
আমাকে কি আপনার কচি খুকি বলে মনে হয়?
না তা না। তবে আমার বড়রা অনেক সময় ছোটদের মত আচরণ করি।
তা অবশ্যি করি। এখন কি আপনি বড়দের মত একটা আচরণ করবেন? আপনাকে একটা টেলিফোন নম্বর দিচ্ছি। ঐ নম্বরে টেলিফোন করে খোঁজ নিয়ে আসবেন মীরারা ভাল আছে কিনা। মা চিন্তা করছেন। কোন একটা দোকানে বা ফামেসিতে টেলিফোন পাবেন।
নম্বরটা বলুন।
খুব সহজ নম্বর ৪৪২৩৪৫ মনে থাকবে না কাগজে লিখে দেব?
মনে থাকবে।
টেলিফোন করে আসুন তারপর চা খাবেন। নাকি আজও ঐ দিনের মত ভাত খেতে চান?
মামুন বিস্ময় বোধ করছে। জাহানারা কথা বলার ভঙ্গি তার স্বভাবের সঙ্গে মিশ খাচ্ছে না। বড় বেশি তরল গলায় কথা বলছে।
আজ খাবার কিন্তু ঐ দিনের চেয়েও খারাপ। ডিমের তরকারি এবং আলু ভাজা। খেতে পারবেন?
পারব।
জাহানারা হেসে ফেলল। তার হাসিটা খুব সুন্দর। যার হাসি সুন্দর তার কান্না নাকি কুশ্ৰী। জাহানারা কাঁদলে কেমন দেখাবে কে জানে। জাহানারা বলল, এ রকম মুখ গম্ভীর করে কী ভাবছেন?
মামুন বলল, কিছু ভাবছি না। আপনার জন্যে সামান্য একটা উপহার এনেছি। গল্পের বই। আপনার জন্মদিনের উপহার হিসেবে।
জাহানারা অবাক হলে বলল, আজ আমার জন্মদিন আপনাকে কে বলল?
মীরা বলেছিল। গতবার যখন এসেছিলাম। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
ওর কোনো কথা বিশ্বাস করবেন না। আজ হচ্ছে ওর জন্মদিন। ফুপু এই উপলক্ষে তাকে দাওয়াত করেছেন। গল্পের বইয়ে কী আপনি আমার নাম লিখেছেন?
জি না।
তাহলে এটা তাকেই দিন। এখন যান টেলিফোন করে আসুন। নম্বরটা মনে আছে?
জি আছে–৪৪২৩৪৫
আপনার স্মৃতিশক্তি তো চমৎকার।
মামুনের স্মৃতিশক্তি মনে হচ্ছে তেমন ভাল নয়। পানিতে ভিজে, কাদায় মাখামাখি হয়ে সে যখন টেলিফোনের একটা ব্যবস্থা করল তখন দেখা গেল নম্বর মনে নেই। ২৩ এবং ৪৫-এ গণ্ডগোল। কোনটা আগে কোনটা পেছনে কিছু মনে নেই। সব তালগোল পাকিয়ে গেছে।
হাসিনার শরীরটা আজ অন্য দিকে চেয়ে অনেক ভাল। ঝড়বৃষ্টির সময় ছোটাছুটি করে দরজাজানালা বন্ধ করেছেন। অন্য সময় অল্প একটু হাঁটাহাঁটিতেই হাঁপ ধরে যেত। আজ তেমন হচ্ছে না। বরং অনেক দিন পর ঝড়বৃষ্টিটা তাঁর ভালই লাগল।
এখন আর তেমন ভাল লাগছে না। জাহানারা ছেলেটির সঙ্গে খুকিদের গলায় কথা বলছিল। কেন বলছিল? জাহানারা এ রকম করে কখনো কথা বলে না। ছেলেটির সম্পর্কে তার মনে কি আছে তা পরিষ্কার জানা উচিত। জিজ্ঞেস করতে যেন কেমন বাধো বাধো লাগে। মীরা হলে এতক্ষণে হড়বড় করে সব বলে ফেলত।
জাহানারা।
বল মা।
ঐ ছেলে চলে গেছে?
হুঁ আবার আসবে। টেলিফোনে মীরার খোঁজ নেবে তারপর আসবে।
ও।
রাতে এখানে খাবে মা। চট করে কিছু কী করা যায়?
হাসিনা একবার ভাবলেন–বলবেন, রাতে খাবে কেন?
তিনি তা বলতে পারলেন না। শীতল গলায় বললেন, দেখ কিছু আছে কিনা।
রাতে খাবে বলে কি তুমি বিরক্ত হচ্ছে নাকি মা?
না। বিরক্ত হব কেন? ঢাকা শহরে কি এই ছেলের কোনো আত্মীয়-স্বজন আছে?
কেন বল তো?
না। এমনি। একটু খোঁজখবর করতাম।
কিসের খোজখবর?
হাসিনা জবাব দিলেন না। জাহানারা সহজ গলায় বলল, তুমি যা ভাবিছ সে সব কিছু না মা।
সে সব কিছু হলেই বা ক্ষতি কী?
হাসিনা তীক্ষ্ণ চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে রাগ ছিল, অভিমান ছিল, বিষাদ ছিল এবং কিছু পরিমাণে মিনতিও ছিল। জাহানারা একটি নিঃশ্বাস ফেলল।
হাসিনা নরম স্বরে বললেন–ছেলেটা ভাল। আমার পছন্দ হয়েছে।
জাহানারা বলল, পছন্দ হলে কী করতে হবে? জাহানারা গলার স্বরে রাজ্যের বিরক্তি। হাসিনা অবাক হলেন। এর রকম তো হবার কথা না। তার ধারণা জাহানারাও ছেলেটিকে পছন্দ করে। এই পছন্দ সাধারণ পছন্দেরও বেশি। তাহলে কি তার ধারণা ভুল। ভুল তো হবার কথা না। এই সব ব্যাপারে মারা সচরাচর ভুল করেন না। তিনিও করেননি। ছেলেটি যে কবার এসেছে জাহানারার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সে কথা বলেছে কিশোরীদের তরল গলায়। শব্দ করে হোসেছে। এসব কিসের লক্ষণ তা তিনি জানেন। তাহলে জাহানারা এমন করছে কেন? অন্য কোনো গোপন রহস্য আছে কি? তার জানতে ইচ্ছে করে। তবে জানতে ইচ্ছা করলেও লাভ নেই। জাহানারা মুখ খুলবে না। মুখ তালাবন্ধ করে রাখবে। দশটা কথা জিজ্ঞেস করলে একটা জবাব দেবে। সেই জবাব থেকে কিছু বোঝা যাবে না।
হাসিনা ক্ষীণ স্বরে বললেন, জাহানারা তুই আমার পাশে বস তো। জাহানারা সহজ গলায় বলল, পাশেই তো বসে আছি মা।
হাসিনা পাশ ফিরে মেয়ের কোলে একটা হাত রাখলেন। কোমল স্বরে বললেন, ছেলেটাকে আমার খুব পছন্দ। ঠাণ্ডা ছেলে। আজকাল এ রকম দেখা যায় না।
আজকাল বুঝি ছেলেরা সব গরম হয়ে গেছে?
তুই এমন রেগে যাচ্ছিস কেন রে মা? রেগে যাবার মতো কিছু বলেছি? ছেলেটাকে ভাল লেগেছে এইটা শুধু বললাম। এতে দোষের কী হল?
না দোষের কিছুই হয়নি। আমি রাগ করিনি। একজনকে ভাল বলবে তাতে আমি রাগ করব। কেন?
আমরা আগের কালের মানুষ। এ কালের কাণ্ডকারখানা কিছু বুঝি নারে মা।
জাহানারা খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। মার রোগশীর্ণ হাতের ওপর নিজের হাত রাখল। তারপর খুবই নিচু গলায় প্রায় অস্পষ্ট স্বর বলল, ছেলেটাকে নিয়ে তুমি যা ভাবতে শুরু করেছ তা না ভাবলেই ভাল হয় মা। মামুন সাহেবের বিয়ে ঠিক হয়েছে আছে। কিছু দিনের মধ্যেই বিয়ে হবে।
হাসিনা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কিছুদিনের মধ্যে বিয়ে হবে তাহলে এখানে এসে বসে থাকে কেন? এটা কি ধরনের ভদ্রতা?
বিয়ে হচ্ছে বলে সে এ বাড়িতে আসবে না। এমন তো কোন কথা নেই মা।
হাসিনার চোখে পানি এসে গেল। তিনি সেই লুকুবার কোনো চেষ্টা করলেন না। তিনি ভেবেই নিয়েছিলেন জাহানারার সঙ্গে এই ছেলেটির বিয়ে হবে। সংসারের ভিত পাকা হবে।
জাহানারা বলল, চা খাবে নাকি মা?
না।
শরীর খারাপ লাগছে?
উঁহু।
তুমি এমন ভেঙে পড়ছি কেন? এই ছেলে ছাড়া কি ছেলে নেই? মেয়ের বিয়ে দিতে চাও দেবে। আমি তো কখনো না বলিনি। এক’দিন শাড়ি গয়না পরে বরের বাড়িতেই চলে যাব। তখন হায় হায় করবে।
হাসিনা জবাব দিলেন না। মেয়ের কোল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে পাশ ফিরলেন। জাহানারা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে এখন আর ইচ্ছা করছে না।
জাহানারা রান্নাঘরে চলে গেল। রান্না করতে ইচ্ছা করছে না। শুরু করতে হবে। এর থেকে উক্ত নেই।
মার জন্যে তার বেশ খারাপ লাগছে। এই মহিলার ভাগ্যটাই এ রকম। দু’দিন পর পর শুধু আশাভঙ্গ হয়। বছর দুই আগে একবার হল। চমৎকার ছেলে। ফর্সা লম্বা, হাসি-খুশি। এমন একটা ছেলে যে, দেখলেই পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছা করে। বিয়ের সব ঠিক ঠাক। ছেলের এক মামা পাথর বসানো একটা আংটি দিয়ে জাহানারার মুখ দেখে গেলেন।
বিয়ের দিন-তারিখ হল, ১৭ কার্তিক। বিয়েটা হল না। কেন হল না সে এক রহস্য। তারা হঠাৎ জানাল একটু সমস্যা হয়েছে। কী সমস্যা কিছুই বলল না। কি লজ্জা কি অপমান লাল পাথর বসান আংটি জাহানারা খুলে ট্রাংকের নিচে লুকিয়ে রাখল। একবার ভেবেছিল নর্দমায় ফেলে দেবে। ফেলতে পারেনি। আংটিটাি হাতে নিলেই ফর্সা, লম্বা, কোঁকড়ানো চুলের ছেলেটির ছবি মনে আছে। শত অপমানের মধ্যে কেন জানি ভাল লাগে।
কত দিন কত জনের সঙ্গে দেখা হয় এই ছেলেটির সঙ্গে কখনো দেখা হয় না। জাহানারা ঠিক করে রেখেছে। যদি কখনো দেখা হয় তাহলে সে হাসিমুখে এগিয়ে যাবে। খুব পরিচিত ভঙ্গিতে বলবে কী কেমন আছেন? চিনতে পারছেন আমাকে?
জাহানারা কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। আর ঠিক তখন ছোটখাটো একটা দুর্ঘটনা ঘটল। বা পায়ের ওপর কেতলি উল্টে পড়ল। কেতলি ভর্তি ফুটন্ত পানি। হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ঝলসে গেল। জাহানারা কোন শব্দ করল না। দাঁতে দাঁত চেপে কষ্ট সহ্য করল।
রাতে প্রচণ্ড জ্বর এল। জ্বরের ঘোরে মনে হল যেন লম্বা, ফর্সা, কোকড়ানো চুলের ছেলেটি তার পায়ের কাছে বসে আছে। বিরক্ত গলায় বলছে, তুমি এত অসাবধান কেন? পা সম্পূর্ণ ঝলসে গেছে আর তুমি একজন ডাক্তার পর্যন্ত দেখালে না? এ রকম ছেলেমানুষী করার কোন অর্থ হয়? ইস কী অবস্থা হয়েছে পায়ের।
জাহানারা বলল, ছিঃ, তুমি পায়ে হাত দিচ্ছ কেন?
পায়ে হাত দিলে কী হয়?
লজ্জা লাগে।
এত লজ্জা লাগার দরকার নেই।
জ্বরের ঘোরে সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। ফর্সা, লম্বা, কোকড়ান চুলের ছেলেটিকে এক সময় মামুন বলে মনে হতে থাকে।
জাহানারার বড় ভাল লাগে। তার বলতে ইচ্ছে করে, তুমি এত দূরে বসে আছে কেন? ব্যথায় মরে যাচ্ছি। আর তোমার একটু মায়া লাগছে না? আরো কাছে আসা। দেখ তো জ্বর আর বাড়ল কিনা। কপালে হাত দিলে কোন পাপ হবে না।
দুর্ঘটনা শুরুতে যত সামান্য মনে হয়েছিল দেখা গেল তা মোটেই সামান্য নয়। পা ফুলে উঠল। দুদিনের মাথায় ঘা বিষিয়ে গেল। তৃতীয় দিনের দিন ভর্তি করতে হল হাসপাতালে। হাসপাতালের ডাক্তাররা ঘা দেখে চমকে উঠলেন।
এক রাতে আধো ঘুম আধা জাগরণের মধ্যে জাহানারা শুনল বুড়ো মতো একজন ডাক্তার বলছেন–আর একটা দিন দেখব তারপর এম্পুট করে ফেলব। গ্যাংগ্রিনের সূচনা।
জাহানারা চেঁচিয়ে বলতে চাইল–দয়া করুন, আমার পা কাটবেন না। বলতে পারল না। তার কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। সমস্ত শরীরে ভয়াবহ ক্লান্তি পায়ে কোন ব্যথা নেই। মাথায় ভোতা যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণার ধরনটাও অদ্ভুত। তেমন যে নেশা লেগে যায়।
মনে হয় থাকুক না। আর শুধু ঘুমুতে ইচ্ছা করে। শরীরের প্রতিটি কোষ আলাদা আলাদা ভাবে ঘুমুতে চায়।
এগার দিনের দিন জাহানারা পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে পেল। তার বিছানার পাশে মামুন বস আছে। ঘরে অনেক লোক। মা আছেন, মীরপুরের বড়খালা আছেন। বড়খালার ছেলে যে আর্মির অফিসার সেও আছে। জাহানারা বলল, আমার পা কেটে বাদ দিয়েছে তাই না?
মামুন বলল, না।
জাহানারার বিশ্বাস হল না। অথচ বিশ্বাস না হবার কানো নেই ঐ তো রোগা রোগা পায়ের পাতা দু’টি দেখা যাচ্ছে। মামুন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। এত সুন্দর লাগছে কেন মামুনকে? কি সুন্দর তাকে লাগছে। সাদা পাঞ্জাবিতে তাকে এত সুন্দর লাগে। জাহানারা চোখ বন্ধ করল। আবার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমে তলিয়ে যাবার আগ মুহূর্তে শুনল, মামুন বলছে খালা আর ভয় নেই। আপনারা বাসায় যান। বিশ্রাম করুন। আমি আছি।
আহ কী চমৎকার শব্দ–আমি আছি। আমি আছির মত সুন্দর আর কোন শব্দ কী বাংলা ভাষায় আছে? না নেই।
জাহানারা সুস্থ হবার পনের দিনের মাথায় মামুনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল। হাসিনা মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ করে যতটা হৈচৈ করবেন বলে ভেবে রেখেছিলেন তার কিছুই করতে পারলেন না। একটা কমিউনিটি সেন্টার পর্যন্ত ভাড়া করা গেল না। আলো দিয়ে বাড়ি সাজানো হল না। মেয়েকে নতুন একসেট গয়নাও দিতে পারলেন না। তবু তার মনে কোন অপূর্ণতা রইল না। দীর্ঘদিন পর গভীর আনন্দ বোধ করলেন। তাঁর ভাড়া বাড়ির প্যালাস্তারা ওঠা কুদর্শন একটা কোঠায় বাসর হবে। মেয়েরা ছোটাছুটি করে গর সাজাচ্ছে। এক ফাঁকে সেই ঘরও তিনি দেখে এলেন। অপূর্ব লাগল। চোখ ভিজে উঠল।
কি সুন্দর লাগছে জাহানারাকে। তাঁর এই কালো মেয়ের মধ্যে এত রূপ কোথায় লুকিয়ে ছিল? নাকি তার এই মেয়ে রূপবতীই ছিল শুধু তার চোখে পড়েনি? হাসিনার চোখ বারবার ভিজে উঠতে লাগল। তার বড় বোন তার হাত ধরে মেয়ের সামনে থেকে তাকে সরিয়ে নিলেন। রাগী গলায় বললেন, আনন্দের দিনে এ রকম কাঁদে কেউ। কাঁদতে কাঁদতে তুই দেখি চোখে ঘা করে ফেলবি।
বাসর রাতে ঘোর বর্ষণ। পৃথিবী ভাসিয়ে নিয়ে যাবার মত বৃষ্টি। খুব আনন্দ করছে সবাই। পাড়ার মেয়েরা বৃষ্টিতে ভিজে হৈচৈ করছে। এ ওকে ধরে কাদা পানিতে মাখামাখি করছে। অকারণে হাসছে। হাসিনা ঘর অঙ্গদকার করে একা একা তার ঘরে শুয়ে আছেন। সমস্ত দিনের উত্তেজনায় তার হাঁপানীর টান প্রবল হয়েছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। হোক কষ্ট আরো কষ্ট হোক। শুধু মেয়েটা সুখী হোক। আজ রাত হোক তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম রাত।
হাসিনার কেন জানি গা ছমছম করতে লাগল। মনে হচ্ছে অন্ধকার ঘরে কে যেন এসে ঢুকেছে। নিঃশব্দে হাঁটছে। উৎসবের দিনে মৃত আত্মীয়-স্বজনরা এসে উপস্থিত হন। তাই নিয়ম। তাঁরাই কি এসেছেন? জাহানারার বাবা তো আসবেই। কে বলবে এই মুহূর্তে এই ঘরেই হয়ত সে আছে। মেয়েকে দেখে ফিরে যাবার মুহুর্তে অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে এসেছে। হাসিনা কাতর গলায় বললেন, কে? কে ওখানে?
কোনো জবাব পাওয়া গেল না। কিন্তু হাসিনার মনে হল কেউ-একজন এসে যেন তার পাশে বসল। শব্দহীন স্বরে বলল, আমি। চিনতে পারছি না হাসু?
পারছি। পারব না কেন?
অনেক দিন তো হয়ে গেল, ভয় হচ্ছিল হয়ত চিনতে পারবে না।
হাসিনা ধরা গলায় বললেন, মেয়ের বিয়ে দিয়েছি।
খুব ভাল করছে। একা একা অনেক কষ্ট করলে হাসু।
হাসিনা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তুমি পাশে ছিলে না। এইটাই একমাত্র কষ্ট। এছাড়া অন্য কোন কষ্ট-কষ্টই না। তুমি কেমন আছ?
রাত বাড়ছে। ঝড়বৃষ্টির চমৎকার একটি রাত।
মুনা লক্ষ্য করল আজ সারাদিন বকুল মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুপুরে ভালমত খেল না। খানিকটা মুখে দিয়েই উঠে পড়ল। মুনা বলল, কি হয়েছে রে?
বকুল হাসিমুখে বলল, ক্ষিধে নেই। ক্ষিধে হলেই আবার খাব। তুমি আজ অফিসে গেলে না। কেন আপা?
আজ শুক্রবার। অফিস বন্ধ।
ও আচ্ছা। আমার কিছু মনে থাকে না।
বকুল উঠে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। হাতে গল্পে বই। পাড়ায় পারলিক লাইব্রেরি হয়েছে। বাবু তার মেম্বার। রোজ বই নিয়ে আসছে। সাত আট পাতা পড়ে বকুল সে সব বই ফেরত পাঠাচ্ছে। পড়তে ভাল লাগে না। অথচ আগে কোনো একটা বই হাতে পেলে শেষ না কর উঠতে পারত না।
আজও পড়তে ভাল লাগছে না। হাই উঠছে। বকুল বই নামিয়ে রাখল। ঘুম ঘুম আসছে। অথচ ঘুমুতে ইচ্ছা করে না। কারো সঙ্গে গল্প করতে পারলে ভাল লাগতে গল্প করার মানুষ নেই।
ঘুমুচ্ছিস নাকি বকুল?
বকুল বিছানায় উঠে বসল। মুনা আপা গম্ভীর মুখে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে।
কিছু বলবে আপা?
তোর কি হয়েছে বল তো?
কী আর হবে কিছু হয়নি।
জহির কী রাগ করে চিঠিতে কিছু লিখেছে?
না তো। বিশ্বাস না হলে তুমি চিঠি পড়ে দেখ আপা। এনে দেই? ড্রয়ারে আছে।
না। এনে দিতে হবে না। তোর কি বাচ্চ-কাঁচা হবে? বল তো ঠিক করে।
বকুল অবাক হয়ে বলল, বাচ্চ-কাচ্চা হবে কী জন্যে?
মুনা বিরক্ত গলায় বলল, যা জিজ্ঞেস করেছি। তার জবাব দে। হ্যাঁ বা না বল।
না।
নেত্রকোনা যেতে ইচ্ছে করছে? জহিরের কাছে?
না।
ইচ্ছা না করলেও যেতে তো হবে। সারা জীবন এখানে পড়ে থাকবে? তোর নিজের ঘর-সংসার আছে না?
কী করে যাই আপা। আমার তো শরীর খারাপ। মাথার ঠিক নেই।
মাথা খুব ঠিক আছে।
আজেবাজে। জিনিস যে দেখি।
এখন তো আর দেখছিস না।
ঐখানে গেলেই দেখব।
তাহলে আবার চলে আসবি।
আচ্ছা। তুমি যা বল তাই
বকুল একটু আগে বন্ধ করা বই আবার মেলে ধরল। রাগে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। আপা মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলে যে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
মুনা বলল, একটা দিন ঠিক করে বাবুকে নিয়ে চলে যা। বাকের ভাইও সঙ্গে যাবে। নয়ত জহির রাগ করবে। কে জানে হয়ত করেও বসেছে। রাগ না করলে এর মধ্যে এখানে একবার আসত।
রাগ করেনি।
রাগ না করলেই তো ভালই।
মামলায় হার হয়েছে এই জন্যে মনটন খারাপ। আরেকটা কী মামলা দিয়েছে। ঐটাতোও হারবে।
কে বলল হারবে?
আমার মনে হচ্ছে। একবার হারাতে শুরু করলে হারিতেই হয়।
তোকে বলল কে?
কেউ বলেনি। আমি জানি আপা। পান খেতে ইছে হচ্ছে। বাবুকে পাঠিয়ে একটা পান আনাও তো। ঐ বাড়িতে থেকে থেকে আমার পান খাওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে। তুমিও একটা খাও আপা। ঠোট লাল হবে। দেখতে সুন্দর লাগবে।
মুনা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরুল। যতই দিন যাচ্ছে বকুলের ছেলেমানুষি ততই বাড়ছে। মানুষের বয়স বাড়ে বকুলের বয়স কমছে। শরীরও খারাপ হচ্ছে। এই বয়েসী মেয়েদের চোখে-মুখে যে উজ্জ্বল আভা থাকে বকুলের তা নেই।
রাতে খেতে বসেও খানিকক্ষণ ভাত নাড়াচাড়া করে বকুল উঠে পড়ল। মুনা বলল, কী হয়েছে রে?
পেট ব্যথা করছে আপা?
পেট ব্যথা করছে?
হুঁ।
বেশি?
না বেশি না।
দুপুরেও তো খাসনি।
শোবার আগে এক গ্লাস দুধ খাব। আপা ওতেই হবে।
মুনা দুধ নিয়ে নিজেই গেল। বকুল বিনা বাক্যে ব্যয়ে দুধ শেষ করে হঠাৎ নিচু গলায় বলল, তুমি যা বলছিলে তাই সত্যি আপা।
আমি কি বলছিলাম।
ঐ যে দুপুরে বললে। বাচ্চা হবার কথা।
সে কি?
এখন কি করব। আপা?
কি করাবি মানে? করাকরির কি আছে?
বাবুকে মিষ্টি দিয়ে একটা পান আনতে বল তো আপা। খেতে ইচ্ছে করছে। আলাদা করে যেন জর্দা আনে। আমি নিজেই বাবুকে বলতাম। কিন্তু এখন ওর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়ে হয়েছে সমস্যা।
বকুল হাসছে। কেমন অদ্ভুত ভয় এবং সংকোচ মেশানো হাসি। মুনা এসে বলল বকুলের পাশে। বকুল প্ৰায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, রাগ করনি তো আপা?
রাগ করব কেন?
বাচা হচ্ছে যে এই জন্যে।
পাগলের মতো কথা বলছিস কেন রে বকুল? তুই কী পাগল হয়ে যাচ্ছিস নাকি?
হ্যাঁ আপা পাগল হয়ে যাচ্ছি। পুরোপুরি যেদিন হব সেদিন বুঝবে। আমাকে একটা পাগলাগারদে রেখে আসতে হবে।
বকুল এবার কাঁদতে শুরু করল। শিশুদের কান্না। সবাইকে জানাতে হবে যে কান্না শুরু হয়েছে। চোখে পানি তেমন থাকবে না। ফুপানোর শব্দ থাকবে, না ফুপানোর শব্দ থাকবে, শরীর বারবার দুলে উঠবে। আশপাশের সবাই বুঝবে ভয়াবহ কিছু ঘটে গেছে।
কাঁদছিস কেন রে বকুল?
মনের দুঃখে কাঁদছি।
এত কি তোর মনে দুঃখ যে কাঁদতে হবে?
তাহলে যাও মনের আনন্দে কাঁদছি।
মুনা হেসে ফেলল। তার হাসি দেখে বকুলেরও হাসি পেলে গেল। অনেক কষ্টে সে হাসি৷ থামিয়ে রাখল। মুনা বলল, কাল ভোরে তোকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। তারপর জহিরুকে টেলিগ্ৰাম করব চলে আসতে। বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত তুই থাকবি আমার কাছে।
আমার বুঝি ঘর-সংসার নেই আপা?
একটু আগেই না থাকতে চাচ্ছিলি।
একন চাচিছে না।
বেশ তো জহির এসে নিয়ে যাবে। য
মুনা, বকুলের হাত ধরে খানিকক্ষণ বসে রইল। মুনার মুখ এখানো হাসি হাসি। বকুল খাকিনকটা গম্ভীর হয়ে আছে। কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু বলতে পারছে না।
কিছু বলবি বকুল।
হুঁ।
কী বলবি বলে ফেল।
বাবু যেন কিছু জানতে না পরে আপা।
বাবু জানলে কী?
লজ্জা লাগে আপা।
বকুল, মুনাকে জড়িয়ে ধরল। তার গা কাঁপছে। হয়ত আবার কাঁদবে। কিংবা কে জানে হয়ত আনন্দে হাসছে। বকুলের হাসি কান্নার কোন ঠিকঠিকানা নেই।
বুড়ো ডাক্তার সাহেব খুব আগ্রহ করে বকুলকে অনেক কিছু বললেন, সকাল-বিকাল হাঁটতে হবে। শারীরিক পরিশ্রম খুব প্রয়োজন এতে রক্তের অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা বাড়ে। শরীর সুস্থ থাকে। সুষম খাদ্যও খুব ইম্পর্টেন্ট। সেই সঙ্গে দরকার মানসিক প্রশান্তি।
তিনি বকুলকে একটা চটি বই দিলেন মা ও শিশু। বইটির মলাটে একটি শিশুর ছবি যে মার দুধ খাচ্ছে। লজ্জায় লাল হয়ে বকুল বই হাতে নিল। ডাক্তার সাহেব অবাক হয়ে বললেন, তোমার বয়স কত?
ষোল।
এত অল্প! আজিকাল তো এ বয়সে মেয়েরা মা হচ্ছে না। তবে মা হবার জন্যে বয়সটা খারাপ ও না। তুমি কিন্তু খুকি প্রথম বাচ্চার পর খুব সাবধান হবে। শিশু দিয়ে দেশ ভর্তি করে ফেলার কোন মানে হয় না। এক মাস পরে আবার আসবে।
বকুল মাথা কাত করল। লজ্জায় তার মুখে কথা ফুটছে না। ডাক্তার সাহেব বললেন, এক মাস পর যখন আসবে তখন বাচার হাট বিট তোমাকে শুনিয়ে দেব। আর এক মাস পর থেকেই হার্টবিট করতে শুরু করবে। নিজের বাচার হার্টবিটি শোনা একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা।
বকুল ফিসফিস করে বলল, কিভাবে শুনব?
খুব সোজা। ঐদিন টের পাবে।
মুনা ডাক্তার সাহেবের কথাবার্তায় বেশ অবাক হচ্ছে। কোন ডাক্তার রুগীর সঙ্গে এত আগ্রহ নিয়ে কথা বলেন না। ইনি বলছেন। এমন না যে এর কাছে রুগী আসে না। অনেক’দিন পর একজন রুগী পাওয়া গেছে। ডাক্তার সাহেবের চেম্বার রুগীতে ভর্তি। নম্বর লেখার স্লিপ হাতে নিয়ে সবাই অপেক্ষা করছে।
বকুলের জন্যে এই ডাক্তার এতটা আগ্রহ কেন দেখালেন?
চলে আসবার সময় দরজা পর্যন্ত এগিয়ে মৃদু গলায় বললেন, রিকশায় চলাফেরা করলে সাবধানে করবে যেন ঝাকুনি না লাগে। কেমন?
পৃথিবীতে অনেক রহস্য আছে! সেই সব রহস্যের একটা হচ্ছে মানবিক সম্পর্ক। এর কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। হঠাৎ যে কোনো একজন মানুষের জন্যে হৃদয় মমতায় উদ্বেলিত হতে পারে।
মুনা, ডাক্তারের ঘর থেকে বেরিয়ে বলল, চল বকুল তোর বাচ্চার জন্যে কিছু একটা কেনা যাক।
বকুল লজ্জিত গলায় বলল, কি কিনবে?
চল নিউ মার্কেটে গিয়ে দেখি কি পাওয়া যায়। আমি তো ছাই জানিও না।
লজা লাগে যে আপা।
লজ্জার কী আছে? তাছাড়া তোরই যে বাচ্চা তাও তো কেউ বুঝবে না।
নিউ মার্কেট থেকে কিনবে না। কিনবে না করেও অনেক কিছু কেনা হয়ে গেল। যাই দেখে তাই বকুলের পছন্দ হয়ে যায়। নিচু গলায় বলল, এটা কিমব আপা, বেবি সোপ। এত দাম গাচ্ছে। থাক লাক্স সাবান দিয়ে গোসল করলেই হবে। এত বাবুয়ানির দরকার নেই। বকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে মুনাকে বাধ্য হয়ে বলতে হয়–কিনে নে।
এই টাওয়াল কিনব। আপা? হাত দিয়ে দেখি কত নরম।
পছন্দ হলে নে।
পরে কিনলেও তো হবে। এত আগেভাগে কিনে লাভ কী আপা?
তাহলে পরে কিনব।
কিন্তু পরে যদি না পাওয়া যায়। ভাল জিনিস কিছুই থাকে না।
তাহলে কিনে ফেলাই ভাল।
গভীর সুখ ও গভীর আনন্দে বকুলের চোখ ঝলমল করে। তার দিকে তাকিয়ে মুনার বড় মায়া লাগে। পুঁটলা পুটলি সব বকুলের নিজের হাতে। মুনার কাছে দিতে রাজি না। মুনা বলল, তোর কষ্ট হচ্ছে কিছু আমার কাছে দে।
বকুল হাসিমুখে বলল, কষ্ট হচ্ছে না আপা। তাছাড়া পরিশ্রম করার দরকার। ডাক্তার সাহেব তো। তাই বললেন।
কিছু খাবি ক্ষিধে পেয়েছে?
হুঁ পেয়েছে? ঝাল কিছু খেতে ইচ্ছ করছে।
চল কিছু খাই।
ঝাল খেলে বাচার আবার ক্ষতি হবে না তো আপা? ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করার দরকার ছিল। বাসায় ফেরার পথে একবার থেমে জিজ্ঞেস করে যাব আপা?
তা করা যেতে পারে।
কাঠের একটা দোলনা বানাতে দিতে হবে। তুমি এ রকম করে হাসছ কেন আপা?
যা আর হাসব না।
তোমার অনেক টাকা খরচ করিয়ে দিলাম।
তা দিলি। কি আর করা।
তুমি আবার মনে মনে আমার ওপর রাগ করছ না তো?
করছি।
বকুল হাসল। চমৎকার হাসি। মুনার মনে হল এত সুন্দর করে বুকল এর আগে কখনো হাসেনি। সকালবেলার রোদ এসে পড়েছে তার মুখে। গায়ে হালকা নীল রঙের একটা শাড়ি। সেই নীল রঙের আভা পড়েছে তার মুখে-চমৎকার ছবি।
জহির বৃহস্পতিবার ভোরে এসে উপস্থিত। তার দিকে তাকিয়ে আঁৎকে উঠতে হয়। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। অনেক দিন চুল কাটা হয়নি বলেই মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল। এই গরমে গায়ে হলুদ রঙের ময়লা একটা কোট। বাসায় পা দিয়েই প্রথম যে কথাটি বলল তা হচ্ছে–বিরাট ভুল হয়ে গেল। নিতান্ত বেকুবের মতো কাজ করেছি। ছিঃ ছিঃ!
বেকুবের মতো কাজ আর কিছুই না। সঙ্গে সে একটা মাছ নিয়ে এসেছিল। রুই মাছ। ট্রেনে সিটের নিচে রাখা ছিল। নামার সময় মাছ না নিয়েই নেমে এসেছে।
মুনা বলল, এখন আর আফসোস করে কি হবে? মাছ গেছে গেছে। রুই মাছ ঢাকাতেও পাওয়া যায়। তোমার এই অবস্থা কেন? দেবদাসের মতো লাগছে।
গালে অ্যালার্জির মত হয়েছে। আপা–ব্লেড ছুলেই ফুলে ওঠে। এই জন্যে দাড়ি কাটা বন্ধ। মন মেজাজও খারাপ।
কেন?
পর পর দুটো মামলায় হেরেছি। তৃতীয় একটা শুরু হয়েছে। এটাতেও মনে হচ্ছে হারব। ঢাকা আসার মূল কারণ হচ্ছে বড় বড় উকিল ধরব।
টেলিগ্রাম পাওনি?
না তো। কিসের টেলিগ্রাম?
ঠিক আছে, পরে শুনবে। যাও মুখ ধোও। দয়া করে কাপড়গুলিও বদলাও। এত ময়লা কাপড় তোমার আছে জানতাম না।
জহির টেলিগ্রামের বিষয়ে কোন রকম আগ্রহ প্রকাশ করল না। গোসল করে পর পর দুকাপ চা খেয়ে চাদর গায়ে ঘুমিয়ে পড়ল। টানা ঘুম। মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন সে আরাম করে ঘুমুতে পারছে না।
মুনা অফিসে যাবার আগে বকুলকে বলে গেল ঘুম ভাঙলেই সব গুছিয়ে বলবি। জহিরের মনটন খুব খারাপ। খরবদার ঝগড়া-টগরা করবি না।
বকুল অবাক হয়ে বলল, শুধু শুধু ঝগড়া করব কেন?
জহির রেগে কিছু বললে ও চুপ করে থাকবি।
ওইবা রেগে রেগে কথা বলবে কেন? রাগ করবার মত আমি কী করলাম?
তুই বড়ই বোকা বকুল। এই রকম বোকা হলে তো মুশকিল।
তোমার মতো চালাক হলে আপা মুশকিল। চালাক মেয়েরা বিয়ে-টিয়ে কিছুই করতে পারে না। একা একা থাকে এবং মনে করে বিরাট একটা কাজ করা হল।
মুনা, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কি অদ্ভুত কথা বকুলের। চোখ-মুখ শক্ত করে কথা বলছে। আগের বকুলকে এখন আর চেনা যাচ্ছে না। মুনা কিছু বলল না। বাবুকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল। বাজার করে বাবুকে পাঠাবে। ঘরে প্রায় কিছুই নেই। আজও নিশ্চয়ই অফিসে যেতে দেরি হবে।
দুপুর বেলা জহির ঘুম থেকে উঠল। হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসল। খেতে খেতেই বকুলের খবর শুনে সহজ গলায় বলল, ভালই তো। আমি অবশ্যি আগেই সন্দেহ করেছিলাম। ডাক্তারকে দিয়ে কনফার্ম করিয়েছ তো?
হুঁ।
এখন খাওয়া-দাওয়া ঠিক করবে। তোমার এনিমিয়ার ভাব আছে।
নতুন শিশু প্রসঙ্গে এখানেই তার আগ্রহের সমাপ্তি। যেন যা বলার বলা হয় গেছে। আর কিছু বলার নেই। নতুন একটি শিশু আসার ঘটনাটা যেন কোনো ঘটনাই না। জ্বর বা সর্দি হবার মতো একটা ব্যাপার।
বকুল।
বল।
তোমার ঐ অসুখটা সেরেছে। স্বপ্লটপ্ল কী যেন দেখতে।
সেরেছে।
গুড। আমি ভেবেছিলাম এসে দেখব তোমাকে পাগলাগারদে ট্রান্সফার করা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর হা হা হি হি করছে।
বকুল কিছু বলল না। ডালের বাটি এগিয়ে দিল। জহির বলল, যন্ত্রণা যখন শুরু হয় চারদিক থেকে এক সঙ্গে শুরু হয়। আটপাড়ার জল মহাল হাতছাড়া হবার উপক্রম হয়েছে।
কেন?
আরে কাজগপত্র কিছু নেই। সরকারি রেকর্ডে গণ্ডগোল। আমি তো এইসব নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি। মা দেখত। কি করে রেখেছে। এখন আমার মাথায় হাত। পথের ফকির হচ্ছি বুঝলে। স্ট্রিট বেগার। এমন অবস্থা হয়েছে শান্তিমত ঘুমোতে পারি না।
ঘুমোতে পার না কেন?
মা সারাক্ষণ কাঁদে। দরজায় মাথা বাড়ি দেয়। এর মধ্যে ঘুমোব কী করে বল। এক’দিন আবার পুকুরে ডুবে মরতে গিয়েছিল। বিরাট কেলেংকারি।
এইসব কথা তো কিছু লেখনি।
লেখার মত কোনো কথা তো না। চা কর তো বকুল। ভাতটা শেষ করেই চা খেয়ে রওনা হব।
কোথায় রওনা হবে?
তিনজন দেওয়ানি উকিলের এ্যাড্রেস নিয়ে এসেছি। দেখি ব্যাটাদের কাউকে রাজি করানো যায় কিনা।
জহির চা পুরো শেষ করল না। দুচুমুক দিয়ে বের হয়ে গেল। তার ভাবভঙ্গি পুরোপুরি স্বাভাবিক, এ রকম বলা যাবে না। কিছুক্ষণ পরপর বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। বকুলের বড় মায়া লাগছে। সারাক্ষণ তার ইচ্ছা হচ্ছিল বলে–তুমি যেখানে যাচ্ছ যাও কিন্তু আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও। আমি সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে থাকব। বলা হল না। লজ্জা লাগতে লাগল।
জহির ফিরল রাত এগারটার দিকে। বিধ্বস্ত চেহারা। বঁ হাতের কনুইয়ের কাছে অনেকটা কেটে গেছে। হলুদ শার্ট রক্ত জমে কালচে হয়ে গেছে। জহির বিব্রত স্বরে বলল, রিকশা থেকে তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে এই অবস্থা।
বকুল গরম পানিতে হাত ধুইয়ে দিল। ঘরে ডেটল ছিল না। বাবু এক বোতল ডেটল, তুলা, গজ কিনে আনল।
জহির বলল, এ্যাকসিডেন্ট হওয়ায় মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল বুঝলে বকুল। ভাবলাম অযাত্রা। আসলে তা না। বেনী মাধব বাবুকে পেয়ে গেলাম।
বেনী মাধব কে?
খুব নামকরা লইয়ার। দিনকে রাত করতে পারে। ঘাণ্ড লোক। কাগজপত্র দেখেই সব বুঝে ফেলল। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল, তারপর বলল দাগ নম্বরে গণ্ডগোল আছে। তখনি বুঝলামএ হচ্ছে আসল জিনিস। এর কাছে হেংকি–পেংকি চলবে না।
চলবে..