কোথাও_কেউ_নেই
হুমায়ুন আহমেদ
২০.
শ্রাবণ মাসের গোড়াতে শওকত সাহেবের শরীর খুব খারাপ করল। তিনি প্ৰায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। কাজের মেয়েটিও নেই। খুব ঝামেলা। মুনা অফিসে চলে গেলে সামান্য এক গ্লাস পানিও নিজেকে গড়িয়ে খেতে হয়। তাতেও কষ্ট হয়। এক সন্ধ্যায়। তার অসুখ বেশ বাড়ল। প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা, সেই সঙ্গে গা কাঁপিয়ে জ্বর। বাইরে ঘোর বর্ষ। বৃষ্টিতে পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে। সন্ধ্যা থেকেই ইলেকট্রিসিটি নেই। মুনা হারিকেন জ্বালিয়ে মামার ঘরে নিয়ে গেল। তিনি বললেন, কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। তুই এখানে খানিকক্ষণ বসে থাক।
মুনা বসল। শওকত সাহেব এলোমেলা ভাবে দু’একটা কথাটথা বলতে চেষ্টা করলেন। সবই বকুলকে নিয়ে। গত মাসে বকুল এসেছিল। খবর না দিয়ে আসা। জহিরের মামাতো ভাইয়ের বিয়ে নারায়ণগঞ্জে সেখানে যাবার পথে ঘণ্টা তিনেকের জন্যে এ বাড়িতে থাকা। মুনা সে সময়টা বাসায় ছিল না। শওকত সাহেব বকুলের গল্প পঞ্চাশবার করেছেন। প্রতিবারেই নতুন নতুন কিছু তথ্য যোগ হয়েছে। মুনার কেমন সন্দেহ হয় বেশির ভাগই বোধ হয় বানানো। আজও সেই গল্পই শুরু হল।
মেয়েটা সুন্দর হয়েছে খুব, বুঝলি মা খুব সুন্দর।
সুন্দর হবারই তো কথা। বিয়ের পর মেয়েরা সুন্দরী হয়। এটাই নিয়ম।
সবাই হয় না। যারা সুখী হয় তারাই হয়। মেয়েটা সুখী হয়েছে। আর হবে না কেন বল ছেলেটা তো ভাল। ভাল না?
হ্যাঁ হয়।
এসেই পা ছুঁয়ে সালাম করল।
কী যে তুমি বল মামা! তোমার জামাই আর তোমাকে পা ছুঁয়ে সালাম করবে?
না মানে সবাই তো করে না। আজকালকার ছেলে। জহির বিদেশ যাচ্ছে বুঝলি।
কবে যাচ্ছে?
এখনো ঠিক হয়নি। চেষ্টা চলছে। তার এক চাচা থাকেন ইংল্যান্ডে। তিনিই ব্যবস্থা করছেন।
ভাল।
একবার গেলে বকুলকেও নিয়ে যাবে তাই না?
নেওয়াই তো উচিত।
দেশ বিদেশ দেখা হবে মেয়েটার ভাগ্যের ব্যাপার তাই না?
তাতো বটেই। আচ্ছা মামা আমার কথা বকুল কিছু জানতে চায়নি, তাই না?
শওকত সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, জানতে চাইবে না। কেন? চেয়েছে। অনেক কথা জিজ্ঞেস করেছে।
কি জিজ্ঞেস করেছে?
তিনি সে সব কিছু বলতে পারলেন না। মুনা মৃদু হাসল। বকুল কিছুই জানতে চায়নি। কিন্তু কোন চাইবে না?
মামা। তুমি শুয়ে থাকে। আমি খাবার তৈরি করি। রুটি খাবে তো?
হ্যাঁ। আরেকটু বাস। ঝড় কমুক।
ঝড় কোথায় দেখলে তুমি! বাতাস দিচ্ছে। তুমি শুয়ে থােক। কয়েকটা রুটি বানিয়ে চলে আসব। বেশিক্ষণ লাগবে না। তুমি খানিকক্ষণ থাকতে পারবে অন্ধকারে? হারিকেনটা নিয়ে যাই।
রুটি বানাতে মুনার অনেকক্ষণ লাগল। চুলায় কি একটা হয়েছে। বারাবার নিভে যাচ্ছে। রান্নাঘরের জানালার কবাট একটা ভাঙা। বাতাসের ঝাপটায় হারিকেন নিভে যাচ্ছে। যন্ত্রণার এক শেষ।
মুনা রুটি বানিয়ে মামার ঘরে এসে দাঁড়াল। হালকা গলায় ডাকল, মামা ঘুমিয়ে পড়েছ?
মামা জবাব দিল না। দ্বিতীয়বার মামাকে ডাকতে গিয়ে তার গলা কেপৌ গেল। কেউ তাকে বলে দেয়নি। কিন্তু সে জানে মামা আর কোনো প্রশ্নের জবাব দেবেন না। মুনা খুব সাবধানে হরিকেনটি মেঝেতে নামিয়ে রাখল। সে বুঝতে পারছে না। এখন কি করবে। চিৎকার করে কাদবো? ছুটে যাবে রাস্তায়? কিন্তু কোনটিই করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সে বারান্দায় বেরিয়ে এল। বৃষ্টির ছাঁট এসে গায়ে লাগছে। ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তার আলোয় চারদিক ঝলমল করে উঠছে। আবার সব ঢেকে যাচ্ছে অন্ধকারে। বৃষ্টির শব্দ, বাতাসের শব্দ, বজপাতের শব্দ তবুও কী অসম্ভব নীরবতা চারদিকে।
ছোটবেলায় মুনা যখন একলা হয়ে পড়েছিল তখন তার এই মামা তাকে নিয়ে এসেছিলেন নিজের কাছে। ঝড়-বৃষ্টির রাতে তার বড় ভয় লাগত। মামা তাকে উঠিয়ে নিয়ে যেতেন নিজের বিছানায়। ফিসফিস করে বলতেন, ভয় কি রে পাগলী, আমাকে শক্ত করে ধরে থােক। মুনা তাকে শক্ত করে ধরে থাকত। তবু ভয় কাটত না। মুনা বারান্দায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এক সময় তার পা ভার হয়ে এল। সে বাচ্চা মেয়েদের মত পা ছড়িয়ে বসে পড়ল মেঝেতে। ফিসফিস করে সম্ভবত নিজেকে শোনাবার জন্যেই বলল, তোমাকে কতটা ভালবাসি। এই কথা কি মামা আমি কোনোদিন তোমাকে বলেছি?
চার মাস হাজতবাসের পর হঠাৎ বিনা নোটিশে বাকের ছাড়া পেয়ে গেল। দুপুর বেলা রুটি আর ডাল খেয়ে সবে বিড়ি ধরিয়েছে–ডিউটির একজন সেপাইকে ডেকে নরম স্বরে বলেছে, ভাইজান একটা পান এনে দেন। রিকোয়েস্ট। বমি বমি লাগছে। ঠিক তখন ঘটনোটা ঘটল। জমাদার হাজাতের দরজা খুলে বলল, ওসি সাহেব ডাকে।
বাকেরের খুব ইচ্ছে হল বলে, তোমার ওসিকে এখানে আসতে বল। বলেই ফেলত শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলাল। সময় খারাপ। মারধর করবে। রুল দিয়ে আচমকা পেটে এমন গোতা মারে যে চোখ অন্ধকার হয়ে যায়। গত শুক্রবারে একজন পেটে গোতা খেয়ে রক্ত পেচ্ছাব করতে লাগল। হাসপাতালে নিয়ে যাবার নাম করে বের করে নিয়েছে। হাসপাতালে নিশ্চয়ই নেয়নি। রাস্তায় নিয়ে ফেলে দিয়ে এসেছে। এর নাম পুলিশ। এদের যত কম ঘটানো যায় ততই ভাল।
ওসি সাহেব বাকেরকে দেখে হাই তুললেন। বিকট হাই। বাকের বিনীত ভঙ্গিতে বলল, কী জন্যে ডেকেছেন স্যার?
বসুন। বাকের চমকে উঠল এতদিন এই লোক তুমি তুমি করেছে। আজ আপনি বলছে। কেউ কলকাঠি নেড়েছে কি না কে জানে। তুমি-আপনির এই ব্যাপারটা বেশ ভাল। অনেক কিছু বোঝা যায়। বাকের বসিল।
খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?
জি স্যার।
বাড়ি যেতে চান?
যেতে দিলে যাব।
তাহলে কাগজ-কলম নিন। মুচলেকা দিতে হবে। লিখুন রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজে লিপ্ত থাকব না। আইন-শৃঙ্খলা মানিয়া চলিব। লিখে সই করুন। এই নিন কলম।
বাকের হাসিমুখে বলল, রাষ্ট্র বানান কি স্যার?
যা মনে আসে লিখে ফেলেন। বুঝতে পারলেই হল আর আসল কথাটা মন দিয়ে শুনুন। এখন থেকে প্রতি মঙ্গলবারে একবার হাজিরা দিতে হবে। পারবেন তো?
জি পারব।
ঐটাও লিখুন–প্রতি মঙ্গলবার একবার থানায় হাজিরা দিব। থানার নাম লিখুন।
ওসি সাহেব। আবার একটা বিকট হাই তুললেন। বাকের ওসি সাহেবের পাশে বসা সেকেন্ড অফিসারকে বলল, স্যার রাষ্ট্র বানানটা কি হবে একটু কাইন্ডলি বলবেন?
চৈত্র মাসের ঝাঝা রোদে বাকের রাজকীয় চালে হাঁটছে। দুটিাকা পঁচিশ পয়সা দিয়ে সে একটা বেনসন কিনেছে। হাজতে যাবার আগে দেড় টাকায় পাওয়া যেত।–চার মাসে এতটা দাম বেড়েছে দেশটার হচ্ছে কি? দেশের চিন্তা তাকে খুব বেশি বিচলিত করল না। তার বড় ভাল লাগছে। চৈত্র মাসের তপ্ত হওয়াও বড়ই মধুর মনে হচ্ছে। পকেটে পঁচিশ টাকার মতো আছে। এখন আর অতি সাবধানে এই টাকা খরচ করতে হবে না। ব্যবস্থা একটা হবেই।
মীরপুর রোডে উঠে সে রিকশা নিল। হুঁড় ফেলল না। মাথার উপরের কড়া রোদ ও ভাল লাগছে। চমৎকার দিন। আকাশ ঘন নীল। দৃষ্টি পিছলে যায়। তবু তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগে। বাকের হালকা গলায় রিকশাওয়ালাকে বলল, রিকশা কোন জায়গার?
রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা শুরু করার জন্যে এটা হচ্ছে সবচে ভাল ডায়ালগ। সব রিকশাওয়ালাই এই প্রশ্নের জবাব খুব আগ্রহ করে দেয়। আজকের এই রিকশাওয়ালা জবাব দিল না। বাকের দ্বিতীয়বার বলল, রিকশা কোন জায়গার ভাই? রিকশাওয়ালা তিক্ত গলায় বলল, হেইটা দিয়া আপনের কী দরকার?
অন্য সময় হলে চট করে বাকেরের মাথায় রক্ত উঠে যেত। আজ সে রকম হল না। বরং রোগা আধাবুড়ো রিকশাওয়ালার জন্যে সে মমতা বোধ করল। কেমন টপটপ করে ঘামছে। ন্যায্য ভাড়ার উপরেও ব্যাটাকে দুটাকা বিকশিস ধরে দিতে হবে। ভাগ্যিস সে রিকশাওয়ালা হয়ে জন্মায়নি। প্যাসেঞ্জার নিয়ে এই দুপুরে রোদে বেরুতে হলে সর্বনাশ হয়ে যেত। বাকের দরাজ গলায় বলল, আস্তে চালাও ভাই। তাড়াহুড়ার কিছু নাই। সিগ্রেট খাবে?
বাকের তার আধখাওয়া বেনসন বাড়িয়ে ধরেছে। রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। কিন্তু সিগারেটের জন্যে কোনো আগ্রহ দেখাল না। ব্যাটা নবাবের বাচ্চা একটা চড় দিলে হারামজাদা তার বাপের নাম ভুলে যাবে। বাকের অবশ্যি চড় দিল না। দুটাকা বিকশিসের জায়গায় এক টাকা বকশিস দিল। বেয়াদবি না করলে দুটাকাই পেত। হারামজাদার কপালে নেই কি করা যাবে।
জলিল মিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। জলিল মিয়ার চোখে চশমা, গায়ে ধবধবে পাঞ্জাবি। পেট আরো বড় হয়েছে। সে দোকানের বাইরে গ্যাসের চুলার কাছে বসে আছে। বিশাল কড়াইয়ে তেল গরম হচ্ছে। কারিগর এলেই জিলিপি ভাজা শুরু হবে। গত এক মাস ধরে তার দোকানে প্রতি বিকালে জিলিপি ভাজা হচ্ছে। সস্তায় ভাল কারিগর পাওয়া গেছে। রোজ আধমণের ওপর জিলিপি বিক্রি হয়। অবস্থা দেখে মনে হয় এই ব্যবসাটা তার কপালে লেগে গেছে। একবার যদি নাম ফেটে যায়–জলিল মিয়ার জিলিপি তাহলে আর দেখতে হবে না।
এই সব ব্যবসা হচ্ছে ভাগ্যের ব্যবসা। একই কারিগর তিন জায়গায় জিলিপি বানাবে এক জায়গায় লাগবে দুজায়গায় লাগবে না। লেগে গেলেও যন্ত্রণা, কারিগরকে চোখে চোখ রাখতে হবে। কে কখন ভাগিয়ে নিয়ে যায়। এখন বাজছে তিনটা। কারিগর আসছে না। লোক পাঠানো হয়েছে। জলিল মিয়া মনের উদ্বেগ চাপিতে পারছে না. এর মধ্যে উপস্থিত হয়েছে বাকের। আবার কোন যন্ত্রণ করবে। কে জানে?
বাকের দোকানে ঢুকতে ঢুকতে বলল, তারপর কেমন চলছে?
জলিল মিয়া শুকনো গলায় হাসল। অতিরিক্ত দরদ ঢেলে জিজ্ঞেস করল, কবে ছাড়া পেলেন। বাকের ভাই?
বাকের এই প্রশ্নের জবাব দিল না। হাজত প্রসঙ্গটা সে ভুলে থাকতে চায়। সে উদাস দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, এখানকার খবর কী জলিল মিয়া?
জ্বি ভাল।
সিদ্দিক হারামজাদা কেমন আছে?
জলিল মিয়া চুপ করে রইল। বাকের উদাস গলায় বলল, হারামজাদাটাকে খুন করবার জন্যে এসেছি? বডি ফেলে দেব। টপ করে ফেলে দেব। আমার সাথে হুঁজ্জত। শালার পোঁদ পেকে গেছে। পোঁদ পাকার ওষুধ আমার কাছে আছে।
ইলেকশন করবেন। কমিশনার ইলেকশন। ৬নং ওয়ার্ড।
ছয় নম্বর ওয়ার্ড আমি শালার পাছা দিয়ে ঢুকায়ে দেব। ছয় নম্বর ওয়ার্ড! শালা খবিস।
একটু আস্তে কথা বলেন বাকের ভাই।
আস্তে কথা বলব কেন? এটা কী মসজিদ নাকি?
না মানে লাগানি-ভাঙানির লোক আছে তো।
আমি ভয় খাই নাকি? আমি ভয় খাওয়ার লোক?
জলিল মিয়া বিমর্ষ মুখে তাকাতে লাগল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে বড় রকমের ঝামেলা শুরু হতে যাচ্ছে। শুরুটা তার দোকান থেকে না হলেই ভাল হত। সিদ্দিক সাহেব বর্তমানে পাড়ার মুরুকিব। মানী লোক। উঠতি গুণ্ডী প্রায় সব কটাকে হাত করে ফেলেছেন। দু’একটা অচেনা মুখ আজকাল তার সঙ্গে দেখা যায়। ওদের চালচলন ভাল না। একজন সেদিন তার সটলে এসে চা ওমলেট খেল। দাম না দিয়ে চলে যাচ্ছিল। আটকানোর পর দাম দিল ঠিকই কিন্তু এমন করে হাসল যে রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। নির্বিঘ্নে ব্যবসা করার দিন শেষ। জলিল মিয়া একা ক’দিন সামলাবে।
জলিল মিয়া!
জি বাকের ভাই।
ঐ বাড়ির খবর কি?
কোন বাড়ির?
ঐ যে তিন কন্যার বাড়ি?
কিছু জানি না তো।
কিছু জানি না মানে? খোঁজখবর রাখু না?
নানান ধান্ধায় থাকি। ব্যবসা পাতির অবস্থা খুব খারাপ।
কি বল ব্যবসা পাতির অবস্থা খারাপ। দশ সেরা গোসত লেগেছে তোমার শরীরে। আধাসের আধাসের করে তোমার দুই গালেই আছে একসের। গোসত তো আর আপনা–আপনি হয় না।
চা দিব বাকের ভাই? কোন চা আছে। ইসপিসোল।
বাকের জবাব না দিয়ে উঠে পড়ল। পাড়ায় একটা চক্কর দেবে। এর মধ্যে পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে তো ভালই দেখা না হলেও ভাল। ভালমত সাবান দিয়ে একটা গোসল দেয়া দরকার। ইয়াদের বাসায় যাওয়া যেতে পারে। গোসলের পর গরম চা আর একটা বেনসন খেয়ে লম্বা ঘুম;
পরিচিতদের মধ্যে দুজনের সঙ্গে দেখা হল একজন হচ্ছে মোহসিন। বেশ কিছু দিন সে বাকেরের শাগরেদী করে এখন জগন্নাথ কলেজে বি কমে ভর্তি হয়েছে। শুক্রবারে জুম্মার নামাজ পড়ে। বাকেরের সঙ্গে দেখা হলে না চেনার ভান করে। আজ অবশ্যি তা করল না। চোখ কপালে তুলে বলল, বাকের ভাই না?
হুঁ। আছ কেমন?
কবে ছাড়া পেলেন বাকের ভাই?
বাকের গম্ভীর গলায় বলল, ছাড়া পাইনি। ছুটি নিয়ে এসেছি। সিদ্দিক হারামজাদাকে খুন করার জন্যে ছুটি নিলাম। খুন করে আবার গিয়ে ঢুকে পড়ব।
কি যে বলেন বাকের ভাই।
কথাবার্তা পছন্দ হয় না? সত্যি কথা বললাম।
আপনার চেহারা খারাপ হয়ে গেছে বাকের ভাই।
চেহারা দিয়ে আমি করব কী বল, আমি তো আর সিনেমায় পার্ট করব না।
বাকের তাকে আর কিছু বলার সময় না দিয়ে এগিয়ে গেল। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হবার ইচ্ছাটা মরে যাচ্ছে। তবু দ্বিতীয়জনের সঙ্গে দেখা হল জোবেদ আলি। এই চার মাসে লোকটা যেন আরো বুড়ো হয়ে গেছে। যে ভাবে মাথা নিচু করে হাঁটছে তাতে মনে হয়। পিঠে কুজ গজিয়ে যাবে। জোবেদ আলি বাকেরকে না দেখার ভান করে সরে পড়তে চাইছিল। বাকের সে সুযোগ দিল না। এগিয়ে গেল এই যে ব্রাদার, পালাচ্ছেন নাকি?
জোবেদ আলি আমতা আমতা করে বলল–কে?
চিনতে পারছেন না? ভাল করে দেখেন। মাথাটা কামিয়ে ফেলেছি। বাকি সব ঠিকই আছে।
আমার কিছু মনে থাকে না।
সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে চারপাশে নিয়ে থাকেন মনে না থাকারই তো কথা। আমার নাম বাকের।
ও আচ্ছা বাকের সাহেব।
চিনতে পারছেন তাহলে?
জি। অনেক’দিন আপনাকে দেখি নাই।
দেখবেন কি করে–আমি হাজতে ছিলাম। আপনাদের দোয়ায় আজ ছাড়া পেয়েছি।
জোবেদ আলির চোখ সরু হয়ে গেল। চশমা ঝুলে পড়ল। সে প্রায় ফিসফিস করে বলল, এখন যাই। কাজ আছে।
আরে ভাই এই চৈত্র মাসের দুপুরে কিসের কাজ? দাঁড়ান একটু গল্পগুজব করি। মেয়ে কি আপনাদের এখনো তিনটাই না। আরো বাড়িয়েছেন?
আপনার কথা বুঝলাম না।
বিজনেস আরো বড় করেছেন না। আগের মত ছোটখাটো আছে?
আপনি খুব বেতালা কথা বলেন।
তাই নাকি?
বেতালা কথা বেশি বলা ভাল না।
জোবেদ আলি হাঁটা শুরু করল। মাথা নিচু করে চোরের মতো ভঙ্গিতে হাঁটা। একবার শুধু থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরল। বাকের তাকিয়ে আছে। তার মুখ হাসি হাসি। কিছুক্ষণ আগে যে বিরক্তি তাকে ঘিরে ছিল এখন আর তা নেই। তার বেশ মজা লাগছে। ইয়াদের বাসায় যাবার ব্যাপারে এখন বেশ আগ্রহ বোধ করছে।
ইয়াদ বাসায় ছিল না।
দরজা খুলল তার বৌ। ছোটখাটো একটা মেয়ে মাত্র গোসল করে এসেছে। চুলে গামছা জড়ানো গায়ের শাড়িও ভালমত পরা নেই। সে ভেবেছে ইয়াদ। কড়া নাড়া মাত্র দরজা খুলে এমন হকচাকিয়ে গেছে। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, উনি বাসায় নেই।
কোথায় গেছে?
অফিসে।
আমার নাম বাকের। আজ হাজত থেকে ছাড়া পেয়েছি।
মেয়েটি কিছুই বলল না। সে শাড়ি দিয়ে নিজেকে ভালমত ঢাকতেই ব্যস্ত।
ইয়াদ আসবে কখন?
সন্ধ্যার পর আসবে। আপনি সন্ধ্যার পর আসুন।
মেয়েটি এমন ভাবে দরজা বন্ধ করল যেন সে একজন ভিখিরিকে পয়সা দিয়ে বিদেয় করে দিচ্ছে। বাকেরের মন অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা বলতে পারত। আপনি বসূন। বসুন বললেই তো সে খালি বাড়িতে হুঁট করে ঢুকে যেত না। মেয়েটি তাহলে এ রকম করল কেন? কোথায় যাওয়া যায়? সারা গায়ে প্রচুর ফেনা তুলে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল কবার জন্যে মন কেমন করছে। গোসলের পর গরম এক কাপ চা। একটা ফাইভ ফাইভ কিংবা বেনসন।
বাকের আবার রাস্তায় নামল। সূর্য হেলে পড়েছে। কিন্তু এখনো তার কী প্রচণ্ড তেজ। রাস্তায় পিচ গলে যাচ্ছে। জুতার সঙ্গে লেগে সমান মোটা হলে একটা কথা ছিল … একটা বেশি উঁচু অন্যটা। কম। যার জন্যে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে।
বাকের ভাই না? কবে ছাড়া পেয়েছেন?
অচেনা একটা ছেলে। দাঁত বের করে আছে। ইয়ারকি দিতে চায় সম্ভবত। কিংবা তাকে দেখে যে কোন কারণেই হোক মজা পাচ্ছে।
আপনাকে অবিকল কোজাকের মতো লাগছে।
তাই নাকি?
ছেলেটি মাথা ঝাকাল। বাকের একবার ভাবল ব্যাপারটা গুরুত্ব দেবে না। চেংড়া ছেলে।পুলের সব কথা ধরতে নেই। তবু শেষ সময়ে মাথায় কি যেন হল বাকের প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিল। ছেলেটি ছিটকে পড়ল। রাস্তায়–সেখান থেকে গড়িয়ে গেল আরো কিছু দূর। সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। কপাল ফেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে।
বাকের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। চায়ের পিপাসা হচ্ছে। জলিল মিয়ার স্টলে গিয়ে এক কাপ চা খেলে হয়। মুখের ভেতরটা তেতো লাগছে। সারা শরীরে ঘামের কটু গন্ধ। আশ্চর্য কোথাও গিয়ে সে কি শান্তিমত একটা গোসল ও করতে পারবে না? মুনার কাছে গেলে কেমন হয়?
ঠিক এই অবস্থায় মুনার সামনে উপস্থিত হবার কোন মানে হয় না। তাছাড়া মুনাকে এখন নিশ্চয়ই পাওয়াও যাবে না। অফিস করছে। সন্ধ্যার আগে ফিরবে না। অফিস করা মেয়েগুলি আবার অফিস ছুটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফিরতে পারে না। সাজানো-গোছানো দোকান দেখলেই তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে; ঘণ্টা খানিক চলে যায়।
বাকের সন্ধ্যর পর পর মুনাদের বাসার দিকে রওনা হল। ইতিমধ্যে তার বেশভূষা পাল্টে গেছে। গায়ে ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি (ইয়াদ দিয়েছে), নতুন স্যান্ডেল (কেনা হয়েছে), পকেটে নতুন রুমাল (কেনা)। গালে আফটার শেভ দেয়ায় ভুরিভুর করে গন্ধ বেরুচ্ছে। এটা একটু অস্বস্তিকর। আফটার শেভ না দিলেই হত।
মুনাদের বাসায় বিরাট এক তালা ঝুলছে। বাকের তালা ধরেই খানিকক্ষণ ঝাকাঝাকি করল। অফিস থেকে এখনো ফিরেনি তা কি করে হয়? আটটা বাজে। রাত আটটা পর্যন্ত মুনা বাইরে ঘুরবে: নাকি? তালার সাইজ দেখে মন হয় মুনা বেশ কিছু দিন ধরেই বাইরে। অফিসিযাত্রীরা এত বড় তালা লাগায় না।
রাত নটার দিকে বাকের আবার গেল। এখনো তালা ঝুলছে। ঘর অন্ধকার। বাড়িওয়ালার কাছ থেকে জানা গেল দিন দশেক আগে মুনা তাকে বলেছে সে কিছু দিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে কবে ফিরবে কিছু বলে যায়নি।
বাকের থমথমে গলায় বলল, কোথায় গেল জিজ্ঞেস করলেন না?
বাড়িওয়ালা বিরক্ত স্বরে বলল, আমার এত ঠেকা কিসের?
কথার ধরনে বাকেরের রাগ উঠে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে সে রাগ থামাল। মনে মনে কয়েকবার বলল, লাশা, লাশা। উল্টো করে শালা বললে রাগ নাকি কমে যায়। এই জিনিসটা সে হাজতে শিখে এসেছে। ব্যাপারটা সত্যি না। বাকেরের রাগ কমল না। তবুও সে কয়েকবার বলল–লাশা লাশা।
বাড়িওয়ালা হারামজাদা, মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল।
চলবে..