অবশেষে দোতলার ভৌতিক বাসাটা ভাড়া হলো।
আগামী পরশু থেকে ভাড়াটিয়া উঠবে। -ভেবেছিলাম একদম ফাঁকা পড়ে থাকার থেকে মাস শেষে যা কিছু আসে তাতেই লাভ। কিন্তু ছেলেটা বেশ ভালো দামেই বাসাটা ভাড়া নিচ্ছে।
আতিক সাহেবের কথা শুনে সাহেরা বেগম মুখে একটু ফিকে হাসি টেনে বললো,
-ভাড়া তো কতো জনই নিলো। ১ সপ্তাহের বেশি তো কেউ ই টিকতে পারলো না। বাসায় ওঠার দু’দিন পরে তো ঠিক সেই ভুত ভুত বলে পালাবে,অযথা ঝামেলা টানার দরকারটা কি ছিলো শুনি?
সাহেরা বেগমের কথা শুনে একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে আতিক সাহেব বলে,
-না গো,এবার সেই ভুল আর করিনি। ছেলেটার নাম সোহান। তাকে শুরুতেই সবটা খুলে বলেছি, বুঝলে তো। আমার কথা শুনে ছেলেটা তো হো হো করে হেঁসে উঠেছে।আমাকে বলল, এই যুগে এসে ভুতের ভয়ে বাসা ছেড়ে পালানোর বিষয়টা সত্যিই অদ্ভুদ।ভুত বলতে পৃথিবীতে কিছু নেই,যা আছে সবই মস্তিষ্কের ভুল ধারণা। উল্টো আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি কখনো নিজ চোখে কিছু দেখেছি কিনা। আমি না বলাতে বলে, নিজ চোখে না দেখে অন্যের কথা কেন বিশ্বাস করলেন?
ওর প্রশ্নটা শুনে মনে আসলো, আসলেই তো। আমি নিজে তো কখনো কিছু দেখিনি। তবে এতোগুলো মানুষের মুখের কথাকে মিথ্যা ভেবে বিষয়টা এড়িয়ে যাই কিভাবে বলো?
ছেলেটি আরও বললো, ভুত-প্রেতে সে বিশ্বাস করে না। আর যদি এমন কিছু থেকেও থাকে সেই ভুতকে নাজেহাল করে তাড়ানোর পদ্ধতিও নাকি তার জানা আছে। আমিও আর কথা বাড়াইনি।
ছেলেটা ডাক্তার, বউ নিয়ে থাকবে। শিক্ষিত একটা পরিবার আসছে, এতে মন্দ কি?
-তাহলে তো ভালোই হলো।সে যদি মানিয়ে চলতে পারে তাহলে আমাদের আর আপত্তি কি বরং আমাদের তো ভালোই হবে।
টেবিলে বসে দুপুরের খাবার খেতে খেতে কথা বলছিলো বাড়ির মালিক আতিক সাহেব ও তার স্ত্রী সাহেরা বেগম। দু’টো সন্তান নিয়ে তাদের ছোট পরিবার। দুই ছেলেই বিয়ে করে এমেরিকায় স্থায়ী হয়ে গেছে। বাংলাদেশে সাহেরা বেগম তার বোনের ছেলে সুমনকে নিয়ে বসবাস করেন।বোন মারা যাওয়ার পর থেকে সুমন বড় হয় সাহেরা বেগমের কাছেই। সুমনকে নিয়ে তাদের অনেক স্বপ্ন ছিলো। পড়ালেখা করে তাদের সন্তানের মতো সুমনও অনেক ভালো ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে। কিন্তু সুমনের কিছু ব্যবহারে আশাহত হতে হয় তাদের। টাকা পয়সা, আদর ভালোবাসা কোনোকিছুর কমতি না থাকার পরেও একদম অধঃপতনে গিয়েছে সুমন। খারাপ ছেলেদের ভেতরে যত ধরণের বদঅভ্যাস থাকা প্রয়োজন সবকিছুই তার মাঝে বিদ্যমান। ভালো পথে আনার জন্য আতিক সাহেব কম চেষ্টাও করেননি কিন্তু ফলাফল শূন্য। তবুও তিনি তার চেষ্টায় বহাল। এই ছেলেকে নিয়ে আতিক সাহেবের চিন্তার শেষ নেই।
.
.
.
.
কথা হচ্ছিল আতিক সাহেবের বাড়ির দ্বিতীয় তলার একটা বাসা নিয়ে। অনেকের অভিযোগ ওই বাসায় নাকি অলৌকিক কিছুর অস্তিত্ব আছে। ভুল করেও কেউ ওই বাসায় উঁকি মারার সাহসটুকুও করে না। ভাড়া কম দেখে কেউ কেউ বাসাটা ভাড়া নিলেও, ১ সপ্তাহের ভেতর সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এভাবে অনেক ভাড়াটিয়া এসেছে আবার চলেও গেছে।এরপরে প্রায় চার মাস ধরেই বাসাটা একদম খালি পড়ে ছিল। ভাড়া হওয়ার আশাও একদম বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন আতিক সাহেব। কিন্তু আজ সকালে হঠাৎ করেই বাসাটি ভাড়া হয়ে যাওয়ায় আতিক সাহেব বেজায় খুশি হন।
.
.
.
.
আজ সোমবার।
দ্বিতীয় তলার বাসাটিতে আজ সেই ডাক্তার ছেলেটার ওঠার কথা ছিলো। কিন্তু সারাদিন পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পরেও তার কোনো খোঁজ পায় না আতিক সাহেব। অগত্যা নিজের থেকেই একটা কল করেন তিনি। ওপাশ থেকে সোহান নামক ছেলেটা জানায়, সবকিছু গোছাতে একটু সময় লাগছে তাদের।
বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে একটু রাত হতে পারে। বেশি রাত হলে দারোয়ানের কাছে চাবি দিয়ে রাখবে জানিয়ে আতিক সাহেব ফোনটা কেটে দেয়।
.
.
.
.
রাত বারোটা বেজে পঁচিশ মিনিট।
গাড়ির হর্ণের শব্দ শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে পরে দারোয়ান।
গাড়ি থেকে নেমে আসতে দেখে সুদর্শন একজন যুবককে। দারোয়ান একটু এগিয়ে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে, তিনি “ডাক্তার সোহান” কি না!
যুবকটি হ্যা-সূচক জবাব দিতেই দারোয়ান তড়িঘড়ি করে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়, জিনিসপত্র সব নামিয়ে বাসায় উঠিয়ে দিতে। গাড়ির দিকে যেতেই সোহান দারোয়ানকে বাঁধা দিয়ে জানায়,সে একাই সবকিছু নিতে পারবে। দারোয়ানও কিছু না বলে বাড়ির চাবিটা দিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ে।
.গাড়ির হর্ণের শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেছিলো সাহেরা বেগমেরও। বিছানা থেকে উঠে জানালার কাছে এসে গেটের দিকে তাকিয়ে ছিলো সে।
সাহেরা বেগম দেখতে পান, একটি ছেলে হাতে কিছু ব্যাগ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। তার পেছনে পেছনে হেঁটে যাচ্ছে বোরকা পড়া একজন মেয়ে। সাহেরা বেগম বুঝতে পারেন দোতলার ভাড়াটিয়ারা এসে গেছে।
ছেলেটা ব্যাগসহ তার স্ত্রীকে বাসায় রেখে আবারও গাড়ির কাছে ফিরে আসে। গাড়ি থেকে বড় বড় দু’টি পুতুুল বের করে। দেখতে একদমই মানুষের মতো। দেখে মনে হচ্ছে কোনো পুতুল রূপী মানুষ। এই পর্যন্ত সাহেরা বেগম সরাসরি কখনোই এতো বড় পুতুল দেখেননি।
চারতলা থেকেই বোঝা যাচ্ছে পুতুলের ভেতরের একটি ছেলে এবং অপরটি মেয়ে ।
দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে ঘুমে ঢুলতে দেখে সাহেরা বেগম বেশ রেগে যান। মনে মনে ঠিক করে নেন একবার সকাল হোক এই ঘুমের কারণে কাল আবারও খুব বকা দিতে হবে তাকে।
.
.
.
.
পরদিন সকাল।
সাহেরা বেগম, আতিক সাহেব ও সুমনকে চা দিয়ে তাদেরকে জানান, দোতলার ভাড়াটিয়ারা কাল রাতে এসে পড়েছে। আতিক সাহেব “ওহ আচ্ছা ” বলে নিউজ পেপারে চোখ বুলাতে থাকেন।
সাহেরা বেগম আবারও নিজ থেকে বলেন,
-“নতুন সংসার বোধহয় বুঝলে তো!
আসবাবপত্র তেমন কিছুই দেখলাম না। শুধু দেখলাম বড় বড় কয়েকটি ব্যাগ এনেছে। আর বড় বড় দু’টো পুতুল। এতো বড় পুতুল যে, তুমি দেখলেও অবাক হতে । পুতুলগুলো কি সুন্দর! মনে হয় জীবন্ত কোনো মানুষ। তবে যাই হোক নতুন ভাড়াটিয়া আসলো একবার গিয়ে তাদের সাথে কথা বলা উচিৎ তাই না বলো?”
আতিক সাহেব নিউজ পেপার থেকে মুখ তুলে বললেন,
-“হ্যা তা তো অবশ্যই। কাল আসার পরে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা,সবকিছু ঠিকঠাক গুছিয়ে নিতে পারলো কিনা সে ব্যাপারে একটু খোঁজখবর তো নিতেই হয়। একটা কাজ করো কিছু নাস্তা নিয়ে বরং ওদের সাথে দেখা করে আসো।”
সাহেরা বেগম আতিক সাহেবের কথায় সম্মতি জানিয়ে উঠে রান্নাঘরে চলে যান।
.
.
.
.
প্রায় ১০ মিনিট ধরে দোতলার কলিংবেল বাজিয়ে চলেছে সাহেরা বেগম। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো ধরণের সাড়াশব্দ পায় না সে। এভাবে আরও কয়েকবার কলিংবেল প্রেস করতেই ভেতর থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, -“কে?”
-“আমি চারতলা থেকে এসেছি। তোমাদের বাড়িওয়ালা আন্টি।”
সাহেরা বেগমের প্রতিউত্তরে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। তবে কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে দেয় ২৮-৩০ বছর বয়সী একজন যুবক।
এসে সাহেরা বেগমকে সালাম জানিয়ে বলে,
সে “ডাক্তার সোহান”।
সাহেরা বেগম কুশল বিনিময় শেষে জিজ্ঞেস করেন এখানে থাকয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। সোহান না সূচক জবাব দিয়ে জানায় তাদের বাসাটা খুব পছন্দ হয়েছে। সাহেরা বেগম সোহানকে তার স্ত্রীর কথা জিজ্ঞেস করলে সোহান জানায় সে এখন ঘুমাচ্ছে।
বেলা ১১ টা পর্যন্ত কেউ ঘুমাচ্ছে শুনে বেশ অবাক হয় সাহেরা বেগম। পরমুহূর্তে আবার ভাবে হয়ত সারারাত ধরে বাসার কাজে ব্যস্ত ছিলো তাই ক্লান্ত শরীরে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে।
নিজের চিন্তাকে দীর্ঘ না করে সাহেরা বেগম সোহানকে তার স্ত্রীর নাম জিজ্ঞেস করেন।
ডাঃসোহান জানায় তার স্ত্রীর নাম “তাবিয়া”
সাহেরা বেগম আর কথা না বাড়িয়ে ডাঃ সোহানের দিকে নাস্তার প্লেট এগিয়ে দেন। সোহান সাহেরা বেগমের হাত থেকে প্লেটটি নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দেয়।
.
.
.
.
বাসায় ঢুকে রাগে গজগজ করতে থাকে সাহেরা বেগম। আতিক সাহেব “কি হয়েছে?” জিজ্ঞেস করতেই সাহেরা বেগম বলে ওঠে,
-“শিক্ষিত মানুষ ঠিক আছে কিন্তু এক ফোঁটা সভ্যতাও কি তার ভেতরে নেই? দরজার সামনে গিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম তাদের কোনো সাড়াশব্দ নেই, দরজা খুললো বিশ মিনিট পর। দরজার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে কথা বলে গেল আমার সাথে। ভেতরে গিয়ে একবার বসতেও বলল না।
এমনকি প্লেটটি নিয়ে মুখের উপর দরজা আটকে দিলো। এটা কোন ধরণের ভদ্রতা বলো তো?”
আতিক সাহেব সাহেরা বেগমকে তেমন কিছুই বললেন না। শুধু বললেন, বাসা হয়ত অগোছালো নতুন উঠেছে তাই লজ্জায় তোমাকে ভেতরে নেয়নি।
.
.
.
.
.
এভাবে কেটে গেলো বেশ কিছুদিন।
এরমাঝে ডাঃ সোহানের থেকে বাসা নিয়ে কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি। সবার ধারণা হয়ত অলৌকিক শক্তির প্রভাব কেটে গেছে বাসা থেকে।
তবে আজ সকাল থেকে পুরো বাড়িতে হৈ-হুল্লোড় লেগে আছে। তিনদিন ধরে সুমন গায়েব। বন্ধুদের বাসায় গিয়ে মাঝে মাঝেই সময় কাটায় সুমন তবে না জানিয়ে কখনো দু’দিনের বেশি বাড়ির বাইরে সময় কাটায় নি। এবার হঠাৎ তিনদিন ধরে লা-পাত্তা হওয়ায় চিন্তায় পড়ে যায় আতিক সাহেব ও সাহেরা বেগম দুজনেই। ইতিমধ্যে
থানায় একটা মিসিং ফাইলও করে এসেছেন আতিক সাহেব। মাঝেমধ্যে এভাবে না জানিয়ে কোথাও চলে যাওয়া সুমনের পুরোনো অভ্যাস। দুশ্চিন্তা হলেও তারা আশা রাখেন খুব শীঘ্রই সুমন ফিরে আসবে।
.
.
.
ডাঃ সোহান তাদের বাসায় ওঠার পরে কাগজপত্রের ফর্মালিটিগুলো সারা হয়নি। সাহেরা বেগম এ উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকবার সোহানের বাসায় গেলেও ফিরে আসতে হয়েছে তাকে। দিনের বেশিরভাগ সময়ই বাসা তালাবদ্ধ অবস্থায় থাকে।
আজ হঠাৎ দরজা খোলা পেয়ে কয়েকবার কলিংবেল প্রেস করে সাহেরা বেগম।
কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে একটা মেয়ে এসে দরজা খুলে দেয়। ওড়না দিয়ে খুব সুন্দর করে মাথা ঢেকে রাখা। শুধু মুখ আর কিছু দেখা যাচ্ছে না তার। বেশ মায়াবী চেহারা মেয়েটির। তাকে দেখে সাহেরা বেগম বুঝতে পারে সে-ই ডাঃ সোহানের স্ত্রী “তাবিয়া”।
তাবিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে সাহেরা বেগম দেখতে পান, তাবিয়ার চোখ দু’টি পানিতে ছলছল করছে। লাল টকটকে ঠোঁটদুটো অনবরত কাঁপছে। মনে হচ্ছে তাবিয়া চোখের ভাষায় অনেক কিছু বলতে চাচ্ছে, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছে না।
মেয়েটাকে দেখে অনেক মায়া হয় সাহেরা বেগমের। সাথে তার মনে জাগে কৌতুহলও। সাহেরা বেগম কিছু একটা বলতে যাবেন এর মধ্যেই ভেতর থেকে ডাঃ সোহানের ডাক ভেসে আসে। সোহানের গলা শুনেই তাবিয়া কিছুটা কেঁপে ওঠে। সাহেরা বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দৌড়ে ভেতরে চলে যায়।
পুরো বিষয়টাই সাহেরা বেগমের বেশ অদ্ভুত লাগে। নিজের কাছেই নিজে প্রশ্ন রাখে,
” তাবিয়া কি বিশেষ কিছু বোঝাতে চেয়েছিলো আমাকে? যদি তাই হয় তাহলে কি বলতে চায় সে যা সরাসরি মুখে বলতে পারছিলো না?”
.
.
.
.
চলবে…?
ইনসাইড_দ্যা_ডোর
#পর্ব_১
লেখিকা_সাইবা_চৌধুরী