#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২৮
ইমাদ ব্যাগ থেকে দীপা আর কাদিনের বিয়ের উপহার বের করল। দুজনের জন্য দুটো ঘড়ি। গিফ্টবক্সটা হাতে নিয়ে দীপার ঘরের দিকে যেতেই আবার কারেন্ট চলে গেল। ইমাদ থমকে দাঁড়াল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফ্ল্যাশ লাইটের আলোতে পা এগুতেই দেখল পেছন থেকে কড়ি দ্রুত হেঁটে ওকে ক্রস করে সামনের দিকে গেল। ইমাদ মোবাইল উঁচু করে ধরে কড়ির পথে আলো দিলো। এ বাড়িতে কড়িকে চোখ বন্ধ করে ছেড়ে দিলেও কড়ি দৌড়ে দৌড়ে চলতে পারবে। কোনো সমস্যা নেই। তাই সে পেছনে না তাকিয়েই বলল, “আমার আলো লাগবে না। আপনি সাবধানে হাঁটুন।”
বলতে না বলতেই কড়ির পেছনে ইমাদ ঘরের দাওয়ায় হোঁচট খেয়ে পড়ল। কড়ি পেছন ফিরে তাকাল। ইমাদের হাত থেকে লাল র্যাপিং পেপারে মোড়ানো সুন্দর একটা গিফ্টবক্স ঘরের মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। শক্ত করে ধরে রাখায় মোবাইলটা হাত থেকে পড়ল না। মোবাইলের আলোতে কড়ি দেখল গিফ্টবক্সের উপর লেখা “টু দীপু এন্ড কাদিন ভাইয়া।” ইমাদ উঠে দাঁড়িয়ে বক্সটা তুলল। কাদিন ডাকছিল তাই কড়ি চলে এল।
“কিরে কিসের শব্দ হলো? ঠিক আছিস?”
“মেজো ভাবির ফ্রেন্ড হোঁচট খেয়ে পড়েছে।”
ইমাদ বলল, “আসব?”
কাদিন বলল, “হ্যাঁ অবশ্যই।”
“চোখ দুইটা কই ছিল তোর? আয় বস।” দীপা সরে জায়গা করে দিলো।
ইমাদ দীপার পাশে বসতেই কাদিন বলল, “একটু চা করে আন, কড়ি। কতক্ষণ ধরে রিমা আপুকে খুঁজছি, পাই না। ওরাও আছে একসাথে খাব।”
দীপা বলল, “আরে ওকে বলছেন কেন? এই গরমে ও এখন রান্নাঘরে চা করতে যাবে? খোকার মা না কে যেন আছেন ওই খালাকে বললেই ত হয়।”
কাদিন বলল, “আমি বাইরের কারো হাতে কিছু খাই না।”
দীপা ফিক করে হেসে ফেলল, “হোটেলে, রেস্টুরেন্টে, দাওয়াতে গেলে কি করেন? ঐগুলাও কি রিমা আপু আর কড়িই রান্না করে দিয়ে আসে?”
কাদিন বলল, “বাইরের খাবার খাই না।”
“দেখি কি করে আজ না খেয়ে বাঁচেন! এই কড়ি তুমি কোথাও যাবে না। এখানেই বসো। আমি চা করে নিয়ে আসি। না খেলে জোর করে খাওয়াব তোমার ভাইকে।”
কড়ি মিটিমিটি হাসতে হাসতে বসল, “আচ্ছা ঠিক আছে।”
দীপা চা করতে চলে গেল। কাদিন দীপার পিছু নিয়ে রান্নাঘরে এল। রান্নাঘর ফাঁকা পেয়ে কাদিন রাগের স্বরে বলল, “তোমাকে করতে হবে না। সরো তুমি। আমি করছি।”
“কেন? কেন? এত নকশা কেন আপনার? এই অভ্যাস ছাড়েন।”
“তোমার বুঝা উচিত যে আমি তোমার হাতের চা খাব না বলেই কড়িকে ডেকেছি। নাহয় তোমাকেই বলতাম।”
“চা আমার হাতের কি করে হয়? চা তো হবে চা পাতার। আমাকে কি চা পাতা মনে হয়?”
কাদিন বলল, “তোমার যা ইচ্ছা তাই করো। আমার চা খাওয়ার শখ মিটে গেছে।”
দীপা হঠাৎ খুব কষ্ট অনুভব করল। মনমরা হয়ে মুখভার করে বলল, “আমাকে কেন এত ঘেন্না করেন আমি বুঝে পাই না।”
কাদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “তুমি কিচ্ছু বুঝো না, দীপা। কিচ্ছু না! রাগও বুঝো না। সবকিছু তোমাকে এক্সপ্লেন করতে হয়। নিজ থেকে কিছু বোঝার ক্ষমতা আল্লাহ তোমার এই ফাঁকা মাথাটায় দেয়নি।”
দীপা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল বলে কাদিনের আরো রাগ হলো। সে কঠিন গলায় বলল, “এখনো বুঝোনি? আরো খুলে বলতে হবে? আরো? ওকে ফাইন। তাহলে শুনো। রিমা আপু, কড়ি আর তুমি বাদে আর সবাই বাইরের লোক। তোমার উপর রেগে আছি তাই তুমি এখন চা করে দিলেও খাব না। এখন প্লিজ বলো না যে কেন রেগে আছি তা তুমি জানো না।”
কাদিন এমনভাবে তাকিয়ে, এত শক্ত করে কথাগুলো বলল যে দীপার চোখে জল এসে যাচ্ছিল। এখন মোটেও কাঁদা যাবে না। কেঁদে ফেললে কাদিন আরো বেশি রাগ করবে। কিন্তু দীপা কি করবে? ওকে কেউ একটু কড়া করে কথা বললেই কান্না এসে যায়। না কান্না করা যাবে না। দীপা ঢোক গিলে কান্না আটকাল। কাদিন বলল, “তুমি এখন এখান থেকে যাও।”
দীপা অনেক কষ্টে বলল, “আচ্ছা।”
দীপা চলে যাচ্ছিল। কাদিন বিরক্ত হয়ে গেল, “এখন যেও না। দাঁড়াও এখানে। এখন চা না নিয়ে গেলে তোমার বন্ধুরা কি বলবে?”
কাদিন নিজেই ডেকচিতে পানি বসাল।
দীপা রান্নাঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। নীচের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নখ দিয়ে দরজা খুটছে। কাদিন ফিরে তাকিয়ে বলল, “চেহারা এরকম বানিয়ে রেখেছ কেন? তোমাকে আমি এমনকিছু বলিনি যে এরকম থোতা নামিয়ে রাখতে হবে। আর নখ দিয়ে দরজা খুটছ কেন? এগুলো কোনধরনের অভ্যাস? নিজের বয়স দেখেছ? আমার ছোটবোন কড়ি থেকেও তুমি কত সিনিয়র অথচ, আচরণ পনেরো ষোলো বছরের টিনএজারদের মতন। আমার বাচ্চাকাচ্চাগুলো যেন অন্তত তোমার মত নাহয়। হলে মুহূর্তে মুহূর্তে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবে।”
দীপা এবার কেঁদেই ফেলল। কাদিন বুঝে উঠার আগে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে চোখ মুছে ফেলল সে। চা হয়ে যাওয়ার পর কাপে চা ঢেলে ট্রেটা দীপার হাতে দিলো কাদিন। বলল, “নিয়ে যাও। ওদের আবার বলো না যে আমি করেছি।”
দীপা পা বাড়াতেই কাদিন বলল, “সাবধানে।”
কারেন্ট চলে এল। কাদিন বলল, “ভালো হয়েছে। যাও তুমি, আমি আসছি।”
দীপা মাঝপথেই ট্রে হাত থেকে ফেলে দিলো। সবগুলো কাপ ভেঙে গেল। গরম চায়ের কিছু পড়ল দীপার শাড়িতে, পায়ে আর বাকিটুকু মেঝেতে ভেসে গেল। দীপার পা পুড়ে গেল। তবুও টু শব্দ সে করল না। কাদিন রান্নাঘর থেকে দ্রুত এল। দীপা ভাঙা কাপ তুলতে তুলতে অসহায়ের মতন ঘাবড়ানো গলায় বলল, “স্যরি, স্যরি, স্যরি, কীভাবে যেন পড়ে গেছে। স্যরি।”
কাদিন দীপার হাত টেনে ধরে ওকে সরিয়ে আনল, “কিছু হবে না। এগুলো ছাড়ো। দেখি তোমার পায়ে পড়েনি তো?”
কাদিন ঝুঁকে দীপার পায়ের পাতা দেখল। ফোসকা পড়ে গেছে। বাড়ির সবাই শব্দ শুনে ছুটে এল। কাদের সাহেব বললেন, “এখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন? বৌমাকে ঘরে নে।”
দীপা ঘরে যেতেই কড়ি দ্রুত টুথপেস্ট এনে দিলো। দীপাকে দেখে ইমাদ আর নিলয় ভীষণ অবাক হলো! পায়ে ফোসকা পড়ে গেছে অথচ, দীপা একদম চুপ। একবারো মরে যাচ্ছি, মরে গেলাম, আহ আমি শেষ জাতীয় কিছু কিংবা চিৎকার চেঁচামেচি, কান্নাকাটি কিছুই করছে না। ঝড়ে কুঁকড়ে যাওয়া পাখির মতন চুপসে বসে আছে। নিলয় ত বলেই ফেলল, “দোস্ত, কি হয়েছে তোর?”
দীপা বলল, “কই কিছু না।”
এভাবে থাকলে নিলয়রা সব বুঝে ফেলবে তাই দীপা মজা করার চেষ্টা করে বলল, “ভাবছিলাম তোরা দুইটা কত বড় কিপ্টা হলে আমার বিয়ের গিফ্ট এখনও আমাকে দিসনি। ছিহ্ শেইম অন ইউ। তোরা মরতে পারিস না? মর। কলা গাছে ফাঁসি দিয়ে মর। এক গ্লাস পানিতে ডুবে মর।”
নিলয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “স্যরি দীপু। এই মাসটায় আমি অনেক প্যারায় আছিরে। খুব টানাটানি অবস্থা। তাই তোর বিয়ের গিফ্ট কিনতে পারিনি। ভালো একটা কিছু দিতে চাই। তাই দুই তিন মাস সময় নিচ্ছি।”
কাদিন আরেকদফা বিরক্ত হলো দীপার উপর। যত ভালো বন্ধুই হোক মজার ছলেও এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি ওর। যেহেতু গিফ্ট দেয়নি সেহেতু নিশ্চয় কোনো একটা সমস্যা আছে সেটা তার বুঝা উচিত ছিল। আবার বলল তো বলল কড়ি আর তার সামনে বলল। ছেলেটা লজ্জা পেলো না? আহা অবুঝ বউটা তার!
দীপা কথাটা বলে নিজেও বিপদে পড়ে গেল। এখন কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ইমাদ বলল, “আমারো একই হাল।” কড়ি চমকে তাকাল। সে নিজ চোখে গিফ্টবক্স দেখেছে। কড়ি ইমাদের পকেটের দিকে তাকাল। বক্সটা এখনও পকেটে।
নিলয় হেসে দিলো, “হায়রে দীপু তোর ভাগ্য বহুত খারাপ। গরীব গরীব সব বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরিস তুই।”
দীপা বলল, “প্লিজ তুই এইসব ফালতু কথা বলবি না তো। আমাকে চিনিস না? আমি অনেককিছু বুঝি না। মজার ছলে বলেছিলাম।”
ইমাদ বলল, “রেস্ট নে তুই। আমরা যাই।”
ইমাদ আর নিলয় বেরিয়ে যেতেই কড়িও ইমাদের পেছন পেছন গেল। নিলয় সাথে থাকায় ইমাদকে ডাকতে গিয়েও ডাকল না। নিজের ঘরে গিয়ে মোবাইল থেকে মেসেজ লিখল, “একটু বাইরে আসতে পারবেন?”
ইমাদ লিখল, “আচ্ছা।”
চলবে…