#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২
দিপু শেষ পর্যন্ত মরেনি। ইমাদ দিপুর সাথে দেখা করতে হাসপাতালে এল তিনদিন পর। দিপু হাসপাতালের বেডে শুয়ে অসহায় চোখে ইমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। ইমাদ চেয়ার টেনে বসতে বসতে গলা উঁচিয়ে ডাকল, “আপনি কী একটু ভেতরে আসবেন?”
“দোস্ত, তাহমিদ এসেছে?” দিপু চাতকিনীর মতন ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করতে করতে এই আধমরা অবস্থাতেও উঠে বসল।
ইমাদ কিছু বলল না।
দিপু চোখ ঘুরিয়ে দরজায় তাকাল। না তাহমিদ ত আসেনি। সে দেখল লম্বা বেণুণী সামনে ফেলে রাখা, বড় বড় বিড়াল চোখের একটা মেয়েটা ভেতরে এল। পাতলা গোল মুখ,ভাসা ভাসা চোখ। দিপু ক্লান্ত স্বরে ইমাদকে বলল “আমিও কী পাগল তাইনা বল? ও আসবে কেন?” দিপু আবার শুয়ে পড়ল। মেয়েটি কোনো ভূমিকা না করে সোজা এসে দিপুর মাথার কাছে বেডেই বসল। ইমাদ পরিচয় করিয়ে দিলো, “ও হলো আমার বন্ধু দিপা। আমরা সবাই দিপু ডাকি।”
কড়ি দিপার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কড়ি। আপনার কাছে আমার একটু দরকার আছে।”
“দরকার?” দিপা অবাক হল। এখনও দরকার ফুরিয়ে যায় নি তার!
কড়ি সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “আমিও কী আপনাকে দিপু ডাকতে পারি?”
দিপা বিভ্রান্ত হয়ে ইমাদের দিকে তাকাল। ইমাদ মনোযোগ দিয়ে কমলা খাচ্ছে। একটু আগে দিপার বড় খালা দিপাকে দেখতে এসে এতসব ফলফ্রুট দিয়ে গেছেন। ইমাদ সেই প্যাকেট খুলেই কমলা খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। ওর দিকে না তাকিয়েই বলল-
“উনি তোর দলেরই লোক।”
“আমার দলের মানে?”
কড়ি তাদের কথায় বাগড়া দিলো, “আপনার কাছে ধার চাইতে এসেছি। কিছু সাহস আর দুঃখ ধার দিবেন? আপনার বড্ড সাহস। দুঃখেরও শেষ নেই।”
দিপা ভ্যাবলাকান্তের মতন হা করে কড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। এই বিষণ্ন সময়ে এত সব নাটকীয়তা তার পছন্দ হচ্ছে না।
ইমাদ এখন কমলা রেখে আঙুরে মন দিয়েছে। একটা বাটিতে আঙুর ভিজিয়ে রেখে টুপটুপ করে মুখে দিচ্ছে। আঙুরের দাম বেশি। দীপুর জন্য আঙুর আনার কথা সে ভাবতেই পারেনি। কমলা আনতে চেয়েছিল। দাম করল। ১৪০ টাকা কেজি শুনেই উল্টোপথে হাঁটা ধরেছে। জিনিসপাতির দাম শুনলেই তার ইচ্ছে করে বইয়ের পাতায় ডুব দিয়ে শায়েস্তা খানের আমলে চলে যেতে। এক টাকায় আট মণ চাল!
আচ্ছা এই বকবকে, কথা না শোনা, ফ্যাচফ্যাচে কাঁদুনি দীপুটাকে নিয়ে সে যাবে কোথায়! দীপু বোধহয় তার মাথাটা নষ্ট করে দিয়ে এরপর শান্তি হবে। কখনো কোনো কথা শুনেছে মেয়েটা? শুনবে কেমন করে? নিজে বলেই ত শেষ করতে পারে না। কতবার সে আর নিলয় বুঝাল তাহমিদ ছেলেটা ভালো না। শুনলই না। ব্রেকআপের পর আবার মরতে বসল। আরেকটুর জন্য তার আত্মা উড়ে যাচ্ছিল। কিছু যদি হয়ে যেত দীপুর! তাও ভালো কড়ি নামের এই মেয়েটিকে গত তিনদিন ধরে বহু আরাধনা করার পর পেয়েছে সে। কাজিনের বিয়েতে গিয়ে বসেছিল মেয়েটা। আর সে এদিকে তার বাড়ির সামনে রাতদিন ঘুরঘুর করেছে। দোকানদারের সন্দেহ দূর করতে মিথ্যে বলেছে। বলেছে এই এলাকায় টিউশনী করে। অথচ, এই এলাকায় সে এর আগে….
আচমকা শার্টের আস্তিনে টান পড়ায় ইমাদের চমক ভাঙল। দীপু হাত ধরে টানছে, “ইমাদ, তুই ওকে কোথা থেকে আবিষ্কার করলিরে?
আঙুর খাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটায় ইমাদ মনে মনে বিরক্তির শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল। তবে চেহারায় সেই বিরক্তির কোনো প্রকাশ নেই। সে অস্ফুট গলায় বলল, “ফুডপাণ্ডায় অর্ডার করলাম।”
দিপা ইমাদ থেকে বাটিটা কেড়ে নিলো। কড়ির দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “নাও কড়ি আঙুর খাও।”
কড়ি আঙুরের বাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি টিয়া আঙুর খাই না।”
“কালো আঙুর খাও?”
“খাই।”
দিপা ইমাদের হাতে বাটিটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “ডানদিকের প্যাকেটটায় কালো আঙুর আছে। কালো আঙুর দে ওকে।”
ইমাদ বলল, “আচ্ছা।”
কড়ি আর দীপা আবার কথায় মন দিলো। একটু পর দীপা আবার রুষে উঠল, “ইমাদ!”
ইমাদ আঙুর খেতে খেতে ইমাদ মুখ তুলে বলল, “কী?”
“তোকে বলেছিলাম ওকে আঙুর ধুয়ে দিতে।”
“ও আচ্ছা।” ইমাদের আচ্ছা দীপুর ক্লান্তি আর বিরক্তি আরো বাড়িয়ে দিল। এত বিরক্ত হলো দীপা! শরীরটা ভালো থাকলে এখনি সে ইমাদের মাথা ফাটিয়ে দিতো।
ইমাদ চেয়ার ছেড়ে উঠল। আরেকটা বাটিতে কালো আঙুর ধুয়ে হেঁটে এসে কড়িকে দিয়ে গেল। কড়ি বলল, “ধন্যবাদ।”
ইমাদ ফিরে এসে আবার চেয়ার বসল। এবার সে আনারের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়াল। তার খাওয়ায় ফের ব্যাঘাত ঘটল আধ ঘণ্টা পরই। এবার কড়ি ডাকল। উঠে এসে বলল, “আমি আসছি।”
ইমাদ ধীর গতিতে উঠে দাঁড়াল, “আচ্ছা।”
কড়ি দিপার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, “টাটা।”
দিপা বলল, “তোমায় যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না।”
“তাই?”
দিপা উপর নীচ মাথা নাড়ল, “একদম তাই। আবার এসো।”
কড়ি তার কানের কাছে বেণুণীতে গুঁজা ফুলটা খুলে দিপার কানের কাছে গুঁজে দিলো। হেসে বলল, “সুন্দর লাগছে।”
“থেঙ্ক ইউ।”
“নট এট এল।” কড়ি ডানদিকে হাতটা প্রসারিত করে সুর তুলে বলল।
তারপর দরজার দিকে এগুলো। ইমাদও কড়িকে এগিয়ে দিতে পেছন পেছন যাচ্ছিল। দিপা পিছু ডাকল, “ইমি?”
ইমাদ ঘাড় ঘুরতেই দীপা বলল, “আই লাভ ইউ দোস্ত।”
ইমাদ খেয়াল করল দীপুর আগের সেই ক্লান্ত স্বর এখন কিছুটা সতেজ। সে তার স্বভাবসুলভ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আচ্ছা।”
দিপা সাথে সাথে সাইডে থাকা টেবিল থেকে স্টিলের গ্লাসটা ইমাদের দিকে ছুঁড়ে ফেলল, “শালা, আরেকবার আচ্ছা বললে আমি আবার হাত কাটব।”
ইমাদ সেদিকে না তাকিয়েই হেঁটে করিডোরের দিকে চলে গেল। নীচে নেমে কড়িকে একটা রিকশা ঠিক করে দিলো। কড়ি রিকশায় উঠে চলে গেল। ইমাদ একটু সামনে হেঁটে একটা অটোতে উঠল। ড্রাইভারের পাশের সিটটায় বসতেই অবাক হয়ে দেখল কড়ির রিকশাটা একটু সামনে গিয়েই থেমে গেছে। রিকশা এদিকেই ফিরে আসছে আবার। কড়ির রিকশাটা এসে ওর অটোর সামনেই থামল। কড়ি হুড তোলা রিকশার মাঝ থেকে মাথা বের করে ইমাদকে বলল, “আপনি এখন শান্ত হতে পারেন। আপনার বন্ধু ঠিক হয়ে যাবে। ”
“আমি তো শান্তই আছি।”
“তাই?”
“জি।”
কড়ি অনেকক্ষণ চুপ করে ইমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর একসময় বলল, “আপনি আমাকে যাওয়ার সময় ধন্যবাদটুকুও বলেননি। আপনি স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। এতটা অশান্ত হবেন না। দিপু এখন থেকে ভালো থাকবে।”
ইমাদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে অটোচালককে বলল, “ভাই চলুন।”
চলবে…