তোমার_আমার_চিরকাল🌸 || পর্ব – ৩১ || #লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৩১ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

সকাল সকাল একটু শীতের আভাস পাওয়া যায়। শীত খুব শিগ্রই আসতে চলেছে। ঘুমের রেশ এতো সহজে কাটে না। ঘুমের মধ্যেই মীরার মনে হলো কেউ তার পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। একটু নেড়ে চেড়ে উঠলো সে। চোখ খুললো না তবুও। আবারও কেউ যেন তার পায়ে সুড়সুড়ি দিতে লাগলো। মীরা এবার আহানকে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ পর আহান ও মীরার মাঝখানে কিছু একটা ধপ করে বসে পড়ল। মীরা ঘুমের মধ্যেই “ভুত” বলে চিৎকার দিল। মীরার চিৎকারের আওয়াজ শুনে আহান ধড়ফড়িয়ে উঠে। আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে কোনো কিছুই নজরে আসেনি তার। আশ্চর্য! মীরা তাহলে কেন চিৎকার দিল? মীরা ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। ক্রমশ কাঁপছে সে। আহান দেখে পিয়াওমি মীরা আর তার মাঝে বসে আছে। আহান বুঝলো মীরার চিৎকার দেওয়ার কারণ। পিয়াওমিকে নিজের কোলে তুলে নেয় সে। পিয়াওমির পা দিয়ে মীরার গালে ছোঁয়ায়। মীরা চোখ খুলে ওদের দেখে আরও জোরে চিৎকার দেয়। আহান সোজা মীরার মুখ চেপে ধরে। “যখন তখন এতো চিৎকার দাও কেন? কান ফেটে যায় তো। এতো ভয় পেলে চলে?”
আহান মীরার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়। মীরা শোয়া থেকে উঠে বসে। “আপনারা আমাকে এতক্ষণ ভয় দেখাচ্ছিলেন?”
“আমি মাত্র উঠেছি। পিয়াওমি ছিল এতক্ষণ।”
“আমি বিশ্বাস করি না। আপনি ইচ্ছে করেই এসব করেছেন। মিথ্যেবাদী একটা।”
“আমি মিথ্যা বলিনা। আমি তোমায় কেন ভয় দেখাব? আমি তো তোমার চিৎকার শুনেই উঠেছি।”
“আপনি দিন দিন অনেক পাজি হচ্ছেন আহান। আমি কিছু বুঝিনা ভাবছেন?”
“মহা মুশকিল। কিছু না করেও দোষী হতে হচ্ছে। ওকে ফাইন। সব দোষ আমার। হ্যাপি?”
মীরা গোমড়া মুখ করে কাঁথা সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে গেল।


ইরার বিয়েতে আহানদের সবাইকে দাওয়াত দিয়েছেন ইরার বাবা মা। আজ মীরা, আহান ও আয়ান যাবে ইরাদের বাসায়। তিনদিনের মতো বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবে তারা। আজ ইরার হলুদ সন্ধ্যা। মীরারা আজ বিকেলেই ইরাদের বাড়িতে যাবে। ও বাসা থেকে মিরাজ ও মিরাজের মা যাবে। মীরার ভাবিকে এখন কোথাও যেতে দিচ্ছেন না মীরার মা। একজন মহিলা ঠিক করে রেখেছেন রান্নাবান্নার কাজ করার জন্য। এদিকে আয়ান খুশিতে যেন আত্মহারা হয়ে গেছে। দিবার সাথে দেখা হবে, কথা হবে এই ভেবে তার রাতের ঘুম যেন শেষ হচ্ছে না। দেখা হলেই দিবাকে প্রপোজ করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় আয়ান। মীরার শাশুড়ী এখন মীরার সাথে অনেকটাই ফ্রী হয়ে গেছেন। তবে আহান এখনো তার প্রতি সন্তুষ্ট নয়। তবুও তিনি চেষ্টা করে যান আহানকে খুশি রাখার।

বিকেল হতেই মীরা রেড়ি হয়ে যায়। আহান ও আয়ান রেড়ি হয়ে মীরার জন্য বাহিরে অপেক্ষা করে। মীরা তৈরি হয়ে নিচে নেমে আসে। শ্বশুর শাশুড়ীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে যায় সে। ওনারা বিয়ের দিন যাবেন মীরার বাবার সাথে। মীরা বাহিরে এসে দুই ভাইকে দেখে। দুজনেই সবুজ পাঞ্জাবি পড়েছে আজ। কাকে রেখে কাকে দেখবে! কেউই কারো থেকে কোনো অংশে কম না। যেমন আহান, তেমনি আয়ান। স্মার্ট ও সুদর্শন। মীরা মনে মনে আহানের কথা ভাবছে। এভাবে সেজেগুজে বিয়ে বাড়িতে থাকলে তো মেয়েদের নজর তার দিকেই পড়বে। এটাও মীরাকে চোখে দেখতে হবে। অসহ্য! অন্যদিকে আয়ানের কথা বাদ দিল সে। নিশ্চয়ই দিবার কথা ভাবছে। সুযোগ পেলে হয়তো আজই মনের কথা বলে দিবে। আর দিবা যা মেয়ে! আয়ানকে ভালো লাগলেও মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস পাবে না সে। এটা নিয়েও এক চিন্তা। দিবার উত্তর না পেলে আয়ান মীরার মাথা খেয়ে ফেলবে। মীরার হচ্ছে যত জ্বালা। আহানরা নিজেদের গাড়ি নিল যাওয়ার জন্য। মীরাদের বাসার সামনে থেকে মীরার মা ও মিরাজ কে পিক করে নেয় তারা। আহান ও মীরা একসঙ্গে পিছনের সিটে বসেছে। মীরা ফিসফিসিয়ে আহানকে বলে, “এতো সেজেছেন কেন?”
আহান ভ্র‍ু কুচকায়। বলে, “কোই সাজলাম? শুধু পাঞ্জাবি আর পায়জামা পড়েছি। এটাও কি সাজ হয়ে গেল নাকি?”
“শুধু এগুলোই? চুলে দেখলাম জেল দিয়ে সোজা করে রেখেছেন। পাঞ্জাবীর হাতা ফোল্ড করে রেখেছেন। হাতে দামী ঘড়ি পড়েছেন। পাঞ্জাবীর কলারে আবার সানগ্লাসও ঝুলিয়ে রেখেছেন। শুধু কি তাই? বিয়ে বাড়িতে যাবেন বলে ক্লিন শেভও করেছেন। কোন মেয়েকে ইম্প্রেস করতে যাচ্ছেন শুনি? দাড়ি কাটলেন কেন? হিরো সাজতে এসেছে?”
“আমায় সত্যিই হিরো লাগছে!”
আহানের মজা করা নিয়ে মীরা আরো বেশি ক্ষেপে যায়। বলে, “আমি শুধু একবার বিয়ে বাড়িতে যাই। তারপর আপনার ব্যবস্থা করব।”
“তুমি কেন খামাখা কষ্ট করতে যাবে। ওরা আছে না। জামাই আদর বেশ ভালো করেই করবে।”
“খুব কথা শিখেছেন আপনি। দেখে নিব আপনাকে।”
সামনের সিট থেকে আয়ান পিছনে ফিরে মীরাদের উদ্দেশ্যে বলল, “তোমরা আস্তে কথা বলো। সবাই তোমাদের কথা শুনছে।”
মীরা এর দোষও আহানকে দিয়ে দিল। “আপনার জন্যই এসব হলো। ওরা সব শুনে নিয়েছে।”
“এখানেও আমার দোষ!”
“ম্যাডাম! আমার ভাইয়ের কথা না। আপনার কথাই আমরা শুনতে পাচ্ছি বেশি। দয়া করে মুখটা একটু অফ রাখুন।”
আয়ানের কথায় আহান ফিক করে হেসে দেয়। মীরা সেই হাসি দেখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

বাড়িতে আসার পর থেকেই আয়ান এদিক ওদিক চোখ বোলাচ্ছে। কিন্তু যাকে দেখার এতো আগ্রহ তার সে-ই নেই। আয়ান কেমন ছটপট করছে। ও পারছে না যে এখান থেকে উঠে সারা বাড়ি খুঁজে দেখতে। অন্যদিকে আয়ানের এমন কাজ মীরা অনেক্ক্ষণ যাবত লক্ষ্য করছে। সে আয়ানকে একটা চিমটি দিয়ে বলে, “সোজা হয়ে বসো। বিয়ে বাড়িতে এসেছ, মেহমান হয়ে থাকবে। এমন ছটপট করলে মানুষ তা ভালো চোখে দেখবে না।”
“মানুষের পরোয়া আমি করিনা।”
“আমি করি। আমার মান-সম্মান ডোবাবে নাকি?”
“কিন্তু, দিবাকে দেখছিনা কেন?”
“আশ্চর্য! বোনের বিয়ে, সে কি এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াবে নাকি? কাজ করছে হয়তো। সময় হলে আসবে।”
“আমার এতো ধৈর্য্য নেই।”
তাদের কথার মাঝেই দিবা আর ইরা এসে উপস্থিত হয়। দিবাকে দেখে আয়ানের ছটপটানি বন্ধ হয়ে যায়। স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে সে দিবার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওরা মীরার মা’কে সালাম করে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে। পাশাপাশি দাঁড়ালে দিবা আর ইরাকে চেনা যায় না। কারণ তাদের চেহারা অনেকটাই মিল। দু’জনেই জমজ। তবে দিবা চশমা লাগায়, তাই তাকে আলাদাভাবে চেনা যায়। আর একটা দিক দিয়েও দিবাকে চেনা যায়। তা হলো দিবার ঠোঁটের মাঝে একটা তিল আছে। যেটা বেশ নজর কাড়া। দিবার চেয়ে ইরা কিছু মুহুর্তের বড়ো।
ইরা তাদের চা দিয়ে চলে যায়। আর দিবা এসে মীরার পাশে বসে। আয়ান মীরার পাশেই বসে ছিল। ডানপাশে আয়ান ও বামপাশে দিবা। মাঝখানে মীরা। আয়ান বারবার দিবাকে দেখছে আড়চোখে। দূর থেকে এটা মিরাজের চোখে পড়ে। সে অনেক্ষণ ধরেই আয়ানকে ফলো করছে। তার হাভভাব মিরাজের সুবিধা লাগেনি। কিন্তু সে এখন আয়ানকে কিছুই বলবে না। বিষয়টা কতদূর গড়ায় আগে সেটা দেখবে।

রাত ১২ টার পর থেকে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়। এর মধ্যে সবাই রেড়ি হতে হতেই দেরি করে ফেলে। ছেলের বাড়ি থেকে ডালা ভর্তি ফুলের মালা, গাজরা ও দুল নিয়ে আসা হয়। সেগুলো দিয়ে কণে সাজানো হয়। এরপর আগে মা বাবা হলুদ লাগায়। তারপর ছেলের বাড়ি থেকে আসা লোকজন হলুদ লাগিয়ে দেয়। তারা খেয়েই চলে যায়। তাদের বাড়িতে এখনো অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। মীরারা সবাই রেড়ি হয়ে এক এক করে হলুদ মাখায় ইরাকে৷ সামনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কেক মিষ্টি, বিভিন্ন ফল। ফটোগ্রাফাররা ছবি তুলছে। মীরা আহানের সাথে উঠতে চাইলেও আহান লজ্জায় উঠেনি। এতে মীরার বেশ মন খারাপ হয়। আয়ান আর আহান দুজনে একসাথে স্টেজে উঠেছে। আর মীরা দিবার সাথে উঠেছে। মন খারাপ থাকলেও কাউকে বুঝতে দেয়নি মীরা। খিঁলখিঁলিয়ে হেসে গেছে সবার সাথে। সবার খাওয়ানো শেষ হলে মীরা আর দিবা মিলে ইরাকে মেহেদী পড়িয়ে দেয়। তখন আস্তে আস্তে সবাই ঘরে চলে যায়। দু’ চারজন শুধু ওখানে অবস্থান করছে। মীরা আর নিজেকে হাসিখুশি রাখতে পারলো না। মন খারাপ নিয়ে বসে আছে। ইরাকে মেহেদী লাগানোর সময় দিবা বারবার জিজ্ঞেস করছে মীরার কি হয়েছে। মীরা কিছু বলেনি। মেহেদী লাগানো শেষ করে একটা রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে নেয় সে। মীরাদের আলাদা রুম দেওয়া হলেও মীরা গিয়ে ইরার কাছে শুয়ে পড়ে। মুখ কাঁথা দিয়ে ঢেকে ভিষণ কাঁন্না করতে থাকে সে। আহান তাকে আজ অনেক দুঃখ দিয়েছে। ও আর আহানের সাথে সহজে কথা বলবে না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here