তোমার_আমার_চিরকাল🌸 || পর্ব – ৩০ || #লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৩০ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

রেস্টুরেন্টে খেতে এসে আহান এর সাথে অন্য মেয়েকে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে মেজাজ বিগড়ে যায় মীরার। আহানের গায়ে পুলিশের পোশাক জড়িয়ে আছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে মীরা। দাঁতে দাঁত পিষে চলেছে। রাগে ফোসফাস করতে থাকে সে। যেন এক্ষুণি আহানকে খেয়ে ফেলবে এমন অবস্থা তার। মীরা এসেছিল দিবা ইরা ও সাইমুন (ইরার হবু বর) এদের সাথে শপিং মলে। শপিং শেষ হওয়ার পর সাইমুন বলল আজ সে সবাইকে ট্রিট দিবে। মীরারা সবাই বোরকা ও হিজাব পড়ে এসেছিল। রেস্টুরেন্টে সবাই বসে গল্প করছিল। সাইমুন অর্ডার করল। কিন্তু তারা বলল খাবার আসতে একটু লেইট হবে। তাই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে সবাই মিলে টুকটাক গল্প করছিল। এমন সময় মীরার চোখ পড়ে আহানের দিকে। রেস্টুরেন্টের ভেতর থেকে একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে বলতে আসছিল সে। তাতেই রেগে আগুন হয়ে যায় মীরা। কোই তার সাথে তো এতো হাসাহাসি করে কথা বলে না। কে এই মেয়ে যে তার সাথে এতো ঢলাঢলি, এতো হাসাহাসি। মীরার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে দিবা ভ্রু কুচকে তাকাল। বলল, “কোথায় তাকিয়ে আছিস? কি হয়েছে?”
মীরা নিজের দৃষ্টি সরিয়ে বলল, “কিছুনা।”
“কিছুতো হয়েছে। নাহলে এভাবে ওদিকে কেন তাকিয়ে আছিস?”
আহান এতক্ষণে চলে গেছে। তাই দিবারা কেউই আহানকে দেখতে পায়নি। মীরা হঠাৎ বলল, “আমি আজ উঠি। বাসায় যেতে হবে।”
মীরার কথায় সবাই অপ্রস্তুত ছিল। সাইমুন মীরাকে থামানোর জন্য বলল, “আপু কোথায় যাচ্ছেন! আমি কিন্তু আপনাকে যেতে দিচ্ছিনা এতো সহজে। খেয়ে তারপর যাবেন।”
মীরা যেন শান্ত থাকতে পারলো না। গর্জে উঠে বলল, “খাব না আমি, বাসায় যাব। শুনতে পাচ্ছেন না কেউ?”
সাইমুন চুপ হয়ে যায়। কিন্তু দিবা আর ইরার এটা মোটেও ভালো লাগেনি। দিবা মীরাকে বলে, “মীরা, তুই কিন্তু সিনক্রিয়েট করছিস। হঠাৎ হলো কি তোর? ভালোই তো ছিলিস এতক্ষণ। ভাইয়ার সাথে এমন বিহেভ করলি কেন? ভাইয়া কি মনে করলো এইবার?”
তখন সাইমুন দিবাকে থামিয়ে বলে, “দিবা! আমি কিছু মনে করিনি। আপুর মনে হয় শরীর খারাপ লাগছে। আপুকে কিছু বলো না। চলো আমরা আপুকে পৌঁছে দেই।”
“আমি একাই চলে যেতে পারব। প্লিজ আমায় নিয়ে কেউ ভাববেন না। অ্যান্ড স্যরি।”
এই বলে মীরা ওখান থেকে উঠে গেল। রেস্টুরেন্টের বাহিরে এসে একটা সিএনজি ডেকে নিল। তারপর তাতে উঠে সোজা বাসায়। এদিকে সাইমুন, দিবা আর ইরা এরা কেউই বুঝলো না মীরার কি হয়েছে। শুধু জানে মীরা কিছু একটা দেখেছিল। তার জন্যই রেগে গেছে। তা নাহলে, মীরা এতো সহজে রেগে যাওয়ার মেয়ে না।

বাসায় এসে কাউকে কিছু না বলে সিঁড়ি দিয়ে পা ফেলে নিজের রুমে চলে আসে মীরা। বোরকা হিজাব খুলে শাওয়ার নিয়ে নেয়। আজান দেওয়ায় নামাজও পড়ে শেষ করে সে। মোনাজাত করার পর কোত্থেকে যেন পিয়াওমি দৌড়ে এলো মীরার কাছে। মীরা পিয়াওমিকে কোলে নিয়ে বসে। কিছুক্ষণ ওকে আদর করার পর সে জায়নামাজ ভাজ করে বিছানায় বসে। পিয়াওমির শরীরে হাত বোলাতে বোলাতে চোখে ভেসে আসছে আহান আর ওই মেয়েটিকে। মীরার হৃদয় পুঁড়ছে। ভীষণভাবে পুঁড়ছে। পুঁড়তে পুঁড়তে দগ্ধ হচ্ছে মন। চোখ দিয়ে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। ভেঁজা আঁখি পল্লব কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। মেয়েরা যে তার প্রিয় মানুষটির পাশে কাউকেই সহ্য করতে পারে না। মীরাও তার ব্যতিক্রম নয়। সে পারেনি আহানের পাশে অন্য মেয়েকে সহ্য করতে। হুঁহুঁ করে কেঁদে উঠলো সে। কেন এমন করলো আহান! অনেকক্ষণ কাঁদলো মীরা। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো বুঝতেই পারেনি।


বিকেল পাঁচটা বাজতে চললো। মীরা নিচে এসে তার শাশুড়ী মায়ের সাথে কেক বানাচ্ছিল। কথা বলতে বলতে দুজন অনেকটাই ফ্রি হয়ে যায়। তার শাশুড়ী মা তাকে কেক বানানো শিখাচ্ছেন। মীরা খুব মনোযোগ দিচ্ছে তাতে। আশেপাশের কথা একদমই ভাবছে না। কেক বানানো শেষ হলে তারা দুজন চা বানিয়ে খেয়ে নিল। আয়ান নিচে এসে দুজনের এই কার্যকলাপ দেখে সম্ভিত। সে রাম্নাঘরে এলে মীরা তাকে চা দেয়। আয়ান চা নিয়ে সোফায় বসে টিভি দেখতে থাকে। হঠাৎ কলিংবেলটা বেজে উঠল। মীরা জানে এখন কে এসেছে। জেনেও গেল না দরজা খুলতে। আয়ানের মা সাহস নিয়ে দরজা খুলে দিলেন। দরজা খোলার পর নিজের সৎ মা’কে দেখে আপাতদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আহান। আয়ানের মা বলে, “ফ্রেশ হয়ে আসো। তোমার জন্য একটা জিনিস বানিয়েছি।”
আহান যেন দফায় দফায় চমকে উঠে। ঠোঁট চেপে ধরে চুপ করে আছে সে। রান্নাঘরে মীরাকে দেখলেও মীরার নজর অন্যদিকে। আহান চুপচাপ চৌকাঠ মাড়িয়ে ভেতরে ঢুকে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।

রাতের দিকে আহান বসে বসে ফোনে গেইমস খেলছিল। মীরা রুমের এলোমেলো জিনিস গোছাচ্ছে। আহান আসার পর থেকেই মীরা একটি কথাও আহানের সাথে বলেনি। এ নিয়ে আহান পরে মীরার সাথে আলাপ করবে ভেবেও বলা হয়ে উঠেনি। এখন সময় পেয়েছে। কিন্তু মীরা কাজে ব্যস্ত। আহান ফোনে গেইমস খেলা বাদ দিয়ে মীরার পানে চাইলো। শান্ত গলায় জিগ্যেস করল, “মীরা! তোমার কি কিছু হয়েছে?”
মীরা কাজ করতে করতে বলল, “আমার কি হবে! কিছুই না।”
“তুমি আমার সাথে কথা বলছ না যে।”
“কথা বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিনা আপাতত। তাছাড়া, আমার কথা বলার জন্য আপনি তো বসে নেই। আপনার তো কথা বলার মানুষের অভাব নেই।”
আহান ভ্রু কুচকে তাকালো। কি হলো হঠাৎ মীরার। এভাবে কেন কথা বলছে। মীরার গোছগাছ শেষ হলে সে বিছানা ঝাড় দিতে আসে। আহান বিছানায় বসে ছিল। মীরা শলা দিয়ে বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে কয়েকটা বারি আহানের শরীরেও ফেলে৷ আহান বুঝলো না মীরা কি রেগে আছে কোনো কারণে? “আমার শরীরে লাগছে মীরা!”
“উঠে যেতে পারছেন না? হাতির মতো বসে আছেন কেন।”
“কি হয়েছে তোমার? এভাবে কথা বলছ কেন? কি হয়েছে না বললে বুঝব কিভাবে?”
“আজকাল ডিউটি কি থানা ছেড়ে রেস্টুরেন্টে হয় মিস্টার আহান?”
“মানে?”
“মানে টা আপনি ভালো করেই জানেন। ডিউটি ছেড়ে আপনি রেস্টুরেন্টে কি করছিলেন? কার সাথে ছিলেন!”
“তুমি আমায় দেখেছ?”
“দেখেছি বলেই তো বলছি। এক রমনীর সাথে হাসাহাসি করছেন। কে সে? আপনার প্রেমিকা?”
আহান বিনা বাক্যে হাসতে থাকে৷ মীরার রাগ হচ্ছে আহানের উপর। সোজাসাপ্টা উত্তর না দিয়ে ক্যাবলার মতো হাসছে কেন? আহান বলল, “ম্যাডামের বুঝি এ জন্য মন খারাপ? কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন এই জন্য কি?”
মীরা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আহান মিটিমিটি হেসে বলল, “যার সাথে দেখেছেন, তাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনিই না। আসলে ওই রেস্টুরেন্টটা আসলে তার। কিছুদিন আগে এক কাস্টমার কমপ্লেইন করেছিল ওই রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে। তাদের খাবারে নাকি সমস্যা আছে। আমরা তদন্ত করে দেখি খাবারে কিছুইনা। উল্টো সিসিটিভি তে তাকে দেখা গেল, নিজেই একটা তেলাপোকা খাবারের মধ্যে দিয়ে বদনাম করেছে। পরে ওই ছেলেটাকে আমরা থানায় নিয়ে যাই। তখনই মহিলাটি আমাকে ধন্যবাদ জানায়। এই নিয়েই টুকটাক কথা বলছিলাম আর হাসছিলাম। বায় দ্য ওয়ে! তুমি কি সেখানে ছিলে? কেন গিয়েছিলে?”
“ইরার বিয়ে উপলক্ষে শপিং করতে গিয়েছিলাম।”
আহান মজার ছলে বলল, “আজকাল শপিং বুজি রেস্টুরেন্টে হয়?”
মীরা গর্জে উঠলো। আহানের কাছে এসে সোজা তার কলার চেপে ধরলো। “একদম চুপ! আমি বলেছি শপিং রেস্টুরেন্টে করেছি? পুরো কথা শেষ করতে দিয়েছেন আমায়?”
আহান বলে, “আচ্ছা, বলো শুনছি।”
“শপিং শেষে ইরার বর আমাদের খেতে নিয়ে গিয়েছিল।”
“আমার ছাড়বে কি? দেখো, আমার শার্টের বোতাম প্রায় ছিঁড়েই গেছে। অবশ্য তুমি যদি চাও, তাহলে থাকতে পারো। আমার কোনো সমস্যা নেই।”
মীরা আহানের কথা শুনে হকচকিয়ে আহানের কলার ছেড়ে দূরে দরে বসলো। কি বদমাশ হচ্ছে দিন দিন। “আগে তো ভাবতাম ভাজা মাছটাও উলটে খেতে জানেন না। এখন তো দেখছি তলে তলে এতো দূর।”
“ঠিক কতদূর গিয়েছি বলতো? তাছাড়া এমন চণ্ডী বউ কারো থাকলে সে তো পরিবর্তন হবেই।”
“অ্যাঁই! অ্যাঁই! কি বললেন! আমি চণ্ডী বউ?”
মীরা একটা বালিশ নিয়ে আহানকে মারতে থাকে। তা দেখে আহান আরও জোরে হাসতে থাকে। বিছানায় গড়াগড়ি খায়৷ মীরা আর না পেরে কেঁদে দেয়। আহান মীরার কান্না দেখে হাসি অফ করে উঠে বসে। মীরাকে সোজা নিজের কাছে টেনে বুকের সাথে চেপে ধরে। মীরা চুপচাপ তার মাথাটা আহানের বুকে রাখে। অদ্ভুত এক শিহরণ হচ্ছে মন গহীনে। হৃদয়জুঁড়ে নেমে এসেছে প্রশান্তির ঢেউ। আহান বলল, “তোমার চোখে জল মানায় না মীরা। তোমাকে হাসিতেই মানায়৷ আমি চাই আমার শেহজাদী সবসময় প্রাণখুলে হাসুক।”
“কেন রাগান আমাকে?”
“স্যরি মীরা। প্লিজ ডোন্ট লিভ মি এলোন।”
“আ’ম অলওয়েজ উইথ ইউ।”
“থ্যাঙ্কিউ।”
“আপনি কবে থেকে আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছেন?”
“তোমার ভাইয়ের বিয়ের দিন থেকে তোমাকে পছন্দ করি আমি।”
“আর আমি কি দেখে আপনাকে পছন্দ করেছি জানেন? আপনার আচরণ দেখে। আপনার সরলতা আমায় মুগ্ধ করেছে। আপনার কাজের প্রতি সততা দেখে আপনার প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান বেড়ে গেছে আমার।”
“আমি তোমার কথার মাধুর্য ও তোমার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিলাম।”
“ভালোবাসেন আমায়?”
“মুখে বললেই তা ভালোবাসা হয়ে যায় না। ভালোবাসা হলো অনুভব করার জিনিস। তুমি অনুভব করে দেখো সব উত্তর পেয়ে যাবে।”
“আমি আপনাকে প্রতি মুহুর্তে অনুভব করি।”
“আমিও।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here