তোমার_আমার_চিরকাল🌸 || পর্ব – ২৯ || #লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ২৯ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

সকাল বেলা একটা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটল! যা দেখে আশ্চর্যের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল সবাই। ঘটনাটা ঘটেছে আহান ও মীরার সাথে। আর ঘটিয়েছে আহানের সৎ মা। ঘটনাটা যা হলো, আহান আর মীরা সোফায় বসে ছিল। আহান পেপার পড়ছিল। আর মীরা টিভি দেখছিল আহানের পাশে বসে। আহানের বাবা ডাইনিং টেবিলে বসে ছিলেন
সাথে আয়ানও ছিল। আহানের সৎ মা তাদের নাশতা দিয়ে, একটা ট্রে করে দু প্লেট নাশতা ও চা নিয়ে হাজির হয় আহানদের সামনে। আহান পেপার পড়ায় সামনের দিকে নজর গেল না তার। কিন্তু টিভি দেখায় মীরা তার শাশুড়ী মা’কে দেখে চমকে গেল। উনি কিছু না বলে তাদের সামনে থাকা ট্রি টেবিলে নাশতার ট্রে টা রেখে দ্রুত হেটে চলে গেলেন। যেন তার খুব তাড়া। পেপার থেকে চোখ সরিয়ে আহান টেবিলের উপর নাশতা দেখে অপ্রস্তুত হলো। বা’দিকে তাকিয়ে আয়ানের মা’কে চলে যেতে দেখলো সে। মীরার দিকে তাকিয়ে দেখে সে বিশ্মিত চোখে আহানের পানে চাইলো। অন্যদিকে খেতে বসে এই দৃশ্য দেখে খাওয়া বন্ধ করে দিল আহানের বাবা ও আয়ান। হা করে তাকিয়ে আছে দু’জন। তারা ভাবছে আজ কোনদিকে সূর্য উঠল। মীরা নিজের বিস্মিত হওয়া দমিয়ে মুচকি হাসলো। যাক! শাশুড়ী তবে ধীরে ধীরে গলছেন। আহান হতবিহ্বল চাহনিতে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল, “কি হলো মীরা? আজ হঠাৎ উনি আমাদের দু’জনকে চা দিয়ে গেলেন! জানো কিছু?”
মীরা ভাব নিয়ে নিজের চায়ের কাপটা উঠিয়ে বলল, “আমি কি জানি। আপনাদের মা ছেলের ব্যপার, আপনারাই জানেন।”
আহান একটু রেগে গিয়ে বলল, “আমি জানলে কি আর তোমায় জিগ্যেস করতাম। জুটেছে আমার কপালে! মেয়ে মানুষ এতো কথা ঘুরায় কেন বুঝিনা।”
মীরা মিটিমিটি হাসতে থাকে। আহান উপায় না পেয়ে নাশতা করতে লাগল। আহানের বাবা নিজের স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন, “তোমার শরীর ঠিকাছে? যা’কে তুমি সহ্যই করতে পারো না, আজ তাকে আর তার বউকে নিজে নাশতা দিয়ে আসলে!”
আয়ানের মা বললেন, “তোমার কোনো সমস্যা আছে? আমি যা খুশি তাই করব। তোমাদের কি।”
নিজের মায়ের কথা শুনে আয়ানের কাশি উঠে গেল। তার বাবা তাকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। আয়ান পানি খেয়ে হেসে উঠল। বাপ ছেলের এমন রসিকতা দেখে আয়ানের মা গজগজ করতে করতে প্রস্থান করলেন।


কলেজ টাইম হলে মীরা চট করে রেড়ি হয়ে যায়। আহান আয়ানকে বলে যায় মীরাকে যেন সাথে নিয়ে যেতে। আহানের জরুরি কাজ থাকায় সে আগে থানায় চলে যায়। মীরা রেড়ি হয়ে নিচে আসে। আয়ানও রেড়ি ছিল। সে মলিন হেসে মীরাকে বলল, “চলো।”
আয়ানের এই মলিন মুখশ্রী মীরার ভালো লাগলো না। আজ কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছে, আয়ান চুপচাপ হয়ে গেছে। আগের মতো তেমন কথা বলে না। চাঞ্চল্য নেই। মীরার সাথেও এখন দুষ্টুমি করে না। হঠাৎ আয়ানের হলো কি! দেরি হয়ে যাচ্ছে বিধায় মীরা আয়ানের পিছু পিছু গেল। ওরা একটা রিক্সা নিয়ে প্রথমে হাসপাতাল মোড়ে এবং ওখান থেকে একটা সিএনজি নিয়ে কলেজে গেল। মীরা ও আয়ান এখন তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। ওরা দুজনেই সমবয়সী।

ক্লাস শেষে মীরা আয়ানকে অনেক খুঁজেও পেল না। তাই সে একাই বাসায় ফিরেছে। বাসায় এসে দেখে আয়ানের জুতো জোড়া সিঁড়ির এক কোণে পরে আছে। মীরা বুঝলো আয়ান তার আগেই বাসায় এসেছে। মীরা উপরে নিজের রুমে গিয়ে ব্যাগটা বিছানায় রাখলো। অতঃপর সে জামা কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
ফ্রেশ হয়ে এসে রুমের কিচেনে ঢুকলো। মোটামুটি কিছু রান্না করলো। তারপর ভাবলো আহান আসলে একসাথে খাবে। তার আগে একবার আয়ানের সাথে দেখা করা যাক। দেখতে হবে হয়েছে কি তার। এতো চুপচাপ হয়ে গেল কেন। মীরা মাথায় ঘোমটা দিয়ে আয়ানের কক্ষে গেল। দরজায় কড়া নাড়লে আয়ান দরজা খুলে দেয়। মীরাকে দেখে সে অবাক হয়। কিন্তু পরক্ষণেই গম্ভীর গলায় বলে, “তুমি হঠাৎ?”
মীরা আয়ানকে কিছু উত্তর না দিয়েই ভিতরে ঢুকে যায়। আয়ান মীরার কাজ দেখছে। মীরা তাকে ডিরেক্টলি জিগ্যেস করে। “তোমার কি হয়েছে? দেখো, একদম এটা বলতে আসবে না যে কিছু হয়নি। আমি জানি তোমার কিছু একটা হয়েছে। একদম চুপ হয়ে গেছ তুমি। বলো কি হয়েছে।”
আয়ান ভাবলেশহীন হয়ে জবাব দেয়। “কিছুই হয়নি। তুমি একটু বেশিই ভাবছ।”
মীরা আয়ানের দিকে আঙুল তাক করে বলে, “অ্যাঁই! একদম আমাকে বোঝাতে আসবে না। আমি ছোট নই। আমার চোখ ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। কি হয়েছে বলো জলদি। নাহলে তোমার ভাইয়াকে বলে দিব।”
“চলে যাও প্লিজ।”
আয়ান অনুরোধ করলো। কিন্তু মীরা অবাধ্য। সে যাবে না মানে যাবেই না। মীরা বলে, “আমি তোমার ভাবি হলেও আমাকে তুমি বন্ধু ভাবতে পারো। তোমার যদি কোনো সমস্যা হয় তা আমাকে বলো। আমি চেষ্টা করব তা সমাধান করার। একবার বলে তো দেখো।”
আয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “আ’ম ইন লাভ, উইথ ইউর কাজিন।”
মীরা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। আয়ান এসব কি বলছে। সে কাউকে পছন্দ করে। সেটা আবার তার কাজিন! মীরা ভাবতে ভাবতে বলে, “হু ইজ শি?”
“দিবা! আই লাইক হার।”
“বাহ্। কবে থেকে এসব চলছে?”
“ওয়ান সাইড লাভ।”
“তুমি কি এর জন্য মনমরা হয়ে আছো?”
“আমার ভাবনায় সে বার বার আসে। তাকে কিছুতেই ভুলতে পারিনা। অনেকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কেমন যেন আরও তাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি। কিন্তু সে তো আমার কখনো হবেই না।”
মীরা ভ্রু কুচকে বলল, “তোমার হবে না এতো শিউর কি করে?”
“মা যদি তাকে মেনে না নেয়। তাছাড়া সে যদি আমাকে পছন্দ না করে? তার যদি অন্য কোথাও রিলেশন থেকে থাকে!”
মীরা কোমরে হাত রেখে বলল, “আমি আছি কি করতে হ্যাঁ? আমার বোনকে আমি চিনি। ও এসব রিলেশন এর মধ্যে নেই।”
“তুমি কি শিউর?”
“নট শিউর। তবে আমি ওদের চিনি। ওরা মামা মামি পছন্দ করে না এমন কাজ করবে না।”
“অহ্।”
“বিদ্রোহী প্রেমিকের মতো মুখ গোমড়া করে থেকো না। মানুষ তখনই খুব আবেগপ্রবণ হয়, যখন সে তার ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে কষ্ট পায়। তুমি কি ছ্যাঁকা টাইপ কিছু খেয়েছ নাকি! যত্তসব আজিব ধারণা।”
মীরার কথায় আয়ান হেসে উঠল। স্বাভাবিক হয়ে মীরাকে জিগ্যেস করল, “তুমি আর্ট করতে পারো?” জানো, আমার একটা বিজনেস আছে। যেখানে আমি টি-শার্ট, জ্যাকেট ও হুড়ি তৈরি করে বিক্রি করি। এ কাজে আমিসহ আমার দুজন ফ্রেন্ডও ইনভলভ আছে। আমি চাচ্ছি এবার পাঞ্জাবিও তৈরি করব। মুলত টি-শার্ট এ হ্যান্ড পেন্টিং করি। তুমি যদি হ্যান্ড পেন্টিং করতে পারো তাহলে আমার ব্যান্ড এ যোগ দিতে পারো।”
“আমি টুকটাক আর্ট করি। এতো ভালো পারিনা।”
“তোমার আর্ট দেখতে পারি?”
“এখন!”
“হ্যাঁ এখন।”
আয়ান একটা ক্যানভাস নিয়ে আসে মীরার সামনে। সাথে রঙ তুলি। মীরাকে বলে আর্ট করে দিতে। মীরা একটু নার্ভাস ফিল করলো। তারপর আয়ানের হাত থেকে রঙ তুলি নিয়ে ক্যানভাসে কিছু একটা আঁকতে বসলো। মীরার একটা ইউনিক ডিজাইন করলো। আর সেটা দেখে আয়ান খুব খুশি হলো। সে বলল, “তাহলে আজ থেকে তুমি আমার পার্টনার। এতে তোমারও কিছু ইনকাম হবে। আজকাল মেয়েরা নিজেদের কত স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করছে। তোমারও তো ইচ্ছে করে নিজের যোগ্যতায় কিছু একটা করার।”
“হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক। থ্যাংক ইউ তোমাকে।”
মীরার ফোনে হঠাৎ একটা কল আসে। মীরা দেখে ওটা দিবার নাম্বার। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে, “কোই আছিস মীরা?”
“বাসায়, কেন?”
“আমাদের বাড়িতে পাত্রপক্ষ এসেছে।”
মীরা চমকে যায়! পাত্রপক্ষ! তাহলে কি দিবাকে দেখার জন্য এসেছে? এবার সে আয়ানকে কি জবাব দিবে? ঢোক গিলে জিগ্যেস করে, “তোকে দেখতে এসেছে?”
“না রে। ইরাকে দেখতে এসেছে। তাছাড়া আমাকে কি কারো পছন্দ হবে বল? আমি চোখে চশমা দেই, তাই অনেকেই ভাবে আমি চোখে দেখিনা। কিন্তু তুই তো জানিস, আমি মাথা ব্যথার জন্য চশমা ইউজ করি।”
“অহ!”
মীরা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। আয়ান কৌতুহলে মীরার দিকে তাকিয়ে আছে। মীরা দিবাকে বলে, “এখন কি খবর ওখানের?”
“ভালো, শুনেছি ইরাকে তাদের খুব পছন্দ হয়েছে। বিয়ের ডেটও ঠিক করে ফেলেছে।”
“মানে? দেখা হলেই বিয়ে করিয়ে ফেলবে নাকি?”
“আরে না রে। প্রস্তাবটা অনেক আগেই এসেছে আব্বুর কাছে। আব্বু অনেক খোঁজ খবর নিয়েছেন। তারপর ওনাদের আমাদের বাড়িতে আসতে বলেছেন। ওনারাও আমাদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিল। ব্যাস! তাই আর দেরি করলেন না। বিয়ে ঠিক করে ফেললেন।”
“ছেলে দেখতে কেমন? বাসা কোই?”
“হ্যান্ডসাম আছে। আহান ভাইয়ার মতোই হ্যান্ডসাম। শোন, পরশুদিন তোদের ওখানে যাব। শপিং করতে। তুই থাকবি কিন্তু। ওখানে সেই ছেলেটিও থাকবে।”
“আচ্ছা। আমাদের বাসার কেউ জানে?”
“তোকে আমি বেশি ভালোবাসি। তাই দেখ, কেউ তোকে জানায়নি। আমিই জানালাম। তোদের বাসায় আব্বু অনেক আগেই খবর দিয়ে দিয়েছে। আগামী শুক্রবার এ বিয়ে।”
“অহ। আর তো এক সাপ্তাহ।”
“হ্যাঁ।”
কল কেটে দিল দিবা। আয়ান জিগ্যেস করলো, “কে ছিল?”
“দিবা।”
“কি বলল।”
“পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে।”
আয়ান স্তব্ধ হয়ে গেল। তারমানে দিবাকে দেখতে এসেছে? দিবার বিয়ে হয়ে যাবে? আর সে কিছুই করতে পারবে না? আয়ান ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। ছ্যাৎ করে উঠে তার হৃদয়। বুক ভেঙে আসছে তার। আয়ানের অবস্থা বুঝে মীরা দ্রুত বলল, “আরে আরে! দিবাকে দেখতে আসেনি। ইরাকে দেখতে এসেছে।”
আয়ান যেন প্রাণ ফিরে পেল। মীরা মুচকি হেসে বলল, “এইটুকু তে এই অবস্থা! সামনে যদি আরও বড়ো ঝামেলা হয়, তখন কি করবে!”
“আই ডোন্ট নো।”
“রেস্ট নাও আসছি আমি।”
মীরা চলে গেল আয়ানের রুম ছেড়ে। নিজের রুমে এসে দেখে আহান এসেছে। আহান ফ্রেশ হয়ে আসলে দুজনে একসাথে খাবার খায়। আহান আজ আর থানায় যায়না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here