তোমার_আমার_চিরকাল🌸 || পর্ব – ৩ || #লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৩ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

পেরিয়ে গেছে এক সাপ্তাহ। সকালের মিষ্টি রোদে ঝলমল করছে পুরো শহর। মীরা সবে বেরিয়েছে কলেজের উদ্দেশ্যে। মীরা ফেনী সরকারি কলেজে অনার্স ২য় বর্ষে পড়ছে, ইংরেজি নিয়ে। পথে ভিষণ জ্যাম বেঁধেছে। মীরা রিক্সা থেকে নেমে হাটা ধরলো। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে কলেজে ক্লাস শুরু হতে বেশি দেরি নেই। মীরা অস্থির হয়ে উঠলো। দ্রুত হাটছে সে। এক সময় দৌঁড় দিল। এই দৌঁড়ই যেন তার জন্য কাল হলো। দৌঁড় দিয়ে কলেজে যাওয়ার আগেই একজনের সাথে হালকা ধাক্কা লাগে মীরার। মীরা তাকে স্যরি বলে। বিপদ ঘটে তখনই। যার সাথে সে ধাক্কা খায় সেই ছেলেটা মীরার হাতে একটা ব্যাগ গুঁজে দিয়ে দৌঁড়ে ওখান থেকে চলে যায়। যেন তার খুব তাড়া। মীরা হা করে ছেলেটার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। হাতে থাকা ব্যাগের দিকে তাকায় সে। এই ব্যাগটা তাকে কেন দিল ছেলেটা? এমন সময় ওখানে ক’জন পুলিশ কর্মকর্তা আসেন। মীরা তাদের দেখে ভড়কে যায়। তাদের মধ্যে একজন বলে, “এই ব্যাগ তোমার কাছে কেন? তার মানে তুমিও এর সাথে যুক্ত? দেখে তো স্টুডেন্ট মনে হয়। এরকম কাজ করতে লজ্জা করে না?”
মীরা পুরো তাজ্জব বনে গেল। এসব কি বলছেন তারা। ও কি করেছে? মীরা শান্ত হয়ে বলল, “আমি কি করেছি। কি বলছেন কি আপনারা?”
“তুমি কি করেছো ওটা থানায় গেলেই জানতে পারবে। এই ওকে নিয়ে চলো।”
মীরার মাথায় বাজ পড়ে। তাহলে কি ব্যাগে কিছু আছে যার জন্য ওরা তাকে সন্দেহ করছে? মীরা জোর কন্ঠে বলে, “আপনারা ভুল বুঝছেন। একটা ছেলে মাত্র আমার হাতে এই ব্যাগটা দিয়ে দৌঁড়ে চলে গেছে। এই ব্যাগ সম্পর্কে আমি অবগত নই।”
“ধরা পড়লে না সবাই এরকম গল্প বলে। চলো থানায়।”
মীরাকে একটা মহিলা পুলিশ তার একটা হাত ধরে টানতে থাকে। মীরা বারবার বলছে সে কিছু করেনি কিন্তু কেউ তাকে বিশ্বাসই করছে না।


থানায় বসে একটা ফাইল দেখছিল আহান। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম লেপ্টে আছে। ভ্রু জোড়া কানিক পর পর কুচকাচ্ছে। এমন সময় দরজা থেকে একটা মেয়ের চ্যাঁচামেচির আওয়াজে দৃষ্টি ফাইলের উপর থেকে সরে যায় আহানের। কৌতুহলে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে সে। পুলিশরা একটা মেয়েকে ধরে নিয়ে এসেছে। মেয়েটিকে দেখে চোখ কপালে উঠে তার। ফাইলটা বন্ধ করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে দরজার দিকে।
“ছাড়ুন আমাকে ছাড়ুন।” চিৎকার করে উঠে মীরা। সামনে তাকিয়ে আহানকে দেখতে পায় সে। এতক্ষণ রাগ যা ছিল, আহানকে দেখে তার থেকে আরও বেশি পরিমান রাগ উঠেছে তার। আহান একজন পুলিশকে জিগ্যেস করে, “আপনারা এনাকে এভাবে কেন নিয়ে এসেছেন?”
পুলিশটি বলল, “স্যার, আমরা ওনার কাছে চোরাই ব্যাগ পেয়েছি।”
আহান বেকুব হয়ে যায়। চোরাই ব্যাগ? মীরা? রাগ দেখায় মীরা। “এইজন্যই আমি পুলিশদের ঘৃণা করি। মানুষকে যাচাই বাছাই না করেই ধরে নিয়ে আসে। সত্যিটা কি সেটা একবারও জানতে চায়না।”
আহান বলে, “ওনাদের হয়ে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। আপনি একটু বলবেন কি হয়েছে?”
মীরা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এই মুহুর্তে তার কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই। একজন পুলিশ বলে, “আপনি ওনাকে চিনেন স্যার?”
আহান বলে, “আপনাদের একটা কথা বলি, আপনাদের কয়েকজনের জন্যই কিন্তু এই পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এর বদনাম হয়। মানুষ পুলিশদের উপর থেকে ভরসা হারায়। যাকে তাকে বিনা অপরাধে ধরে নিয়ে আসেন। আসল লোককে তো ধরতেই পারেন না আবার উল্টো যারা কিছুই করেনি তাদের নিয়ে আসেন। গায়ে থাকা পোশাকটার মর্যাদা রাখুন।”
সবাই মাথা নিচু করে থাকে।
মীরার বিরক্তি লেগে উঠে। একেই তো এখানে নিয়ে এসে কলেজের লেইট করালো, তারউপর এই আহান ভাষণ শুরু করেছে। আহান মীরার দিকে তাকিয়ে বলে, “কি হয়েছে বলবেন কি?”
মীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। “আমি কলেজে যাচ্ছিলাম। দেরি হচ্ছিল বিধায় একটু জোরে হাটা দেই। কিন্তু একটা ছেলের সাথে ধাক্কা লাগে। এরপর সে আমার হাতে একটা ব্যাগ গুঁজে দিয়ে দৌঁড় শুরু করে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ওনারা এসে আমাকে যা তা বলেন। আমি ওনাদের বলেছি আমার কোনো দোষ নেই তবুও ওনারা শোনেননি।”
আহান ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে। তখন মীরা বলে, “পরিক্ষার সময় যখন একটা বাজে স্টুডেন্ট একটা ভালো স্টুডেন্ট এর বেঞ্চের নিচে নকল ফেলে দেয়। আর সেই মুহুর্তে ম্যাজিস্ট্রেট এসে ওই নকলের কাগজটা দেখে ভাবে যে ভালো স্টুডেন্ট টা নকল করেছে। অথচ সেই নকলের ব্যাপারে ভালো স্টুডেন্ট অবগত ছিলই না। ম্যাজিস্ট্রেট তাকে সাস্পেন্ড করে। একটা ভালো স্টুডেন্ট এর জীবন নষ্ট হয়ে যায়। আপনার পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এর লোকগুলোও ঠিক ওই ম্যাজিস্ট্রেট এর মতোই। যাচাই বাছাই না করেই ভুল মানুষকে তুলে নিয়ে আসে।”
আহানের খারাপ লাগলো। এখন কেউ যদি জানতে পারতো যে মীরাকে পুলিশ ধরে নিয়ে এসেছে তখন মীরার জীবনের একটা দাগ লেগে যেত। কেউ এটা জানতে চাইবে না যে কেন থানায় নিয়ে আসা হলো। বরং সবার এটা মাথায় থাকবে যে ও থানায় পা রেখেছে।
আহান বলে, “এমনটা আর হবে না মিস। স্যরি সবার তরফ থেকে।”
মীরা বলে, “তাহলে আমি কি এখন যেতে পারি?”
আহান বলে, “জি। আসুন আপনি।”

মীরা থানা থেকে বেরিয়ে গেল। আজ আর তার কলেজে যাওয়া হলো না। সবশেষে সে সিদ্ধান্ত নিল সে বাসায় চলে যাবে। থানার রোড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা রিক্সা বা অটোর জন্য। এটা আবার একটা ঝামেলা। থানার সামনে কেউই গাড়ি দাঁড় করাতে চায়না। মীরা বাধ্য হয়ে হাটা ধরে। কিছুদূর যেতেই একটা বাইক এসে থামে ওর সামনে। বাইকারের হেলমেটটা খুলতেই মীরার মুখে এক চিলতে হাসি ফুঁটে উঠে। তুর্য এসেছে। মীরা বলে, “ভালো সময় এসেছো। চলো বাসায় যাই।”
“তুই এখানে কি করছিস? কলেজে যাসনি?” তুর্যর প্রশ্ন। মীরা খানিক চুপ থেকে বলে, “মাথা ব্যথা করছে। বাসায় যাই প্লিজ।”
তুর্য মীরাকে একটা হেলমেট দিল। মীরা সেটা পড়েই তুর্যর পিছনে বাইকে বসলো। তুর্য বাইক স্টার্ট দিল বাসার উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য।


মাথার উপর খাড়া রোদ। খা খা করছে চারপাশ। বাসায় যেতে যেতে মীরার ক্লান্ত মাথাটা নুইয়ে দিল তুর্যর পিঠে। তুর্য সেটা বুজতে পেরে মীরার এক হাত শক্ত করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে। অন্য একটা হাত দিয়ে বাইক চালাচ্ছে সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসার সামনে চলে আসে ওরা। তুর্য মীরার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় রেখে বাইক থেকে আস্তে করে নেমে পড়ে। তারপর আস্তে করে মীরাকে ধরে বাইক থেকে নামায়। মীরা এতটাই ক্লান্ত যে চোখ মেলে তাকাতেই পারছে না। তুর্য ভাবছে সে কি করবে। কপালে চিন্তার ভাজ। চট করেই মীরাকে সে কোলে তুলে নিল। কিচ্ছু ভাবলো না, সোজা বাসার ভিতরে ঢুকে গেল।

এদিকে তুর্যর কোলে মীরাকে দেখে পরিবারের লোক সবাই ঘাবড়ে যায়। মীরার পরিবারের লোকেরা সবে খেতে বসেছিল। কিন্তু তুর্য মীরাকে কোলে নিয়ে বাসার ভিতরে ঢুকলে চমকে উঠে সবাই। মীরার মা দৌড়ে এসে অস্থির হয়ে বলে উঠে, “মীরা! কি..কি হয়েছে আমার মেয়ের?”
তুর্য নিজের কোল থেকে মীরাকে নামিয়ে তাকে সোফায় শোয়ালো। মীরার দাদি হঠাৎ করেই বলে উঠল, “এই ছেলে আমাদের মেয়ের সাথে কি করছো?”
মীরার দাদির কথায় তুর্য বিশ্মিত হলো। বাসার সবাই বিরক্তবোধ করলো। মীরার মা তার শাশুড়ীকে বললেন, “বাজে কথা বলবেন না মা। ও আমার ভাইয়ের ছেলে। কি বলছেন এসব আপনি।”
মীরার দাদি বলে, “আজ কালকার ছেলেমেয়েদের উপর বিশ্বাস নেই।”
মীরার বাবা বললেন, “আহ্ মা। থামো তুমি।”
তুর্য নিচু সরে বলল, “ফুপ্পিমা, মীরার হঠাৎ মাথা ব্যথা উঠে, তীব্র গরমে হয়তো তা সহ্য করতে না পেরে সেন্সলেস হয়ে যায়। ওকে দেখে রেখো।” আর কোনো কথা না বলেই তুর্য ওখান থেকে বেরিয়ে গেল। মনে একটু কষ্ট পেয়েছে মীরার দাদির কথা শুনে। সে মীরার ক্ষতি করবে? যা সে কল্পনাতেও আনে না। কল্পনাতে মীরাকে নিয়ে এক অন্য স্বপ্ন বুনে রেখেছে সে।


পড়ন্ত বিকেল। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম দিকে। মানুষের শোরগোল, বাচ্ছাদের চিৎকার পাখির টুকটাক কিচিরমিচির আওয়াজ কানে ভেসে আসছে। মীরা ছাদে এসেছিল শুকাতে দেওয়া কাপড়গুলো নিয়ে যেতে। কাপড়গুলো হাতের মধ্যে রেখে ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো সে। নিচে তাকিয়ে দেখে তাদের গলির মধ্যে বাচ্চারা ক্রিকেট খেলছে। কয়েকজন মানুষের যাতায়াত সেখানে। মীরা বাচ্চাদের খেলা দেখছে। শৈশবের স্মৃতি মনে পড়ে গেল। ছোটবেলায় দল বেঁধে তারা খেলা করতো। মীরার পাশে এসে দাঁড়িয়ে রইলো তার নতুন ভাবি। সে এক পলক তার ভাবির দিকে তাকিয়ে আবারও খেলা দেখায় মনোযোগ দিল। তার ভাবি তাকে বলল, “তুর্য ভাইয়ার সাথে তোমার কি কিছু হয়েছে?”
মীরা চমকে উঠলো। দৃষ্টি রাখলো তার ভাবির চোখে। সে বলে, “মানে? তুর্য ভাইয়ার সাথে আবার আমার কি হবে।”
“তুমি অজ্ঞান অবস্থায় তুর্য ভাইয়ার কোলে ছিলে। আর দাদি তা দেখেই কিছু কথা শুনিয়ে দিয়েছে। ভাইয়া বোধয় কষ্টও পেয়েছে।”
“কি বলেছে দাদি? তুমি বলো কি হয়েছে।”
মীরার ভাবি তাকে সব কথা খুলে বলে। মীরার চোখ কপালে উঠে যায়। তার দাদি তুর্যকে এসব বলেছে? এই জন্যই বুঝি জ্ঞান ফেরার পর তুর্যকে সে দেখেনি? মীরার ভিষণ খারাপ লাগলো। এ বিষয়ে সে তুর্যর সাথে কথা বলে ক্ষমা চেয়ে নিবে। না জানে তুর্য কতটা কষ্ট পেয়েছে। তাই হয়তো এতক্ষণে একটা মেসেজও সে মীরাকে দেয়নি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here