তোমার_আমার_চিরকাল🌸 || পর্ব – ৪ || #লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৪ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

দিনপুঞ্জিকায় শুক্রবার। আর শুক্রবার মানেই ছুটির দিন। খেটে খাওয়া মানুষদের আরাম করার দিন। বিশেষও বটে। শুক্রবার মানেই জু’মা। শুক্রবার দিনটি অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশিই ভালো লাগে সবার। কথায় বলে দিনের সবচেয়ে উত্তম দিন হলো এই শুক্রবার।

মীরা এই মুহুর্তে তার মামার বাসায় আছে। আজকে মীরার বড়ো মামিরা তার ভাই, ভাবি কে দাওয়াত দিয়েছে। সে-ই সাথে মীরাকেও আসতে বলেছে। মীরাও একটা সুযোগ খুঁজছিল ও বাড়িতে যাওয়ার। তুর্যর দেখা নেই কয়দিন। না আছে কোনো যোগাযোগ। মীরা বুঝতে পারলো দাদির কথায় ভিষণ মন খারাপ লেগেছে তুর্যর। মীরা তার ভাইয়া ভাবির সাথে সোফায় বসে আছে। তার বড়ো মামি তাদের নাশতা দিয়েছেন। তার বড়ো মামা তাদের সামনে বসে গল্প করছেন। মীরা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। অন্যদিন হলে তো তুর্য মীরার গলার আওয়াজ পেলেই চলে আসে। কিন্তু আজ ওর সামনে আসছে না কেন? মীরা হালকা কিছু মুখে দিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে, “আসছি একটু।”
মীরা ওখান থেকে উঠে যায়। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যেতে নিলে তার মামি তাকে দেখে ডাক দেয়। মীরা থেমে যায়। মীরার মামি তার কাছে এসে বলে, “কোথায় যাচ্ছিস?”
মীরা আমতা আমতা করে বলে, “ও,,ওই ওয়াশরুমে যাচ্ছি একটু।”
“ঠিকাছে। তাড়াতাড়ি আসিস। আমি আজ তোর পছন্দের একটা জিনিস বানিয়েছি। টেস্ট করে দেখিস।”
মীরা পাশ কাটিয়ে চলে আসে। পা চালিয়ে সোজা তুর্যর রুমে ঢুকে যায় সে। তুর্য তখন শুয়ে ছিল। মীরা তুর্যর বেডের কাছে গিয়ে তুর্যকে ডাক দিল। “তুর্য ভাই।”
তুর্য চোখ খুলল। মীরাকে দেখে লাফ দিয়ে বেড থেকে উঠে যায় সে। তুর্য দরজার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই? কেউ দেখেনিতো আসতে?”
মীরা আরও অবাক হয়। সে তুর্যর রুমে বহুবার এসেছে। কই, তুর্যতো এমন প্রশ্ন কখনো করেনি। তাহলে? মীরা বলে, “তুমি খুব খারাপ তুর্য ভাই।”
“কেন?”
“দাদি তোমাকে কি না কি বললো তার জন্য তুমি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবে?”
“আমি কথা না বললেই বা কি আসে যায় মীরু? আমার সবচেয়ে বড়ো ভুল হচ্ছে তোর আশেপাশে থাকাটা। তোর সাথে মিশলেই কথা উঠে। যেটা তোর জন্য ভালো না। তাই আমিও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। তোর সামনে যাওয়াটা বন্ধ করে দিয়েছি।”
মীরা তুর্যর সামনে বসে পড়ে। “এসব তুমি কি বলছো। আমরা কাজিন। তুমি, আমি, দিবা, ইরা আর মিরাজ ভাইয়া আমরা সবাই তো একসাথেই সময় কাটাই। কতো মজা করি। আর কি বলো এসব তুমি।”
“ওদের সাথে থাকা আর তোর সাথে থাকাটা এক নয় মীরু।”
“তুমি আর আমার সাথে কথা বলবে না তুর্য ভাই? আর আমাদের বাড়ি যাবে না? এতো ইগো তোমার?”
“আমার কোনো ইগো নেই মীরু।”
“তুমি আমায় কষ্ট দিচ্ছো তুর্য ভাই। মনে হচ্ছে এ সব কিছুর জন্য আমিই দায়ী। আমার জন্যই তুমি আমাদের বাড়িতে যাও না।”
“নিজেকে দোষ দিস না। তোর কোনো দোষ নেই সব দোষ আমার।”
“সত্যিই তুমি খারাপ তুর্য ভাই।” মীরার চোখের কোণে জল এলো। এক্ষুণি তা গড়িয়ে পড়বে। মীরা চোখে জল নিয়েই ওখান থেকে চলে গেলো। তুর্য মীরার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। “তোর চোখের জল আমি একদমই সহ্য করতে পারিনা। কাঁদিস না মীরু।”

দুপুরের দিকে সবাই খেতে বসলো৷ তুর্য নিচু হয়ে খাবার খাচ্ছে। কারো সাথে কোনো কথা নেই। এই বিষয়টা মিরাজের ভালো লাগেনি। হঠাৎ তুর্যর হলোটা কি? কারো সাথে কোনো কথা নেই৷ হাসি নেই। যেই ছেলেটা মিরাজকে দেখেই লাফিয়ে উঠতো, মজা নিতো আজ সে চুপ কেন? মিরাজকে বিষয়টা ভাবাচ্ছে। সেদিনের পর থেকেই তুর্য ওদের বাসায় যায়নি। মিরাজকেও কল দেয়নি। তাহলে কি দাদির কথায় তুর্য কষ্ট পেয়েছে?
মীরা তুর্যর দিকে তাকালো। কি করে পারছে সে এতো চুপ করে থাকতে?

তুর্য তার রুমেই ছিল। হুট করে মিরাজ প্রবেশ করে। তুর্য চমকে যায়। মিরাজ বলে, “সমস্যা কি তোর? কথা নাই কিচ্ছু নাই। হলো টা কি?”
তুর্য মলিন হেসে বলে, “কই কি হবে আমার।”
“দাদির কথা নিয়ে পড়ে আছিস?”
“না তো। এমনিই মন ভালো নেই।”
মিরাজ তুর্যর কাছে গিয়ে বসলো। তুর্য মাথা নিচু করে রইলো। মিরাজ বলল, “একটা কথা ক্লিয়ারলি বলবি?”
তুর্য মাথা তুলে মিরাজের দিকে তাকালো। “কি কথা?”
“তুই মীরাকে ভালোবাসিস?”
মিরাজের প্রশ্নে তুর্যর মুখ থমথমে হয়ে গেল। এই প্রশ্নের জন্য অপ্রস্তুত ছিল সে। চোখ এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছে। মিরাজ আবার প্রশ্ন করলো। “বলবি তুই?”
তুর্য মিরাজকে জড়িয়ে ধরে। মিরাজ স্তম্ভিত হয়ে যায়। তুর্য বলে, “ভালোবাসি। তোর বোনকে আমি ভিষণ ভালোবাসি মিরাজ। আমার খুব কষ্ট হয় যখন মীরা আর আমাকে নিয়ে কথা উঠে। আমি চাইনা আমার জন্য মীরাকে কেউ কিছু বলুক।”
“আমার বোনকে বলতে পারবি তোর ভালোবাসার কথা?”
“পারবো, কিন্তু ও আমায় মেনে নিবে?”
“তুই বলে দেখ। পরের টা আমি দেখবো।”
“তুই আমার সত্যিকারের বন্ধু মিরাজ।”
“তুর্য তুই আর মীরা আমার কাছে অনেক কিছু। তাছাড়া আরও একজন আছে, আহান। আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু!”


প্রবল বেগে বাতাশ হচ্ছে। এক্ষুনি ঝড় শুরু হবে। সবাই ছুটাছুটি করছে। সময়টা বিকেল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির হাওয়া গায়ে মাখছিল মীরা। তার সঙে ছিল তার নতুন ভাবি। ঝড় উঠছে দেখে মীরা তার ভাবিকে বলে, “চলো আমতলী। আম কুঁড়াবো।”
মীরার ভাবি মলিন হেসে বলে, “এই তুফানের মধ্যে তুমি আম কুঁড়াবে?”
মীরা কোনো কিছু শুনলো না। তার ভাবির হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেল তাদের বাড়ির সামনে থাকা বিশাল দুটো আমগাছের তলায়। শত শত আম ধরে আছে। কিছু আম নিচে পড়ে আছে। মীরা আর তার ভাবি মিলে একটা ঝুড়িতে আম কুড়িয়ে রাখছে। মীরার ভাবি বাতাশ দেখেই বলে, “মীরা চল, বাতাশে ধুঁলো উড়ছে। অনেকগুলো হয়েছে, আর কুড়াতে হবে না।
মীরা বলে, “তুমি যাও, আমি আর দুটো নিয়ে আসছি।”
মীরার ভাবি আম ভর্তি ঝুড়ি নিয়ে স্থান ত্যাগ করলো। মীরা আরও কয়েকটা আম হাতে নিল। এদিকে বাতাশে মীরার চুল এলোমেলো হয়ে আছে। খোলা চুলগুলো চোখে এসে বারবার বিরক্ত করছে তাকে। ধুঁলো এসে চোখের ভিতরে ঢুকে গেছে। মীরা চোখ মেলে তাকাতেও পারছেনা। আম গাছের একটা ঢাল ইতিমধ্যেই ভেঙে গেছে। কিন্তু সেটা এখনো আম গাছেই ঝুলে আছে। বাতাশে সেটাও আর রইলো না। ধুপ করে পড়তে নিল। তাও আবার মীরার মাথার উপর। মীরা একটুখানি চোখ মেলে তাকাতে দেখলো ঢালটা তার মাথার উপর পড়ছে। মীরা ভয় পেয়ে গেল। আচমকাই একটা হাত মীরাকে টেনে নিল। বাঁচিয়ে দিল অনেক বড়ো বিপদ থেকে। কারো শরীরের সাথে মিশে রয়েছে সে। একটু আগের ঘটনায় বুকের ভিতর কেমন উথাল-পাতাল করছে। আজই কিছু একটা হয়ে যেত তার। কিন্তু তাকে কে বাঁচালো? কার সংস্পর্শে রয়েছে সে? মীরা উপরে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে চেনা একজন মানুষ। ধুঁলো পড়ায় মীরার চোখ লাল হয়ে পানি পড়ছে চোখ থেকে। সেই অশ্রুভেজা চোখ নিয়ে মীরা আহানের দিকে তাকিয়ে আছে। সাথে সাথেই সে আহানের থেকে দূরে সরে গেলো। আহান তখন বলল, “ঝড় উঠেছে দেখতে পাচ্ছেন না? যান ভেতরে যান।”
মীরা কানিকটা কেঁপে উঠলো আহানের ধমকে। মনে মনে ভাবছে, তার ভাইয়ের লাজুক বন্ধু ধমকও দিতে জানে? মীরা এক দৌঁড়ে বাড়ির ভিতরে।
আহান তার বাসায় যাচ্ছিল। কিন্তু ঝড় উঠায় সে ভাবে মিরাজের বাসায় কিছুক্ষণ থেকে যাবে। কিন্তু বাড়ির সামনে আসতেই দেখে মীরা আম নিয়ে এই ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, আর একটা ঢাল মীরার মাথার উপর পড়ছে। সাথে সাথেই মীরাকে টেনে নিয়ে আসলো নিজের কাছে।

আহান এখন মিরাজদের বাড়ির ভিতরে। মিরাজ আজ আহানকে জোর করে তাদের বাড়িতে রেখে দিয়েছে। রাতে রান্না হয়েছে। আহানকে খেতে দেওয়া হলো। আহান লাজুক স্বরে বলল, “আন্টি এগুলোতে কি ঝাল আছে?”
মীরার মা বলেন, “হ্যাঁ, আমরা সবাই তো মোটামুটি ঝাল খাই। তাই ঝালই রান্না করেছি।”
“আন্টি আমিতো ঝাল খেতে পারিনা। আমার এলার্জি আছে।”
মীরার মা লজ্জা পেয়ে গেলেন। ইশ! ছেলেটাকে এবার কি খাওয়াবেন উনি? মিরাজ বলল, “স্যরি আহান। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে তুই ঝাল খাস না। দাড়া, আমি অনলাইন থেকে খাবার অর্ডার করছি।”
আহান বলে, “এই থাক। লাগবে না। আমি বোধয় খেতে পারবো।”
মীরার মা ধমক দিয়ে বলেন, “এই ছেলে, রাখো। আমি তোমার জন্য অন্য কিছু বানিয়ে আনছি। এসব খেতে হবে না তোমাকে।”
মীরার মা চট করেই রান্নাঘরে গেলেন। দুটো ডিম ভেজে দিলেন। মসুর ডাল ভুনা করে নিলেন তাড়াতাড়ি করে৷ প্রায় দশ মিনিটের মতো লাগলো তার। কিন্তু লজ্জা লাগছে এগুলো দিতে। ভালো মন্দ রান্না করলো, কিন্তু ঝাল দেওয়ায় ছেলেটা খেতে পারলো না। মীরার মা নিচু হয়ে নিয়ে এলেন খাবার টেবিলের সামনে। মিরাজ আর আহান এতক্ষণ ধরে ফোন চাপছিল। আহান এর জন্য মিরাজও খায়নি। দুজন মিলে ফোন চাপছে দেখে মীরার মা এক ধমক দিলেন। “খাওয়ার সময় কিসের ফোন হ্যাঁ?”
আহান নিচু হয়ে রইলো। মীরার মা আহানের পাতে ডিম দিলেন, সামনে রাখলেন ডাল ভুনা। আহান হেসে বলল, “ডাল ভুনা? আমার অনেক পছন্দের আন্টি। ধন্যবাদ।” মীরার মা মলিন হেসে বললেন, “আসলে কি রান্না করবো এই কম সময়ে ভেবেই পাচ্ছিলাম না। তোমায় ভালো করে খাওয়াতেই পারলাম না।”
আহান বলে, “আরে আন্টি, ব্যাপার না। আমি অন্য একদিন এসে খেয়ে নিব আপনার হাতের রান্না।”

মীরা ডাইনিং টেবিলে এসে দেখে আহান মাংস রেখে ডিম ভাজি আর ডাল ভুনা দিয়ে ভাত খাচ্ছে। মীরা তার ভাবিকে ফিসফিস করে বলছে৷ “কি ব্যাপার ভাবি? এসব কি?”
মীরার ভাবি বলে, “ঝালে ভাইয়াটার এলার্জি আছে। আর তুমি তো জানো আমরা কি পরিমাণে ঝাল খাই। তাই মা তাড়াতাড়ি এসব রান্না করে দিয়েছেন।”
মীরা চুপচাপ ডাইনিং টেবিলে বসলো। কোনো দিকে না তাকিয়ে ডাল দিয়ে খাওয়া শুরু করে। মীরার মা আর মিরাজ মীরার কাণ্ড দেখে অবাক। মীরা হঠাৎ মাংস ছেড়ে ডাল দিয়ে খাচ্ছে কেন? মীরার মা বলে, “মাংস খা। শুধু ডাল কেন খাচ্ছিস?”
“মেহমান ডাল খাচ্ছে, আর আমি কিনা মাংস খেয়ে তাকে অপমান করব? এটা আমি পারব না। স্যরি।”
মীরা খেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে গেল। আহান ভাবছে মীরা তার এতকিছু ভেবেছে? মীরার ভাবনা অন্যরকম। যা সে মিরাজের হলুদের দিনই বুঝে গেছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here