তুমি_আমার_অনেক_শখের(০৪) #লেখনীতেঃসুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি

#তুমি_আমার_অনেক_শখের(০৪)
#লেখনীতেঃসুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি

রাত পেরোলে ধরণীতে আরেকটি দিনের সূচনা। সূর্যের আলোয় আলোকিত হয় ধরণী। জনপদের মানুষ ব‍্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেদের স্ব স্ব কর্মে। আজ প্রজ্ঞার গায়ে হলুদ। সকাল থেকেই প্রজ্ঞার প্রচণ্ড জ্বর, মাথা ব‍্যথা শুরু হয়েছে। জ্বর এবং মাথা ব‍্যথার তীব্রতার দরুণ চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না বেচারি। পরিবারের সকলের মুখে খুশির চিহ্ন মিলিয়ে গিয়ে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। আজ হলুদ। পরদিন বিয়ে। এরমধ্যে বিয়ের কণের এমন অসুস্থতা। চিন্তার বিষয় তো বটেই। একমাত্র কন‍্যা হিসাবে পরিবারের সবাই চেয়েছিল গায়ে হলুদটা জাকজমকপূর্ণ করে দিতে। কিন্তু প্রজ্ঞা বিষয়টি সমর্থন করেনি। সে ঝামেলা না করে বুঝিয়ে বলেছে তার আব্বু-আম্মুকে। গায়ে হলুদ বাঙালি একটি সংস্করণ মাত্র। এতে সওয়াবের কোন ছিটেফোঁটা নেই। ইসলাম পর্দাহীন অনুষ্ঠান অনুমোদন করে না। হলুদের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মানুষ আসবে। আমার গালে হলুদ ছোঁয়াবে। মিষ্টিমুখ করাবে। এতে খুশি হওয়ার মত কিছু নয়। আমার তো এতে অস্বস্তি ছাড়া ভালো লাগার কিছু মনে হয় না। তবে তোমাদের মনের ইচ্ছা পূরণ করতে চাইলে অন্দরে ছোট করে ব‍্যবস্থা করতে পারো। যেখানে বাহিরের পুরুষ মহিলা কেউই থাকবে না। আর যেটা টাকা হলুদের অনুষ্ঠান খরচ করতে চেয়েছো সেটা কোন মাদ্রাসা এতিমখানায় দান করতে পারো। এতে আল্লাহর রহমত ও সন্তুষ্টি অর্জন হবে। কিছু এতিম শিশু হয়তো একবেলা ভালো খাবার খেতে পারবে। হলুদের অনুষ্ঠান অর্থ অপচয় ছাড়া আর কি! আর অপচয়কারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না সেটা নিশ্চয়ই তোমাদের অজানা নই। আমি আমার মতামত জানিয়ে দিলাম। এবার তোমরা তোমাদের ইচ্ছানুযায়ী করো। প্রজ্ঞার আব্বু মেয়ের এমন সুন্দর যুক্তিযুক্ত কথায় খুবই সন্তুষ্ট হয়েছেন। পর্দা, নামাজ, যাকাত পালন করার মত মানুষের অভাব নেই বতর্মান মুসলমানদের মধ্যে। কিন্তু এসব পালন করলেও বহু মুসলিম (নাম ধারী) বাদ‍্যযন্ত্র, মদ‍্য পান, নাচ-গান এসবে মগ্ন থাকে। কিন্তু প্রজ্ঞা ইসলাম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করতে পারে না। সে প্রাক্টিসিং মুসলিমাহ্। প্রজ্ঞার সুন্দর যুক্তিমুলক কথা শুনে মেয়ের কপালে স্নেহের পরশ একে দিয়েছেন ভদ্রলোক।

প্রজ্ঞার জ্বর একশ তিন ডিগ্রি। চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছে। প্রজ্ঞার মা সব কাজকর্ম ফেলে মেয়ের শিয়রে বসে আছে। চোখেমুখে দুশ্চিন্তার তীব্র ছাপ। বেলা বাজে দশটা। আত্মীয়স্বজনেরা আসতে শুরু করেছে। ঘরোয়া ভাবে হলুদের অনুষ্ঠান সারতে হবে। কিন্তু যার বিয়ে তারই তো খোঁজ নেই। প্রজ্ঞার হবু শশুর বাড়িতে এখনো প্রজ্ঞার অসুস্থতার কথা জানানো হয়নি। কিন্তু আজরাফ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। প্রজ্ঞা বরাবরের মতোই এড়িয়ে চলেছে।

দুপুরের কিছু পরে। প্রজ্ঞার জ্বর কিছুটা কমেছে। কিন্তু একেবারে যাইনি। মুখে তেতো ভাব। শরীর দূর্বল। প্রজ্ঞার মা অল্প কিছু খাবার, ওষুধ খাইয়ে গিয়েছেন। প্রজ্ঞা ঘুমে মগ্ন। মাঝেমধ্যে মর্জিনা এসে দেখে যাচ্ছে।
,,,,আজরাফ অন‍্য একটি মেয়ে মানুষের সঙ্গে পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছে। বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েই। মেয়েটির মাথা আজরাফের কাধের ওপর। তাদের মধ্যে কি কথোপকথন চলছে দুর থেকে বোঝা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু এটুকু আন্দাজ করা যাচ্ছে তাদের মধ্যে প্রণয় ঘটিত কোন সম্পর্ক তো নিশ্চয়ই আছে। এটুকু দেখে প্রজ্ঞার পা থমকালো। পরবর্তী ধাপে পা ফেলার সাহস তার হলো না। প্রজ্ঞার দুয়ে দুয়ে চার মেলার পালা। কারণ আজরাফ বেশ কদিন ধরে তাকে অবহেলা করছে। অফিস থেকে ঠিকঠাক সময় বাড়িতেও ফিরছে না। প্রজ্ঞা কোন প্রশ্ন করলে বা কোন কথা বললে অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে প্রতিত্তোর করছে। আজকাল ঘনঘন ফোন আসা শুরু করেছে আজরাফের। তাছাড়া সচক্ষে দেখা পার্কের ঘটনা। সবমিলিয়ে এখন তো সব হিসেব মিলে যাচ্ছে। প্রজ্ঞা ঠিক করলো সরাসরি আজরাফকে এ ব‍্যপারে প্রশ্ন করবে। চোখের দেখা সবসময় সত্য নাও হতে পারে।
আজরাফ অফিস থেকে ফেরার পর প্রজ্ঞা সরাসরি জিজ্ঞাসা করলো, “আজরাফ! কি হয়েছে বলুন তো? ইদানিং ইগনোর করছেন।”

আজরাফের ভরাট কন্ঠের সহজ স্বীকারোক্তি, “কিছু হয়নি। তোমার কাছে যা ইগনোর আমার কাছে সেটা স্বাভাবিক। তাই অহেতুক প্রশ্ন করে আমার কান ভারী করতে আসবে না।”

প্রজ্ঞা থমকালো। মস্তিষ্ক অনাড় হয়ে আসলো। চোখ উপচে পানি বেরিয়ে আসতে চাইছে। প্রজ্ঞা প্রাণপন চেষ্টা করলো আজরাফের সামনে নিজের আবেগ প্রকাশিত না করতে। হয়তো কিছুটা সফলও হলো সে। ফের প্রশ্ন করলো, “আপনাকে আজকাল খুব অচেনা লাগে আজরাফ। কি হয়েছে সরাসরি বলুন। আমার ভুলত্রুটি থাকলে সুধ্রে নিব ইন শা আল্লাহ।”

“কিছু হয়নি বললাম তো। কানের কাছে ঘ‍্যানঘ‍্যান করিও না প্লিজ!”

“তাহলে পার্কের মেয়েটি কে? আমার থেকে কিছু আড়াল করছেন? কি হলো বলুন?”

“তোমার জেনে কাজ কি? নিজে তো পারো না কিছু। এত বুঝতে এসো না। নিজের কাজ করো। যাও!”

প্রজ্ঞাকে পরবর্তীতে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আজরাফ গটগট করে চলে গেল ওয়াশরুমে। প্রজ্ঞা স্থির চিত্তে খানিক সময় আজরাফের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। তার অবচেতন মনে প্রশ্ন উদয় হলো, “মানুষ কি করে এতটা বদলাতে পারে? তবে কি কাউকে বিশ্বাস ভরসা না করাই শ্রেয়?”,,,,,,,,,

প্রজ্ঞা ধরফরিয়ে উঠলো ঘুম থেকে। ঘামে শরীর ভিজে উঠেছে। সে যখন ঘুমিয়ে ছিল গায়ে পাতলা কম্বল দেওেয়া ছিল। জ্বর ছিল কিছুটা। প্রজ্ঞা চোখ মুখে হাত বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সে এখন কোথায় আছে। জ্বর নেমে গিয়েছে। প্রজ্ঞা তার নিজের বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল। তার মানে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল? কি ভয়ংকর স্বপ্ন! বিয়ে হতে পারলো না অথচ মানুষটাকে নিয়ে কি আজব স্বপ্ন দেখে ফেলেছে সে। প্রজ্ঞার গলা পানির অভাবে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সে হাত বাড়িয়ে টেবিলের থেকে পানির গ্লাস নিয়ে পানি খেল। পানিতেও তৃপ্তি নেই। কেমন বিষাদ। প্রজ্ঞা এ মুহূর্তে অসহায় বোধ করছে। কি করবে ঠিক ভুল নির্ধারণ করতে পারছে না। তার আবেগতাড়িত মন বলে উঠলো আজরাফের সাথে কথা বলা উচিত। তাৎক্ষণিক ফোন লাগাল আজরাফের ফোনে। কল রিং হতেই ওপাশ থেকে রেসপন্স না করে কল কে’টে দিল। পরমুহূর্তেই আবার আজরাফ নিজেই কল দিল। প্রজ্ঞা ইতস্তত করে কল রিসিভ করলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সালাম দিল, “আসসালামু আলাইকুম।”

আজরাফ গমগমে কন্ঠে সালামের জবাব দিল, “ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছেন?”

“জি আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি?”

“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। আপনি মেবি ঘুম থেকে উঠেছেন সবে তাই না মিস প্রজ্ঞা?”

প্রজ্ঞা অবাক হলো। অবাক কন্ঠে শুধালো, “কি করে বুঝলেন?”

“না বোঝার কিছু নেই তো। আপনার কন্ঠ কেমন জড়িয়ে আসছে। ঘুম ঘুম কন্ঠস্বর। তাই আন্দাজ করলাম। তবে আমার আন্দাজ কিন্তু ভুল হয়নি।”

“হ‍্যাঁ তা ঠিক। কিছু কথা বলার জন্য ফোন করেছিলাম। সময় হবে?”

প্রজ্ঞার কথার পিঠে আজরাফ শব্দ করে হেসে উঠলো। বলল, “কি রকম কথা বলুন তো মিস প্রজ্ঞা! কাল যাকে বিয়ে করতে যাব সেই আমার হবু বউ হঠাৎ ফোন দিয়ে বলছে কিছু কথা বলব সময় হবে? মিস, আপনার জন্য আমার সময়ের অভাব নেই। এইযে ফোন করেছেন আমি ধণ‍্য। শুনেন যাই বলবেন বলুন কিন্তু বিয়ে ভাঙা বাদে সবকিছু বলেন। আমি শুনছি!”

“আজরাফ সাহেব! এখনো সময় সুযোগ আছে। ভেবে দেখুন। আমি অন‍্য পাঁচটা মেয়ের মত দেখতে হলেও কিছুটা শারীরিক জটিলতা আছে। সে তো জানেনই। এসব নিয়ে যদি পরবর্তীতে কোন সমস্যা হয়। আমাকে যদি তখন ভালো না লাগে? নতুন মুখ নতুন মানুষের সন্ধান খুজেন তখন? একটাবার ভাবুন তখন আমার কি হবে?”

আজরাফ গম্ভীর স্বরে প্রতিত্তোরে বলল, “দেখুন, কে কেমন কি করছে এসব নিয়ে আমার কিছু আসে যায় না। আপনাকে সবকিছু বলেছি এবং আপনার সব কথা শুনেছি। আমার যখন কোন আপত্তি থাকছে না তাহলে এত ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনার সমস্যা বুঝেশুনে বিয়ে করছি। ইনশা আল্লাহ ভবিষ্যতে কোন সমস্যা হবে না। আমি চাই শরীরের সন্ধি হওয়ার আগে মনের সন্ধি হওয়াটা বেশি জরুরি। জীবন কদিনের? সত্তর বা আশিঁ। মরেই তো যাব। কিন্তু এই ছোট্ট জীবনে জীবনসঙ্গী নির্বাচনে যদি ভুল করি তবে গোটা জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে। সেই সাথে আখিরাতও ধুলিসাৎ। আমার ছোট্ট জীবনে আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আসবেন কি মিস প্রজ্ঞা? কথা দিচ্ছি আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আপনাকে ভালোবাসবো। সে ভালোবাসায় এক রতি খাদ খুজে পাবেন না। আবারও বলছি দ্বিধা সংশয় থেকে বেরিয়ে আসুন। সবকিছু পজেটিভ ভাবে নেন। তাহলে সবকিছু সহজ হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ। বুঝতে পেরেছেন প্রজ্ঞা?”

“কিন্তু, আজ একটি খারাপ স্বপ্ন দেখেছি আমি। অবহেলা করছেন আমায়। বিরক্ত হচ্ছেন আমার কথায়। তাই খুবই চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ভাবলাম আপনার সাথে সরাসরি আলাপ করে নেয়।”

“শুনন, স্বপ্ন মানুষ বিভিন্ন কারণে দেখে। কোন বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত ভাবনা চিন্তার কারণেও সেসব নিয়ে মানুষ স্বপ্ন দেখে। আবার খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকেও দেখানো হয়। স্বপ্ন নিয়ে বিচলিত হবেন না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন। সবকিছু ভালোই হবে ইন শা আল্লাহ।”

“জি ধন্যবাদ আজরাফ সাহেব।”

“নিজের মানুষকে ধন্যবাদ দেওেয়া লাগে না। আর হ‍্যাঁ এত চিন্তা করিয়েন না তো। পৃথিবীর হাতেগোনা কয়েকটা বছর শুধু আমার হয়ে থাকুন। জান্নাতে আর আপনাকে চাইব না। আমার হুরদের নিয়ে থাকবো। আর জ্বালাবো না আপনাকে খুশি তো?”

“ভুলে যান মিস্টার আপনার হুর‍দের সরদারনী কিন্তু আপনার বিবিই হবে। সুন্দর সাবধান। বিবি হুকুম দিলেই না তাদের পাবেন।”

প্রজ্ঞার কথায় হেসে ফেলল আজরাফ। বলল, “আসলেই তো। তাহলে তো বিপদ!”

“বিপদ শুধু? না একেবারে মহাবিপদ।” কথাটা বলে প্রজ্ঞাও ফিক করে হেসে ফেলল। প্রথমবার আজরাফের সাথে কথোপকথনের সময় তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। প্রজ্ঞার মন বলে উঠলো আসলেই তো কিছু অনুভূতি সুন্দর। খুবই সুন্দর। কেমন সুখ সুখ লাগে।

ইনশাআল্লাহ…চলবে।

ক্ষমাপ্রার্থী! নিয়মিত দেওয়ার কথা থাকলেও দিতে পারছি না। আমার নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগে। ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। ভুলগুলো মার্জিত ভাষায় ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইল।
বাসি ঈদ মোবারক ♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here