ফানাহ্ 🖤 #পর্বসংখ্যা_৩৮ #হুমাইরা_হাসান

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৩৮
#হুমাইরা_হাসান

শীতল ঠান্ডা স্রোত’টা মেরুদণ্ড বয়ে সমস্ত কায়াময় ছড়িয়ে পড়লো, ‘ জড়িয়ে ধরবেন মোহ ‘ এই কথাটির জবাবে ঠিক কোন শব্দের ব্যবহার টা যথাযথ হবে? কোন ইশারাবার্তা’টা বোঝাতে সক্ষম হবে সামনের মানুষ টিকে যে তার বুকখানা এখন সর্বোচ্চ লোভে পরিনত হয়েছে মোহরের নিকট, সদা সর্বদা ওখানে মিশে পড়ে থাকার অভিলাষ, বাসনা টা ক্রমেই লালসা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

মাথা ঝুকিয়ে অস্থিরতম স্ফূর্তিতে ওড়নাটা আঙ্গুলের ডগায় পেঁচিয়ে যাচ্ছে অনবরত। বেশ খানিকটা সুনসান নীরবতা পালন করে জড়ত্বময়ী চোখ দু’টো উঁচিয়ে তাকালো, মেহরাজ ডিভানের হেডবোর্ডে দু’হাতে হেলান দিয়ে ঘাড় কাৎ করে একদৃষ্টে তাকিয়ে মোহরের পানে। কিঞ্চিৎ রাগ হলো মোহরের, রাগ নয় বরং অভিমান। প্রেয়সীর ব্যকুল মনটা যে জড়িয়ে ধরার তীব্র বাসনা টাকে লজ্জা, জড়তার প্রলেপে দমিয়ে নিঃশব্দে সম্মতি দিলো তা মেহরাজ একটুও বুঝলো না!
ভ্রুদ্বয় কুঞ্চন রূপে ঘাড় ঘুরিয়ে নিলো মোহর। মেহরাজের পক্ষ হতে তবুও কোনো প্রত্যুত্তর, নাইবা অভিব্যক্তি এলো , খোলা আসমানের তারকারাজি আর চন্দ্রিমায় চোখ রেখে বেশ কয়েক মুহুর্ত অতিবাহিত হলে একবার আড়চোখে তাকালো বাঁ পাশটায়। মেহরাজের জাগায় শূন্যস্থান দেখে ললাটে সরু ভাঁজ গভীর হলো, অভিমানের গূঢ়তা পেটময় ঝিরঝির ধরিয়ে দিলো। মানুষ টা ওকে ডেকে এনে এভাবে রেখে চলে গেলো! চোখ দু’টো আত্মহীন হয়ে ভিজে উঠতে চাইলো। কিন্তু হুট করেই প্রচন্ড জেদ চেপে ধরলো মোহরকে, গূঢ় হয়ে বসেই রইলো এই স্থির করে, যে আজ আর ও ঘরেই যাবে নাহ,লোকটার সাথে এক বিছানার শোয়া তো দূর। প্রচন্ড খারাপ, বিশ্রি রকম নিষ্ঠুর লোকটা।

মান অভিমানের ক্রমবর্ধমান পাল্লা টা তরতর করে বেড়েই চললো সময়ের কাঠি পরোয়া না করেই। মেহরাজের অনুপস্থিতিতে দুই মিনিট যেনো মাস সমান ঠেকছে মোহরের কাছে। ক্ষোভ, রোষাবেশে চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইলো দূর আকাশের পানে চেয়েই,,, মিনিট দুয়েক নিঃশব্দে অতিবাহিত হলে বাতাসের ধাক্কায় চিরচেনা সুবাস টা আবারও নাকে এসে ঠেকলো, নৈশব্দে কারোর উপস্থিতি টের পেয়েও মুখ ফিরিয়ে তাকালো না মোহর। কেনো যানেনা আজ ভীষণ অভিমান হচ্ছে, মানুষ টার ওপর রাগ,জেদ করার মতো অদৃশ্য অধিকার, বন্ধনবোধে লিপ্ত হচ্ছে ভেতরটা। মেহরাজ পেছনে বসলেও মোহরের অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখায় গলা ঝেরে দৃষ্টিকার্ষনের প্রচেষ্টা করলো। মোহর তবুও ঠাঁই বসে রইলো অন্যদিকে ফিরে। মেহরাজ কৌতুহলী চোখে প্রশ্নসূচক কণ্ঠে বলল

– মোহ?

– ডাকবেন না আমায়, চলে যান এখান থেকে। আমাকে একা ফেলে যেখানে গেছিলেন ওখানেই যান। কাওকে দেখতে চাচ্ছি না আমি।

একদমে ঝাঝালো স্বরে কথা গুলো বলে আবারও চুপ করে রইলো মোহর। মেহরাজ নিঃশব্দে হাসলো, পুরু অধর কোণে বাঁক ধরানো হাসিটা একবারও চোখ মেলে দেখলো না মোহর, বুঝতেই পারলো না তার অভিমানিনী মুখটা দেখে কারো তৃষ্ণার্ত চোখ জোড়া কি করে তেষ্টা মেটাচ্ছে, কারো ভুবন ভোলানো হাসিটা কি করে শুধু তার নামেই লিপিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, শুধু মোহ আর মোহমায়ার নামেই।

– মোহ? আমার মোহমায়া!

কণ্ঠস্বরটা একদম নিজের কানের পিনার নিকট হতে ভেদ করলো শ্রবণেন্দ্রিয়। গাঢ় প্রশ্বাসের উচ্ছ্বাস, আর নিঃশ্বাসের মিষ্টি সুবাস টা খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারলো মোহর, প্রিয়তম কণ্ঠের মাদকতায় থরথর করে কেঁপে উঠলো ভিত্তিহীন অভিমানের ভিত। এতক্ষণ অভিমান করলেও এখন প্রবল উৎকণ্ঠায় চোখ ফেরানোর সাহস পাচ্ছে না! ওই চোখ দু’টো যে বড্ড মারাত্মক, তাকানো যায়না। ভ্রম ধরিয়ে দেবে! তবুও বেহায়া মনটা কেমন ঝড় তুললো অন্তপুরিতে, ঘন ঘন নিঃশ্বাসের সাথে আস্তে আস্তে ঘাড়টা ঘুরিয়ে বাঁয়ে তাকালো, মুখের একদম কাছাকাছি মুখটা, আরেকটু সরে আসলো হয়তো গালে গাল,নাকে নাক ছুঁয়ে যাবে। এতটা কাছ হতে পুরুষালী চেহারাটার দর্শনে কেমন অস্থির জেঁকে ধরলো।

– রাগ করেছে আমার বিবিজান?

মোহর ঘনঘন পলক ফেলে অন্যদিকে তাকানো চেষ্টা করলো, মেহরাজ আর এক মুহূর্ত দেরী না করে বলিষ্ঠ হাতের পাঞ্জা টা মোহরের কোমরে আঁকড়ে ধরে একটানে ঘুচিয়ে দিলো মধ্যবর্তী অতি তুচ্ছ দূরত্ব টুকুও। আরেক হাতে মোহরের মাথাটা চেপে ধরলো বুকের মাঝখানে, দুহাতের পেশিবহুল তাগড়া বন্ধনে পরিপূর্ণ রূপে বন্দিনী করে ফেললো মোহরকে।
যতটা সম্ভব তার চেয়েও হয়তো বেশি গভীরত্বে মিশিয়ে নিলো বুকের মাঝখানে। প্রচন্ড সামর্থবান বন্ধনে বন্দি হয়ে মোহরের যেনো দমটাই বন্ধ হয়ে আসলো, শরীর টা মিশে চুরমার হতে থাকলো। কিন্তু তবুও একচুল বিরক্ত হলো না,নাইবা কষ্টভূত করলো। আজ নিজেও স্বেচ্ছায় দুহাতের নখ বিঁধিয়ে খামচে ধরলো মেহরাজের পিঠ। প্রশস্থ বুকটার মাঝে নাক ডুবিয়ে বারংবার ঘষে দিলো আদুরে স্পর্শে।রন্ধ্রে রন্ধ্রে নেশাক্ত শীতলতা ঢুকে গেলো দুটো শরীরে। ফোঁসফোঁস নিঃশ্বাসের শব্দের সাথে ভেতরের অস্থিরতা ঝড় তুললো স্তব্ধ পরিবেশে। মেহরাজ মোহরের কোমর চেপে উঁচিয়ে আরও টেনে নিলো, ঘাড়ের ভেতর মুখ ডুবিয়ে নিশ্চুপ, স্থির বসে রইলো। প্রচণ্ড ঝটকায় কেঁপে উঠলো মেয়েলী শরীর টা, অস্থির করা স্পর্শ টা অসহ্য করে তুলছে ওকে, পুরো শরীর টা যেনো মিইয়ে দিচ্ছে, বুকের উপর হাতের দূর্বল তালুটা বসিয়ে সরিয়ে দিতে গেলে বরং আরও দৃঢ়তর স্পর্শে কাহিল হয়ে পড়লো।
মিনিট পাঁচেক ওভাবেই পড়ে রইলো নিস্তেজ হয়ে, মেহরাজের হাতের বন্ধন টা আস্তে আস্তে ঢিলে হয়ে আসলো, মোহরকে বুক থেকে তুলে সোজা করে ওর একটা হাত মুঠোয় পুড়ে বুকের উপর চেপে ধরলো, অস্থির গলায় ফিসফিসিয়ে মেহরাজ বলল

– এইখানটাতে কি চলে তার নূন্যতম আঁচ ও কি করতে পারেন মোহ? আমার তীব্র বাসনা টুকু বললে শুনতে পারবেন তো? একটু স্পর্শেই তো সরিয়ে দিতে চান,পুরো আমিটাকে কি করে সহ্য করবেন! তাই সময় দিচ্ছি, নিজেকে সামলে তৈরী করুন। আমি যখন চাইবো পুরোটাই চাইবো, এক চুল ও কিন্তু ছাড় দেবো না বিবিজান।

মোহর নিশ্চুপতায় মলিন রইলো। হাতের তালুর নিচের জায়গাটার প্রবল ধুকপুকানির স্পষ্ট টের পাচ্ছে। মেহরাজ মুচকি হেসে হাতটা সরিয়ে নিলো। পেছন ঘুরে ডিভানে হেলান দিয়ে রাখা বস্তুটা হাতে তুলে মোহরের সামনে ধরে বলল

– গিটার বাজানো শিখতে চেয়েছিলেন না? ওটাই আনতে গেছিলাম। তাতে যে বিবিজান এতো ক্ষেপে যাবে আমিতো বুঝি নাই, তা না হলে আপনাকে সাথেই নিয়ে যেতাম। বউ ছাড়া আমার আবার চলে নাহ

না চাইতেও ফিক করে হেসে দিলো মোহর। মেহরাজ ভ্রু উঁচিয়ে নরম গলায় বলল

– ইউর হাইনেস,,মে আই?

মোহর কোনো ভয়ভীতি বা জড়তা ছাড়াই সরে এসে বসলো মেহরাজের গা ঘেঁষে। গিটার টা দেখেই মনে অফুরন্ত আনন্দ আর শেখার আগ্রহে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে। মেহরাজ পেছন থেকে মোহরের কোলের উপর গিটার রেখে দুপাশে বাহুডোরে আঁকড়ে ধরলো। আঙুলের স্পর্শে ঘাড়ের উপরের চুলগুলো সরিয়ে থুতনি ঠেকালো নির্দ্বিধায়। মোহরের বাম হাত টা নিয়ে গিটারের হেডে আর ডান হাতটা মুঠোয় পুরে গিটারের তারে ছোঁয়ালো।
সুরের তরঙ্গের সাথে তাল মিলিয়ে ঝনঝন করে উঠলো মোহরের নিজ শরীর টাও। ছোট ছোট মৃদু শব্দ তুলতে তুলতে আস্তে আস্তে সুর টাও তুলে ফেললো মেহরাজের স্পর্শের সাহায্যে। মেহরাজের ঘন ঘন উষ্ণ নিঃশ্বাস সারা ঘাড়, পিঠময় ছড়িয়ে পড়ছে মোহরের। মোহরের পুরো পরিবেশটাই যেনো মেহরাজের শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণে সুবাসিত। মোহর কেঁপে উঠছে বারবার, বুকভরা তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে, শরীরের ভার ছেড়ে মিইয়ে পড়ছে মেহরাজের বুকে, মেহরাজ মোহরের কানের কাছে মুখ এনে বলল

– মোহ ঠিক আছেন? কাঁপছেন যে?

– উঁহু

রয়েসয়ে স্মিত স্বরে জবাব দিলো। নিজেকে ধাতস্থ করে সোজা হয়ে বসলো। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশ, হীম অনিল কাঁটা দিচ্ছে গায়ে। মোহরের কেঁপে ওঠা মেহরাজ লক্ষ্য করে বলল

– বাইরে ঠান্ডা, চলুন ঘরে যাই। অনেক রাত হয়েছে।

মোহর দ্বিরুক্তি করলো নাহ। কথার পৃষ্ঠে কথা ঠেলবার জো নেই। তাই চুপচাপ ঘরে এসে শুয়ে পড়লো।

_______________________

ডাইনিং রুমের ব্যস্ত পরিবেশটা জুড়ে নিগূঢ় থমথমে অবস্থা, হার এক মানুষের মুখের ভাবায়ব বেশ গুরুতর। আম্বি বেগম তার স্বামী আর দেবরের সাথে বসে। মাত্রই নাস্তা সেরেছে সবাই, এখন শুধু মেহরাজের উপস্তিতির অপেক্ষা, এতকিছুর মধ্যেও একটা চেহারা একেবারেই সহজ সাধারণ রূপী যাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলার কথা ছিলো, বরং সেই খুব স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে পায়ের উপর পা তুলে টিভি দেখছে।
আম্বি নিঃশব্দে একবার তাথইয়ের নিরেট ভাবাপন্ন চেহারাতে তাকাচ্ছে তো একবার ওর দিকেই রূঢ় দৃষ্টি তাক করে রাখা কাকলির দিকে। কাল থেকে মুখটা চরম ভাবে ভার করে রেখেছে, অরুণের এতো দোষ থাকা সত্ত্বেও এই বিচ্ছেদের ব্যপারটা মেনে নিতে পারছেন নাহ।

– এতটা স্বাভাবিক কি করে আছিস তুই? তোকে দেখে মনে হচ্ছে আগে থেকেই ঠিক ছিলো তোর আর অরুণের সেপারেশন?

নীরবতা ভেদ করা শব্দবাণেও তাথইয়ের কোনো রূপ পরিবর্তন লক্ষ করা গেলো না। শান্ত দৃষ্টিতেই তাকালো মায়ের দিকে, টিভির রিমোট চেপে দেদারসে একের পর এক চ্যানেল পালটাতে লাগলো কথাগুলোকে হরদমে অগ্রাহ্য করে।

– আমি তোর সাথে কথা বলছি? তোর এই একগুঁয়ে ঘাড়ত্যাড়া স্বভাব টা আমার চরম অপছন্দ তাথই। সবসময় নিজেকে আর নিজের মনমর্জিকেই প্রায়োরিটি দিস। তোর বাবা মা কে, তারা তোর কাছে ম্যাটার ই করে নাহ। এতো কিছু যখন হয়ে গেলো অথচ তোর ভেতর কোনো দুঃখ বা হতাশা কিছুর ছাপ নেই। তোর ব্যবহারে আমি এ ভাবতে বাধ্য হচ্ছি যে এক হাতে তালি বাজে নাহ, অরুণের দোষ ছিলো কিন্তু তুই ও ধোঁয়া তুলসী পাতা নোস।

ভীষণ শান্তভাবে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো তাথই।কাকলি বেগমের এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো তাথইয়ের এই শান্ত অথচ তীক্ষ্ণ চাহনি আর স্বভাব টা মেহরাজ থেকে পেয়েছে। কই বাড়িতে আর কারো তো এমন আচরণ নেই ও বাদে, আর আগেও তো এমন ছিলো না তাথই। কাকলির একভাবে চেয়ে থাকা নজরকে ধাক্কে দিলো তাথইয়ের শাণিত গলা

– প্রথমত তোমার বা তোমাদের কথার উত্তরে কি বলা উচিত আমার জানা নেই, আমি একগুঁয়ে ঘাড়ত্যাড়া আর নিজের মর্জিকেই প্রায়োরিটি দেওয়ার স্বভাব টা যদি সত্যিই থাকতো, তাহলে আজ পরিস্থিতি এখানে এভাবে আসতো নাহ। বরং আড়াই বছর আগেই নিজের ঘাড়ত্যাড়া স্বভাব টা খাটিয়ে বিয়েতে নাকচ করে দিতাম,নাইবা তোমাদের হাতের কাঠপুতুল হয়ে নিজের ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও বিয়েতে বসে পড়তাম। আর এতো কিছুর পরেও আমি দুঃখ পাবো, আমিই পাবো? কেনো বলোতো? আমার দুঃখের মেয়াদ ও উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। একটা মানুষ ঠিক যতটা দুঃখ পেতে পারে আমার পাওয়া শেষ, আর পেতে চাইনা নাইবা পাবো। এতো কিছু দেখা শোনার পরেও আমাকে দোষারোপ করছো? কোন মুখে? নিজেদের ব্যবসায়ীক সখ্যতা আরও ভালো করার জন্য দুটো পরিবার হুট করেই বিয়ে দিয়ে দিলে যেখানে সেই মানুষটার সাথে আমার চেনা জানা কিছুই ছিলো নাহ। সেও পারিবারিক চাপে বিয়েটা করেও নিলো কিন্তু আদও কি আমার স্বামী হলো? দিনের পর দিন হেয়ালী অবহেলা শুরু নামমাত্র সম্পর্ক বয়ে বেড়াচ্ছিলাম, প্রথম প্রথম তোমাকেও তো বলেছি আমি । তুমি কি বললে ‘ছেলে মানুষ দুদিন গেলে এমনিতেও ঠিক হয়ে যাবে, বউয়ের আঁচলের তলেই আসবে’ তোমার এই এক কথা শুনে শুনে আমি ক্লান্ত তাই হয়ে আর কিছু বলতেও আসিনি। কাকেই বা বলতাম, নিজের স্বামীকে রাত জেগে অন্য মেয়ের সাথে গল্প করতে শুনতাম,বিজনেস পার্পজে এ শহর ও শহর যাওয়ার নাম করে সপ্তাহ সপ্তাহ থেকে আসতো অথচ ফেরার পরে আমি ওর পকেটে রিসোর্ট, হলিডেই ট্রিপের রিসিপ্ট পেতাম এর পরেও আর কি দেখার বাদ ছিলো আমার! আমি কি দেওয়ালের সাথে সংসার করতাম! হ্যাঁ আমিও ধোঁয়া তুলসী পাতা নই দোষ আমারও ছিলো, আমি খুব বড়ো দোষ করেছি ওসব গায়ে না মেখে মুখ বুজে সহ্য করে নিয়ে, সোসাইটিতে বাড়ির স্টেজ টাকে আলোচনায় তুলতে না চেয়ে সহ্য না করে নিজের টা ভেবে আগেই ডিভোর্স কার্যকর করা উচিত ছিলো তাহলে আজ এতো কিছু হতো নাহ। বরং আফসোস, নিজের টা না ভেবে বাবা মা বাড়ির সম্মান রক্ষার্থে এতো কিছু সহ্য করে নিলাম আর শেষে আমাকেই শুনতে হচ্ছে এক হাতে তালি বাজে না, বলি লজ্জা করে না তোমার নিজেকে মা বলে পরিচয় দিতে?

দীর্ঘ সময় ধরে বলা কথাগুলো উপস্থিত প্রতিটি মানুষ নিঃশব্দে হজম করে নিলো, আজহার মুর্তজার বারবার আফসোস হচ্ছে কেনো তারা এরূপ একটা ভুল করে ফেললো। তাথইয়ের কাটকাট কথা গুলোর একটাও ভুল নাহ।
ক্ষিপ্ত চেহারাটা মায়ের থেকে সরিয়ে নিলো তাথই, উঠে চলে আসতে নিলেও সিড়ির দিকে চেয়ে থেমে গেলো। মেহরাজ চোখের ইশারায় তাথইকে বসতে বলে নিচে নেমে এলো, ওর পেছন পেছন মোহর। সকলের উৎসুক চাহনি তাথইয়ের বাধ্যতা কে কেন্দ্র করে মেহরাজের দিকে গেলো। কাকলির নাক সিটকে এলো মেহরাজের পেছনে হেঁটে আসা মোহরকে দেখে। মেয়েটা দিনকে দিন সুন্দর হচ্ছে। মেডিক্যাল ইয়ার কমপ্লিট করে কিছুদিনের মধ্যেই ইন্টার্নশিপ শুরু করবে এমন মেয়ের বয়স নিশ্চয় একেবারে কম নয়, অথচ মোহরের চেহারাটা যেনো দিন দিন কিশোরীদের মতো কোমলমতী হচ্ছে। উচ্চতায় বেশ লম্বা, চিকন গড়নের মেয়েলী উজ্জ্বল চেহারাটার দিকে তাকালে আরেকবার চোখ একাই চলে যায়। ছোট ঘরের লো ক্লাস একটা মেয়ে আলিসান বাড়িতে রাজরানী হয়ে আছে অথচ নিজের মেয়েটারই সংসার ভেঙেছে ভাবতেই গা পিত্তি জ্বলে উঠলো কাকলি বেগমের। হিংসাত্মক চোখ দুটি যেনো মোহরকে চোখ দিয়েই ভস্ম করে দিচ্ছে।

– কাল আমি বলেই দিয়েছি এ ব্যাপারে আর কারো কোনো মতামত চাইনা। এখন তাই হবে যা আশু চাইবে।

মেহরাজ এসে বসলো চেয়ারে, মোহর গুটি গুটি পায়ে মেহরাজের পেছন ঘেঁষে দাঁড়ালো। সাঞ্জের কোল থেকে তাথইয়ের বাচ্চাটা হুট করেই কান্না করে উঠলে তাথই ওকে কোলে করে দাঁড়ালো, পা বাড়িয়ে এগোতে নিলেও এই মুহূর্তে আগত চেহারাটা দেখে না চাইতেও দাঁড়িয়ে পড়লো। রুক্ষ গলায় বলল

– আপনি এখানে কেনো এসেছেন?

তাথইয়ের ক্ষোভাত্মক গলাটা সবার ই কান অব্দি পৌঁছালো। আগন্তুকের জবাবের আগেই মেহরাজ বলল

– পৃথককে আমি ডেকেছি আশু।

– তুই ওকে কেনো ডেকেছিস ভাইয়া?

মেহরাজ বোনের অসন্তুষ্ট চেহারাটাতে মোলায়েম নজর বুলিয়ে বলল

– কাম ডাউন আশু, এদিকে আই। আমার পাশে বোস

মন ভরা তিক্ততা নিয়েই এগিয়ে এসে বসলো তাথই। পৃথককে চোখের ইশারায় সহজ হতে বলল মেহরাজ। দু কদম ফেলে ওউ এগিয়ে এলো। মেহরাজ আজহার মুর্তজার দিকে তাকিয়ে বলল

– আমি চাই তাথই আর অরুণের সেপারেশনের কেসটা পৃথক নিজে হ্যান্ডেল করুক। আপাতত অন্য কোনো অ্যাডভোকেটের নাম ও নিতে চাইনা আমি।

আজহার বা আরহাম মুর্তজা কোনো কথা বলার আগেই তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলো কাকলি বেগম। বিরোধীর ন্যায় বলল

– সেদিন রাতে অরুণের গায়ে হা’ত তোলা ব্যক্তিটা পৃথক নিজেই ছিলো মেহরাজ সেখানে তুমি ওর হাতেই এই কেস দিতে চাচ্ছো? আর পৃথক! আমি জানি আমাদের পরিবারের সাথে তোমার সম্পর্ক অনেক পুরোনো, তাথই আর সাঞ্জে কে তুমি ছোট থেকেই স্নেহ করো, কিন্তু তা বলে তুমি অরুণের গায়ে হা’ত তুলবে? ও অন্যায় করে থাকলেও তুমি আমাদের বলতে পারতে। এখন যদি ওই হা’তাহাতি কে ইস্যু করে ওরা স্টেপ নেয়?

এতক্ষণে মুখ খুললো পৃথক। এ বাড়িতে আসার একেবারেই ইচ্ছে ছিলো না ওর, তাথইয়ের কথা গুলো এখনো স্ফূলিঙ্গের মতো বিঁধে আছে ভেতরে, তবুও আসার একটা মাত্র কারণ হলো মেহরাজ, যার কথা ও কখনও ফেলতে পারবে নাহ। পৃথক দু হাত মুঠোবন্দি করে চেপে বলল

– ও যেটা করছিলো তার বিরুদ্ধে যদি আমি একটা স্টেপ নেই তাহলে কি হবে আপনার জানা আছে? ও নিজের স্ত্রী কেই…

– চুপ করো, যা হয়ে গেছে তা নিয়ে একটা কথাও আমি আর শুনতে চাইনা। তোমাদের এতো আলোচনা আমার একদম ভাল্লাগছে নাহ। এসব থামাও

পৃথকের কথাটা সম্পূর্ণ করতে দিলো না তাথই। তার আগেই চেঁচিয়ে উঠলো। সেদিন রাতের জঘন্য ব্যাপারটাকে যে পরিবারের সামনে তুলতে চাইনা সেটা পৃথক বুঝতে পারলো। তাই দ্বিতীয় টা বাক্য করলো নাহ।
মোহর নির্বাক শ্রোতার ন্যায় অবলোকন করছে সবটা, ওর সূক্ষ্ম দৃষ্টি এখন স্থির পৃথকের দিকে। পৃথক ইয়াসির, লন্ডন থেক ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরা ব্যারিস্টার। দেখেই বোঝা যায় বয়সে তাগড়া যুবক। শ্যামবর্ণের চেহারাটিতে অদ্ভুত জৌলুশ। খুব আহামরি কিছু না, অতি সাধারণ চোখ, লম্বা পাতলা নাক মুখ। অতি সাধারণ চেহারাতেও কেমন অমায়িকত্বের ছাপ আছে।
মোহরের ভাবনা ভঙ্গুর হলো মেহরাজের কণ্ঠে, গম্ভীর গলাটিতে বলল

– যত দ্রুত সম্ভব এই চ্যাপ্টার ক্লোজ করতে চাই আমি,ওই স্ক্রাউ’ন্ডেলের ছায়াটাও আমি আর দেখতে চাইনা আমার বোনের জীবনে
.
.
.
চলমান

#হীডিংঃ কালকের অনুপস্থিতিটা আজও অনাকাঙ্ক্ষিত সময়েই ঘুচিয়ে দিলাম। এখন শুধু আপনাদের ভালোবাসা পূর্ণ মন্তব্য গুলোর অপেক্ষায়। শিগগির পড়ে ফেলুন, পড়ে ফেলুন আর মতামত লিখে ফেলুন। সকলের ভালোবাসার মাপকাঠিটা পাল্লায় যথাযথ ভরলে আজ আরেকটা বোনাস দিতে পারি।

©Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here