ফানাহ্ 🖤 #পর্বসংখ্যা_৩৯ #হুমাইরা_হাসান

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৩৯
#হুমাইরা_হাসান

বাংলার ঋতুচক্র থেকে প্রায় বিলুপ্তপ্রায় ঋতুটির মাঝামাঝি সময়। শরতের শেষ লগ্ন পেরিয়ে আকাশভর্তি সাদা মেঘের বিচরণ কমে আসে হেমন্তে। কয়েক পশলা বৃষ্টির পর শরতকে সাদরে বিদায় দিয়ে আগমন হয় হেমন্তের,হালকা শীতের আমেজে পরিবেশে ঘনঘাটা হেম এর আগমনী সুবাস। তিন শব্দের সম্মিলিত গঠনের ক্ষুদ্র শব্দটি বোধহয় বড্ড নিষ্ঠুর! মানুষের গ্লাণি, দুঃখ, আফসোস, আক্ষেপে জড়িয়ে থাকা চাতক পাখির ন্যায় দৃষ্টি উপেক্ষা করে ছুটে চলে নিজ গতিতে। সময় তার নিষ্ঠুরতার পাল্লা বহমান রেখে ছুটিয়ে নিয়েছে দিন তিনেক।
এর মাঝে শ্রীতমাকে বাড়িতে আনা হয়েছে প্রথম দিনেই। এই দুদিন শরীরের কিছু জাগায় ব্যথার উপস্থিতি থাকলেও আজ বেশ হালকা লাগছে শরীর টা, তবে শরীর টা যতই হালকা সুস্থ লাগুক,রোগ তো ধরেছে মনে। মিথ্যে,ছলচাতুরী, অভিনয়, প্রতারণায় হেরে যাওয়া মানব মনটা আঘাতে জর্জরিত। মন হতে বিষাদের বিষক্রিয়া পুরো বদনে ছড়িয়ে পুরো দুনিয়াটায় বিষাদময় করে তুলেছে।
হোস্টেলের তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিস্তেজ চোখ দুটি সুদূর বাগানের গাছগুলোর নড়াচড়া দেখছে, নিষ্পলক চেহারাটা ভীষণ ক্লান্তিকর।
ফর্সা চামড়া টার বর্ণটা যেনো ফিকে পরে গেছে, ভাসা ভাসা চোখ দু’টোর নিচে কালচে প্রলেপে ঢেলে গেছে চাঞ্চল্য। শুকনো ওষ্ঠভাঁজের কোণে জমে আছে হাজারো না বলা হাহাকারের বুলি। আজ ছোট বেলায় গল্পটা খুব করে মনে পড়ছে, আশ্রমে থাকতে শুনেছিলো কোনো এক হেমন্তের মাঝামাঝি সময়েই কোনো এক অল্পবয়েসী মহিলা ছেড়ে গেছিলো মা ঠাকুরনের হাতে, মাঝবয়েসী মহিলা ছিলেন আশ্রমের গুরুভারের দ্বায়িত্বে, শ্রীতমার নামকরণ টাও তিনিই করেছিলেন। ওর মতো আরও কয়েকজন ছিলো পিতৃ-মাতৃহীন আশ্রিতা। তবে চেহারায় অনেক বেশি জৌলুশ আর সৌন্দর্যের অধিকারী হওয়াই পনেরো পার হতেই অসংখ্য প্রস্তাব আসতে থাকে ওর জন্য কিন্তু আঠারো পূরণের আগে মা ঠাকুরন কারো বিয়ের ব্যাপারে একমত ছিলেন নাহ। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে উনার শরীর টাও ক্রমেই খারাপ হয়ে আসতে থাকে,অতঃপর কোনো একদিন শ্রীতমা ডেকে সব বুঝিয়ে কোনো এক পরিচিতের সাথে পাঠিয়ে দিলেন শহরে হোস্টেলে থেকেই মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পার করেছিলো। উচ্চ মাধ্যমিকের কিছুদিন আগেই খবর আসে মা ঠাকুরন আর বেঁচে নেই, সব ছেড়ে শ্রী ছুটেও গেছিলো মাতৃতুল্যা মহিয়সীর মুখ খানা শেষ বার দর্শনের জন্য, তারপর আর ও মুখো হয়নি কখনো। মেডিক্যাল, ক্লাস, টিউশন, আর আপনজন বলতে মোহর এই নিয়েই যাচ্ছিলো জীবন।
তারপর হুট করেই একদিন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখা হলো এক অপরিচিতের সাথে একদিন দুদিন, তিনদিন এভাবে কাকতালীয় ভাবে দেখা হওয়া টা হুট করেই নিয়মমাফিক হয়ে উঠলো। শ্রীতমার এখনো মনে পরে। উঁচা লম্বা,উজ্জ্বল মায়াবী চেহারার মানুষটার সাথে দেখা হয়েছিলো নিউ মার্কেটে, তারপর থেকেই হুটহাট দেখা হয়ে যেতো। আস্তে আস্তে দেখা থেকে, মায়া টান বাড়তে লাগলো আর খুন সযত্নে ভালোও বেসে ফেললো শ্রীতমা। অথচ সেই মানুষ টাই…
চোখ ছাপিয়ে বিরতিহীনা ফোঁটা গুলোকে মুছে হাত সরাবার আগেই পুনরায় ভিজে যাচ্ছে কপোল। কি করে ঠেকাবে সে চোখের বারিধারা! বাবা মা কেও নেই, যে পালন করেছিলো সেও বহু আগেই পরলোকে গিয়েছে, অতঃপর যাকে মনটা দিলো!

– শ্রী?

অতি পরিচিত গলাটা কানে আসতে হকচকিয়ে তাকালো শ্রীতমা। পরিচিত মুখটার দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হাসলো। মলিন হাসির আড়ালেও চিকচিক করা চোখ দু’টো নজর এড়ালো না মোহরের, ও হাতের ব্যাগটা সিঙ্গেল বেডটার উপরে রেখে এগিয়ে এলো শ্রীতমার কাছে

– কি করছিলি এখানে?

– কিছুই নাহ এমনিতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুই এখন,হোস্টেলে এসেছিস যে?

– কেনো আমি কি আসতে পারিনা?

শ্রীতমা স্বাভাবিক হওয়ার প্রয়াসে খানিকটা হেসে বলল

– তা হবে কেনো। বিয়ের পর তো আর ম্যাডামের পা ই পরেনি এখানে।

মোহর স্মিথ হেসে শ্রীতমার হাতটা ধরে বিছানার কাছে এনে বসতে বসতে বলল

– নতুন করে আর কি বলবো। যাই হোক, শরীর কেমন এখন? এভাবে কেও পাগলামি করে? ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি তো!

মোহরের উৎকণ্ঠিত গলায় শ্রী নিস্তেজ চোখে তাকালো, মৃদু ঠোঁট নাড়িয়ে বলল

– কিসের ভয়, ঠিক আছি তো। শরীর, আমি দুটোই ভালো।

– আদও কি ভালো?

কৌতুহলী চোখ,জিজ্ঞাংসুক চাহনি। ব্যাকুল হওয়া মুখটার পানে না তাকিয়ে শ্রী মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল

– যতটুকু যাক থাকার দরকার তার চেয়ে বেশিই আছি। এর চেয়ে ভালো থাকা সম্ভব নাহ

শ্রীতমার স্পষ্ট কথার আড়ালে অস্পষ্ট ব্যাথা, আঘাতের ছাপ মোহরের বোধগম্যের বাইরে ছিলো না, প্রাণপ্রিয় মানুষটার এরূপ মলিন দশা একেবারে সহ্য হচ্ছে না ওর। হাতটা তুলে শ্রীতমার মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল

– খবরদার যদি আর এসব কথা বলেছিস। কি পেয়েছিস টা কি, কে না কে দুদিনের মেহমান হয়ে আসলো তার জন্য বসে বসে দুঃখবিলাস করবি? আর আমি কেও না! তার কথা ভেবে নিজেকে কষ্ট দিবি ক্ষতি করবি আমার কথাটা একবার ও ভাববি না? এখন ওই সব হল তোর?

– তুই ছাড়া যে আমার আপনজন কেও নেই সেটা তুই নিজেও ভালো মতোই জানিস মেহু।

– তাহলে এমন কেনো করছিস? আমি আছি তো! আমাকে কি বলেছিলি মনে নেই? বিধাতা যখন তোকে এইখানটাই এনে দাঁড় করিয়েছে তার নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। সত্যের সাথে কখনো মিথ্যে জিততে পারে না, জীবনে প্রতিটি ঘটনায় আমাদের কিছু না কিছু শিক্ষা দেয়। তাই খারাপ টা ধরে বসে না থেকে বরং এ থেকে শিক্ষা টা নিয়ে এগিয়ে যা। সামনে ভালো কিছু আছে, খারাপ টাকে ছুড়ে ফেলে দে নিজের জন্যে বাঁচ,নিজের মতো করে বাঁচ

শ্রীতমা নিরুত্তর রইলো। বুকভর্তি আহাজারি ওর, ভুলতে যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এখনো সবটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের ন্যায় লাগছে। দু চোখ ছলছল করে উঠলো। মোহর দুহাতে জড়িয়ে ধরলো শ্রীতমাকে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

– কক্ষনো কাঁদবি না শ্রী, তুই হলি আমার উজ্জ্বল নক্ষত্র তোকে নিভিয়ে যাওয়া মানায় নাহ। আমি সবসময় আছি তোর সাথে, যতো খারাপ কিছু আসুক আমি সবসময় আছি, থাকবো শুধু তুই হাসিমুখে থাক

চোখ বুজে আসতেই দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো চোখ থেকে। মোহরকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘক্ষণ মুখ বুজে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ পর মোহর শ্রীতমাকে সোজা করে ওর চোখ মুছিয়ে দিয়ে মোহর বলল

– এখন ওঠ তো। চটপট রেডি হয়ে নে, বুবু গ্রাম থেকে ফিরেছে বেশ কয়েকদিন হলো। আমাকে ফোন করেছিলো,তোকে নিয়ে যেতে বলেছে

– এখন?

– হ্যাঁ অবশ্যই এখন। শিগগির ওঠ

বলে শ্রীতমাকে ঠেলে জামা পালটে সাথে করে নিয়ে বেরোলো। সিড়ি বেয়ে নেমে, মেইন গেইটের সামনে আসতেই বাঁয়ে চোখ যেতেই পা থেমে গেলো মোহরের ভ্রু কুচকে তাকালো মানুষটার দিকে।

অভিমন্যু চোরা চাহনি দিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে অন্যদিকে ঘুরে মিছিমিছি ফোনে কথা বলার নাটক করে অন্যদিকে চলে যেতে নিলেও নিজেকে আড়াল করতে পারলো না, অতঃপর পেছন হতে আসা ডাকে না চাইতেও দাঁড়াতে হলো প্রচন্ড আড়ষ্টতা নিয়েই

– অভিমন্যু? তুমি এখানে যে?

মোহর এদিক্ব এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো। অভি মোহরকে দেখে চমকে যাওয়ার ভঙ্গিমায় বলল

– ম ম্যাডাম, আপনি এখানে যে!

– হ্যাঁ, এটা তো শ্রীতমার হোস্টেল। ওকে নিতেই এসেছিলাম। কিন্তু তুমি এখানে যে

বলে পাশে তাকাতেই চোখ গেলো গাড়িতে রাখা ফ্লাওয়ার বুকের দিকে। অভিমন্যুর দিকে তাকালে ও আমতা-আমতা করে বলল

– আসলে এদিকে একটু কাজ আছে ম্যাডাম তাই এসেছি । আপনারা কোথায় যাচ্ছেন

মোহর বিব্রত ভাবে তাকিয়ে বলল

– আমার বড়ো বোনের বাড়িতে যাচ্ছিলাম আমরা দুজনে।

– ওহ, তাহলে চলুন আমি ড্রপ করে দেই আপনাদের

– কিন্তু তুমি যে বললে কাজ আছে তোমার।

অভিমন্যুর মেকি হাসি হাসি মুখটা নিমিষেই চুপসে গেলো। এই হলো এক দোষ, কোনো কথা বানিয়ে বলতে গেলেই হাবি জাবি মিশিয়ে জগা খিচুড়ি করে ফেলে। তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে যায়। ও কিছুক্ষণ স্থুলদৃষ্টিতে চেয়ে বলল

– কাজ শেষ হয়ে গেছে ম্যাডাম, কোনো সমস্যা নেই। আপনারা প্লিজ বসুন আমি অফিস যাওয়ার পথে ড্রপ করে দেবো

– কিন্তু তুমি কি করে জানলে আমার বুবুর বাড়ি তোমার অফিস যাওয়া পথেই পরবে?

অভিমন্যু হতবুদ্ধির মতো চেয়ে রইলো মোহরের সূক্ষ্ম নজরে। ঘনঘন পলক ফেলে মনে মনে ভাবলো ‘ বুনো ওলের সাথে তো বাঁঘা তেঁতুল ই থাকতে পারবে ‘ যার মর্মার্থ ঠিক যেমন তার বস, তেমন ই বসের মিসেস। জহুরি নজর, কথার মারপ্যাঁচ ধরার সূক্ষ্ম কৌশল টা মেহরাজের চেয়ে কোনো অংশে কম নাহ। অভিমন্যুকে চুপ থাকতে দেখে মোহর স্মিত হেসে বলল

– আচ্ছা চলো। অল্পতেই এতো কনফিউজড হয়ে যাও কেনো তুমি

বলে এগিয়ে আসলে অভিমন্যু গাড়ির পেছনের দরজা টা খুলে দাঁড়ালো, মোহর ঢুকে বসলে পেছন পেছন শ্রীতমাও বসলো।অভি শ্রীয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিজে উঠে বসলো ড্রাইভিং সিটে। ঠিকানা বলে দিলে অভিমন্যু গাড়ি ছুটিয়ে পনেরো মিনিটের মাথায় এনে দাঁড় করালো দুইতলা একটা পুরোনো বিল্ডিং এর সামনে। মোহর দরজা খুলে বের হলে শ্রীতমাও বের হতে নিলো, মোহরকে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অভিমন্যু সাবধানী গলায় মৃদু শব্দে শ্রীতমাকে বলল

– শুনুন?

শ্রী কৌতুহলী চোখে তাকালে অভিমন্যু আমতা-আমতা করে বলল

– আসলে সেদিন গাড়িতে..

পুরোটা বলার আগেই মোহর পেছন ঘুরে শ্রীতমাকে বলল

– চল

তারপর অভিমন্যুকে উদ্দেশ্য করে বলল

– থ্যাংকস। তুমি চলে যাও আমরা একাই ফিরতে পারবো।

– আপনি বললে আমি অপেক্ষা করছি ম্যাডাম

– মোটেও নাহ।তোমার কাজের অনেকটা সময় এমনিতেই ওয়েস্ট হয়ে গেছে। এখন তুমি যাও, আমরা একাই ফিরবো

মোহরের আদেশ সুলভ বাক্যের দ্বিরুক্তি টা আর করলো না অভি। টলটলে চোখ দুটোয় একবার শ্রীতমার দিকে তাকিয়ে তারপর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বেরিয়ে গেলো।

.

– তুই কি রে। আমাকে একবার বলবি না যে আসছিস। এভাবে হুট করে ভূতের মতো এইটাকে সাথে করে চলে এলি

– ওমা। তাহলে এসে ভুল করেছি? ঠিক আছে আর আসবো না

মিথিলা চায়ের ট্রে সেন্টার টেবিলে রাখতে রাখতে বলল

– তুই খুব মা’র খাবি পুতুল। বেশি কথা শিখেছে

– বেশি কোথায় বললাম? তুমিই তো বলছো হুট করে কেনো এসেছি

– তো আমাকে একটা ফোন করে আসবি না। কতদিন পর শ্রী কে নিয়ে আসলি অথচ আমি কিছুই রান্না করতে পারলাম নাহ

মোহর এক হাতে চা তুলে চুমুক দিলো, শ্রীতমা ভ্রু কুচকে বলল

– কিসব বলো বুবু, আমি এসেছি বলে কি এখন বরণডালা সাজাতে হবে নাকি।

ওদের কথার মাঝেই ইফাজ ঘর থেকে বেরিয়ে এলো দুই বছরের ছোট্ট একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে। ওকে দেখেই মোহর এগিয়ে গিয়ে টেনে কোলে নিলো, ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি, ছোট্ট একটা তুলার দলার মতো মোহরের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো বাচ্চাটা। মোহর ওর গালে চুমু দিয়ে বলল

– ঝুমু সোনা দেখো তো কে এসেছে

ঝুমু টিপটিপ করে চোখ খুলে তাকিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে হেসে অন্যদিকে ঘাট ঘুরিয়ে নিলো। ওর এমন দুষ্টু হাসি দেখে চারজনেই হেসে দিলো। মোহর ওকে নিয়ে সোফাতে এসে বসলে ইফাজ বলল

– এতদিন পরে তাহলে চরণ ধুলি টা বাড়িতে পড়লো ডাক্তার সাহেবার

মোহর ঝুমুর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল

– আমার খোঁজ ও তো নিলেন না, বরং বাপের বাড়িতে গিয়ে আরামসে ছুটি কাটিয়ে এলেন

– আর ছুটি কোথায়। ওখানে গেছিলাম মা অসুস্থ তাকে দেখতে, গিয়ে তোমার বোনটাও অসুখ বাঁধিয়ে বসলো আর দুজনের অভাবে আমার মেয়েটাও অসুস্থ হয়ে পড়লো। এখন তিনজনকে নিয়ে পড়েছি আমি মহা ঝামেলায়। অফিসে এতো লম্বা ছুটি কিছুতেই মঞ্জুর করছিলো না, এদিকে মাও অসুস্থ বউ বাচ্চা নিয়ে আসতে দেবে নাহ। তাই সকাল বিকাল জার্নি করে অফিস করতে হয়েছে।

ওদের কথার মাঝেই মিথিলা বলল

– শ্রী মুখটা এমন শুকনো কেনো তোর? অসুস্থ নাকি? আর কপালে কিসের দাগ? কোথায় লেগেছিলো?

শ্রীতমা চুপচাপ বসে কথা শুনছিলো ওদের। মিথিলা শুরু থেকেই শ্রীতমার স্বভাব বিপরীত ঠান্ডা চেহারাটা দেখছিলো। অবশেষে প্রশ্ন করলে মোহর বলল

– রাস্তায় পড়ে গেছিলো। অসুস্থ ছিলো দুইদিন। এই জন্য ভাবলাম ওকে নিয়ে একটু ঘুরে যাই।

বেশ সময় ধরে আরও গল্প হলো। বোন-ঝি কে এতো দিন পর কাছে পেয়ে মন ভরে আদর করলো মোহর। গল্প আড্ডা দিয়ে বের হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলো। ফেরার পথে রিকশাতে বসে দুজন গল্প করছিলো। ট্রাফিকের জন্য দাঁড়িয়ে আছে রিকশাটা। এর মাঝেই বেখেয়ালি ভাবে শ্রীতমার চোখটা একটু দূরেই গাড়ির দিকে যেতেই চেনা চেনা মুখটা দেখে ভ্রু কুচকে নিলো। বিব্রত হয়ে বলল

– মেহু, দেখ না ওটা ফায়াজ স্যার নাহ?

বাড়ি থেকে ফোন এসেছিলো, মোহর ফোনটা রেখে শ্রীতমার কথা শুনে পাশে তাকালো। এক মুহুর্তের জন্য দুটো চেহারা চোখের পর্দায় আঁটকাতেই মুহুর্তেই তা সরব গেলো। জ্যাম ছেড়ে গাড়িটা অন্যদিকে এগিয়ে গেছে কিন্তু ফেলে গেছে মোহরের জন্য একরাশ কৌতুহল আর বিস্ময়ের ছাপ, মোহর ললাটে প্রকাণ্ড ভাঁজ ফেলে বলল

– তিয়াসা! ফায়াজ স্যারের সাথে ওটা তিয়াসা ছিলো না?

– তিয়াসা মানে ওই মেয়েটা না?

মোহর মাথা উচু নিচু করে সাঁই দিলে শ্রীতমা বিহ্বলিত মুখাবয়বে বলল

– কিন্তু ওই মেয়ের সাথে ফায়াজ স্যার? শুনেছি ফায়াজ স্যারের হসপিটালেই মেয়েটা ইন্টার্নশিপ করছে, সেই জন্যেই হয়তো!

কিন্তু কথাটা তেমন যুক্তিযুক্ত মনে হলো না মোহরের নিকট। হোক দুই এক সেকেন্ড কিন্তু সেটুকু দৃশ্যেই এইটা স্পষ্ট ছিলো যে ওদের সম্পর্ক টা শুধু ডক্টর অ্যাসিস্ট্যান্ট এর নাহ। বেশ খোলামেলা আচরণে গল্পগুজব করছিলো দুজন। হুট করেই মোহরের সাঞ্জের বলা কথাটা মনে পড়লো। ও বলেছিলো ফায়াজ স্যারকে ওর চেনা চেনা লাগে।
তবে এই ভাবনাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো নাহ। রায় হচ্ছে, শ্রীতমাকে হোস্টেলের সামনে নামিয়ে মোহর নিজেও বাড়ি ফিরে আসলো তাইবার সে ব্যপার টা নিয়ে বেশি ঘাটলো নাহ।

_________________________

– আপনি আর কতক্ষণ এমন মুখ ফুলিয়ে রাখবেন?

কোনো ভাবাবেগ লক্ষ্য করা গেলো না মোহরের চেহারায়। ঠাঁই গাট হয়ে বসে রইলো বিছানায় পা গুটিয়ে। হাতে রেডিওলোজী নামক মোটাসোটা একটা বই। চোখ দু’টো বইয়ে স্থির থাকলেও মনটা অনেক বেশিই অস্থির। তবুও কোনো ভাব প্রকাশ করলো না।
মেহরাজ এবার উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে, ডিভান থেকে খাটের এক কোণায় এসে বসলো। প্রসারিত চোখে তাকিয়ে রইল মোহরের দিকে, ঘড়িতে বারোটা ছাব্বিশ, মেয়েটা প্রায় এক ঘন্টা ধরে এমন মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। আর একটুও সহ্য হলো না মেহরাজের মোহরের হাত থেকে বইটা ছিনিয়ে নিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিলো। মোহর তবুও নড়লো না, নাইবা তাকালো মেহরাজ এক টান দিয়ে ওর কোমর ধরে নিজের কাছে সরিয়ে আনলো। একহাতে কোমর পেঁচিয়ে ধরে আরেক হাতে মোহরের থুতনিটা ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল

– তাকাচ্ছেন না কেনো আমার দিকে?

মোহর চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। ঘোর অমানিশার ন্যায় চোখ মুখ আধার করে রইলো। মেহরাজ ওর মুখটা আরও কাছে টেনে এনে বলল

– আমার দিকে তাকান মোহ। আপনার রাগ, জেদ, ক্ষোভ যত কিছুই হোক না কেনো। তবুও এভাবে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখবেন নাহ। রাগ করলেও আমার দিকে তাকিয়েই করবেন ভালো বাসলেও আমার দিকে তাকিয়েই। মোট কথা আমি যতক্ষণ থাকবো চোখ দু’টো যেনো আমার উপর থেকে না নড়ে, বুঝলেন?

– আর যখন থাকবেন নাহ? তখন তো চোখটা অন্যদিকেই ঘুরিয়ে রাখা লাগবে, তাই এখন থেকেই রাখছি।

মেহরাজ চোখ দুটির দৃষ্টি আরও ধারালো করলো, মুখ টা মোহরের মুখের উপর ঝুকিয়ে এনে বলল

– আমি সবসময় আছি, হার হামেশা। আমার শরীর টা দূরে গেলেও আমার আমিত্ব,আমার মন, সবসময়ই আপনার পাশে, আপনার কাছে।

– লাগবে না। যেখানে যাচ্ছেন আপনার মনকেও সেখানেই নিয়ে যান

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো মেহরাজ। মেয়েটাকে যতটা ম্যাচিউর ভেবেছিলো ততটা নয়, বরং অনেক বেশিই অস্থির। মেহরাজের নতুন প্রজেক্ট টা শুরু করেছে অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি ওটাতেই ইনভেস্ট করছে। যৌথভাবে হোটেলের কাজ চলছে। সাইট চেক করে কনফার্মেশন দিতে মেহরাজকেই যেতে হবে কাল পরিদর্শনের জন্য, মি.রায়ান গসলি নিজে আসছেন কাল বাংলাদেশে, এক্ষেত্রে চেয়ার পারসন হয়ে মেহরাজের যাওয়া টা আবশোক। কিন্তু এই কথা টা তার বিবিজান কে কে বোঝাবে। কাল যাওয়ার কথা শোনার পর থেকেই মুখটা ফুলিয়ে বসে আছে। মোহরের এই অভিমানিনী মুখটা মেহরাজের বুকে এক অদ্ভুত বেদনাদায়ক প্রশান্তির ঝড় তুলছে। আনন্দ লাগছে এটা ভেবে যে তার প্রেয়সী ও তার জন্য ব্যকুল হয়ে ওঠে, আবার যন্ত্রণাও হচ্ছে মেয়েটাকে রেখে যেতে হবে বলে। কিন্তু তা এই মেয়েকে কে বোঝাবে এই যে গোমড়া মুখে বসে আছে!

– আমিতো ঘুরতে যাচ্ছিনা, যাওয়া টা অবশ্যক মোহ, আর দুদিনের ই তো ব্যাপার চলে আসবো আমি।

মোহর যেনো এবার না চাইতেও দমে গেলো। শক্ত খোলস টা ছাড়িয়ে আবেদনময়ী হয়ে বলল

– না গেলে হয় না রুদ্ধ!

মোহরের টলটলে চোখ দু’টো আর মায়াভরা চেহারাতে চেয়ে বুকের ভেতর নিস্তব্ধ তুফান উঠলো মেহরাজের। শোঁ করে নিঃশ্বাস টেনে নিলো। মোহরের কপালে কপাল ঠেকিয়ে অস্থির গলায় বলল

– কেনো পাগল করে দিচ্ছেন বলুন তোহ। আর কতভাবে ঘায়েল করবেন আমাকে!

মোহর প্রত্যুত্তর করলো নাহ। মেহরাজ ওকে ছেড়ে উঠে গিয়ে লাইট বন্ধ করে দিলো, ঘরময় হলদেটে আলোর মৃদুমন্দতা ছড়িয়ে গেলে বিছানাতে এসে শুয়ে পড়লো মেহরাজ, মোহরকে এক হাতে টেনে বুকের কাছে এনে ফেললো, পেছন থেকে দুটো হাত কোমরের মাঝে ঝপটে ধরে। মোহর নড়েচড়ে উঠতে গেলে ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিয়ে ফিসফিস করে বলল

– হুসস, একটুও নড়বেন নাহ। এখন আমাকে একটু শান্তিতে ঘুমাতে দিন তো, আপনাকে ছেড়ে গেলে সেটা তো আর কপালে জুটবে না
.
.
.
চলমান

©Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here