ফানাহ্ 🖤 #লেখিকা_হুমাইরা_হাসান #পর্বসংখ্যা_১৯

#ফানাহ্ 🖤
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
#পর্বসংখ্যা_১৯

– মুখটা এমন ফ্যাকাসে করে রেখেছিস ক্যান মেহু, কিছু হয়েছে?

শ্রীতমা আসতে আজকে বেশ দেরি করে ফেলেছিল । এসে ক্লাসে বসতে না বসতে টিচার ঢুকেছে। বেশ ঘন্টা দুয়েকের ক্লাস শেষে ক্লাসরুম থেকে বেরোতে বেরোতে বলল মোহরকে। এসে থেকে ওর নির্জীব, ফ্যাকাসে চেহারা টা বেশ ভাবাচ্ছিল ওকে ৷ শুধু যথাযথ সুযোগের অভাবে জিজ্ঞাসা করতে পারেনি।

– আগে বল আমাদের ভার্সিটিতে তিয়াসা চৌধুরী নামের কোনো স্টুডেন্ট আছে? রিসেন্ট ইন্টার্নি শেষ করেছে বা করছে?

– এ কথা কেন জিজ্ঞাসা করছিস বল তো?

– আগে তুই বল আমাকে

শ্রীতমা বেশ কিছুক্ষণ ভাবলো। খানিক বাদে জড়ো হওয়া ললাটের ভাঁজ প্রসারিত করে বলল

– হ্যাঁ হ্যাঁ আছে। রিসেন্ট ই ও ইন্টার্নি কমপ্লিট করে হসপিটালে জয়েন করেছে। শুনেছি অনেক বড়োলোকের মেয়ে,আর খুব অহংকারী। আমার রুমমেট ওর গল্প করেছিল। একই ব্যাচের ওরা।

খানিক থেমে মোহর কিছু বলার আগেই ও বলল,

– কিন্তু তুই হঠাৎ ওর কথা জানতে চাইছিস কেন বলতো?

মোহর তপ্ত শ্বাস ফেললো। সুগভীর চোখের প্রসারিত দৃষ্টিতে তাকালো শ্রীতমার দিকে। সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে সকালের সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। প্রায় গেইটের সামনে এসে পৌঁছালো পুরো কথা টা শেষ হতে হতে৷ তমা ভ্রুকুটি করে বলল

– এতো রেখে ওই জল্লাদ, ধিরিঙ্গি টাকেই তোর সতিন হতে হলো মেহু। ও আচ্ছা বজ্জাত মেয়ে আমি শুনেছি। তোর লাইফটাকে যে ঘেটে দেওয়ার জন্য ও সব টোটকা মশলা লাগাবে তা ভালই বুঝতে পারছি।

মোহর ক্লান্ত ভঙ্গিমায় কিঞ্চিৎ হেসে বলল

– লাইফ এমনিতেও খুব একটা সমতলে নেই। আমার এখন নিজেকে নিজেরই বোঝা মনে হচ্ছে। না আমার সাথে ওই লোকটার বিয়ে হতো নাইবা এতো সব ড্রামা হতো। সেদিন একা একা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই পারতাম।

– মোটেও না। ভগবান যা করেন ভালোর জন্যেই করেন। এতে নিশ্চয় বিধাতা তোর ভালোই লিখেছেন

– কি ভালো লিখেছে বলতে পারবি? শুধু কতগুলো মানুষের চক্ষুশূল হওয়া ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না নিজেকে

মোহরের বিতৃষ্ণা ভরা কথাগুলো গলা হতে নিঃসৃত হতেই শ্রীতমা ওর হাতটা ধরে দাঁড় করালো। বেশ গুরুতর ভঙ্গিমায় বলল

– বিয়েটা তো তুই পুরো পরিবার কে করিস নি, বা স্বেচ্ছায় পটিয়েও করিস নি। তোরা দুজনই সে পরিস্থিতি সাপেক্ষে বাধ্য ছিলিস এটা তো কোনো বাচ্চারও বুঝতে অসুবিধা হবে নাহ তবুও এই কথাগুলো কেন বলছিস বল তো। এসব বাইরের মানুষের কথা বাদ দে, মানুষই মানুষের দুশমন। সেখানে অন্য কারো আচরণে তুই কেন নিজেকে দোষারোপ করবি, তুই যার আমানত হয়ে এসেছিস সে তো তার খেয়ানত করছে না। ভরা রাস্তায় যে তোর গায়ে তোলা হাতটা আঁটকে যদি তোর ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারে সে বাকিটা জীবন ও পারবে পাশে থাকতে।

মোহরের ভাবভঙ্গিমায় তখনও কোনো পরিবর্তন এলো নাহ৷ স্থির দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার সামনের দিকে চেয়ে, তমা ওর গালে হাত রেখে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল

– এত কেন ভাবছিস বল তো। আমাকেই দেখ জন্মের পর থেকেই অনাথ আশ্রমে বড়ো হয়েছি, আঠারো বছর পর সেই ছাদটুকুও হারিয়েছি। আমার সবকিছুই তো তোর জানা। আশ্রম থেকে যখন চলে আসতে হলো তখন তুই ই তো বলেছিলি ‘ চিন্তা করিস না শ্রী যার কেও নেই তার স্রষ্টা আছেন, তোকে সেই দেখবেন ‘ দেখ আজ আমি একা থেকেও কতো ভালো আছি। টিউশনি করিয়ে আমার দিন দিব্বি চলে যায় আরামসে। আর। সেখানে তোকে বিধাতা একজন রঙিন দূত পাঠিয়েছে যে নিজের রঙেই রামধনু করে দেবে তোর নিস্তেজ জীবনটা। কিসের দোটানায় ভুগছিস তুই? কি হারানোর ভয় পাচ্ছিস আর? যা হারাবার হারিয়েই তো গেছে। এখন যেটা ভগবান তোকে দিয়েছে ওটাই আঁকড়ে ধরে থাক।

– কিন্তু শ্রী, যাকে চিনি না জানি না তাকে স্বামী মেনে ভরসা করে নেব? ও বাড়ির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই আমায় পছন্দ করে নাহ

– ও বাড়ির লোক তো তোকে বউ করে আনেনি, যে এনেছে সে তো পছন্দ করে?

মোহর ছলছল চোখে তাকালে শ্রীতমা মোহরের হাতটা আরও জোরে ঝাপটে ধরে বলে

– মেহু, যে মানুষটা একটা মেয়ের সম্মান বাঁচাতে তার গুরুদায়িত্বটা নিজ ঘাড়ে চাপিয়ে নিয়েছে সে আর যাই হোক ঠক হবে এমনটা আমি ভাবতে পারছি না। আজ তো ছেলেরা মেয়েদের নিয়ে বছর বছর প্রেম করে মাতামাতি করেও বিয়ের কথা শুনলে পালাই সেখানে তিয়াসার মতো এমন বড়োলোক বাপের একমাত্র মেয়েকে ছেড়ে তোকেই বেছে নিল। ভালো মানুষি দেখিয়ে বিয়ে করে এনে মুখের উপর দুটো হাজার টাকার বান্ডিল ছুড়ে ঘাড় থেকে নামিয়ে দিতে পারতো। সেখানে নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে তোকে বউ রূপে স্বীকৃতি দিয়ে নিজের ঘরে অবদি রাখছে অথচ স্বামীত্ব ফলাতে একবার ছুয়েও কিন্তু দেখেনি মেহু।

বিরতিহীনা শ্রীতমা আবার বলে গেল

– পরিবারের সামনে, ভরা রাস্তায় যে তোর হাত ধরে পাশে দাঁড়ায় তাকে অন্তত অবিশ্বাসের ট্যাগ লাগিয়ে অপমান করিস না। সম্পর্ক আগাতে সে যখন এতগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে তোর কি উচিত না নিজের দিক থেকেও একটু এগোনো? আর কতদিন আটকে রইবি এক জাগায়?

অকস্মাৎ ব্রেক কষে গাড়িটা থামিয়ে কোনো রকমে অ্যাক্সিডেন্ট হওয়া থেকে সামলে নিল অভিমন্যু। সানন্দে গাড়ি চালাচ্ছিল হুট করেই লাল রঙের একটা গাড়ি এসে ওকে টপকে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিমন্যু পরিস্থিতি উপলব্ধি করে সামলে ওঠার আগেই সামনের গাড়ি থেকে বের হয়ে গটগট পায়ে এগিয়ে এসে গাড়ির জানালার কাঁচে ধাক্কাতে লাগলো

– গাড়ি থেকে বেরোও, ফাস্ট

অভিমন্যুর বিরক্তিতে মুখ কুচকে এলো। গাড়ি দেখেই বুঝেছিল এই মালটাই এসেছে তাকে জ্বালাতে।

– কি বলছি কানে যাচ্ছে না? গেট আউট ফ্রম দ্যা কার ড্যাম ইট!

অভিমন্যু প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরোলো গাড়ি থেকে। অবিলম্বেই তিয়াসা চড়া গলায় বলল

– তোমার স্যার কোথায় হ্যাঁ? ওকে ফোনে পাচ্ছি না কেন?

– স্যারের ফোন স্যার জানেন, আমাকে জিজ্ঞাসা করে কি হবে

তিয়াসা অভিমন্যুর এমন গা ছাড়া কথায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। চেঁচিয়ে বলল

– তোমার তেড়া বাঁকা উত্তর শুনতে আসিনি। তোমার স্যার কোথায় সেটা ভালোই ভালোই বলে দাও। নয়তো তোমার গাড়ির কাঁচ ভে’ঙে দেব আমি

– ম্যাডাম এটা স্যারের গাড়ি, আমাকে তো শুধু চালাতে দিয়েছে। ভাঙলে কৈফিয়ত টা আপনিই দিবেন

– সামান্য একজন পিএ হয়ে আমার সাথে তর্ক করার সাহস পাও কি করে তুমি। আমি আজই ড্যাডকে বলে তোমার চাকরি উচ্ছন্নে দেব স্টুপিড।

– ম্যাডম আপনি নিজেই বললেন আমি সামান্য পিএ। তাহলে আপনিই বলুন স্যারের ফোন কলস এর মতো পারসোনাল ব্যাপারে আমি কিভাবে জানবো, আর তাছাড়াও আমি কক্সবাজারে গেছিলাম, আজকে সকালের ফ্লাইটেই ল্যান্ড করেছি। বিশ্বাস না হলে আমার টিকিট দেখতে পারেন আপনি।

তিয়াসা খানিক দমে গেল। কিন্তু রাগে জিদে ওর মাথা ফেটে যাচ্ছে। আজ রাস্তা ভর্তি মানুষের সামনে অপমান করেছে মেহরাজ ওকে। তাও আবার ওই লেইম চিপ মেয়েটার জন্য। এর উত্তর ওর চাই ই চাই, কোনো কথা ছাড়াই ধুপধাপ পা ফেলে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। আজ মেহরাজের সাথে দেখা করেই ছাড়বে।

তিয়াসা চলে যেতেই অভিমন্যু পকেট থেকে ফোন বের করে কানে ধরলো। চটপটে গলায় বলল

– স্যার তিয়াসা ম্যাডাম গাড়ির সামনে এসেছিল

– অ্যাক্সিডেন্ট করিয়ে দিয়েছো?

– এমা কি বলেন না না। আমি বলতে চেয়েছি উনি আমার গাড়ি থামিয়েছিল। আপনার কথা জিজ্ঞাসা করলো, এখন মনে হয় অফিসের দিকেই গিয়েছে

তারপর আর কিছু শোনা গেল না ওপাশ থেকে। অভিমন্যু বাধ্য ভৃত্যের মতো ‘ ইয়েস স্যার ‘ বলে ফোনটা রেখে আবারও গাড়ি স্টার্ট দিল।

– স্যার আসতে পারি?

– কাম ইন

হাস্যজ্বল চেহারার মোটা সোটা গোলগাল গড়নের মাঝ বয়েসী লোকটা এগিয়ে এলো কতগুলো ফাইল হাতে। হালকা নীল রঙের ফাইলটা মেহরাজের হাতে তুলে দিতে দিতে বলল

– এই ছবি গুলো আজই মেইল করেছেন মি.রায়ান গসলি৷ আপনি অ্যাপ্রুভাল দিলেই শিপ ঢুকবে খুলনাতে।

মেহরাজ ফাইল গুলো চেক করা অবস্থায় হুট করে কেবিনের দরজা খুলে কেও হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো। মেহরাজ সেদিকে না তাকালেও ইবনাত হক সেদিকে মুখ ভরা বিব্রতি নিয়ে তাকালো। ভয়াতুর চাহনিতে একবার আড়চোখে মেহরাজকে পরখ করে নিল। তার মুখাবয়ব পুরোপুরি স্বাভাবিক। তবুও ভীতিকর ভাবনা জড়ো হলো ইবনাত হকের মস্তিষ্কে। । মেহরাজ দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে স্টাফদের সাথে দেখা বা মিটিং করে, তা বাদে পারমিশন বা রেফারেন্স ছাড়া ওর কেবিনে আসার সাহস কেও করে নাহ।
ভয়াতুর চাহনি ঠেলে খানিক হাসি হাসি মুখে বলল

– আরে তিয়াসা ম্যাডাম, ভালো আছেন?

– আপনি বাইরে যান ইবনাত আংকেল আমি রাজের সাথে পারসনালি কথা বলতে চাই

ইবনাত দ্বিধাদ্বন্দ্বিত চোখ মুখে মেহরাজের দিকে তাকালো। সে খুব স্বাভাবিক গতিতে ফাইলটা সম্পূর্ণ ভ্যারিফাই করে সেটা ইবনাতের হাতে দিয়ে বলল

– আমি আমার পছন্দ মতো শিপের পিকচার মেইল করে দেব মি.গাসলি কে। আপনি আগেরটাই রিসিভ করার ব্যবস্থা করুন

– জ্বি স্যার, আসছি

বলেই মেহরাজের পারমিশন নিয়ে বেরিয়ে গেল। তিয়াসা এখনো দরজায় দাঁড়িয়ে, মেহরাজ আবারও ওকে ইনসাল্ট করলো! এই স্টাফের সামনে যাদের কি না ওর বাবাই বেতন দিয়ে খাটায়। বড়ো বড়ো পা ফেলে তিয়াসা মেহরাজের সামনে এসে দাঁড়ালো,

– তুমি আমার সাথে এমন কি করে করতে পারলে মেহরাজ। রাস্তার মাঝে অপমান করেও হয়নি এই স্টাফের সামনেও আমাকে হেয় করলে?

– কেবিনে ঢোকার আগে পারমিশন নিতে হয়। এই মিনিমাম বোধ টুকু নেই?

– কথা এড়িয়ে যাবে না। দুইদিন কি থাকলে একসাথে আর এতো প্রটেকটিভ হয়ে উঠলে, এতো কেয়ার? কই আমাকে তো করোনি কখনো? একটা বস্তি, ছেলেবাজ মেয়ের মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছো তুমি? আমিতো ভেবেছিলাম তুমি ওকে শে..

ক্ষেপে উঠলো মেহতাজ। চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে এসে তিয়াসার সামনে দাঁড়ালো দূরত্ব বজায় রেখে, রাগান্বিত গলায় ফোঁসফোঁস করে বলল

– মোহরের ব্যাপারে একটাও বাজে কথা নয়, আমার ব্যাপার আমি বুঝে নেবো। আমি কার সাথে কেমন ব্যবহার করবো কার মায়ায় জড়াবো সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। মেহরাজ না কাওকে জবাবদিহি করে নাইবা কারো ইচ্ছাতে কাজ করে।

মেহরাজের এহেন ক্ষিপ্ত রূপে তিয়াসা দুকদম পিছিয়ে গেল। ভড়কানো চাহনি দিয়ে খানিক তাকিয়ে থাকলেও পরমুহুর্তেই মনে হলো এই রাগ তৎপরতা,উৎকণ্ঠা সব ওই মোহরের জন্য। ওই মেয়েটার জন্যে আজ ওকে অপমান হতে হচ্ছে। তিয়াসা কান্নামিশ্রিত গলায় চেঁচিয়ে বলল

– ওই দুই পয়সার মেয়েটার জন্য তুমি আমাকে ইগনোর করতে পারো না রাজ। তুমি আমার, তোমাকে আমার চাই-ই এর জন্য যা করার আমি করবো। প্রয়োজনে ওই মেয়েটাকে নর্দমায় ফেলে আসতে আমি তিয়াসা চৌধুরী দুবার ভাববো নাহ।

মেহরাজ আর নিজেকে সংযত করে রাখতে পারছে না। ওর সামনে দাঁড়িয়ে এতো বড়ো দুঃসাহসিকতা অন্য কেও করলে এতক্ষণে পুঁ’তে রাখতে দুবার ভাবতো নাহ। শুধুমাত্র মেয়ে বলে মেহরাজ দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য হচ্ছে।
মেহরাজ তিয়াসার দিকে রক্তচক্ষুতে চেয়ে চিৎকার করে বলল

– মোহর আমার, ওর দিকে বাড়ানো হাত ঝলসে দিতে আমি মেহরাজ আব্রাহাম ও দুবার ভাববো না। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না। তার ফল একেবারেই ভালো হবে নাহ। দূরে থাকো নিজের সম্মান, সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখো

তিয়াসা থ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো খানিক।এর আগে কক্ষনো মেহরাজের এমন ভস্ম করা চাহনি কেও দেখেনি হয়তো। এতো উত্তেজনা, অস্থিরতা শুধু ওই মেয়েটার জন্যে? এই মায়া,মোহ তো তিয়াসা চেয়েছিল। ওর এতদিনের বাসনা দুমড়ে মুচড়ে গেল?
তিয়াসার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে মেহরাজ জলদগম্ভীর গলার ধারালো স্বরে ধমকে উঠলো

– আমি ধৈর্যহারা হয়ে যায় তার আগেই এখান থেকে বেরিয়ে যাও তিয়াসা। গেট আউট!!

ভয়ে থতমত খেয়ে গেল তিয়াসা। মেহরাজের ক্রুদ্ধতা বাড়িয়ে দেওয়ার মতো দুঃসাহস চেয়েও যোগাতে পারল নাহ। দ্রুত পায়ে কেবিনের দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল।

– আলে লেলেলে, গুল্লু গুলু! চুল্লুমুনু! বুলবুল

তাথই প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা ভরা চোখে তাকালো সাঞ্জের দিকে। কখন থেকেই এসব অদ্ভুত শব্দ করছে। আর বাচ্চাটাও আছে, এসব শুনেই খিলখিল করে হাসছে। এসব বিশ্রী নাম শুনে এমন খিলখিলানোর মানে বুঝতে পারে না তাথই।

– ভাবী শোনো ওর নাম চমচম, বুঝলা। দেখো কেমন তুলতুলে টুসটুসে। এসব কঠিন নাম ওকে মানাবে না৷ তাই ওর নাম চমচম, আমি দিলাম তোমরা সবাই ও তা বলেই ডাকবা।

সাঞ্জের কথায় খিলখিল করে হেসে উঠলো মোহর। কোলের বাচ্চাটাও কোনো কিছুর অর্থ না বুঝেই ফোকলা গালে হেসে উঠলো। ওর হাসি দেখে সাঞ্জে প্রাণোচ্ছল গলায় বলল

– দেখলে ওর ও নামটা পছন্দ হয়েছে। বাচ্চারা যখন কিছু পছন্দ করে সেটা দেখে ওরা এমন খিলখিল করে হাসে, আর যেইটা পছন্দ হয়না সেটা দেখে কাঁদে। ও যখন নামটা শুনে হাসছে তার মানে ওর পছন্দ হয়েছে,, ইয়ে চমচম, তাকাও আমার দিকে তাকাও

বলেই তোয়ার হাতটা ধরে টানতে লাগলো। তাথইয়ের মেজাজ টা তুঙ্গে উঠে গেল এবার। এক তো আজ কয়েকদিন ধরেই বাচ্চাটাকে ওর কাছে রাখতে দেয়না। সারাদিন কাকলির কাছেই থাকে। সুযোগ পেলেই মোহর নিয়ে বসে,এখন তো সাঞ্জেটাও এসে জুড়েছে। তার উপর এসব উদ্ভট নাম দিচ্ছে। চমচম? এটা কখনো কোনো মানুষের নাম হয়? সে কত সাধ করেই তো নাম রেখেছে তোয়া। তাথই এর সাথে মিলিয়ে। সেটা তো বলেই না।এতক্ষণ ধরে গুলু মুলু চুলু যা তা বলে এখন আবার চমচম দিয়ে নামকরণ করছে।

ধপ করে উঠে দাঁড়ালো তাথই, ধুপধাপ পা ফেলে ওদের সামনে গিয়ে বাচ্চাটাকে ধপ করে কোল থেকে তুলে বুকের সাথে ধরে বলল

– ও আমার মেয়ে, আমি যা নাম রেখেছি সেটাই ওর নাম হবে। এসব গুলুমুলু চমচম তোদের কাছেই রাখ

বলেই ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সাঞ্জে ওর দিকে তাকিয়ে আহাম্মক বনে গেল। টেনে টেনে বলল

– যাহ বাবা। যেই চমচম বেচে মানুষ লাখপতি হয়ে গেল এমন দামী একটা নাম কিনা হেয় করে চলে গেল। এই জন্যেই বলে বাঙালির ভালো করতে হয়না।

মোহর হুহা করে হেসে দিল সাঞ্জের কথায়। এইরকম ছেলে মানুষী দেখতে থাকলে পাগল হয়ে যাবে ও। মোহরের হাসি দেখে সাঞ্জে খানিক মুখ ফুলিয়ে রেখে, চটপট করে বলল

– এই যে সুহাসিনী। বহুত হেসেছেন।এখন ফট করে রেডি হন তো। বেরোবো এমনিতেই চমচমের জন্য দেরি হয়ে গেছে

– আজকে না গেলে হয় না? এমনিতেই তো বিকেল গড়িয়ে পড়লো

মোহরের কথাকে হরদমে উপেক্ষা করে ঘনঘন ঘাড় নাড়িয়ে সাঞ্জে নাকচ করে বলল

– একদমই না। আমার অনেক শপিং করতে হবে। আর আমি আজই যাবো। তোমাকেও যেতে হবে, জানি না আমি। আর বিকেল হোক বা রাত ওসব ব্যাপার না। দাভাই থাকলে অল গুড বেটার বেস্ট।

সাঞ্জের মুখে দাভাই শুনে থমকে গেল মোহর। জড়তাগ্রস্ত হয়ে বলল

– দাভাই মানে? উনি কি আসছেন?

– জ্বি, তোমার উনিই নিয়ে যাবে শপিংয়ে। এখন শিগগিরী রেডি হও তো। আমাকে বলেছে দেরি করলে নিয়ে যাবে না

বলে তাড়া দিয়ে মোহরকে নিজের ঘরে পাঠালো রেডি হওয়ার জন্যে। মোহরের অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানতে হলো। কিন্তু ওই মানুষটার কথা শুনলেই তো বুকের ভেতর টাইফুন শুরু হয়,এই যে আবারো শুরু হয়েছে!

বেলা গড়িয়ে সূর্যটা হেলে পড়েছে পশ্চিমে। টকটকে লালাভ রোশনাইতে ভরে গেছে আকাশে বুকের পশ্চিমাস্থল।
ঘর্মাক্ত শরীরে, ব্যস্ত পায়ে বাড়িতে ঢুকলো মেহরাজ। গায়ের ব্লেজারটা খুলে হাতে ঝুলিয়ে দ্রুতপায়ে সিড়ি ভেঙে উপরে উঠলো। ঘরের সামনে এসে নব মুচড়ে দরজাটা খুলতেই পা বাড়াতে গিয়েও থমকে গেল।
আধখোলা দরজার নবে হাত রেখেই থ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো আয়নার প্রতিফলিত চেহারাটার দিকে। আস্তে আস্তে পা ফেলে ভেতরে এসে দাঁড়ালো মোহরের পেছনে।
কারো ঘরে ঢোকার শব্দে মোহর তড়িঘড়ি করে পেছনে তাকিয়ে মেহরাজকে দেখেই দমে গেল। কিন্তু পরমুহূর্তে ওর এহেন নিষ্পলক চাহনি দেখে ইতস্তত ভাবে জড়তা ঘিরে ধরলো।
মোহরের জড়তা ভরা মুখাবয়বকে দেখেও অগ্রাহ্য করে তাকিয়ে রইলো বেহায়া নজরে। কালো রঙের একটা ঘের দেওয়া জামা পরেছে, জামাটা পায়ের গোড়ালি সমান লম্বায়। কবজি পর্যন্ত কালো হাতা আর পাতলা জরজেটের কাপড় টা মোহরের চিকন শরীরে লেপ্টে জড়িয়ে আছে। মেহরাজ শুকনো ঢোক গিলে মোহরের নতমস্তক মুখের দিকে তাকালো।

মেহরাজের দিকে মুখ করে থাকায় আয়নাতে মোহরের পিঠ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আর মেহরাজের নিষিদ্ধ দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো একদম সেইখানটাই।
মোহর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে প্রচণ্ড অস্বস্তি বোধ করছিল, গলাটা সামান্য উঁচিয়ে তাকালো মেহরাজের ক্লান্ত পরিশ্রান্ত চেহারায়। চোখের নিকে, নাকের আশেপাশে বিন্দু বিন্দু তৈলাক্ত ঘাম জমেছে, পরিপাটি করা চুলগুলো অবিন্যস্ত ভাবে ছড়িয়ে আছে কপালে। মোহরের চেয়ে থাকা অবস্থায় মেহরাজ এগিয়ে এলো, হাতের ব্লেজারটা খাটের উপর ফেলে গলার টাই ঢিলে করে দিল।

– আমি আসছি

বলেই মোহর সরে যেতে নিলেই ওর ওড়না টা আলতো স্পর্শে ধরলো মেহরাজ, ওড়নাতে টান পড়লে মোহর জিজ্ঞাংসুক অস্বস্তিকর চাহনিতে তাকায়,সেদিকে চোখ রেখে হাতটা তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিয়ে মেহরাজ ধীর গলায় বলল

– দাঁড়ান

মোহরকে দাঁড় করিয়ে ওর একদম সামনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিল ঘাড়ের দিকে। ওর শরীরকে কোনো ভাবে স্পর্শ ছাড়াই চুলগুলো তুলে ঘাড়ের একপাশে রেখে আরও কাছে এগিয়ে এলো। মোহরের সারামুখ জুড়ে জড়ত্ব, একরাশ ভীত কৌতুহল। মেহরাজ সেসব পুরোদমে অগ্রাহ্য করে একদম কাছাকাছি আসলেও খানিক দূরত্ব বজায় রাখলো।
দু’হাত মোহরের কাধের উপর দিয়ে নিয়ে পেছনে জামার ফিতাটাতে হাত রাখলো। মেহরাজের আঙুলের স্পর্শ হীনাই কেঁপে উঠলো মোহর। মেহরাজের শরীরের সেই মাদকময় নেশাভরা ঘ্রাণ টা একদম খুব কাছ থেকে এসে নাসারন্ধ্র ভেদ করছে, পুরুষালী নিঃশ্বাস গুলোর ঝংকার তোলা শব্দ অত্যন্ত নৈকট্যে আঁছড়ে পড়ছে। মেহরাজ কয়েক লহমা সময় নিয়ে পিঠের ফিতাটা লাগিয়ে সরে এলো। পুরোটা সময় একচুল স্পর্শ না করলেও মোহরের অবস্থা করুন, পরনের জামাটা খামচে ধরে রেখেছে। মেদুর গালটা টকটকে হয়ে আছে। মেহরাজ ওর গভীর চোখে মোহরের আপাদমস্তক পরখ করে বলল

– এতটা ভয় পাচ্ছেন কেন মোহ, স্পর্শ করিনি তো। আপনি না চাইলে করবোও না। অপ্রিয় স্পর্শে কোমলমতি ফুলকে মিইয়ে দিতে চাইনা আমি। চোখের সামনে তার পরিস্ফুটিত রূপ দেখলেই শান্তি পাই।
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

©Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here