শেষ_বিকালের_আলো (পর্ব ১২)

…#শেষ_বিকালের_আলো (পর্ব ১২)

অবনী সামনে আকাশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। কোন কথা বলতে পারছেনা…

আকাশ তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিলো। সময়ের পরিক্রমায় বয়স বেড়েছে বোঝা গেলেও চেহারার খুব বেশি পরিবর্তন নেই। তাই অবনীর চিনতে তেমন সমস্যা হলোনা।

অবনী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ সময়টার স্মৃতি হাতড়ানো শুরু করলো। অরণ্য তার দু’বছরের সিনিয়র ছিলো। তাদের ভালোবাসার সম্পর্কের কথা প্রথমদিকে কেউ না বুঝলেও শেষের দিকে মোটামুটি সবাই জেনে গিয়েছিলো।

আকাশও জেনে গিয়েছিলো অবনী আর অরণ্যের সম্পর্কের কথা। আকাশ তখন অবনীর উপরে রেগে গিয়েছিলো কেন তাকে এই ব্যাপারটা আগে জানানো হয়নি।

প্রথম রেগে গেলেও পরবর্তীতে আর কোন উপায় না পেয়ে অবনীকে বিভিন্ন ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে সে অবনীকে অনেক আগে থেকেই খুব ভালোবাসে কিন্তু অবনীকে জানাতে পারেনি ভয়ে।অবনী কি ভাবে নেবে ব্যাপারটা এই ভেবে।

আকাশ যে ভয়টা পেয়েছিলো পরে সেটাই হয়েছিলো।অবনী আকাশের থেকে তখন অনেক দূরে সরে গেলো। অবনী কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি যে আকাশ তাকে বন্ধু ছাড়া এতদিন অন্য চোখে দেখেছে।

অরণ্যও তখন আকাশের এই ব্যাপারটা জেনে গিয়েছিলো তাই তার যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পার্ট চুকলো তখন সে বারবার করে অবনীকে একা একা বিয়ে করে ফেলার জন্য চাপ দিতে লাগলো।

অবনী এভাবে একা বিয়েতে রাজি ছিলোনা,সে অরণ্যকে বলল, যাতে সে একটা জব নেয়ার চেস্টা করে তাড়াতাড়ি নাহলে অবনীর বাবা মা তাদের বিয়েতে রাজি হবেন না।

এই সময়টায় অরণ্যের সাথে অবনীর অনেক ঝগড়া হতে লাগলো।কারণ অবনীর পড়াশোনা শেষ হবে আরও দু’বছর পরে।তার সাথে আকাশও আছে। অরণ্য অবনীকে হারানোর একটা ইনসিকিউরিটিতে ভুগতে লাগলো।

অবনী এরপর থেকে আকাশকে সবসময় এড়িয়ে চলতো। অবনীর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষের দিকে আকাশ তখন অস্থির হয়ে গেলো।
অবনীর সামনে এসে অনেক অনুনয় বিনয় করে বলেছিলো ভালো না বাসিস, একবার আমার সাথে আমার বাড়িতে চল, তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

আমার মাও তোকে একটিবার দেখতে চেয়েছে। আমি মাকে কথা দিয়েছি তোকে একবার হলেও নিয়ে যাবো বাড়িতে। তুই একটিবার আমার সাথে না গেলে যে আমার সকল কষ্ট বৃথা হয়ে যাবে অবনী।

অবনী কোনভাবেই আকাশকে তখন বিশ্বাস করতে পারেনি। তাছাড়া অরণ্য এটা জানলে তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে।এমনিতেই অরণ্য আর অবনীর সম্পর্ক আগের মত ভালো যাচ্ছেনা।

অরণ্য এরই মধ্যে চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। চাকরি পাওয়ার ৬ মাসের মধ্যেই অরণ্য আর অবনীর বিয়ে হয়ে যায়। অবনীর সাথেও আকাশের এরপর আর দেখা হওয়া বন্ধ হয়ে যায়।পরে আকাশ অন্য বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছিল অবনীর বিয়ের খবর।

অবনীর স্তব্ধতা ভেঙে আকাশ বলে উঠলো…সেই তো আসলি অবনী তবে এত বছর পরে!

অবনী: কি বলতে চাইছিস তুই?

আকাশ: তেমন কিছুই না..যে বাড়িতে তোকে একটি বার আসতে অনুরোধ করেছিলাম,সে বাড়িতে এখন নিজের ইচ্ছেতে তুই দিনের পর দিন থাকছিস অবনী। আশা করি তুই তোর ১০ বছর আগের সারপ্রাইজ পেয়ে গেছিস।

এই বলে আকাশ তার বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলো।অবনী ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো।
লজ্জায় আর অপমানে অবনীর কান দিয়ে তখন গরম বাতাস বের হচ্ছিলো। অবনী সত্যিই সারপ্রাইজড।

অবনী কোনদিন ভাবতে পারেনি আকাশ যে এভাবে তার গল্প করা কল্পনার বাগান বাড়ি বানিয়ে তাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো।

আকাশ অবনীর বলা বাড়ির নাম থেকে শুরু করে ডুপ্লেক্স বাড়ি, বাড়ির ঝুল বারান্দায় বাগান বিলাস,সামনের বাগানের বারোমাসি ফুলগাছ,বাড়ির ডানদিকে পুকুরঘাট,পুকুরঘাটের বেঞ্চি,বেঞ্চির উপরের ঝাঁকায় মাধবীলতা, পুকুরের শাপলা,মাছ।পুকুর পাড়ের লতানো সবজির মাঁচা, বাড়ির পিছনের সিঁড়ি,ফলের বাগান,তার পাশেই সবজি বাগান এই সবকিছু আকাশ মনে রেখে ধীরে ধীরে তৈরি করেছে শুধুমাত্র অবনীর জন্য এটা ভাবতেই তার শরীর শিউরে উঠছে।

অবনীর বাড়িও দোতলা ডুপ্লেক্স। কিন্তু শহরের বাড়িতে আশেপাশে জায়গা না থাকায় অবনী তার স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চেষ্টা করেছে ছাদবাগানে। যদিও পরিপূর্ণ স্বপ্ন প্রস্ফুটিত হয়নি এখানে যা আকাশের বাগান বাড়িতে হয়েছে।

অরণ্যও খুব ভালো করে জানতো তার এই শখের ব্যাপারে।কিন্তু নিজে থেকে কিছু করেনি। সে যখন দেখলো অবনী একা একা বাগান শুরু করেছে এবং সেই বাগানে ফুল ফল সবজি হচ্ছে তখন ধীরে ধীরে অরণ্যের ভালো লাগা শুরু হলো এবং এক সময় সেও অবনীর মত বাগানপ্রেমী হয়ে উঠলো।

অবনী ভাবনার জগতে বিচরণ করেই যাচ্ছিলো হঠাৎ লিনসার ডাকে সৎবিৎ ফিরে পায়। আম্মু কি করছো ওখানে?লিনিয়া উঠে গিয়েছে ঘুম থেকে।

অবনী দ্রুত পায়ে উপরে উঠে গেলো! তার মাথা কোন কাজ করছেনা। কি করবে এখন। এখানে কিভাবে আর থাকা যায়! সবকিছুই হঠাৎ করে কেমন পরিবর্তন হয়ে গেলো।

অবনী বাচ্চাদের নাস্তা দিয়ে আবার ঠায় বসে রইলো বিছানায়। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হচ্ছে। অবনীর পা শক্ত হয়ে আছে।কিছুতেই পা নাড়াতে পারছেনা। এত বছর পর আবার কোন বাস্তবতার মুখে এসে পরলো অবনী।

এবার জোরে জোরে কড়া নাড়ার শব্দ। অবনী উঠে দাঁড়ালো। রাগে তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। আকাশ কি ভেবেছে।ও যা ইচ্ছে তাই বলে যাবে আর অবনী মেনে নেবে!

আকাশ যে ভালোবাসতো অবনীকে সেটা একতরফা ছিলো তাতে অবনীর কোন হাত ছিলোনা। অবনী আকাশকে মনে করে শব্দ করে দরজা খুলেই কিছু বলতে যাবে এরমধ্যেই দেখতো পেলো কাকিমা দাঁড়িয়ে আছে।

কাকিমাকে দেখেই অবনীর মনে হলো, কাকিমা যদি বুঝে যায়,যে তার ছেলের জীবন এলোমেলো হওয়ার পিছনে একমাত্র অবনী দায়ী তাহলে কি করবে সে!

কাকিমা বলল, অবনী আজ দুপুরে নাতনীদের নিয়ে আমাদের বাসায় খাবে।কিছু রান্না করোনা।অবনী কিছুতেই যেতে চাইছে না।আকাশের মুখোমুখি হতে আর ইচ্ছে করছেনা।

অবনী: কাকিমা আমার শরীর একটু খারাপ।আজ থাক।অন্য একদিন খাবো নাহয়।

কাকিমা: না…না…কি বলছো! আজ আমার ছেলের জন্য কত কি রান্না করেছি।তোমাদের রেখে কি করে খাই! অবশ্যই আসবে,আমি কোন কথা শুনবোনা।

কাকিমা বলে চলে গেলো…অবনী দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। অবনী দেখতে পেলো সামনের বাগানে আকাশ হাঁটছে। হঠাৎ দু’জনার চোখে চোখ পড়তেই অবনী ধাম করে দরজা আটকিয়ে দিলো।

অবনীর দম বন্ধ হয়ে আসছে।কি করে সে এই পরিস্থিতির সামাল দিবে। আকাশ যদি কাকিমাকে সব কিছু বলে দেয়! কি হবে তখন! অবনী আর ভাবতে পারছেনা।

অবনী রান্নাঘরে কাজ করছিলো।ঘরে এসে দেখে লিনসা আর লিনিয়া ঘরে নেই। শোবার ঘরের জানালা দিয়ে দেখতে পেলো লিনসা আর লিনিয়া পুকুরে মাছ ধরছে এবং তাদের সাথে আকাশও মাছ ধরছে।

অবনী জানালা দিয়ে ডাকছে ওদের কিন্তু ওরা মাছ ধরাতে এতই মশগুল কিছুই শুনতে পাচ্ছেনা।বরং আকাশ শুনতে পেয়ে অবনীর দিকে একবার তাকিয়ে আবার মাছ ধরায় মন দিলো। ওদেরকে বললো না পর্যন্ত যে অবনী ডাকছে!

অবনীর মেজাজ আবার গরম হয়ে গেলো।এই আকাশটা ঠিক আগের মত পাঁজি আছে।একটুও স্বভাব বদলায়নি।

অবনী গটগট করে দরজা খুলে নিচে নামলো লিনসা আর লিনিয়াকে নিয়ে আসার জন্য।

পুকুরের কাছে যেতেই কাকিমা কি যেন খাওয়ার লিনসা আর লিনিয়াকে ডাক দিলো।ওরা দৌড়ে চলে গেলো। অবনী আর আকাশ পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

অবনীর হঠাৎ মনে হল…কাকিমা কি তাহলে সব জেনে গিয়েছে!সে কি ইচ্ছে করেই অবনী আর আকাশকে কথা বলার সুযোগ করে দিলো তাহলে…

চলবে….

লেখনী: #নুসু

বি:দ্র: গল্পের সুবিধার্থে আর সময়ের অভাবে আর একটা পর্ব লিখতে হবে। আগামীকাল ইনশাআল্লাহ গল্পের শেষ পর্ব পাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here