#গল্প১৩৮
#সূর্যের_পারিজাত (পর্ব ১৬)-শেষ পর্ব
১.
পারিজাত বিষন্ন মনে ভাবছিল ওর ভুলটা কোথায়। এই ক’টা দিন শুধু বাসা আর কলেজ, অন্য কোথাও যায়নি। নিজেকে বার বার প্রশ্ন করেছে। সূর্যের ভালো কিছু হোক সেটা ও সবসময় চেয়েছে। কিন্তু ও এত অল্পতেই এমন হাল ছেড়ে দিল! ভাবতে ভাবতে একটা কথা হঠাৎই মনে হয়, সেদিন কোনো একটা আর্টিকেল পড়ছিল, জেল ফেরত মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার নিয়ে। অনেকগুলো সামাজিক চাপ থাকে এই মানুষগুলোর উপর। সমাজ এদের অপরাধী পরিচয়টা ভুলতে দেয় না, বার বার মনে করিয়ে দেয়। আচ্ছা, এ কারণেই কি সূর্যের মা মেহেরুন্নেসা এতদিনের পুরনো এলাকা ছাড়তে চাচ্ছেন? আশেপাশের মানুষজন নিশ্চয়ই সূর্যকে ভালো চোখে দেখে না এখন।
পারিজাতের খুব আফসোস হয়, এই দিকটা একদম ভেবে দেখেনি। এমনকি সূর্যকে এ ব্যাপারে ভালো করে জিজ্ঞেসও করেনি। এসব নিয়েই হয়তো ও মানসিক অশান্তিতে থাকে। ও সবার থেকে পিছিয়ে পড়েছে, এই ভাবনাটাও নিশ্চয়ই অস্থির করে রাখে ওকে। নাহ, একজন জেলফেরত মানুষের মনের এমন টানাপড়েন হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে পারিজাত ধৈর্য হারাবে কেন! অনেক মায়া দিয়ে মানুষটাকে যে বুঝিয়ে রাখতে হবে। এই মানুষটা ওকে বাঁচাতে জীবনের সুন্দর সময়টা অন্ধকার কারাগারে ছিল, শুধু ওর জন্য! নাহ, ভুল হয়েছে খুব। ইচ্ছে করছে এখনই ছুটে যেতে ওর প্রিয় মানুষটার কাছে। কাল রাতেই মেসেজ পেয়েছে, টাঙ্গাইলে যাচ্ছে কার সাথে যেন দেখা করতে। ইশ, কেন যে ও ফোনটা করল না।
এমন যখন ভাবছে, ঠিক তখনই পিয়ন এসে জানাল ওর একজন গেস্ট এসেছে ভিজিটর্স রুমে। পারিজাত ভ্রু কুঁচকে ভাবে ওর কাছে তো কখনো গেস্ট আসেনি এর আগে। চিন্তিত মুখে ভিজিটর্স রুমে ঢুকতেই পা টা থেমে যায়, সূর্য! কেমন বিষন্ন মুখটা। রুমটা খালি৷ অন্য কেউ আজ নেই। পারিজাত নরম গলায় ডাকে, ‘সূর্য।’
ঝট করে সূর্য মুখ তুলে তাকায়, পারিজাতের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে, কী যেন খুঁজে চোখটায়। হ্যাঁ, আছে, সেই মায়াটা আছে। সূর্য সব হারানো মানুষের মতো করে বলে, ‘পারিজাত, আজ আমার বইয়ের ২য় মুদ্রণ এর মোড়ক উন্মোচন, তুমি যাবে আমার সাথে? আমার যে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই।’
শেষ কথাটায় পারিজাতের বুকের ভেতর কেমন খালি হয়ে যেতে থাকে, সেখানে এক আকাশ মায়ার মেঘ জমা হয়। চোখের কোণে জলটা মোছে, ভেজা গলায় বলে, ‘অবশ্যই যাব।’
মেলায় যাওয়ার পথে পুরোটা সময় পারিজাত সূর্যের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে। সূর্যের বইয়ের ১ম মুদ্রণ শেষ এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে!
ওরা মেলায় পৌঁছাতেই প্রকাশক সাহাদত ভাই অনেক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। সূর্যকে আলাদা ডেকে নিয়ে বলেন, ‘ভাই, আপনি আগামি বইমেলায় কিন্তু আমাকে নতুন একটা উপন্যাস দেবেন। আর এখন, আপনার পেছনে অনেক প্রকাশক ঘুরবে, আপনি কিন্তু আমাকে ভুলে যাবেন না।’
এমন দিন আসবে, সূর্য কল্পনাও করেনি। পারিজাত ওর হাতে চাপ দিয়ে বলে, ‘কী, বলেছিলাম না, তোমার লেখা সবাই আগ্রহ নিয়ে পড়বে। একটু শুধু প্রচার দরকার ছিল।’
সেদিন ওরা রাত অবধি মেলায় থাকে, অনেকেই বই কিনতে আসে, ওদের সাথে কথা বলতে চায়। যে গল্প নিয়ে বইটা, তার মূল দুটি চরিত্র সামনেই দাঁড়ানো এটা ভেবেই মানুষ শিহরিত হয়। সেই শিহরণের ছোঁয়া ওদের দুজনের মনেও লাগে। পারিজাতের একটা কথা মনে হয়, সূর্যকে ও আর একা থাকতে দেবে না। এই ক’টা দিন দূরে দূরে থেকে শুধু শুধু কষ্ট পেল।
ফেরার পথে পারিজাত একটা সুন্দর কথা বলে, ‘সূর্য, আমরা কি আজ বিয়ে করতে পারি?’
সূর্য প্রথমে কথাটা বুঝতে পারে না, তারপর যখন বোঝে তখন বুকের মধ্যে একটা হাওয়াই মিঠাই মায়া টের পায়, গাঢ় গলায় বলে, ‘অবশ্যই পারি। কিন্তু বাবা মাকে বলবে না?’
পারিজাত মন খারাপ গলায় বলে, ‘আমার বাবা মা আসবে না আমার বিয়েতে। ওনারা বাধা দেবে না, কিন্তু মেনেও নেবে না। আমাদের একা একাই বিয়ে করতে হবে। তুমি নতুন বাসাটা দ্রুত নিয়ে ফেল, আর তোমার মাকে জানিও। আমি আর তোমাকে একা থাকতে দেব না।’
২.
পারিজাতের মনটা আজ একদম ভালো নেই। বিষন্ন মনে একটা ব্যাগ গোছাচ্ছে, প্রয়োজনীয় জিনিস যেগুলো না নিলেই না সেগুলো নিচ্ছে। কাল রাতেই বাবা মাকে বলেছিল আজ ও চলে যাচ্ছে এই বাসা ছেড়ে। বাবা শক্ত শক্ত কথা বলেছিলেন, ও ভুল করছে, যার দায় ওকেই নিতে হবে। মা অনেক কান্নাকাটি করেছেন, বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পারিজাত মনকে শক্ত করেছে, এই সময়টা আসবেই ও জানত। কিন্তু এই যে আজ যাবার সময় কেন জানি বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। বাবা মা চুপ করে বসে আছেন, কী বিমর্ষ মুখ দু’জনের! পারিজাত কাছে এসে ভাঙা গলায় বলে, ‘আমি যাই, ধ্রুব নিচে আছে। উনি দিয়ে আসবে। টেবিলে একটা কাগজে আমার নতুন বাসার ঠিকানা রেখে গেলাম।’
নিলুফার বেগম ফ্যালফ্যাল করে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আশরাফ চৌধুরী ভাবেন, কেন এত কষ্ট করে মানুষ সন্তানদের বড় করে।
৩.
পারিজাত পার্লার থেকে যখন বের হয় ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। বসন্তের মাতাল সমীরণ বইছে। ধ্রুব গাড়ি নিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। পারিজাতকে দেখে হাত নাড়ে, মেয়েটাকে কী সুন্দরই না লাগছে! একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
পারিজাত গাড়িতে উঠতেই বলে, ‘আপনি সূর্যের বাসাটা ঠিক চিনে যেতে পারবেন তো?’
ধ্রুব গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, ‘না যেতে পারলেই ভালো হতো। কিন্তু আজ যে কোনো ভুল করা যাবে না। সূর্যের কাছে পারিজাত যাচ্ছে, পৃথিবী জুড়ে আজ আনন্দের হাওয়া।’
পারিজাত বুঝতে পারে, ধ্রুবর আজ মন খারাপ। ও আজ না আসলেই ভালো হতো। কিন্তু একজন কাছের মানুষ তো দরকার ওর বিয়েতে। পারিজাত কথা ঘুরানোর জন্য বলে, ‘আচ্ছা, আপনি বিয়ে করবেন কবে?’
ধ্রুব দুষ্টুমি করে বলে, ‘আপনার বিয়েটা দিয়েই আমি বিয়ের মাঠে নেমে যাব। আপনার মতো একজন মায়াময় মানুষ খুঁজে দিতে হবে কিন্তু।’
পারিজাত একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে। মায়া জিনিসটা খুব খারাপ, কষ্ট বাড়ায় শুধু। আচ্ছা, বাবা মা কী কাঁদছে? ওর জন্য মন খারাপ করে একা একা বসে আছে?
সূর্য বাসার নিচেই দাঁড়িয়ে ছিল। ওদের গাড়িটা থামতেই ও এগিয়ে যায়। দরজা খুলে পারিজাত নামতেই মুগ্ধ চোখে ও তাকিয়ে থাকে। আমার পারিজাত আজ ফুটেছে। ওর হাত ধরে বাসায় নিয়ে যায়। ধ্রুব হাতে কয়েকটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে পেছনে পেছনে আসে।
মেহেরুন্নেসা পারিজাতকে দেখেই আলতো করে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খান। তারপর বাসার ভেতরে নিয়ে বসান। সূর্য মন খারাপ গলায় বলে, ‘পারিজাত, তুমি মন খারাপ করো না। আমাদের বিয়েতে আমরা ছাড়া আর তেমন কেউ নেই। তোমার বিয়েটা এমন নিরানন্দ হোক আমি চাইনি। আমি কথা দিলাম তোমার বাকি জীবনের প্রতিটা দিন আনন্দময় হবে।’
পারিজাত চোখ তুলে তাকায়, তারপর বলে, ‘আমি জানি, সূর্য তুমি পাশে থাকলে আমার প্রতিটা দিন আনন্দেই কাটবে।’
ধ্রুব এবার পাশ থেকে বলে, ‘আমি রাজুকে নিয়ে দেখি কাজি সাহেব কতদূর। আর কবীর স্যারও তো আসার কথা।’
ওরা বের হয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরেই কলিং বেলটা বাজে। সূর্য ভাবে ওরা বোধহয় ফিরে আসল, দরজা খুলতেই অবাক চোখে দেখে প্রকাশক সাহাদত হোসেন দুই হাত ভর্তি মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সাথে স্টলে থাকা পরিচিত একটা মুখের ছেলে। সূর্য অবাক গলায় বলে, ‘ভাই আপনি?’
সাহাদত কৃত্রিম রাগের গলায় বলে, ‘ভাই, এমন পালিয়ে পালিয়ে বিয়ে করলে হবে? আমি ঠিক খবর পেয়েছি। আমার গল্পের নায়িকা পারিজাত কই?’
কথাগুলো বলতে বলতে উনি কারো অনুমতির তোয়াক্কা না করেই বাসার ভেতরে ঢুকে পড়েন। পারিজাত এসে সালাম দিতেই সাহাদত নরম গলায় বলে, ‘এমন একটা আনন্দের দিন না এসে পারলাম না। আর এই নাও তোমার বিয়ের উপহার, আমার পক্ষ থেকে।’
সাহাদত একটা চেক এগিয়ে দিতেই পারিজাত দেখে সূর্যের নামে একটা তিন লক্ষ টাকার চেক। সূর্যও কাছে এসে টাকার পরিমাণ দেখে অবাক গলায় বলে, ‘এত টাকা!’
সাহাদত হোসেন বলে, ‘আরে এইটা তোমারই টাকা। ভাবলাম আজকে মোক্ষম সময় এই টাকাটা দেবার। তোমার বই তিন হাজার কপি বিক্রি হয়েছে, নতুন লেখক হিসেবে অনেক। এই বইয়ের রয়্যালিটি হিসেবে দুই লাখ টাকা দিলাম আর সামনে যে উপন্যাসটা লিখবা তার জন্য এক লাখ টাকা এডভ্যান্স।’
সূর্য ভাবে ও কী সত্যি শুনছে! পারিজাত আনন্দিত গলায় বলে, ‘বাহ, এ তো দারুণ খবর। আপনি এসেছেন খুব খুশি হয়েছি।’
সূর্য মাকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেয়। সাহাদত এবার মেহেরুন্নেসার সাথে গল্প করতে করতে পুরো বাসাটা ঘুরে দেখেন। তারপর বলেন, ‘শোন, আমি যা দেখলাম তোমাদের নতুন সংসারে ফ্রিজটা জরুরি। আমার পক্ষ থেকে এটাই বিয়ের গিফট, তোমরা কিন্তু আবার ফ্রিজ কিনে ফেল না।’
পারিজাত অবাক গলায় বলে, ‘কিন্তু আপনি তো এইমাত্র তিন লাখ টাকা গিফট দিলেন। তাহলে আবার ফ্রিজ কেন?’
সাহাদত হেসে বলে, ‘আরে ওইটা তো সূর্যের পাওনা টাকা। এইটা আমি গিফট দিলে মানুষ আমারে কঞ্জুস বইলা গালি দেবে।’
ওনার কথায় সবাই হেসে ওঠে।
একটু পর ধ্রুব আর রাজু চলে আসে, সাথে কাজি সাহেব। উনি এসে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো লিখে নেন। সব শেষে যখন পারিজাতকে সই করতে বলে, পারিজাতের ভীষণ মায়ের মুখটা মনে পড়ে। বাবার বিষন্ন মুখটা মনে পড়তেই বুকটা মুচড়ে ওঠে। একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘সূর্য, আমি একটু বাবাকে ফোন দিতে চাই।’
সূর্য নরম গলায় বলে, ‘অবশ্যই পারিজাত। তুমি ফোন দাও।’
পারিজাত ফোনটা নিয়ে বারান্দায় যায়, তারপর কাঁপা হাতে বাবার নাম্বারে ফোন দেয়, কান্না কান্না গলায় বলে, ‘বাবা, তুমি আসবে না? তোমার ছোট্ট পারিজাতের যে আজ বিয়ে। জানো তো আমি কেমন জেদি ছোটাকাল থেকে। কিন্তু তুমি তো আমার সব জেদ প্রশ্রয় দিতে। তুমি যদি এমন মুখ ফিরিয়ে রাখো, আমি কার সাথে জেদ করব, বলতে পারো? আমার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বাবা। খুব একা লাগছে, আসবে না বাবা?’
আশরাফ সাহেব হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন, পাগলের মতো বলেন, ‘মাগো, আমি এখনই আসতেছি। তুই যে আমার ছোট্ট পারিজাত, তুইই তো আমার সাথে জেদ করবি, আবদার করবি। আমি এতদিন একটা ভুলের মাঝে ছিলাম। আমার পারিজাত কখনোই ভুল করতে পারে না। আমার ছোট্ট পারিজাতের আজ বিয়ে, আজ যে আমার অনেক আনন্দের দিন। আমি আসছি মাগো, তোর মাকে নিয়েই আসছি।’
সূর্য আলতো করে পারিজাতের পিঠে হাত রাখতেই পারিজাত মুখ ফিরিয়ে ওর বুকে ভেতর ঢুকে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘বাবা মা আসছেন। আমার বাবা আসছেন সূর্য, আমার বাবা!’
সূর্য আবেগটা টের পায়। একটা মানুষের কাছে তার বাবা মা কত যে মূল্যবান উপহার সেটা ও জানে। বাবা হারানোর পর আজ এতদিনেও ও বাবার মুখটা ভুলতে পারেনি। পারিজাতকে বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে।
ইতিমধ্যে খবর রটে গেছে পারিজাতের বাবা মা আসছেন। সবার চোখেমুখে একটা দারুণ স্বস্তি। মেহেরুন্নেসার বুক থেকে একটা পাথর নেমে যায়, এটা খুব ভালো হলো। তা না হলে পারিজাত সারাজীবন কষ্ট পেত। একজন মেয়ে হিসেবে এটা উনি আরো ভালো করে জানেন।
ধ্রুব দুষ্টুমি করে বলে, ‘বিয়ের কন্যারে তো আবার পার্লারে নিতে হবে। কেঁদেকেটে যে সব সাজগোজ নষ্ট হয়ে গেছে।’
পারিজাত একটু লজ্জাই পায়। মেহেরুন্নেসা ওকে নিয়ে যান, বলেন, ‘আয়, একটু ঠিকঠাক হয়ে নি। তোর মা এসে যদি দেখে তোর এমন হাল তাহলে আমাকে ছাড়বে না।’
সূর্য শুধু অবাক হয়ে দেখে কেমন করে ওর নিরানন্দময় বিয়েটা আনন্দে পালটে যাচ্ছে। সবাই কত খুশি।
পারিজাতের বাবা মা যখন আসে ততক্ষণে রাত দশটা বেজে গেছে। পারিজাতের সাজগোজ আবার নষ্ট হয়, এই মেয়েটা এত কাঁদতে পারে! এত কান্না কই লুকিয়ে ছিল এতদিন।
নিলুফার বেগম সূর্যের হাতে আংটি পরিয়ে দেন। আর আশরাফ সাহেব পকেট থেকে একটা ঘড়ি বের করে ওর হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বলেন, ‘বাবা, আমাকে ক্ষমা করো। আমি স্বার্থপরের মতো শুধু পারিজাতকে নিয়েই ভেবেছি। কিন্তু সেদিন তুমি ওকে না বাঁচালে আমি যে সন্তানহারা হতাম সেটা মাথায় আনিনি। পারিজাতের জন্য তোমার জীবনটা পিছিয়ে গেল, তোমার মা একা একা যুদ্ধটা করলেন। আমি ভীষণ লজ্জিত, আমাকে ক্ষমা করো পারলে। আজ থেকে আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। তুমি ভেব না, তোমার মতো সাহসী মানুষ জীবন যুদ্ধে জিতবেই। ।’
একটা ভালো লাগা ছুঁয়ে যায় সূর্যকে, কতদিন পর বাবার মতো কেউ ওর পাশে দাঁড়ানোর কথা বলল। মেহেরুন্নেসা চোখ মোছেন, তারপর ধরা গলায় বলেন, ‘বাবা হিসেবে আপনি যা করেছেন তাতে দোষের কিছু নেই। আপনি যে সূর্যকে এমন আপন করে নিলেন তাতে আমার মনের যেটুকু খেদ ছিল তা আজ পুরোই মিটে গেল। আমরা সবাই মিলে সূর্য আর পারিজাতের জীবনটা ঘিরে রাখব যাতে ওরা আর কষ্ট না পায়।’
বিয়েটা হয়ে যায়। পারিজাত এবার সই করতে আর দেরি করে না। সবাই খুব হই হুল্লোড় করে। ধ্রুবই প্রস্তাবটা রাখে, ‘সবার রাগ যখন মিটে গেল তখন একটা বড়সড় অনুষ্ঠান করতেই হবে। আমরা সবাই মিলে কবজি ডুবিয়ে বিয়ের খাবার খাব তখন।’
ওর কথাতে সবাই হেসে ওঠে।
সবাই বিদায় নিতে নিতে রাত একটা বেজে যায়। মেহেরুন্নেসা ওদের দু’জনকে নিয়ে ফুলে ফুলে সাজানো ঘরটায় ঢোকেন। পারিজাতের কেন জানি ভীষণ লজ্জা লাগছে এখন, মুখটা তুলতেই পারছেন না। মেহেরুন্নেসা পারিজাতের কপালে চুমু দিয়ে বলে, ‘মাগো, আজ থেকে সূর্যের সব দায়িত্ব তোমার। অবশ্য তুমি অনেক আগে থেকেই এই দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছ। আজ থেকে আমি সত্যিই মুক্ত।’
পারিজাত মায়ের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলে, ‘না মা, আপনি মুক্ত না। আপনার দায়িত্বও কমে যায়নি, বরং বেড়েছে। আজ থেকে আপনার দুটো সন্তান, তাই দায়িত্ব আরো বাড়ল। আমাদের আপনি দেখেশুনে রাখবেন।’
মেহেরুন্নেসার বুকটা ভরে যায়। পারিজাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘শুনলি তো, আজ থেকে ও কিন্তু আমার মেয়ে। কখনো যদি ওকে কষ্ট দিছিস তখন দেখবি আমি তোকে কেমন শাস্তি দেই।’
সূর্য দুষ্টুমি করে বলে, ‘বাহ, দু’জনে মিলে আমাকে শাস্তি দেবার পাঁয়তারা। আচ্ছা, কথা দিলাম, আপনার মেয়েকে কষ্ট দেব না।’
মেহেরুন্নেসা হাসেন, তারপর বলেন, ‘আচ্ছা, আমি ঘুমোতে যাই।’
মা চলে যেতেই সূর্য এবার পারিজাতকে হাত ধরে খাটে বসায়। তারপর দুষ্টমি করে বলে, ‘দেখি, আমার বউটার মুখটা।’
সূর্যের মুখে বউ শব্দটা শুনতেই কেমন রিমঝিম করে উঠে পারিজাতের বুকের ভেতরটা। একটা ভালো লাগা নিয়ে তাকাতেই সূর্য বলে, ‘পারিজাত, এমন করেই আমার পাশে থাকবে তো সারাজীবন? শুধু আমাকেই ভালোবাসবে তো?
পারিজাত গাঢ় গলায় বলে, ‘পারিজাত শুধু সূর্যের জন্যই ফোটে, সূর্যের স্পর্শেই তার ভালোবাসা পূর্ণতা পায়।’
সূর্য আর পারিজাত এক নতুন পৃথিবীতে পা রাখে যেখানে হয়তো অনেক নির্মম বাস্তবতা আছে যা ওরা ইতিমধ্যেই পার হয়ে এসেছে। জীবনের আঘাতগুলো ওদের ভালোবাসার বন্ধনকে শুধু আরো দৃঢ়ই করেছে। ওদের এমন সুন্দর ভালোবাসার গল্পটা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ুক হৃদয়বান মানুষদের হৃদয়ে।
(সমাপ্ত)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
১১/০৩/২০২২
Valobasi sudhu mukhe bollei hoyna valobasar manusher jonno nijer sobtuku diye somosto porisththitai tar pashe thaka tai asol valobasa jeta amader lekhok khub sundor vabe golpe futiye tule6en .khub e valo laglo golpota