কোথাও_কেউ_নেই ৮.
হুমায়ুন আহমেদ
স্কুল টিচারদের বাড়ি যে রকম থাকে বেহানা আপার বাড়ি সে রকম নয়। বাড়ি দেখেই মনে হয়। স্কুল মাস্টারি তিনি সখের জন্যে করেন! মুনা অবাক হয়ে চারদিক দেখতে লাগল; ভালী ভারী সোফা। লাল কাঁপেট ঝকমক করছে। দেয়ালে কামরুল হাসানের ছবি। তিনটি মেয়ে নদীতে নাইতে নেমেছে। রেহানা আপা বললেন অরিজিনাল পেইনটিং; মুনা বলল। চমৎকার তো।
উনি আমাদের দূর-সম্পর্কের আত্মীয় হন। বাসায় প্রায়ই আসেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তুমি চা-টা কিছু খাও।
জি না। আমার শবীর ভাল না। গলাব্যথা। রেহানা। আপা সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহী হলেন।
টনসিল নাকি?
জি।
এক গ্রাস গরম পানির মধ্যে কয়েক দানা লবণ আর পেয়াজের রস দিয়ে গার্গল কর, দেখবে সেরে যাবে।
জি আচ্ছা করব।
এখানেই করা, আমি এনে দিচ্ছি।
মুনা না বলবার সময় পেল না। রেহানা। আপা ভেতরে চলে গেলেন। মুনা বসে রইল একা একা। এ বাড়িতে অনেক লোকজন। কিন্তু কেউ বসবার ঘরে উঁকি দিচ্ছে না। তবে বেশ কয়েকবারই টের পাওয়া গেল পর্দার ওপাশে কৌতূহলী মেয়েরা উঁকি দিচ্ছে! কৌতূহলের কারণটি স্পষ্ট হচ্ছে না! তারা কী জেনেছে সে বকুলের বোন; যার সঙ্গে এ বাড়ির কোনো একটি ছেলের বিয়ের কথা প্রায় পাকাপাকি! সে কথাও জানার কথা নয়। মুনা শুধু রেহানা। আপাকেই বলেছে আমি বকুলের বোন। আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। তিনি নিশ্চয়ই সে কথা বাড়ির ভেতরে সবাইকে বলেননি। তাকে সে রকম মনে হয় না।
মুনাকে গার্গল করতে হল। অপরিচিত কোনো বাড়িতে বেড়াতে এসে শব্দ করে গার্গল করা খুব অস্বস্তিকর। কিন্তু উপায় নেই, রেহানা। আপা পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন, এখন একটু আরাম লাগছে না?
জি লাগছে।
এস, আমরা বসার ঘরে না বসে অন্য কোথাও বসি।
চলুন।
রেহানা আপা তাকে দোতলার বায়ন্দায় নিয়ে এলেন। চমৎকার বারান্দা। ছবির মত সাজানো। ধবধবে সাদা বেতের চেয়ার। ছোট্ট একটা লেতের টেবিল। এই সাত সকালে ও টেবিলের ফুলদানিতে টাটক৷ ফুল রাখা হয়েছে। রোজই কী এ রকম রাখা হয়? রেহানা। আপা বললেন বল কী বলবে? মুনা ইতস্তত করতে লাগল। কীভাবে কথাটা শুরু করা যায় বুঝতে পারল না।
কোনো রকম সংকোচ বা লজ্জা করবে না। বল।
বকুলের ঐ বিয়েটার ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছিলাম। আমার মামা-মমিব খুধ আগ্রহ।
আমাদেরও আগ্রহ। তোমার বোন মেয়েটি ভাল। একটু বোধ হয় বোকা। সেটাও ভাল। বোকা মেয়েরা বৌ হিসেবে ভাল হয়।
মুনা তাকিয়ে রইল। এই নিয়ে আলাপ চালিয়ে যেতে তার ইচ্ছা হচ্ছে না। তবু সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আপনারা একবার বলেছিলেন, পনেরো দিনের মধ্যে কাবিনের ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে চান।
হ্যাঁ তা চাই।
আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আপনারা যখন বলবেন তখনই আমরা রাজি আছি।
রেহনা আপা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন একটা বড় রকমের প্রবলেম হয়েছে। তোমার সঙ্গে খোলাখুলি বলি; বকুলের বাবা শুনলাম অ্যারেস্ট হয়েছে। কথাটা বোধ হয় সত্যি। সত্যি না?
জি। ওঁকে একটা মিথা মামলায় জড়িয়েছে।
সেটা তুমি জানো এবং আমরা জানি। কিন্তু অন্যরা তো জানে না। তারা নিজেদের মত করে ঘটনাটা ব্যাখ্যা করবে! করবে না?
জি করবে।
ব্যাপারটা কী রকম সেনসেটিভ বুঝতে পারছ। পারছ না?
পারছি!
ধর, তোমার নিজের একটি ছেলের তুমি বিয়ে দিচ্ছি। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ দেখলে মেয়ের বাবাকে পুলিশ চুরির দায়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কেমন লাগবে তোমার?
আপ ওটা একটা মিথ্যা মামলা। বিশ্বাস ককোনা!
বিশ্বাস করব না কেন? বিশ্বাস করছি। চা খাও, দাঁড়াও চা দিতে বলি।
মুনা না বলবার আগেই রেহানা আপা চা আনতে ভেতরে চলে গেলেন। ফিরে এলেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে! চা বোধ হয় তৈরিই ছিল। শুধু চা নয় সঙ্গে প্রচুর খাবার-দাবার।
বেহানা আপা অন্তিরিক স্বরে বললেন, খাও কিছু খাও। আমার বাড়ি থেকে কেউ না খেয়ে যেতে পারে না! মুনা ক্ষীণ স্বরে বলল বিয়েটা তাহলে হবে না?
না। তারা অন্য মেয়ে দেখেছে। কথা ও মোটামুটি পাকা করে ফেলেছে।
ও।
দিনাজপুরের মেয়ে। হোম ইকনমিক্সের ছাত্রী। বাবা রিটায়ার্ড সেশন জজ।
মুনা কিছু বলল না। রেহানা আপা বললেন বকুলের বিয়ে নিয়ে চিন্তা করবে না। ওর বিয়ে আমি দিয়ে দেব। এই ছেলের চেয়েও অনেক ভাল ছেলে জোগাড় করব।
কী ভাবে করবেন? ওরাও নিশ্চয়ই বাবা সম্পকে জানতে চাইবে।
তা চাইবে। কিন্তু এ সব কথা লোকজন বেশি দিন মনে রাখে না। প্রথম কিছু দিন খুব হৈচৈ হয়, তারপর সবাই ভুলে যায়।
মুনা বলল আমি উঠি।
একটু বস।
আমার অফিসে যেতে হবে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
না দেরি হবে না। আমার এক ননদ গাড়ি নিয়ে এসেছে, তাকে বলেছি সে তোমাকে পৌঁছে দেবে।
মুনা বসে রইল। রেহানা আপা বললেন কেইস শুরু হবে কবে?
খুব শিগগিরই শুরু হবার কথা।
ভাল উকিল দিয়েছ তো?
দিয়েছি।
আমার নিজের জানাশোনা কিছু উকিল আছে। আমি বললে ওরা বিনা ফিতে মামলা দেখে দেবে। বলব?
তার দরকার নেই।
বকুল স্কুলে আসে না অনেক দিন থেকে। ওকে স্কুলে আসতে বলবে। পরীক্ষাব ডেট দিয়ে দিয়েছে।
মুনা বিস্মিত হল। বকুল স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে তার জানা ছিল না। রেহানা আপা বললেন, বাবা কী করেছে না করেছে তার জন্যে মেয়ে কেন লজ্জিত হয়ে ঘরে বসে থাকবে? তুমি খুব কড়া করে ধমক দিয়ে তাকে স্কুলে পাঠাবে।
জি আচ্ছা!
মুনাকে দিয়ে আবার তিনি গার্গল করালেন; এবং সত্যি সত্যি তার গলাব্যথা অনেকখানি কমে গেল!
সে অফিসে ঢুকল ভয়ে ভয়ে; গত দু’দিন নানান ছোটাছুটিতে অফিসে আসা হয়নি। ঘন ঘন কামাই হচ্ছে। বড় সাহেবের কানে উঠেছে নিশ্চয়ই। নিজের জায়গায় বসে মুনার ধারণা আরো দৃঢ় হল। সবাই তাকাচ্ছে তার দিকে। পাল বাবু এসে বললেন বড় সাহেব খোঁজ করেছিলেন। আপনাকে।
কবে?
পরশু খোঁজ করলেন। কাল খোঁজ করলেন। আমরা বলেছি অসুস্থ!
কি জন্যে খোঁজ করেছেন জানেন?
না! যান জেনে আসুন! স্যার আছেন।
মুনা ঠাণ্ডার মধ্যে ঘামতে লাগল।
বড় সাহেব শুকনো গলায় বললেন বসুন, দাড়িয়ে কেন?
মুনা বসল। এই ঘরটায় ঢুকলেই তার এমন অস্বস্তি লাগে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সব সময় মনে হয় এক্ষুণি এই ছোটখাটো লোকটি চেঁচিয়ে উঠবে। যদিও কোনো সমযই তিনি তা করেন না।
শরীর খারাপ ছিল?
জি না স্যার, একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছি। খুব ছোটাছুটি করতে হচ্ছে।
ঝামেলাটা কী বলুন? অবশ্যি যদি আপত্তি না থাকে। আপনার ঝামেলার জন্যে অফিসের কাজকর্মের ক্ষতি হচ্ছে। কাজেই আপনার সমস্যা জানার রাইট আমার আছে।
মুনা রুমাল দিয়ে কপালেব ঘাম মুছল এবং ক্ষীণ স্বরে তার মামার কথা বলল। বড় সাহেব চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানতে লাগলেন। তার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তিনি কিছু শুনছেন না কিন্তু মুনা জানে তিনি খুব মন দিয়েই শুনছেন।
আপনিই সব দেখাশোনা করছেন?
জি।
বাড়িতে পুরুষ মানুষ কেউ নেই? আছে স্যার; আমার ছোট ভাই। খুব ছোট। ক্লাস সেভেনে পড়ে।
মামলাটা শেষ হতে কতদিন লাগবে?
উকিল সাহেব বলেছেন এক মাসের মত লাগবে।
বড় সাহেব সিগারেট অ্যাসট্রেতে গুঁজে রাখলেন। গম্ভীর গলায়, আপনি মেডিক্যাল গ্রাউণ্ডে এক মাসের ছুটির দরখাস্ত করুন; আমি ব্যবস্থা করে দেব। নিজের সমস্যা ভালমত মেটান।
মুন্না ক্ষীণ স্বরে বলল, থ্যাংকয়্যু স্যার।
বড় সাহেব সহজ গলায় বললেন, আমরা বাবা মারা যান যখন আমরা সবাই খুব ছোট। সেই সময় আমার বড় বোন শুধু এম.এ. পড়তেন। তিনি একটা চাকরি নেন! নানান রকম ঝামেলার মধ্যে দিয়ে আমাদের বড় করতে থাকেন। তিনি কোনোদিন ঠিকমত অফিসে যেতে পারতেন না। প্রাযই অফিস কামাই হত। তার বস প্রতি সপ্তাহেই বলতেন, তোমার চাকরি শেষ। আগামীকাল থেকে আর আসবে না।
মুনা চুপ করে রইল। বড় সাহেব দ্বিতীয় সিগারেট ধরিয়ে হাসি মুখে বললেন, কিন্তু ওটা ছিল মুখের কথা। ঐ বড় সাহেব একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান করলেন এই অজুহাতে যেন আমার আপা ভালমত অফিসের কাজে মন দিতে পারেন। সবাই বলে মানুষের খারাপ সময়ে কাউকে পাশে পাওয়া যায় না। কথাটা ঠিক না। মানুষকে পাশে পাওয়া যায় দুঃসময়ে। আচ্ছা আপনি যান।
স্যার স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। যদি কখনো মনে করেন আমাকে দিয়ে কিছু করানো সম্ভব, জানাবেন। আমি করব।
অফিসের বাইরে এসে মুনা চোখ মুছল। বড় সাহেবের এই সামান্য কথা তাকে অভিভূত করেছে। মাঝে মাঝে আমরা অতি অল্পেই অভিভূত হই। নিজের টেবিলে ফিরে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তারেক এসে উপস্থিত। তার মুখ হাসি হাসি। যেন খুব মজার একটা ঘটনা ঘটেছে। তারেক খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, আপনাকে একটা খবর দেয়া হয়নি, আমি বিয়ে করেছি।
সে কি! কবে?
হুট করে হয়ে গেল। গত পরশু। মায়ের অসুখ শুনে দেখতে গিয়েছিলাম, গিয়ে এই কাণ্ড। তারেক লজ্জিত ভঙ্গিতে মানি ব্যাগ থেকে ছবি বের করল। লম্বা রোগা একটি মেয়ে। মিষ্টি চেহারা। তারেক মৃদু স্বরে বলল, অফিসে আপনিই প্রথম জানলেন, আর কাউকে বলিনি। মুনা অস্পষ্ট স্বরে বলল, খুব সুন্দর বউ হয়েছে।
ছবিতে যত সুন্দর দেখা যাচ্ছে, তত সুন্দর সে না। ফটো জিনিক ফেস আর কী। নাম হচ্ছে তনিমা।
সুন্দর নাম।
ডাকনামটাই সুন্দর। ভাল নাম শুনলে চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠবেন। হা হা হা।
তারেক বেশ শব্দ করে হাসতে লাগল। একজন সুখী মানুষের হাসি। দেখতে ভাল লাগে।
তুমি মনে হয় খুব খুশি?
তা বলতে পারেন। আপনাদের বিয়েটা কবে হচ্ছে আপা?
বুঝতে পারছি না।
শুধু শুধু বঝুলিয়ে রাখবেন না। দি আরলিয়ার দি বেটার।
বিয়ে করার পর এ রকম মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ তা হচ্ছে।
বিয়ের ব্যাপারটা তাহলে খুব খারাপ না?
তারেক মৃদু হাসল। মুনা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। অস্পষ্ট ভাবে তার মনে হল মামুন কী তার কাছে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? কী করছে সে এখন গ্রামে? একটা চিঠি লিখবে নাকি? চিঠি লেখার ইচ্ছা দীর্ঘস্থায়ী হল না। প্রচুর কাজ জমে আছে।
শওকত সাহেব সকাল থেকে বসে আছেন। উকিল খুব ব্যস্ত, সময় দিতে পারছেন না। বাকের শওকত সাহেবের পাশেই বসে আছে। মাঝে মাঝে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট টেনে আসছে। একবার মুহুরি বলে এল আমাদের একটা কাজ আছে ভাই, কাইন্ডলি একটু দেখেন না। মুহুরি তাকে পাত্তাই দিল না। বাকের একবার ভাবল গরম দেখাবে। কিন্তু জায়গা খারাপ, গরম দেখানো ঠিক হবে না। ডাক্তার এবং উকিল। এই দুজায়গায় গরম দেখানো যায় না।
মামা, চা খাবেন?
শওকত সাহেব হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না।
চলুন গলাটা ভিজিয়ে আসি, দেরি হবে মনে হয়। মারাত্মক উকিল। ভিড়টা কেমন দেখলেন। বিকালের আগে চান্স পাওয়া যাবে না।
শওকত সাহেব চা খেতে গেলেন না। একা একা বসে রইলেন। তার খুব-একটা খারাপ ও লাগছে না। এমনিতেও তো বসেই থাকতেন। অফিস-টফিসের ঝামেলা তো আর নেই। অবশ্যি গতকাল অফিসে গিয়েছিলেন। কোনো কাজের যাওয়া না, এমনি হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হওয়া একুশ বছরের অভ্যাস চট করে ছাড়া মুশকিল। তাকে দেখে সাধারণ ভাবে একটা মৃদু উত্তেজনা হল। শমসের আলি হঠাৎ খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে দু’হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন আরে শওকত ভাই যে, আসেন আসেন। চেঁচানোটা এত উঁচু স্বরে হল যে অফিসের সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।
কোনো কাজে এসেছেন নাকি?
নাহ। ‘কাজ থাকলে বলেন। এতদিনের সম্পর্ক এক কথাম শেষ কবে দিলেন। এটা একটা কথা হল? শমসের আলি জোর করে তাকে কান্টিনে নিয়ে গেলেন। হঠাৎ করে এই লোকটির এরকম দরদী হয়ে ওঠার কারণ তার কাছে স্পষ্ট হল না।
তারপর বলেন মামলার তদ্বির কেমন চালাচ্ছেন?
চালাচ্ছি।
ঢিল দেবেন না। একটু ও ঢিল দেবেন না। নেন সিগারেট নেন।
শওকত সাহেব সিগারেট নিলেন। শমসের অ্যালি গলা অনেকখানি নিচু করে বললেন ভেতরের খবর, দেই একটা, সাদেক সাহেবের বিবরুদ্ধে মামলা উইথড্র করা হচ্ছে। আগে তে{ দুজনের বিরুদ্ধে চার্জ ছিল। এখন শুধু আপনার বিবরুদ্ধে।
তাই নাকি?
গুজবটা এ রকমই; গত মঙ্গলবারে সাদেক সাহেব অফিসে এসেছিলেন খুব হাসি হাসি মুখ। বিপদ আসে গবিবোর উপরে, বড় ই-কাতলা পার পেয়ে যায়।
শওকত সাহেব কিছু বললেন না। শমসের আলি নিচু গলায় কথা চালিয়ে যেতে লাগলেন। একজনকে উইথড্র করা মানে কেইস দুর্বল করা। চোখ বন্ধ করে ঘুমান, খালাস পেয়ে যাবেন। শুধু খালাস না। চাকরি ও ফেরত পাবেন। নাইন্টি নাইন পারসেন্ট গেরান্টি।
শওকত সাহেব প্রায় তিন ঘণ্টার মত সমযঃ বিন! কারণে অফিসে বসে ক{ট1লেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন সবাই খুব অস্বস্তি বোধ করছে, তবু তার চলে যেতে ইচেছু করছিল না;
তাঁর চেয়ারে নতুন একটি ছেলে এসেছে। প্রথম চাকরিতে ঢুকেছে বোধ হয়। কিছুই জানে না। বার বার চেয়ার ছেড়ে উঠে অন্যদের জিজ্ঞেস করছে। এইসব অল্প বয়সী ছোকড়া দিয়ে কাজ হয়? ফাইলিং শিখতেই এক বছর লাগবে।
উকিল সাহেবের কাছে তাদের ডাক পড়ল একটার দিকে। উকিল সাহেব টিফিন-ক্যারিয়ার খুলে আলু ভাজা এবং পরোটা খাচ্ছেন। এত নামী ডাকি একজন মানুষ আলুভাজা এবং পরোটা দিয়ে লাঞ্চ খায় শওকত সাহেবের ধারণা ছিল না। উকিল সাহেব দরজা গলায় বললেন বসেন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বাকের হাত কচলে বলল, স্যার ভাল আছেন?
ভালই আছি।
আমাদের কেউসটা দেখেছেন?
হ্যাঁ দেখলাম। কনভিকসন হবে না। নিশ্চিন্ত থাকেন। এই কেইসে যদি আমার ক্লায়েন্টের কনভিকসন হয় তাহলে তো আমাকে ওকালতি ছেড়ে কাঠমিস্ত্রি হতে হবে। হা হা হা।
উকিল সাহেবের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বাকেরও হাসল। সে মুগ্ধ। শওকত সাহেব ক্ষীণ স্বরে বলল, চাকরি ফিরে পাব?
কনভিকসন না হলে নিশ্চয়ই ফিরে পাবেন। কনভিকসন না হওয়ার মানে হল আপনি অপরাধী নন। যে অপরাধী না তার চাকরি থাকবে না কেন? তবে ওলা যদি কোর্টে না এসে ডিপার্টমেন্টাল অ্যাকশন নিত, তাহলে চাকরি থাকত না। ওরা সেটা নেয়নি। কোর্টে এসেছে। আপনার জন্যে শাপে বর হয়েছে। কোনো রকম দুঃশ্চিন্তা করবেন না। ভরসা রাখেন আমার ওপর।
বাকের দাঁত বের করে বলল, আপনার ওপরই স্যার ভরসা। নব্বই পারসেন্ট ভরসা আপনার ওপর। আর দশ পারসেন্ট আল্লার ওপর।
উকিল সাহেব বাকেরের কথা পছন্দ করলেন বলেই মনে হয়। তিনি তার পান খাওয়া কালো কালো দাঁত বের করে হো হো করে হাসতে লাগলেন। যেন খুব-একটা মজার কথা।
বকুল অনেকদিন পর টিনা ভাবীর বাসায় এসেছে। আড়াইটা বাজে। বেড়াতে আসার মত সময় নয়। কিন্তু টিনা ভাবীর বাসায় তার অসময়ে আসতেই ভাল লাগে। বকুল কড়া নেড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। দরজা খুলল এক অপরিচিত মেয়ে। টিনা ভাবীর বোন হবে। তার মত দেখতে।
টিনা ভাবী আছে?
আছে। ঘুমাচ্ছে।
বকুল সরাসরি শোবার ঘরে ঢুকে গেল। টিনা ঘুমাচ্ছিল না। শেষ পর্যায়ে এসে সে খুব কাহিল। হয়ে পড়েছে। চিৎ হয়ে ছাড়া ঘুমুতে পারে না। কাত হয়ে শুলেই মনে হয় পেট শরীর থেকে খসে আসবো। সে বিরক্ত স্বরে বলল, বকুল তুই কী মনে করে?
কেমন আছ ভাবী?
জিজ্ঞেস করতে লজ্জা লাগে না? এত দিন পর তুই কী মনে করে এলি?
আসতে ইচ্ছা করছিল না ভাবী। কোথাও যাই না। আমি স্কুলেও যাই না।
তোব বাবা দোষ করেছে, তুই তো করিসনি?
বাবা কিছু করেনি।
তোদের আচার-আচরণে তো এরকম মনে হয় না। ঐ দিন বাবু যাচ্ছিল বাসার সামনে দিয়ে। আমি এত ডাকলাম, সে ফিরে ও তাকাল না। এ রকম ভাব করল যেন শুনতে পায়নি।
বকুল প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বলল, তোমার পেট তো ভাবী হিমালয় পর্বতের মত হয়ে গেছে।
তা হয়েছে। আগে ভেবেছিলাম যমজ এখন মনে হচ্ছে। যমজ না, তিনজন বাস করছে। তিন বাচ্চাকে কী বলে ত্রিমজ?
বকুল খিলখিল কবে হেসে ফেলল। বহুদিন এমন প্ৰাণ খুলে সে হাসেনি। সে সন্ধ্যা পর্যন্ত টিনা ভাবীর সঙ্গে থাকল। বাচ্চাদের জন্যে কাঁথা বানানো হল খানিকক্ষণ। খানিকক্ষণ ছাদে বসে গল্প হল। তেঁতুল এবং কাঁচা কলার ভর্তা বানিয়ে মহানন্দে খাওয়া হল। এ বড় সুখের সময়।
টিনা একসময় বলল, তুই একবার আমার সঙ্গে সারাবাত থাকবি। রাত জেগে গল্প করব।
কী গল্প?
কিছু কিছু গল্প রাতেই করতে হয়; সেই সব গল্প।
টিনা রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। বাড়ি ফেরার আগে বকুল হঠাৎ নিচু স্বাবে বলল। আচ্ছা ভাবী, যদি কোনো মেয়ের কোনো ছেলেকে ভাল লাগে তাহলে তার কী করা উচিত? ধর ছেলেটাব মেয়েটাকে ভাল লাগছে না। শুধু মেয়েটারই লাগছে।
টিনা বেশ কিছু সময। চুপ চাপ থেকে বলল মেয়েটা যদি তোর মত সুন্দরী হয় তাহলে তার উচিত এক’দিন ভাল লাগার ব্যাপারটি ছেলেটিকে বলা;
আর যদি আসুন্দধ হয়?
টিনা জবাব দিল না। সহজ ভাবেই অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে এল।
তোর বিয়ের কী হল?
কিছু হয়নি। এর জন্যে কী তোর মন খারাপ?
নাহ।
বকুল বাড়ি ফিরল মন খারাপ কবে। যদিও মন খারাপ করার মত কিছুই ঘটেনি সেখানে।
বাবু আজি স্কুলে যায়নি।
অথচ সকাল বেলা বই-খাতা নিয়ে বের হয়েছে। স্কুলের গোট পর্যন্ত গিয়ে নান্টুকে বলল আমার মাথা ধরেছে, আজ যাব না। অথচ তার মাথা ধরেনি।
সে অন্যমনস্কভাবে এদিক-ওদিক খানিকক্ষণ ঘুরল। স্কুলের লাগোয়া মিউনিসিপ্যালিটির একটি শিশু পার্ক আছে। সেখানে বসে রইল একা একা। এখান থেকে স্কুলের ঘণ্টার শব্দ শোনা যায়। সেকেন্ড পিরিয়ড শেষ হবার ঘণ্টা শুনে সে পার্ক থেকে বেরুল।
রাস্তার পাশে একজন বুড়ো মানুষ ম্যাজিক দেখিয়ে নিম টুথ পাউডার বিক্রি করছিল। সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখল। পুরনো ধরনের ম্যাজিক। চারটা হরতনের বিবি চারটা টেক্কা হয়ে যায়। দড়ি মাঝখানে কেটে রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখার পর সেই দড়ি জোড়া লেগে যায়। এই সব হাবিজাবি। বুড়োটা যখন বলল বাচ্চা লোগ তালি লাগাও। তখন সে চলে এল। ছেলে-বুড়ো সবাই মহানন্দে তালি দিচ্ছে, তার তালি দিতে ইচ্ছা করছে না।
হঠাৎ করে তার মন খারাপ লাগছে। বাবুর ইচ্ছা করল হেঁটে হেঁটে অনেক দূরে কোথাও চলে যায়। দূরের সেই অচেনা দেশে থাকবে শুধু অপরিচিত মানুষ। কেউ তাকে চিনবে না। সেও চিনবে না। কাউকে। কেউ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের স্ত্রীর মত জিজ্ঞেস করবে না তোমাদের সংসার এখন কে চালাচ্ছে বাবু? কিংবা আলমের বাবার মত কেউ বলবে না তোমরা নাকি এই বাসা বদলি করছ? সত্যি নাকি?
বাবুর ইচ্ছে হচ্ছিল বলে, আমরা এ বাড়ি ছাড়লে আপনার কী? কিন্তু সে কিছু বলেনি। সে মুনা আপার মত না। কারো মুখের ওপর সে কথা বলতে পারে না। শুধু চাপা একটা রাগ হয়। রাগের জন্যে মাথা ধরে যায়। প্রথম দিকে অল্প অল্প ধরে, তারপর যন্ত্রণাটা বাড়তে থাকে। ধ্বক ধ্বক শব্দ হয়ে মাথায়। পুলের উপর ট্রেন গেলে যে রকম শব্দ হয় সে রকম শব্দ।
ভাল লাগে না, কিছু ভাল লাগে না। সেদিন ক্লাসের ইরাজুদিন স্যার হঠাৎ বললেন এই তোর বাবা নাকি জেল হাজতে, সত্যি নাকি? বাবুর কান্না এসে যাচ্ছিল, সে বহু কষ্টে কান্না সামলাল। স্যার আবার বললেন সত্যি নাকি রে? বাবু চাপা স্বরে বলল, সত্যি না স্যার। বাবুদের ক্লাস ক্যাপ্টেন বলল, মামলা চলছে স্যার। রায় হয় নাই। পড়া বাদ দিয়ে ইরাজুদ্দিন স্যার মামলার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠলেন এবং সবশেষে অন্য সবার মত বললেন, সংসার চলছে কী ভাবে?
বাবু মনে মনে বলেছিল, আমাদের সংসার যে ভাবেই চলুক তাতে আপনার কী স্যার? আপনি কেন সবার সামনে এইসব কথা বলবেন? কেন আপনি অন্য রকম ভাবে তাকাবেন? কেন আমার বাবার নামে আজেবাজে কথা বলবেন?
কেউ অবশ্যি তার মনের কথা শুনতে পেল না। ভাগ্যিস কেউ মনের কথা টের পায় না। এক সময় ইরাজুদিন স্যার সমাজ পাঠ পড়াতে শুরু করলেন। সে পড়া বাবুর কানে ঢুকল না। তার মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। এবং এত দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে যে বাবুর মনে হচ্ছে এই ক্লাস শেষ হবার আগেই মারা যাবে।
সেটা খুব-একটা খারাপ হবে না বোধ হয়। মরার কথা মনে হলেই আগে তাঁর ভয় লগত। এখন সে রকম লাগে না।
কড়া রোদ উঠেছে। কিন্তু বাতাস ঠাণ্ডা। বাবু উদ্দেশ্যহীন ভাবে এগোতে লাগল। আজ প্রথম যে সে এ রকম করেছে তা না। আগেও কয়েকবার সে স্কুল ফাকি দিয়ে হেটে হেটে অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছে। একবার তো লালবাগ কেল্লার কাছে এসে পথ; হারিয়ে ফেলল। যা ভয় লেগেছিল। ছেলে ধরার মত দেখতে একটা লোক তার পিছু পিছু আসছিল। আজ অবশ্যি পিছু পিছু কেউ আসছে না। সকালবেলা সবাই নিজের কার্জ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বিকাল বেলার দিকে এবং কম একা একা হাঁটলে কম হলেও দুতিনজন লোক জিজ্ঞেস করবে, কী খোকা কোথায্য যাচ্ছি? আজ এখনো কেউ সে রকম কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
শাহবাগের কাছে এসে বাবু দেখল। বড় মামা হকারের কাছ থেকে পত্রিকা। কিনছেন। সে প্রত উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল। তাকে দেখলেই বড় মামা এক লক্ষ প্রশ্ন করবেন। শুধু প্রশ্ন না, এমন কথা বলবেন যা শোনা মাত্রই মাথা ধরে যাবে।
বড় মামাকে সে কোনোদিনই পছন্দ করেনি। মুনা আপার সঙ্গে গণ্ডগোলটার পর সে ঠিক করে রেখেছে, কোনোদিন বড় মামার সঙ্গে সে কথা বলবে না। মাঝে গেলেও না।
বড় মামার সঙ্গে মুনা আপার গণ্ডগোলটার প্রথম অংশ বাবু দেখতে পায়নি। সে গিয়েছিল বিসকিট, চানাচুর কিনতে মামা এসেছেন, তাকে শুধু চা তো দেয়া যায় না। মামা অবশ্যি এসব কিছুই মুখে দেবেন না। চায়ের কাঁপে তিন চারটা চুমুক দিয়ে উঠে পড়বেন, তবু তাকে শুধু চা দেয়া যাবে না।
বাবু বিসকিটের ঠোঙা নিয়ে ঘরে ঢুকেই শোনে বড় মামা চিবিয়ে চিবিয়ে বলছেন, উকিলটুকিল সব তুমিই ঠিক করেছ? মুনা আপা বলল হ্যাঁ।
স্ত্রী-বুদ্ধিতে সংসার চলছে এখন?
কী করবে। মামা, পুরুষ-বুদ্ধির কাউকে তো পাওয়া গেল না। কেউ তো সাড়া শব্দ করল না।
সাড়া শব্দ করবে। কী ভাবে? কেউ কী কখনো এসেছে আমার কাছে?
আপনার কাছে যেত হবে কেন মামা? আপনার তো নিজেরই আসা উচিত—
উচিত-অনুচিত আমার শিখতে হবে তোমার কাছ থেকে?
শিখতেই যে হবে এমন কোনো কথা নেই, আপনার শিখতে ইচ্ছে না হলে শিখবেন না।
মুখ সামলে কথা বল।
আমার সঙ্গে এমন চিৎকার করে কথা বলবেন না। আশপাশে লোকজন আছে, ওরা কী মনে করবে?
মামা রেগে অস্থির হয়ে এমন সব কথা বলতে লাগলেন যে, বাবুর সঙ্গে সঙ্গে মাথা ধরে গেল। বকুল কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল বড় মামা, ছিঃ ছিঃ আপনি মুনা আপাকে এসব কী বলছেন? বড় মামা কাঁপতে কাঁপিতে বললেন ঠিকই বলেছি। একটা কথাও ভুল বলিনি। তোমাদের সঙ্গে সম্পর্শক রাখি না। এই সব কারণে।
সেই রাতটা যে কী খারাপ কেটেছে বাবুর। মুনা আপার জন্যে এমন কষ্ট হয়েছে। মনে হয়েছে। মুনা আপনাকে জড়িয়ে ধরে সে খানিকক্ষণ কাব্দে। মুনা আপ অবশ্যি খুব শক্ত মেয়ে। মা যখন বললেন কিছু মনে করিস না মুনা, রাগের সময় মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। তখন মুনা। আপা বেশ সহজ ভাবেই বলেছে এসব আমি পাত্তা দেই না। যার যা ইচ্ছা বলুক।
মুনা আপা যে এসব জিনিস একেবারেই পাত্তা দেয় না, তাও ঠিক না। গভীর রাতে বাবু বাথরুমে যাবার জন্যে জেগে উঠে দেখে–মুনা আপা বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে আছে। অন্ধকারে কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবু বাবু পরিষ্কার বুঝল তার গাল ভেজা।
মুনা আপা তাকে দেখে বলল কী, বাথরুম?
হু।
এক রাতে তিনবার চারবার বাথরুমে যাস, তোর ডায়াবেটিস নাকি?
বলতে বলতেই মুনা আপা শব্দ করে হাসল। কী সহজ স্বাভাবিক আচরণ। যেন তার কিছুই হয়নি। এমনি এমনি বারান্দায় বসে আছে। বাবু ভয়ে বলল, তোমার মন খারাপ আপা?
না। মন খারাপ হলে বারান্দায় বসে থাকব। কেন? মন ভাল করার জন্যে বারান্দায় কিছু আছে নাকি? ঘুম আসছে না। তাই বসে আছি।
ঘুম আসছে না কেন?
কী মুশকিল, ঘুম আসছে না কেন সেটা আমি কী করে বলব? আমি কী ডাক্তার?
দুপুর বারোটার দিকে বারু মগবাজার চৌরাস্তায় উপস্থিত হল। আর হাঁটতে ভাল লাগছে না। এখন আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে রওনা হওয়া যেতে পারে। যে পথে এসেছে সেই পথেই যাবে না। অন্য কোনো পথ ধরবে এটা ঠিক করতে বাবুর কিছু সময় কাটল। চেনা পথ ধরে ফেরাই ভাল। কিন্তু নান্টু সব সময় বলে যে পথে আসা হয়েছে সে পথে ফিরে যেতে নেই। সে পথে ফিরলে বিপদ হয়। বাবু কী করবে বুঝতে পারছে না। ঠিক তখন সে একটি অবিশ্বাসা দৃশ্য দেখল। তার বাবা আইসক্রিমওয়ালার কাছ থেকে আইসক্রিম কিনছেন। নিজের জন্যেই কিনছেন নাকি? বাবুর উচিত পালিয়ে যাওয়া, কিন্তু সে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রইল। বাবা একবার তাকালেন তার দিকে। তার চোখে-মুখে চিনতে পারার কোনো লক্ষণ ফুটে উঠল না। তিনি বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মত লাল রঙের আইসক্রিমটি কামড়ে কামড়ে খেতে লাগলেন। তার বগলে একটি ছাতা। প্রচণ্ড রোদেও ছাতা না খুলে নিশ্চয়ই প্রচুর হাঁটাহাঁটি করেছেন। ঘামে ভেজা মুখ হয়েছে আয়নার মত চকচকে। তিনি আইসক্রিম হাতে রাস্তা পার হলেন। রাস্তা পার হওয়াও শিশুদের মত। কোনো দিকে না তাকিয়ে হঠাৎ ছুটলেন। একজন বয়স্ক মানুষ শিশুদের মত এতগুলো কাণ্ড একসঙ্গে কিভাবে করে?
বাবু নিজের অজান্তেই ডাকল, বাবা।
শওকত সাহেব থমকে দাঁড়ালেন। সামনেই দাঁড়িয়ে, তবু তিনি যেন তাকে চিনতে পারছেন R
তুই এখানে!
বাবু জবাব দিল না। শওকত সাহেব জবাবের জন্য অপেক্ষাও করলেন না। সহজ ভাবে বললেন, আইসক্রিম খাবি?
না।
হঠাৎ তৃষ্ণা লেগে গেল।
যেন তিনি ছেলের কাছে কৈফিয়ত দিচ্ছেন।
খা একটা আইসক্রিম। এ্যাই, এ্যাই আইসক্রিমওয়ালা।
বাবুকে আইসক্রিম নিতে হল।
আমাদের সময় লালগুলি দুপয়সা দাম ছিল, দুধ মালাই একটা ছিল এক আনা করে। চল বাসায় যাই। হেঁটে যেতে পারবি, না রিকশা নেব?
হাঁটতে পারব।
রিকশার চেয়ে হাঁটাটাই আরাম। রিকশায় অ্যাকসিডেন্টের ভয়। পেছন থেকে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা দিলে অবস্থা কাহিল।
বাবু সারাক্ষণই ভাবছিল এই বুঝি বাবা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন, এইখানে কী করছিলি? স্কুলে যাসনি কেন? কিন্তু শওকত সাহেব কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। বরং তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল ছেলেকে হঠাৎ রাস্তায় পেয়ে তিনি বেশ খুশি।
রোদ লাগছে নাকি বাবু?
না!
রোদ লাগলে বলিস, সঙ্গে ছাতা আছে। তবে শরীরে রোদ লোগা ভাল। ভিটামিন ডি আছে। এতে শরীরের হাডিডর খুব পুষ্টি হয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। এই যে ভিখারিগুলো দেখছিস? সারাদিন হাঁটাহাঁটি করে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখ অসুখ-বিসুখ হয় না।
বাবু অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকাল, এমন অদ্ভুত ভাবে কথাবার্তা বলছেন কেন?
আমি সকালবেলা ঘর থেকে বের হয়েই হাঁটা শুরু করি। দুপুর পর্যন্ত হাঁটি আর শরীরে রোদ লাগাই। খুব উপকারী।
বাবু কোনো কথা বলল না। নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল। শওকত সাহেব খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, জেলে কত দিনের জন্যে নিয়ে রাখে কোনো ঠিক আছে? তখন রোদও পাওয়া যাবে না, হাঁটাহাঁটিও করা যাবে না।
শওকত সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। বাবুর হঠাৎ মনে হল বাবা শুধু কথাবার্তাতেই না দেখতেও কেমন যেন অচেনা মানুষের মত হয়ে গেছেন। হাঁটছেন কেমন কঁজো হয়ে। অস্বাভাবিক লম্বা লম্বা পা ফেলছেন।
চলবে…