“বিবাহিত সম্পর্কের সবকিছুই মোটামুটি ভালো লাগলেও দুঃখিত আমি শারী’রিক সম্পর্কের ব্যপারটা একদমী মেনে নিতে পারিনা। এক কথায় এই সম্পর্কটা আমার একটুও ভালো লাগে না। আমি জানি বিবাহিত সম্পর্কে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তাও আমি এর জন্য উপযুক্ত না। দুঃখিত!” অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাগুলো একটানা বলে লম্বা শ্বাস নিল মেয়েটি। যেন কথাগুলো বলে অনেকটা হালকা হলো সে।
বিপরীতে বসা মেয়েটির কথাগুলো শুনে আজরাফের মাথা ঘুরে উঠলো। মস্তিষ্ক কেমন ঝিম ধরে গেছে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল। আজকালকার মেয়েদের বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্ক থাকে। যা খুব কমন ব্যপার। মেয়েটি হয়তো বিয়ে ভাঙার জন্যই এমন কথা বলছে। আজরাফ নড়েচড়ে বসলো। তার মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে দারুণ মজার কিছু শুনছে। এবং মজা পাচ্ছে। সে কোন কথা না বলে অর্ডার করা কফিতে চুমুক দিল।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে প্রজ্ঞা আবারও কিছু বলার জন্য মুখ খুলল। বলল, “দেখুন, আমি বুঝতে পারছি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না। আপনি কেন! কোন মানুষই হয়তো এতবড় একটা কথা বিশ্বাস করবে না। সুস্থ স্বাভাবিক একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের শারী’রিক চাহিদার প্রতি আগ্রহ নেই এটা কেইবা বিশ্বাস করবে! কিন্তু সত্যি তো এটাই। আমার মনে হয়েছে এমন গুরুত্বপূর্ণ কথাটা আপনাকে জানানো উচিত। অসুস্থ আমি। আপনি তো নন। তাছাড়া নিজের এমন অস্বাভাবিকতা বোঝার পর থেকে বিয়ে নামক সম্পর্কে জড়ানোর কথা আমি ভাবিনি। কিন্তু হঠাৎ আপনার পরিবার থেকে বিয়ের কথা বলল আর আমার পরিবারের সবাই আমার থেকে মতামতের আশা না রেখেই বিয়ে ঠিক করে ফেলল। সবকিছু এত দ্রুত হয়ে গিয়েছে যে আমি নিরব চোখে সবটা দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারিনি। বিয়েটা যেহেতু এখনো হয়নি তাই এতবড় সমস্যার কথা লুকানোর কোন মানেই হয় না। এসব বলার জন্যই আপনার সাথে আমার আজকে দেখা করা।”
আজরাফ বলল, “প্লিজ! আপনি ধীরে সুস্থে কথা বলুন। যথেষ্ট সময় আছে। আর আমি স্পেশাল টেবিল নিয়েছি। কেউ আমাদের কথা শুনবেও না। ওয়েটারকে ডাকলে সে আসবে। আমি আপনার কথা শুনছি। সমস্যা নেই। জুস পান করে একটু গলা ভিজিয়ে নিন। তারপর বলুন। আপনি তো রিতিমত হাপিয়ে যাচ্ছেন।”
আজরাফের শান্ত শীতল কন্ঠে বলা কথা ঠিক হজম হলো না প্রজ্ঞার। সে এত বড় সমস্যার কথা জানালো অথচ মানুষটা কত স্বাভাবিক। যেন সে অবাক হওয়ার মত কিছুই বলেনি আজরাফকে।
প্রজ্ঞা বলল, “ইটস ওকে। আপনি কি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন? আপনি নিশ্চয়ই আমার মত শারীরিক অক্ষম মেয়েকে বিয়ে করবেন না?”
“বিয়ে করব কিনা সেটা হচ্ছে পরের কথা। এখনই কোন সিদ্ধান্তে যাচ্ছি না। আচ্ছা, আপনি যদি মনে কিছু না করেন তাহলে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?”
“অবশ্যই কেন নয়। বলুন?”
“বলছি, আপনি কি কোনভাবে ছোট বেলায় বা কখনও শারী’রিক নির্যা’তনের স্বী’কার হয়েছিলেন কোন ভাবে? যার জন্য এমন ভীতি বা সমস্যা?”
প্রজ্ঞা আজরাফের প্রশ্নে খুব একটা অবাক হলো না। আর না কিছু মনে করলো। এমন কিছুই বলবে আরফাজ এমনটাই আশা করেছিল প্রজ্ঞা। সে স্মিথ হেসে বলল, “এমন কিছু কখনোই ঘটেনি। ছোট বেলা থেকেই আমি খুব আদেশ নিষেধে বড় হয়েছি। স্কুল কলেজে তেমন কোন বন্ধুসবান্ধবও নেই। বাড়ি ছাড়া অচেনা অজানা মানুষের সান্নিধ্যে আমার যাওয়া হয়নি। সুতরাং আমার জানা বা অজানাই এমন কিছু কখনও হয়নি। এ ব্যপারে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। কিন্তু সমস্যাটা আমার নিজের। এটা একটা অপূর্ণতাও বলতে পারেন। সৃষ্টিকর্তা সবাই সবকিছু দেন না।”
“এসব নিয়ে আপনার মনে কখনও প্রশ্ন জমে না প্রজ্ঞা? সবাই ঠিক তার মধ্যে আপনিই অন্যরকম। আপনার কি মা হতে ইচ্ছে করে না?”
“আমি জন্মেছিই অপূর্ণতা নিয়ে সেখানে পূর্ণতার আশা কি করে করতে পারি বলুন? একজন নারী তখনই পূর্ণ হয় যখন সে মা হয়। কিন্তু আমি যে চাই না এমন না। কিন্তু কিছু বিষয় আমার ভালো লাগে না। আগ্রহ আসে না আর কি! কিন্তু ওসব বাদে বিবাহিত সম্পর্কের সব দিকই আমার ভালো লাগে।”
“ওসব বাদে সব দিক বলতে?”
“স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক অবশ্যই সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্কের একটি। একসাথে চলা। একে অন্যকে সাপোর্ট দেওেয়া, হাতে হাত রেখে ঘোরাফেরা, খুনসুটি এসব খারাপ লাগে না। বৃষ্টিস্নাত প্রহরে দুজনে বারান্দায় বসে বৃষ্টি বিলাস করা, আবেগঘন মুহূর্তে প্রিয় পুরুষটির বক্ষে মাথা রেখে নিদ্রা যাপন করা এসব খারাপ লাগে না। বরং ভালো লাগে।”
“ওহ্ আচ্ছা। আপনার সমস্যা তাহলে ওসব নিয়ে?”
“জি।”
আরফাজ গভীর ভাবনাই পড়ে গেল। কি সুন্দর মিষ্টি চেহারার একটি মেয়ে তার অপর পাশে বসা। কথা বলার ধরনটাও কি সুন্দর। নিচু কন্ঠে কি সুন্দর করে কথা বলে। সবুজ রঙা একটা কামিজের সঙ্গে হালকা গোলাপি রঙের হিজাব পড়া। কি সুন্দর দেখতে। টানা চোখ। হালকা পুরু ঠোঁট। সবমিলিয়ে যেকোনো পুরুষের জন্য পারফেক্ট। যে কোন পুরুষের নজর কাড়তে বাধ্য। তবুও কি অদ্ভুত সমস্যাই জর্জরিত মেয়েটা। ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো আজরাফের। কি বলা উচিত সে আপাতত বুঝতে পারছে না। কি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত সেটাও মাথায় ঢুকছে না। এ মুহূর্তে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে আরফাজের। কিসের শূন্যতাই তার পৌরুষ বুকটা চিন চিন ব্যথা করছে। কিসের ইঙ্গিত কে জানে!
আজরাফ নিশ্চুপতা প্রজ্ঞাকে নিশ্চিত করলো। যাক বিয়েটা তাহলে হচ্ছে না। সে জানিয়ে দিয়েছে নিজের অক্ষমতা। তাহলে বসে থেকে আর লাভ কি! প্রজ্ঞা চিন্তিত মুখশ্রীর আরফাজকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আরফাজ সাহেব তাহলে উঠি। আমার মনে হয় যা বলার ছিল বলে দিয়েছি। বসে থেকে সময় ব্যায় করার কোন মানে হয় না।”
“বাহ্ আপনি দেখছি বেশ সময় মেনটেইন করেন। ভালো। এ বয়সেই নিজেকে মানিয়ে নিয়ে ভালোই করেছেন।”
“পুরোটা ঠিক হলো না। সময় কতটা মেনটেইন করি জানিনা। কিন্তু এখন এ মুহূর্তে মেনটেইন করছি। যাইহোক চলি তাহলে!”
“মিস প্রজ্ঞা! আপনার কি আমাকে কোনভাবে অপছন্দ?”
“আপনাকে তো বললামই আমার সমস্যার কথা। তাহলে পছন্দ অপছন্দের বিষয় আসছে কেন?”
“মিস প্রজ্ঞা! পাল্টা প্রশ্ন করতে বলিনি। যে উত্তর চেয়েছি সেটা বলুন। অপছন্দ আমায়?” গম্ভীর কন্ঠস্বর আরফাজের।
প্রজ্ঞা ভনিতা না করে জানালো, “আপনাকে অপছন্দ করার মত কিছুই আমি খুজে পাইনি। যথেষ্ট পছন্দ হয়েছে। কিন্তু শুধু হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়ানোর জন্য নিশ্চয়ই আমাকে বিয়ে করবেন না!”
প্রতিত্তোরে আজরাফ বলল,
“আচ্ছা। ওঠা যাক।”
আরফাজের পিছে প্রজ্ঞা বেরিয়ে আসলো। দুজন দুদিকে চলে গেল। প্রজ্ঞা রিকশায় চেপে বাড়ির পথে রওনা দিল। আর আজরাফ পকেটে থাকা রোদ চশমা চোখে দিয়ে নিজের বাইকে উঠে রওনা দিল তার নিজস্ব গন্তব্যে। কেউ জানলো না কারো মনের অব্যক্ত অনুভূতি, কথা। কোনটাই না।
নিজের অপূর্ণতা কুড়ে কুড়ে খাই প্রজ্ঞাকে। ক্রোধে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে। কেন এমন অস্বাভাবিক হলো সে! আর পাঁচটা স্বাভাবিক মেয়ের মত হলেও তো পারতো। হয়তো আরফাজ নামক ভয়ানক সুদর্শন যুবক তার নিজের পুরুষ হতে পারতো। প্রজ্ঞার চিবুক গড়িয়ে দু ফোটা অশ্রু ঝরে পড়লো। সন্তপর্ণে ওড়না দিয়ে মুছে নিল সে। কেউ না জানুক তার দূর্বলতা।
টুংটাং শব্দে ফোনের নোটিফিকেশন বেজে উঠলো। ম্যাসেজ এসেছে আননোন নাম্বার থেকে। ম্যাসেজ অপশনে যেতেই দেখা পেল এক অদ্ভূত বার্তা। শীতল স্রোত বয়ে গেল প্রজ্ঞার শরী’রে।
ইনশাআল্লাহ…চলবে।
#তুমি_আমার_অনেক_শখের (০১)
#লেখনীতেঃসুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি
আসসালামু আলাইকুম।
অনেক দিন পরে আবারও কিছুটা ভিন্নধর্মী গল্প নিয়ে হাজির হয়েছি। পুরোটাই কাল্প’নিক। কেমন লেগেছে জানাতে ভুলবেন না।