বিবশ_রজনী #পর্ব_পাঁচ

#বিবশ_রজনী
#পর্ব_পাঁচ
…..
নিজাম সাহেব হামিদুলকে নিয়ে বাসায় ফিরে এসে পরপর ঈশানের দুই বন্ধুকে ফোন করে বললেন, ঈশানের ব্যাপারে তিনি তাদের সাথে কথা বলতে চান। দুজনের সাথে একসাথে কথা বলতে পারলে সুবিধা হয়, তারা কি বিকেলবেলা শাহবাগ মোড়ে আসতে পারবে কিনা।

ঈশানের দুই বন্ধুর একজন সুমিত্র আরেকজন রাফাত। নিজাম সাহেব ভেবেছিলেন দুইজনকে একসাথে পাওয়াটা একটা ঝামেলার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে কিন্তু দুজনেই বিকেলবেলা শাহবাগে আসতে রাজী হয়ে গেল।

নিজাম সাহেব ল্যাবে ঢুকে খুঁজে খুঁজে একটা বই বের করে হামিদুলকে ডেকে বললেন, “তুই না জানতে চেয়েছিলি, কেন লেবুর রস দিয়ে কাগজে লিখলে লেখা অদৃশ্য হয়ে যায়, কেন কাগজে তাপ দিলে লেখা দৃশ্যমান হয়?”
হামিদুল মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিল খুবই বিরক্তমুখে কারণ তার সামনে টেবিলের উপর বিশাল মোটা একটা বই সে দেখতে পাচ্ছে।
নিজাম সাহেব বইটা হামিদুলকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এইটা পড়ে শেষ কর। আরও অনেক ইন্টারেস্টিং ব্যাপার জানতে পারবি।”
হামিদুল বই হাতে নিয়ে প্রথমেই চিন্তা করলো এই বই সে কতদিনে পড়ে শেষ করতে পারবে। নিজাম সাহেব বললেন, “বইটা নিয়ে যা, আর আমাকে এক কাপ চা দিয়ে যা। আমি একটু বের হবো।”

হামিদুল বই নিয়ে ল্যাব থেকে বের হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে চা বানিয়ে নিয়ে এসে বলল, “আসবে কখন?”
–“কখন আসবো বলতে পারছি না, বাড়ির খেয়াল রাখিস।”
–“আচ্ছা।”

নিজাম সাহেব চা শেষ করে বাসা থেকে বের হলেন। রোডসাইডে ইদানিং ফুটপাতে দোকানের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের জুতোর দোকান, কাপড়ের দোকান, মানিব্যাগ-পার্স সহ হরেক রকম দোকান। এসব দোকানে ক্রেতারও কোনো কমতি নেই, যার কারণে ভিড়-ভাট্টা লেগেই আছে। রাস্তায় জ্যামের অন্যতম কারণ হচ্ছে এইসব ফুটপাতের ভ্রাম্যমাণ দোকান। এসব দোকানীকে মাঝেমধ্যেই উচ্ছেদ করা হয়, তবে সবাইকে উচ্ছেদ করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয় না। এরা চোখ-কান সর্বদা খোলা রেখে ব্যবসা করে, পুলিশ উচ্ছেদ অভিযানে এলে এরা এক নিমিষেই দোকান নিয়ে গায়েব হয়ে যায়, পুলিশ চলে যাবার সাথেই পুনরায় দোকান খুলে বসে।

নিজাম সাহেব আধাঘন্টা গুলিস্থানে গাড়ি নিয়ে বসে রইলেন। জ্যাম ছাড়তেই তিনি দ্রুত গাড়ি ছোটালেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে দিয়ে।

শাহবাগ জাদুঘরের সামনে গাড়ি থামিয়ে তিনি ফোন করলেন সুমিত্রকে। সুমিত্র ফোন ধরে বলল, তারা শাহবাগের কাছাকাছি চলে এসেছে। নিজাম সাহেব গাড়ি থেকে নেমে একটা সিগারেট ধরিয়ে ভাবলেন, হামিদুলকে নিয়ে আসলে ভাল হতো, বেচারা বাসায় একা একা কি করছে কে জানে। হামিদুলকে নিয়ে এলে শাহবাগ থেকে কাজ শেষ করে সংসদ ভবনের দিকে যাওয়া যেতো, নইলে হাতিরঝিলে যাওয়া যেতো।

মিনিট দশেক পর সুমিত্র জাদুঘরের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে নিজাম সাহেবকে ফোন করলো। তারা জাদুঘরের সামনে আছে বলতেই নিজাম সাহেব তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। সুমিত্রদের সাথে হ্যাণ্ডশেক, সৌজন্যমূলক কথা-বার্তা বলে নিজাম সাহেব তাদেরকে নিয়ে শাহবাগ মোড়ের একিটা ফাস্টফুডে গিয়ে বসে বললেন, “কি খাবেন?”
রাফাত বলল, “কফি! আমি কফি ছাড়া কিছু খাবো না।”
নিজাম সাহেব সুমিত্রকে বললেন, “আপনি?”
সুমিত্র বলল, “কফি ইনাফ।”
নিজাম সাহেব ওয়েটারকে ডেকে তিন কাপ কফি দিতে বলে বললেন, “আপনাদের বন্ধু ঈশান যে একটা বড় ধরনের সমস্যায় ভুগছে সেই ব্যাপারে তো আপনারা জানেন, তাই না?”
রাফাত মাথা নেড়ে বলল, “আন্টি বলেছে।”
–“ঈশান যেই সমস্যায় ভুগছে সেটা খুবই বিরল একটা সমস্যা, ইংরেজিতে একে বলা হয় (Sleep Walker) অর্থাৎ যে ঘুমের মধ্যে হাঁটে।”
সুমিত্র বলল, “এসব নিয়ে আমি বেশ ঘেটেছি, তেমন কিছুই খুঁজে পাইনি।”
নিজাম সাহেব বললেন, “খুঁজে পাবার কথা নয় কারণ খুবই কম সংখ্যক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়।”
–“আচ্ছা আপনি তো সাইক্রিয়াটিস্ট তাই না? ঈশানের এরকম সমস্যা হল কেন?”
–“সেটাই খুঁজছি, আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন।”
–“জ্বী।”

ওয়েটার কফি দিয়ে গেল। নিজাম সাহেব কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “আচ্ছা, আপনারা দুজনেই তো ঈশানের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। ওর ব্যাপারে আপনাদের সবথেকে ভাল জানার কথা। আমি কিছু প্রশ্ন আপনাদেরকে করতে পারি চাই, সমস্যা নেই তো?”
সুমিত্ররা দুজনই একসাথে বলে উঠলো, “অবশ্যই।”
নিজাম সাহেব বললেন, “ঈশান ছেলে হিসেবে কেমন ছিল?”
রাফাত বলল, “খুব ভদ্র, ডিপার্টমেন্টের কারও সাথে কোনো ঝৈ-ঝামেলা ছিল না, সবার সাথেই খুব ভালো সম্পর্ক ছিল।”
–“আমার ধারণা ঈশানের কারও সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল, আপনারা কি এই ব্যাপারে জানেন কিছু?”
সুমিত্র রাফাত দুজন দুজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। রাফাত কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, “আসলে আমাদের ডিপার্টমেন্টে অংশী নামের একটা বৌদ্ধ মেয়ে ছিল। ওর সাথে ওর খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল।”
রাফাত থেমে যাবার পর সুমিত্র বলল, “অংশীর সাথে ওর ঠিক প্রেমের সম্পর্ক ছিল কি না সেটা নিয়ে আমাদের বন্ধুদের মাঝে বেশ কথা-বার্তা হতো কিন্তু ব্যাপারটা কখনো ক্লিয়ার হয়নি। এমনিতে ঈশান অংশীর প্রতি যতটা কেয়ারিং ছিল অন্য কারও প্রতি ততটা কেয়ারিং ছিল না।”
নিজাম সাহেব বললেন, “কিছু উদারহণ দেওয়া যাবে?”
সুমিত্র বলল, “মনে করুন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অংশীর জুতোর ফিতা খুলে গেছে, ঈশান নিজ হাতে রাস্তায় বসে জুতোর ফিতা বেঁধে দিত। আমরা একসাথে কোথাও গেলে ঈশান ওর সাথে সাথে থাকতো। একটা সময় তো এমন হয়ে গিয়েছিল, ইউনিভার্সিটি বন্ধের দিনগুলোতে আমরা ঈশানকে ক্যাম্পাসে আসতে বললে ও আসতো না, কিন্তু অংশী ওকে আসতে বললে ওর যত জরুরী কাজই থাকুক না কেন ও চলে আসতো।”
–“আপনাদের সাথে ঈশানের সম্পর্ক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই রকম ছিল?”
রাফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঈশান আমাদের খুব ভালো বন্ধু ছিল, কিন্তু অংশীর সাথে যখন থেকে ও মেশা শুরু করে তখন থেকে আমাদের সাথে ওর তেমন যোগাযোগ হতো না।”
–“আমিও এটাই ধারণা করছিলাম যে ঈশানের সাথে অংশী ব্যতীত আর তেমন কারও যোগাযোগ ছিল না। আরও একটা ব্যাপার আমি ধারণা করেছি, আপনাদের মুখ থেকেই শুনি। অংশী মেয়েটার কি কোন দূর্ঘটনা ঘটেছে?”
সুমিত্র ব্যথিতমুখে বলল, “আপনি ঠিক ধরেছেন, অংশী একটা সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছে।”
নিজাম সাহেব একমুহূর্ত চুপ থেকে বললেন, “আমি এমনটাই ভাবছিলাম। আরেকটা ব্যাপার জানার ছিল, ঈশান কি কখনো আপনাদেরকে বলেছে সে ছাদের রেলিংয়ের উপর দিয়ে হাঁটছে।”
রাফাত প্রায় সাথে সাথে বলল, “হ্যাঁ বলেছে। মাঝে মাঝে ওর কি যেন হতো, ফোন করে বলতো, মনটা ভাল নাইরে। কেন জিজ্ঞাসা করলে বলতে চাইতো না শুধু বলতো কষ্টে আছি, পৃথিবী ভাল লাগে না, ছাদের রেলিংয়ের উপরে দাঁড়িয়ে আছি, পরে গেলে মরে যাব, মরে গেলে মাফ করে দিস।”
–“আমার মনে হয়, অংশী ঈশানকে একটা সময় উপেক্ষা করতে শুরু করেছিল, খুব বেশি যখন উপেক্ষা করতো তখন ব্যাপারটা ঈশান মেনে নিতে পারতো না। অংশীকে সে খুব বেশি ভালোবাসতো কিন্তু আপনাদের কাছে কখনো প্রকাশ করতে পারতো না। ধর্মীয় ব্যবধানের কারণে তাদের মিল হবার সম্ভাবনা নেই এই কথা সে জানতো। আসলে ও চাইতো অংশী ওর পাশে বন্ধুর মতো সবসময় থাকুক কিন্তু অংশী বেশ বদলে গিয়েছিল, এইসব ওকে ভীষণ কষ্ট দিত, কাউকে এই কষ্টের কথাগুলো ও বলতে পারতো না। অংশীর হঠাৎ মৃত্যু ওকে প্রবলভাবে আঘাত দিয়েছে।”
নিজাম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় বললেন, “জানি না ঈশানকে এই সমস্যা থেকে বের করে নিয়ে আসা আদৌ সম্ভব হবে কি না। সমস্যাটা যদি শুধুমাত্র ঘুমের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করা হতো, তাহলে ব্যাপারটা সমাধানের একটা উপায় অন্তত বের করা যেত কিন্তু ঈশান শুধুমাত্র হাঁটেই না হাঁটার সময় বিড়বিড় করে কথাও বলতে থাকে।”
সুমিত্র অবাক চোখে নিজাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কার সাথে কথা বলে?”
নিজাম সাহেব বললেন, “হয়তো অংশীর সাথে, অথবা অবচেতন মনের সাথে।”
রাফাত বলে উঠলো, “সর্বনাশ, এখন কি হবে?”
নিজাম সাহেব কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, “আমি চেষ্টা করছি ঈশানকে এই অবস্থা থেকে বের করার, সেজন্যে আপনাদের সহযোগিতা আমার বিশেষ ভাবে প্রয়োজন। আপনারা যেহেতু একই সাথে পড়েছেন সেহেতু নিশ্চয়ই একে অপরের বিষয়ে কিছু না কিছু জানেন। ঈশান দেখতে বেশ সুদর্শন, স্মার্ট। আপনাদের ডিপার্টমেন্টে এমন কোন মেয়েকি ছিল যে ঈশানকে বেশ পছন্দ করে? এখনো বিয়ে হয়নি এরকম?”
সুমিত্র বলল, “এরকম কয়েকজন ছিল কিন্তু ঈশান তাদের সাথে খুব একটা মিশতো না। তবে একজন আছে যে ঈশানকে খুব পছন্দ করতো, এখনো সম্ভবত করে। সেটা আমাদের ডিপার্টমেন্টের কেউ না।”
নিজাম সাহেব চিন্তিতমুখে বললেন, “কে সে?”
সৌমিত্র বলল, “জেরিন। মেয়েটা আমাদের দুই ব্যাচ জুনিয়র, আমাদের ইউনিভার্সিটিতেই পড়ে।”
–“জেরিন ঈশানের সমস্যার ব্যাপারে জানে?”
–“জানে তবে সমস্যা যে এতটা গভীর সে সম্পর্কে তো জানবার কথা না। ঈশানের সমস্যার ব্যাপারে আমার খুব ধারণা ছিল না, আন্টির সাথে যদিও বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে ফোনে। আমি ভাবিনি ছাদের রেলিংয়ের উপর হাঁটার ব্যাপারটা ঈশানের মানসিক কোন সমস্যার কারণ।”
–“জেরিন ঈশানকে পছন্দ করে ব্যাপারটা কি ঈশান জানে?”
–“জানবার কথা না, জেরিন আমাকে বড়ভাইয়ের চোখে দেখে। প্রায়ই ওর সাথে আমার কথা হয়, সবসময় ও ঈশানের খোঁজ-খবর নেয়।”
–“আপনি নিশ্চিত যে সে ঈশানকে সত্যিই পছন্দ করে?”
–“আমি মোটামুটি নিশ্চিত, তবে সরাসরি তো কখনো ওকে জিজ্ঞাসা করিনি, আমি বরং আজকে ওকে জিজ্ঞাসা করে আপনাকে জানাই।”
নিজাম সাহেব বললেই, “হ্যাঁ সেটাই ভাল হবে। আপনাদের আরও একটা সহযোগিতা আমার প্রয়োজন। সেটা হচ্ছে, এখন থেকে প্রতিদিন আপনারা দুজনই আলাদা আলাদাভাবে ঈশানকে ফোন করে কিছুক্ষণ কথা বলবেন।”
রাফাত বলল, “অবশ্যই দেবো।”
–“ওর সাথে মিশবার চেষ্টা করবেন, ওকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর চেষ্টা করবেন। ঈশানকে বাসা থেকে বের করতে হবে। বাসায় ও যতবেশি একা একা থাকবে, ততবেশি একাকীত্বতা বাড়বে। আজ তাহলে উঠি, আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ আসার জন্যে।”
সৌমিত্র মৃদু হেসে বলল, “ঈশানের জন্যে যেকোন সময় আমাদেরকে প্রয়োজন পড়লে ডাকবেন।”

নিজাম সাহেব কফির বিল পরিশোধ করে ফাস্টফুড থেকে বের হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলেন এমন সময় সিগন্যাল পড়লো। তাঁর ইচ্ছা করলো ট্র‍্যাফিককে গিয়ে আচ্ছামতন ধোলাই দিতে।

রাতে সৌমিত্র নিজাম সাহেবকে ফোন করে জানালো, সে নিশ্চিত জেরিন ঈশানকে পছন্দ করে। নিজাম সাহেব সৌমিত্রকে বললেন, জেরিনের ফোন নম্বর তাকে পাঠিয়ে দিতে। সৌমিত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই জেরিনের ফোন নম্বর ম্যাসেজে পাঠালো।
…..
#চলবে

লেখা,
নাহিদ হাসান নিবিড়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here