অরোনী, তোমার জন্য~১৩,১৪
লিখা- Sidratul Muntaz
১৩
দুইতলার লিভিংরুমে এই মুহূর্তে বাড়ির সবাই সমবেত হয়েছে। সকলের চেহারা গম্ভীর। একটা ভয়ংকর কান্ড ঘটে গেছে বাড়িতে। রাহাত মাত্র অফিস থেকে ফিরেছে। তার একমাত্র বউয়ের ভাইয়ের মুখ পুড়ে গেছে। এটা তার জন্য বিরাট দুঃসংবাদ। অথচ নিজের বাড়ির সদস্যদের কারো কিছু হলে রাহাত এতো মাথা ঘামায় না। যতটা বউয়ের বাপের বাড়ির সদস্যদের জন্য মাথা ঘামায়। রাবেয়া ব্যাপারটা খেয়াল করেছেন।
রুবায়েতের চিৎকার থেমে গেছে। দীপ্তি একটা ছোট পাখা দিয়ে ভাইয়ের মুখে অনবরত বাতাস করছে। রুবায়েতের চেহারা অস্বাভাবিক লাল। দেখলে মনে হবে ভয়ংকর কোনো প্রেতাত্মা। রুবায়েত রিতুকে আশেপাশে খুঁজছে। মেয়েটাকে কাছে পেলে সে নিজেও একটা চড় মারতো। কতবড় বেয়াদব! রিতু দীপ্তির চড় খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে অরোনীর রুমে ঢুকে গেছে। এখনও সেখানেই বসে আছে।
অরোনী বাথরুম থেকে বের হয়েছে অনেকক্ষণ পরে। তার সারা শরীর ভেজা ছিল। এখন শুকনো কাপড় পরে মাথায় টাওয়েল জড়িয়ে শান্তমুখে নিষ্প্রাণ পুতুলের মতো বসে আছে। রাফাত তার গা ঘেষে বসেছে। অরোনীর হাত দু’টো রাফাতের হাতের মুঠোয়। অরোনী থেকে থেকেই কেঁপে উঠছে। রাফাতের বুকে মাথা ঠেকালে ভয় একটু কমছে। তারপর আবার সেই জঘন্য স্মৃতি মনে করে লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। রিতু তাদের থেকে একটু দূরে বসে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে। নিজের জন্য না, তার কান্না পাচ্ছে অরোনীর জন্য। রাফাত এখনও ঘটনা জানে না। অরোনী মুখ খোলেনি। শুধু রাফাতকে অনুরোধ করেছে তার পাশে বসে থাকার জন্য। রাফাত তাই বসে আছে। তবে অরোনীর মুখ থেকে তার কিছু শোনার প্রয়োজন নেই। উড়ো কথা সে যেটুকু শুনেছে তাই যথেষ্ট পরিস্থিতি বোঝার জন্য। এই সামান্য ব্যাপার না বোঝার কিছু নেই। অরোনীর বিধ্বস্ত অবস্থা আর রুবায়েতের পরিণতি দেখলে যে কোনো বুদ্ধিমান মানুষ চট করে বুঝে ফেলবে সব। রাফাত স্থির হয়ে বসে আছে ঠিকই। কিন্তু তার গায়ের শিরা-উপশিরা কাঁপছে। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে রুবায়েতের গলা টিপে ধরতে। একাধারে চোখেমুখে ঘুষি মেরে তার হুশ উড়িয়ে দিতে। কিন্তু কিছুই করতে পারছে না সে। বাড়ির গুরুজনেরা রুবায়েতকে ঘিরে আছে। উফ, রাফাত কেন কিছু করতে পারছে না?
শীলা কথা বললেন,” তুমি সকালে এই বাড়িতে কেন এসেছিলে রুবায়েত? তোমার কি কোনো কাজ ছিল?”
দীপ্তি শীলার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন শীলা খুব খারাপ কথা বলেছেন। রুবায়েতের এই বাড়িতে আসা যেন খুব সাধারণ ব্যাপার। এই নিয়ে কেউ প্রশ্ন করতেই পারবে না। রাবেয়া বললেন,” আমাদের সাথে গাড়িতে উঠেছিলে না তুমি? তারপর আবার নেমে গেলে কেন? এখানে আসার জন্য?”
রুবায়েত নত কণ্ঠে বলল,” বিশ্বাস করুন আন্টি, আমার কোনো দোষই ছিল না। আপা আমাকে পাঠিয়েছিল।”
সবার নজর দীপ্তির দিকে গেল। শীলা চাচী অবাক হয়ে বললেন,” কি ব্যাপার দীপ্তি?”
দীপ্তি থতমত খেয়ে বলল,” আমার পার্স খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম তারপর আর নিতে মনে নেই। সেজন্য রুবায়েতকে পাঠিয়েছিলাম এখানে।”
রাহাত হতাশ হয়ে বলল,” তুমি এজন্য রুবায়েতকে কেন পাঠাতে গেলে! অন্যকাউকে পাঠাতে পারতে।”
দীপ্তি উঁচু কণ্ঠে বলল,” অন্যকাউকে পাঠাবো কেন? আর তুমি এমনভাবে বলছো যেন আমার ভাই সত্যি দোষী! ও তো বলছে ও কিছু করেনি।”
শীলা কঠিন গলায় বললেন,” অরোনী এখানে একা আছে। এটা জানার পরেও তুমি তোমার উপযুক্ত ভাইকে এখানে পাঠাবে কেন?”
” অরোনী একা কোথায় ছিল? আপনারাও তো ছিলেন। আর আমাদের মধ্যে ছেলেমানুষ বলতে কেবল রুবায়েত ছিল। ভেবেছিলাম ও এক দৌড়ে যাবে আবার এক দৌড়ে ফিরে আসবে। আমি কি আর জানতাম যে অরোনী এতো কাহিনী করবে?”
শীলা রুক্ষ গলায় বললেন,” তুমি এমনভাবে কেন বলছো? এটা কি অরোনীর দোষ? ”
দীপ্তি দায়সারা হেসে জবাব দিল,” আমি কিভাবে বুঝবো কার দোষ? আমি তো এখানে উপস্থিত ছিলাম না।”
ছোটচাচা বললেন,” স্বশরীরে এখানে কেউই উপস্থিত ছিল না মা। কিন্তু কমন সেন্স এখানে সবার মাথায় উপস্থিত আছে। বোঝাই যাচ্ছে কি হয়েছিল।”
দীপ্তি রেগে বলল,” আপনারা কি আমার ভাইকে দোষী ইঙ্গিত করতে চাইছেন?আমি অরোনীর দোষও দিচ্ছি না। কিন্তু রুবায়েত আমাকে যা বলেছে তার সারমর্ম হলো, সে কফি খেতে চেয়েছিল অরোনীর কাছে। তারপর কেটলি থেকে কফিটা ওর গায়ে পড়ে গেছে। এটুকুই ঘটনা। আর বেয়াদবি করেছে রিতু। সে কেন রুবায়েতকে মরিচ গুঁড়া দিল সেটার বিচার আগে হওয়া উচিৎ। ”
নির্মল সাহেব বললেন,” যে প্রকৃত দোষী তার অবশ্যই বিচার হবে। কিন্তু তোমার ভাই ফাঁকা বাড়িতে কেন ঢুকবে? এটা একটা অপরাধ। অরোনী একা জেনেও সে কফি খেতে চেয়েছে এটা আরও বড় অপরাধ। আর অরোনী যদি ভুল করেই ওর গায়ে কফি ফেলে দেয় তাহলে ওর মুখ কেন পুড়বে? পোড়ার কথা হাত অথবা পা। কপাল কেন ফাটবে? আর অরোনীই বা এমন অস্বাভাবিক আচরণ কেন করবে?”
দীপ্তি নিশ্চুপ। নির্মল রুবায়েতের দিকে চেয়ে বললেন,” তুমি যে পার্স নিতে এসেছিলে সেই পার্স কি নিতে পেরেছো?”
রুবায়েত ভদ্র গলায় বলল,” জ্বী পেরেছি আঙ্কেল। এইতো পার্স।”
রুবায়েত তার পকেট থেকে পার্স বের করল। এই পার্স আগে থেকেই তার কাছে ছিল। গাড়িতে বসে দীপ্তির ব্যাগ থেকে সে চুরি করেছিল। তারপর দীপ্তির কাছে ভাঙতি টাকা চেয়েছিল। দীপ্তি ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে দেখে তার টাকার ব্যাগ নেই। তখন রুবায়েত আগ বাড়িয়ে বলল,” ফেলে এসেছো মনে হয় বাড়িতে। আমি গিয়ে নিয়ে আসবো?”
দীপ্তি খুশি হয়ে বলল,” যা ভাই।” তারপর রুবায়েত গাড়ি থেকে নেমে যায়৷ দীপ্তি তখন বুঝতে না পারলেও এখন সব বুঝতে পেরেছে। রুবায়েত ভীষণ ঘাড়ত্যাড়া। তাকে দিয়ে একটা ছোট কাজও করানো যায় না। সে হঠাৎ আগ বাড়িয়ে কেন দীপ্তির ব্যাগ নিতে এতোদূর আসতে চাইবে? রুবায়েত তাহলে অরোনীর জন্যই এসেছিল। তাছাড়া ইদানীং অরোনীকে নিয়ে রুবায়েত একটু বেশিই আলোচনা করে। তখনই দীপ্তির ব্যাপারটা বোঝা দরকার ছিল। সে বোঝেনি৷ আগে বুঝে ফেললে আজকে আর এই বিপদ হতো না। তবে এখন দীপ্তির প্রধান কাজ ভাইকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করা। যেহেতু রুবায়েত তার চাচাতো ভাই। রুবায়েত ধরা খেলে শ্বশুরবাড়িতে সেও মুখ দেখাতে পারবে না। এতোদিনের কুঁড়ানো মান-সম্মান সব খোয়া যাবে। ছোটচাচা একটু ভেবে-চিন্তে বললেন,” আচ্ছা রুবায়েত, সত্যিই কি কফিটা ভুলবশত পড়ে গেছিল নাকি অরোনী তোমার মুখে কেটলি ছুড়ে মেরেছিল?”
এই কথা শুনে চাপা শব্দে হেসে ফেলল উর্মি। আশা সঙ্গে সঙ্গে উর্মিকে চোখ রাঙালেন। ছোটচাচা আবার জিজ্ঞেস করলেন,” তোমার কপালে দাগ কেন?”
রুবায়েত অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” আমারই ভুল হয়েছে। আমি ভাবীর সাথে একটা মজা করেছি। ভাবী ভুল বুঝে আমার উপর রেগে গেছেন। কিন্তু তাই বলে যে কেটলি ছুড়ে মারবে এটা বুঝিনি।”
মেঝোচাচা ভ্রু কুচকে বললেন,” কি এমন মজা করেছিলে?”
নির্মল সাহেব শক্ত চোখে চেয়ে আছেন। ইচ্ছে করছে উঠে গিয়ে ছেলেটার গালে দু-চার ঘা এখনি লাগাতে। নির্লজ্জ কোথাকার! রুবায়েত ইতস্তত করে বলল,” এমনিই। সাধারণ একটা মজা। ভাবীর সাথে মানুষ কত মজাই তো করে। আমি বুঝিনি ভাবী যে এতো কনজার্ভেটিভ মাইন্ডের।”
তানজিমা বলল,” রুবায়েত ভাই ঠিক বলেছে। ছোটভাবী সবকিছুতেই বেশি বাড়াবাড়ি করে। সে শুধু শুধু রুবায়েত ভাইকে…”
তানজিমাকে থামতে হলো। বড়চাচা এমনভাবে চোখ পাকিয়েছেন যে বাকি কথা বলার সাহস তার নেই। নির্মল সাহেব ভারী গলায় বললেন,” রুবায়েত, আমার দৃষ্টিতে অপরাধ তুমি করেছো। সেজন্য তোমার শাস্তি প্রাপ্য। কেন তুমি ছোটবউয়ের সাথে মশকরা করবে? এ কেমন দুঃসাহস? ”
দীপ্তি প্রতিবাদী গলায় বলল,” বাবা আপনি এসব কি বলছেন?রুবায়েত মানুষটাই এমন। রুমা, নীলিমা, তানজিমার সাথেও তো ও কত মজা করে। ওরা তো কখনও কিছু মনে করেনি। অরোনী সবার মতো ফ্রী মাইন্ডের না এটা তার প্রবলেম। রুবায়েতের কি দোষ? সে তো আর জানতো না অরোনীর স্বভাব সম্পর্কে।”
নির্মল বললেন,” রুবায়েত জানতো না এটাই তার দোষ। সে কেন জানবে না যে মেয়েরা মজা করার বস্তু নয়? রুবায়েত তুমি এখনি কানে ধরে উঠ-বস করো। ”
রুবায়েত হকচকিয়ে বলল,” স্যরি আঙ্কেল?”
দীপ্তি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো,” বাবা, আপনি এভাবে অপমান করতে কেন চাইছেন? অরোনী রুবায়েতকে ভুল বুঝেছে এখানে শুধু ওর দোষ কেন হবে? অরোনীও দোষী। কিন্তু আপনার বিচার দেখে মনে হচ্ছে আমার ভাই অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছে!”
নির্মল দীপ্তির কথা অগ্রাহ্য করে বললেন,” তারপর অরোনীর কাছে ক্ষমাও চাইবে তুমি।”
রুবায়েত বলল,” আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে। ভাবীর সাথে মজা করাটা আসলেই উচিৎ হয়নি। সেজন্য অবশ্যই আমি ক্ষমা চাইবো ভাবীর কাছে। ভাবী, অরোনী ভাবী। একটু বাহিরে আসুন প্লিজ।”
এই কথা বলতে বলতে রুবায়েত অরোনীদের বেডরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রুবায়েতের কণ্ঠ শুনে রাফাত উঠে এলো। বাহিরে বের হয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিল যাতে ভেতরের দৃশ্য দেখা না যায়। রুবায়েত তাও চেষ্টা করছে অরোনীকে দেখার জন্য। রাফাত কঠিনমুখে বলল,” কি হয়েছে?”
রুবায়েত সরল কণ্ঠে জবাব দিল,” আমি ভাবীর কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।”
” কেন?”
” ছোট্ট একটা মজা করেছিলাম। ভাবী হয়তো কষ্ট পেয়েছেন অথবা আমাকে ভুল বুঝেছেন৷ তাই আমার মনে হচ্ছে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। ভাবীকে একটু ডেকে দিন।”
রুবায়েতের কণ্ঠ থেকে এমনভাবে বিনয় ঝরছে যেন সে ভীষণ নির্দোষ। আর নির্দোষ হয়েও অনুতপ্ত বোধ করছে। রাফাত খুব কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে বলল,” ক্ষমা চাইতে হবে না। যাও তুমি।”
” না, এটা কিভাবে হয়? আমার নিজের কাছেই এতো খারাপ লাগছে। ভাবী যে এভাবে আমাকে ভুল বুঝবে আমি ভাবিনি। তার পায়ে ধরে ক্ষমা না চাইলে আমার শান্তি লাগবে না। যতক্ষণ ভাবী আমাকে ক্ষমা না করবে আমি এখান থেকে যাবো না। প্লিজ, ভাবী একটু বাহিরে আসুন।”
রুবায়েত পারলে রাফাতকে অগ্রাহ্য করেই ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। এবার রাফাতের ধৈর্য্যের বাঁধ একদম ভেঙে গেল। বাবা, চাচা, কাউকে মানল না। হাত মুষ্টি করে রুবায়েতের বাম চোয়ালে ভয়ংকর একটা ঘুষি মারল। সবাই হতবাক হয়ে গেল। যারা বসেছিল তারাও উঠে দাঁড়িয়ে গেছে। রাহাত কাছে এসে চিৎকার করল,” রাফাত এটা কি করলি?”
রাফাত পর পর আরও দুইটা ঘুষি মারল। রুবায়েত মেঝেতে পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। রুমা আর্তনাদ করে উঠল,” ছোটভাইয়া মেরো না প্লিজ।”
রাফাত শুনল না। রুবায়েতের কলার টেনে আরেকটা দিতে যাচ্ছিল তখনি দীপ্তি চেঁচিয়ে উঠল,
” থামো বলছি। আরে এটা কি ধরণের অসভ্যতা শুরু হয়েছে? কেউ ওকে কিছু বলছে না কেন? আমার ভাইটাকে মেরে ফেলল! বাবা আপনিও কি কিছু বলবেন না?”
কেউ দীপ্তির কথার উত্তর দিচ্ছে না। দীপ্তি হিংস্র চোখে রাফাতের দিকে চেয়ে বলল,” আমার ভাইয়ের গায়ে তুমি কোন সাহসে হাত তুললে? তোমার নামে আমি মামলা করবো। গুন্ডা কোথাকার!”
রাফাত রক্তিম দৃষ্টিতে পালটা প্রশ্ন করল,” আগে বলো তোমার ভাই কোন সাহসে অরোনীর গায়ে হাত দিয়েছে? ”
দীপ্তি ফোঁসফোঁস করে বলল,” কে বলেছে? আমার ভাই কখনও এমন কাজ করবে না। অরোনী বললেই হলো? আমি রুবায়েতকে চিনি না? তোমার বউ মিথ্যা কথা বানিয়ে বলছে।”
রাফাত দাঁত খিচে বলল,” অরোনী এখনও আমাকে কিছুই বলেনি। কিন্তু যখন বলবে তখন আমি..”
দীপ্তি ঝটপট বলল,” কিছু বলেনি তাও তুমি ওর গায়ে হাত তুললে? পুরোটা না জেনেই? এখনি ক্ষমা চাইবে তুমি ওর কাছে। ”
রাফাত নির্মল সাহেবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,” বাবা, তুমি কিছু বলবে না?”
নির্মল বললেন,” বাড়ির ভেতর ওকে মারাটা উচিৎ হয়নি।”
দীপ্তি চোখ বড় করে জানতে চাইল,” তাহলে কি বাইরে নিয়ে মারা উচিৎ?”
নির্মল গম্ভীরমুখে মাথা নাড়লেন।
” মারা তো অবশ্যই উচিৎ।” দীপ্তি ক্রোধপূর্ণ কণ্ঠে বলল, ” না জেনে কারো গায়ে হাত তোলা ক্রাইমের পর্যায়ে পড়ে।”
” তাহলে তুমিও ক্রাইম করেছো। পুরো ঘটনা না জেনেই রিতুকে চড় মেরেছো৷ পারবে ওর কাছে ক্ষমা চাইতে?”
রাফাতের কথা শুনে রাহাত বিক্ষিপ্ত মেজাজে ছুটে এলো।
” কি বললি তুই? আরেকবার বল! আমার বউ ক্ষমা চাইবে কাজের মেয়ের কাছে? তুই তো ভালোই হিপোক্রিট। মাকে মাফ চাইতে বলিস বউয়ের কাছে। বড় ভাবীকে মাফ চাইতে বলিস কাজের মেয়ের কাছে। তোর কি দিন দিন বোধশক্তি লোপ পাচ্ছে?”
রাফাত মাথা নিচু করে কঠিনভাবে বলল,” আমার বোধশক্তি ঠিক জায়গাতেই আছে। ভাবী অন্যায়ভাবে রিতুর গায়ে হাত তুলেছে। রিতুর জায়গায় নিলিমা হলেও আমি একই রিয়েক্ট করতাম।”
এই কথা শুনে নিলিমার গা জ্বলে উঠল। এর মানে কি? ছোটভাইয়া রিতুর সাথে তাকে তুলনা করছে! অর্থাৎ এই বাড়ির মেয়ে আর কাজের মেয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই? অথচ ঘরের ভেতর থেকে কথাটা শুনেই রিতুর চোখে আবার পানি চলে এলো। তার চোখের এই অশ্রু কৃতজ্ঞতার। এই বাড়িতে অনেকের কাছেই তো কতবার বকশিশ পেয়েছে সে। কিন্তু সম্মান কারো কাছে পায়নি। আজকে ছোটভাইয়ের কাছে পাওয়া হলো। রাহাত রাবেয়ার কাছে গিয়ে বলল,” মা, তোমাকে আমি আজকেই বলে দিচ্ছি। এই ছেলে তোমার বাড়ির মান-সম্মান ডুবিয়ে ছাড়বে। ওর কথার ধরণ দেখেছো? রীতিমতো দীপ্তি আর রুবায়েতকে জঘন্যভাবে অপমান করেছে। যে আমার বউকে এভাবে অপমান করে তার সাথে আমি এক বাড়িতে থাকবো না। এবার তুমিই ঠিক করো মা, ও বেরিয়ে যাবে নাকি আমি? আজকে এর একটা ফয়সালা অবশ্যই দরকার।”
রাবেয়া একবার বড় ছেলের দিকে তাকাচ্ছেন আরেকবার ছোট ছেলের দিকে। রাহাত হাঁফ ছেড়ে আবার বলল,” আরও একটা কথা তোমাকে বলে দিচ্ছি মা, এই ছেলের সাথে থাকলে তুমি জীবনে আরও অপমানিত হবে। নিজের বউয়ের কাছে তোমাকে মাফ চাওয়েছিল মনে নেই?কয়দিন পর দেখবে তোমাকে দিয়ে বউয়ের পা টেপাচ্ছে৷ তখন কি করবে?”
রাবেয়া হতভম্ব হয়ে যাচ্ছেন। ছোটভাইয়ের প্রতি বড়ভাইয়ের এতো ক্ষোভ! মা হয়ে দুইছেলের এমন বিবাদে তিনি কার পক্ষ নেবেন? দীপ্তি আর অরোনীর মধ্যে রাবেয়া কাউকেই পছন্দ করেন না। অরোনীর সাথে তিনি এখন যেটা করছেন সেটা আলগা আহ্লাদ। দূর্ব্যবহার করে অরোনীকে আর জ্বালানো যাচ্ছে না। তাই ভালো ব্যবহার করে জ্বালাচ্ছেন! কিন্তু রাফাতকে তিনি প্রচন্ড ভালোবাসেন। আজ পর্যন্ত রাফাত কখনোই তাঁর মনে কষ্ট দেয়নি। কিন্তু রাহাত অনেকবার কষ্ট দিয়েছে। তাই রাবেয়াও ভালোমতো বোঝেন কোন ছেলে তাঁর জন্য সঠিক! তিনি রাফাতের কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” আমার ছেলে আমার কাছেই থাকবে। তুই বেরিয়ে যা!”
রাহাত মায়ের উত্তর শুনে হকচকিয়ে গেল।
চলবে
অরোনী, তোমার জন্য~১৪
লিখা- Sidratul Muntaz
বদ্ধ ঘরে দীপ্তি সশব্দে রুবায়েতের গালে চড় মারল। রুবায়েত হতচকিত দৃষ্টিতে বলল,” আপা তুমিও?”
দীপ্তির ক্রোধানলে পুড়ছে। রাগে খিটমিট করে বলল,” এতোবড় স্পর্ধা তোর কিভাবে হলো? একবারও আমার মান-সম্মানের কথা চিন্তা করলি না? ফাজিল, লাফরাঙ্গা!”
রুবায়েত কোনো উত্তর দিল না৷ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিচে তাকিয়ে আছে। দেখলে মনে হবে সে ড্রাগস নিয়ে নেশায় টাল-মাটাল। এই জগতের কোনো ধ্যান-ধারণা তার মাঝে নেই। দীপ্তি ক্রমাগত পায়চারী করতে লাগল। লিভিংরুমে এখন পারিবারিক তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে। সেই সুযোগে দীপ্তি রুবায়েতকে নিয়ে নিজের বেডরুমে চলে এসেছে। ওখানে থাকলে আরও মার খেতো সে। দীপ্তির নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। আগে যেখানে দেবর-ননদেরা মুখে হাসি ছাড়া দীপ্তির সঙ্গে কথা বলতো না তারাই আজ কেমন বক্র দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। রাফাত তো রীতিমতো দীপ্তিকে সবার সামনেই বিনা ডিটারজেন্টে ধুঁয়ে দিয়েছে। কারো সামনে মাথা তুলে তাকানোর উপায়টুকুও নেই৷ এই বাড়িতে আর থাকা সম্ভব না তার পক্ষে। সবার অসম্মানের ব্যাক্তি হয়ে দীপ্তি এখানে থাকতে চায় না। দীপ্তি চেঁচিয়ে বলল,” তোর জন্য রুবায়েত, তোর অসভ্যতামির জন্য আজকে আমার এই শোচনীয় অবস্থা। সবার মাথা হেঁট করে দিলি তুই। তোর কোনোদিন ভালো হবে না দেখিস।”
দীপ্তি কাঁদতে লাগল হাউমাউ করে। আপার কান্না দেখেও রুবায়েতের মধ্যে কোনো হেল-দোল দেখা যাচ্ছে না। সে নিজস্ব ঘোরে আটকে থেকেই বলল,” আপা, আমি অরোনীকে বিয়ে করতে চাই।”
কথাটা শুনে দীপ্তির চোখ স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠল। কাছে এসে রুবায়েতকে একাধারে আরও দু-একটা চড় দিয়ে বলল,” তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। টোটালি ইনসেন তুই৷ তোর ট্রিটমেন্ট দরকার। আল্লাহ, এ কেমন বিপদে ফেললে তুমি? তোর মতো কুলাঙ্গার ভাই আর কারো না হোক।”
রাহাত ঘরে ঢুকেই বলল,” অনেক কষ্ট করে মাকে ম্যানেজ করেছি। নাহলে আজকেই আমাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হতো।”
দীপ্তি বিস্ফোরিত গলায় বলল,” তোমার কিভাবে মনে হলো যে এতোকিছুর পরেও আমি এই বাড়িতে থাকবো? রাফাত আমাকে কি অপমানটাই না করল সকলের সামনে। সে যদি এসে আমার পায়ে ধরে পড়ে থাকে তাও আমি এখানে থাকবো না।”
” রাফাত জীবনেও তোমার পায়ে ধরবে না। সেই আশা করেও লাভ নেই। কিন্তু এখানে না থাকলে তো সমস্যা হয়ে যাবে। এমনিই বাড়ির সাথে আমার দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে।”
” তাহলে তুমি থাকো তোমার বাড়ি নিয়ে। আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। আমি তোমাদের সবার সাথে এখানে অবহেলার পাত্রী হয়ে থাকতে পারবো না। আমার এখনি দমবন্ধ লাগছে। আমার এতোদিনের সব মান-সম্মান ধুঁলোয় মিশে গেল।”
রাহাত আঁড়চোখে রুবায়েতের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলল,” এমন ভাই যার থাকে, তার মান-সম্মান ধুঁলোয় মিশবে না তো কি?”
দীপ্তি রুবায়েতের কাছে গিয়ে রোষপূর্ণ কণ্ঠে বলল,” বের হো তুই এখান থেকে। আমার চোখের সামনে আর কোনোদিন আসবি না।”
রুবায়েত নমনীয় গলায় বলল,” আপা অরোনী..”
” চুপ। একদম চুপ। আরেকবার অরোনীর নাম উচ্চারণ করলে আমি তোকে গলা টিপে মারবো।”
বিকট শব্দ হলো। হুট করেই দীপ্তিদের শোবার ঘরে ঢুকে পড়েছে রাফাত। রুবায়েতকে দেখেই মেজাজটা তার সপ্তম আসমানে উঠে গেল। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” এই স্কাউন্ড্রেল এখনও যায়নি কেন?”
রাহাত দুইহাতে রাফাতকে আটকাতে চেষ্টা করল। কিন্তু সম্ভব হলো না। রাফাত সর্বোচ্চ হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল রুবায়েতের উপর। তার পরনের ডেনিম জ্যাকেট প্রায় টেনে-টুনে ছিড়ে ফেলল। ধাক্কা মারতে মারতে বলল,” বের হো, আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় যেন তোকে আর না দেখি।”
দীপ্তি কাঁদতে কাঁদতে বলল,” রাফাত প্লিজ, ও এমনিই চলে যাবে। তোমার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।”
রাফাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দীপ্তির দিকে তাকালো। দীপ্তি তখনি মাথা নিচু করে ফেলল। মাথা নিচু করা ছাড়া তার আজ অন্যকোনো উপায় নেই। আজ তার মাথা নিচু করার দিন।
” কেউ যদি অরোনীর কাছেও আসে আমি তার মাথা ফাটিয়ে দিবো।”
তানজিমা আর নিলিমা ভয়ে দৌড়ে পালালো। সন্ধ্যায় তারা গিয়েছিল অরোনীর সাথে সকালের দূর্ঘটনার ব্যাপারে কথা বলতে। কিন্তু রাফাত কাউকেই অরোনীর কাছে ঘেষতে দিচ্ছে না। শীলা চাচীকে পর্যন্ত তাড়িয়ে দিয়েছে। সেখানে তানজিমা আর নিলিমা তো কোন ছাড়! এই মাত্র মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার হুমকি শুনে তারা দৌড়ে নিচে চলে এলো।
নিচতলায় একটা গেস্টরুমের মতো আছে। এখানে বুকশেল্ফ দিয়ে ভর্তি। তাহসিন বসে বসে বই পড়ে। এখনও সে বই পড়ছে। তানজিমা আর নিলিমার উপস্থিতি লক্ষ্য করে একবার মাথা তুলে তাকাল। তারপর আবার বইয়ে মনোযোগ দিল। চশমা চোখের ছেলে তাহসিন খুবই কিউট। তাকে বাড়ির সবাই ডাকে,” গুড বয়।” কারণ পড়াশুনা ছাড়া অন্যকোনো কাজ তাকে করতে দেখা যায় না। ছেলেটা কোনো দুষ্টুমীতেও থাকে না। তবে মাঝে মাঝে বুদ্ধিমানের মতো বুদ্ধি করে দু-একটা কথা বলে। তার সেই কথাগুলো খুব কাজে লাগে। তানজিমা আর নিলিমা তাহসিনের সামনে বসেই ফিসফিসিয়ে আলাপ করছিল। তাদের আলোচ্য বিষয় অরোনী।
” অরোনীর অবস্থা খুবই খারাপ। সারাদিন একবারও ঘর থেকে বের হয়নি। আর ওই দূর্ঘটনার পর সে পুরো চল্লিশ মিনিট লাগিয়ে গোসল করেছে। খুব অদ্ভুত তাই না?”
তানজিমার কথার উত্তরে নিলিমা বলল,” অদ্ভুত তো বটেই। কিন্তু ছোটভাবীর শুচিবায়ু রোগ আছে। তাই মনে হয় গোসল করেছিল।”
তানজিমা মাথা নেড়ে বলল,” উহুম। আমার মনে হয় যথেষ্ট খারাপ কিছু হয়েছে। নাহলে অরোনী এতোক্ষণ লাগিয়ে গোসল করবে কেন? ওইসময় কারো গোসল করার মতো অবস্থা থাকে?”
নিলিমা একটু ভেবে বলল,” ধূর, কিভাবে যে আসল ঘটনা জানবো! ছোটভাইয়া তো ভাবীর কাছে যেতে কাউকে এলাউ করছে না। আচ্ছা, ছোটভাইয়া এমন করছে কেন?”
তাহসিনের থেকে উত্তর এলো,” এইসময় ছোটভাবী খুবই মানসিক ফ্রাস্ট্রেশনে ভুগছে। সবাই মিলে যদি তাকে এই ব্যাপারে একাধারে প্রশ্ন করে তাহলে সে আরও বেশি ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে যাবে। ঘটনাটা ভুলতেও তার সময় বেশি লাগবে। তার মানসিক অবস্থা এখন খুবই খারাপ। শারীরিকভাবে সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কিন্তু মেন্টালি অনেক বেশি ড্যামেজ হয়ে গেছে। এই ব্যাপারটা আমরা কেউ বুঝতে চাইছি না। কিন্তু ছোটভাইয়া খুব ভালো মতো বুঝতে পারছেন। আফটার অল, দে আর সৌলমেইটস। ব্যাসিকেলি ছোটভাবীর মেন্টাল হেলথের কথা চিন্তা করেই ছোটভাইয়া তাকে সবার থেকে আলাদা করে রাখছে। এইসময় একটা মেয়ের জন্য মেন্টাল সাপোর্ট আর স্পেস খুব দরকার।”
তাহসিন বইয়ের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছে। মনে হলো যেন বই পড়েই বলছে। নিলি আর তানজু কিছুক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে রইল। একটু পর তানজু বলল,” ঘোড়ার আন্ডা। এতো ঢং নিয়ে কে বসে আছে? বউয়ের চিন্তায় ছোটভাইয়ের মাথা খারাপ হয়ে গেছে তাই সে এমন করছে।”
তানজু কথা শেষ করে হাসতে লাগল। নিলি বলল,” আচ্ছা তাহসিন, তুই সবসময় এমন জ্ঞানীদের মতো কথা বলিস কেন?”
উর্মি এসে উত্তর দিল,” যে সারাক্ষণ বই পড়ে সে-ই তো জ্ঞানীদের মতো কথা বলবে। এটা খুব স্বাভাবিক। তোমাদের মতো কূটনীরা তো আর জ্ঞানীদের মতো কথা বলবে না তাই না?”
তানজু চোখ পাকিয়ে বলল,” কে কূটনী?”
উর্মি নির্বিকার গলায় বলল,” তুমি, রুমাপু, নিলিপু। তোমাদের কূটনীতির সর্দার হলো রুমাপু। ওহ বাই দ্যা ওয়ে, আজ তোমাদের সর্দারনি কোথায়?”
নিলিমা আক্ষেপ করে বলল,
” সে রুবায়েত ভাইয়ের শোকে কাতর হয়ে ঘরে দরজা বন্ধ করে কাঁদছে।”
” কেন?”
” রুবায়েত ভাইয়ের সাথে তার বিয়ের কথা চলছিল না? এখন এই ঘটনার পর বিয়েটা কি আর হবে?”
উর্মি হাসতে হাসতে বলল,” বুঝলাম। এখনও কি তার বিয়ে করার স্বাদ মেটেনি?”
নিলিমাও খিলখিলিয়ে হেসে বলল,” না। এখনও মেটেনি।”
” ওকে দীপ্তি ভাবীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া উচিৎ। দু’জনে একসাথে গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদুক।”
” ঠিক বলেছিস। আজ তাদের দু’জনেরই কাঁদার দিন। একজনের ভাই, অন্যজনের হবু বর আর কখনও এই বাড়িতে ঢুকতে পারবে না।”
তানজিমা তীক্ষ্ণ গলায় বলল,” তোদের কি মনে হয়? সত্যিই আর কখনও রুবায়েত ভাই এই বাড়িতে আসবে না? অবশ্যই আসবে। রুমা কালকেই ফোন করে কেঁদে কেটে ওকে নিয়ে আসবে দেখবি।”
উর্মি সুর টেনে বলল,
” এতো সহজ না! ও আরেকবার এই বাড়িতে ঢুকলে ছোটভাই ওর ঠ্যাঙ ভেঙে দিবে। বলেছে আমাকে।”
তানজু সুযোগসন্ধানীর মতো বলল,
” আর যখন ছোটভাইয়া অফিসে চলে যাবে তখন?”
নিলি কিছু একটা ভেবে বলল,” একটা আইডিয়া পেয়েছি। কাল যখন ছোটভাইয়া অফিসে চলে যাবে তখন আমরা ছোটভাবীর ঘরে উর্মিকে পাঠাবো।”
তানজু বলল,” ভালো বলেছিস। এটা করা যেতে পারে।”
উর্মি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,” আমাকে কেন? হোয়াই মি?”
তানজু মাথা দুলিয়ে বলল,
” আরে তোর সাথেই তো ছোটভাবীর ভালো সম্পর্ক। তুই সবকিছু ডিটেলস জেনে আসবি৷ রুবায়েত ভাই তার সাথে কি কি করেছে, কেন করেছে.. এসব।”
উর্মি মুখ কুচকে বলল,” ছি, তোমরা এসব জানার জন্য বসে আছো? এজন্যই ছোটভাইয়া তোমাদের ঘরে ঢুকতে দেয়নি। একেবারে ঠিক হয়েছে।”
তানজু আর নিলি রাগে চোখাচোখি করল। তানজু বলল,” তোকে মনে হয় খুব ঢুকতে দিয়েছে?”
” আমাকেও দেয়নি অবশ্য। কিন্তু তোমাদের মতো ধমক দেয়নি। আমাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছে।”
তানজু সরু চোখে জিজ্ঞেস করল,” কি বুঝিয়ে বলেছে?
” ছোটভাইয়া বলেছে, এখন তো ছোটভাবীর মন ভালো নেই৷ একটা খারাপ ব্যাপার ঘটে গেছে। বাড়ির সবার মধ্যে কথাটা জানাজানি হয়েছে। তাই সে এখন সবার সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছে। কথা বলতেও তার অস্বস্তি লাগছে। আস্তে আস্তে যখন সে সহজ হয়ে উঠবে তখন নিজেই আমাকে ডেকে দেখা করিয়ে দিবে ভাবীর সাথে। এভাবেই বলেছে ভাইয়া।”
নিলি বলল,” তাহলে তো তাহসিনের কথাগুলোই ঠিক।”
উর্মি মাথা নেড়ে বলল,” হুম। একদম ঠিক।”
অরোনী সারাদিন ধরে কিছু খায়নি। পুতুলের মতো থম মেরে বসে থেকেছে। রাফাত এইমাত্র জোর করে ভাত খাইয়ে দিল। তাও অর্ধেক খাওয়ার পর অরোনী বলল,খাবে না। রাফাত খাবার রেখে দিল। অরোনীকে শুয়ে পড়ার জন্য বিছানা করে দিল। অরোনী রাফাতের হাত ধরে আছে। রাফাত কিছুক্ষণ মায়ার দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল,” চুমু দেই?”
অরোনী মাথা নেড়ে অনুমতি দিল। রাফাত অরোনীর দুইগালে সময় নিয়ে দু’টো আদুরে চুমু দিল। তারপর তাকাতেই দেখল অরোনীর চোখে পানি। রাফাতের গলা জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে ফেলল অরোনী। রাফাত তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” থাক, কিছু হয়নি। সব ঠিক হয়ে গেছে। মনে করো একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছো।”
দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। রাফাত গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,” কে?”
রিতুর কণ্ঠ শোনা গেল,” ছোটভাইয়া আমি।”
রাফাত অরোনীর দিকে চেয়ে বলল,” রিতু এসেছে। দরজা কি খুলবো?”
অরোনী মাথা নেড়ে বোঝালো,” হ্যাঁ।”
রাফাত গিয়ে দরজা খুলল। রিতু একবার অরোনীর দিকে তাকিয়ে বলল,” আজকে ছোটভাবীর সাথে আমি থাকি?”
রাফাত অরোনীর দিকে চাইল। অরোনী মাথা হেলিয়ে রাজি হয়ে গেল। রাফাত রিতুর কাঁধে হাত রেখে বলল,” ঠিকাছে, তোরা দু’জন তাহলে এখানে থাক। আমি ড্রয়িংরুমে শুয়ে পড়ছি।”
রিতু হেসে বলল,” আইচ্ছা।” তারপর সে অরোনীর কাছে বিছানায় গিয়ে বসল। অরোনী কেবল মাত্র রিতুর সাথেই স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে পারছে। এছাড়া বাড়ির অন্যকারো সামনেও যেতে চাইছে না। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে অনেকদিন বিষণ্ণতায় ভুগতে হবে মেয়েটাকে। রাফাত এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে! নিজের বাড়িতেও সে অরোনীকে নিরাপত্তা দিতে পারল না। কতবড় বিপদ ঘটে গেল। কাল থেকে তো অফিসে যেতেও ভয় লাগবে।
রাবেয়া দুইতলায় এসে দেখলেন রাফাত সোফায় শুয়ে আছে। রাবেয়া কাছে এসে বললেন,” কিরে, তুই এখানে কেন? বউমা কি ঘরে একা?”
রাফাত উঠে বসতে বসতে বলল, ” একা না। রিতুও আছে ওর সাথে। তুমি কিছু বলবে মা?”
” হ্যাঁ। আমি এসেছিলাম একটু বউমার সাথে কথা বলতে।”
” অরোনী এখন কারো সাথে কথা বলতে পারবে না।”
” কেন? কথা না বলার মতো কি হয়েছে? এইখানে তো তার দোষ নেই। তাহলে কথা বলবে না কেন?”
” ব্যাপারটা দোষের না। তুমি বুঝবে না। কেন এসেছো আমাকে বলো।”
” তোকে কি সব কথা বলা যায় নাকি? এইসব মেয়েলী ব্যাপার।”
” কি এমন মেয়েলী ব্যাপার যা ছেলে হয়ে আমি বুঝবো না?”
” বুঝবি।কিন্তু…”
” বলে ফেলোতো মা।”
” রুবায়েতের সাথে তুই আজকে যা করলি সেটা কি ঠিক হলো? মেরেছিস আবার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিস। এতো অপমান না করলেও চলতো।”
” তুমি কি এটা বলার জন্য এসেছো?”
” না। আরও কথা আছে। এই ছেলের সাথে তো রুমার বিয়ে ঠিক করেছিলাম।”
রাফাত বিস্মিত হয়ে বলল,” হোয়াট? রুমার বিয়ে? তাও ওই স্কাউন্ড্রেলের সাথে?”
“পাত্র হিসেবে রুবায়েত ভালোই ছিল। বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, ভালো ফ্যামিলি আছে, দেখতেও সুন্দর। আবার দীপ্তির কাজিন। ভেবেছিলাম সবদিক দিয়ে ভালোই হবে। কিন্তু কে জানতো ছেলের চরিত্র যে এতো খারাপ! আমি এই ব্যাপারেই অরোনীর সাথে একটু কথা বলতাম।”
” এই ব্যাপারে অরোনীর সাথে আবার কি কথা?”
রাবেয়া ইতি-উতি করে বললেন,” আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে রুবায়েত আসলেই মজা করেছিল। ভাবী হিসেবে মজা তো করতেই পারে। অরোনীই ভুল-ভাল ভেবে এতোকিছু করে ফেলেছে। ছেলেটার মনে হয় দোষও নেই। অকারণে বেচারা মার খেল। সে কিন্তু একবারও স্বীকার করেনি।”
” চোর কি জীবনে স্বীকার করে যে সে চুরি করেছে? আর তুমি অরোনীর অবস্থা দেখতে পাচ্ছো না মা? মেয়েটার মধ্যে ভয়ংকর পরিবর্তন এসে গেছে। আজকে সারাদিন ও একবারও হাসেনি। কথাও বলছে না ঠিকমতো। একটু পর পর কাঁদছে। সামান্য ঘটনা হলে কি সে এমন করতো?”
রাবেয়া চোখ বড় করে বললেন,” বলিস কি? না জানি কতবড় সর্বনাশ হয়ে গেছে! এটা তো এই বাড়ির মান-সম্মানের প্রশ্ন। আমার এখনি অরোনীর সাথে কথা বলতে হবে।”
” অসম্ভব। তুমি অরোনীর সাথে এই বিষয় নিয়ে একটা কথাও বলবে না।”
” কেন বলবো না? পরিষ্কার করে জানতে হবে না কি হয়েছিল?”
” এটা পরিষ্কার করে জানার মতো বিষয় না মা। জানার থেকেও বেশি ইম্পোর্ট্যান্ট অরোনীর ভুলে থাকা এবং ভালো থাকা। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এটা আর বললেও ফিরে আসবে না। কিন্তু বার-বার এই বাজে বিষয়টা নিয়ে প্রশ্ন তুললে অরোনী আরও হতাশাগ্রস্ত হবে। সে তো এই খারাপ স্মৃতিটা এমনিই ভুলতে পারছে না। তার উপর তোমরা এভাবে উঠে-পরে লাগলে সে কিছুতেই ভুলতে পারবে না। এরপর যদি উল্টা-পাল্টা কিছু করে ফেলে মেয়েটা? আমি ওকে নিয়ে যতটা ভয়ে আছি সেটা তোমাকে বলে বোঝানো সম্ভব না। প্লিজ মা, অরোনীকে একটু স্পেস দাও। একটু নিজের মতো থাকতে দাও ওকে। প্রশ্ন করার জন্য অনেক সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু অরোনীর কিছু হয়ে গেলে সেটা আর ঠিক করা যাবে না।”
রাবেয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,” ঠিকাছে। আমি আর আসবো না। ওকে কোনো প্রশ্নও করবো না। হয়েছে?”
রাবেয়া এই কথা বলেই চলে গেলেন। কিন্তু রাফাত নিশ্চিন্ত হতে পারল না। সে জানে, কাল সে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই আবার সবাই হামলে পড়বে অরোনীর উপর। তাকে হাজারটা প্রশ্ন করে মাথাখারাপ করে ফেলবে। রাফাত এভাবে কতক্ষণ সবাইকে পাহারা দিয়ে আটকে রাখতে পারবে কে জানে?
চলবে