অরোনী, তোমার জন্য~১৫,১৬

অরোনী, তোমার জন্য~১৫,১৬
লিখা- Sidratul Muntaz
১৫

দীপ্তির সারারাত ভালো ঘুম হয়নি। সকালেও দ্রুত ঘুম ভেঙে গেছে। ঘরের বাহিরে বের হতেও লজ্জা লাগছে এখন। কিছুক্ষণ আগে নিচে গিয়েছিল। তখন আড়াল থেকে শুনেছে ডাইনিংরুমে ননদিরা কিভাবে ব্রেকফাস্টে বসে তাকে নিয়ে হাসি-মশকরা করছে! তানজিমা বলছিল দীপ্তি নাকি প্রতিদিন সকাল-সকাল উঠে বাপের বাড়ির মেহমানদের জন্য নাস্তা বানাতো। কিন্তু আজ সে রুম থেকেই বের হচ্ছে না। তখন নিলিমা হাসতে হাসতে বলেছে, আর কখনোই দীপ্তির পরিবারের মানুষ এ বাড়িতে ঢোকার সাহস পাবে না। সেজন্যই নাকি দীপ্তি দরজা আটকে শোক পালন করছে। এসব শুনে দীপ্তি আর ওদের সামনে যায়নি। নীরবে নিজের রুমে ফিরে এসেছে। ইশ, কি অপমান! নিজের চেয়ে বয়সে ছোট মেয়েগুলোর থেকে এমন অপমান সহ্য করা যায় না। দীপ্তির মন চাইছে লুকিয়ে থাকতে। সে কত চেষ্টা করেছিল রুবায়েতের দোষটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য। কিন্তু লাভ হলো না। রুবায়েত বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছিল। বাড়ির সবার সামনে এমনভাবে কথা বলেছে যে কারো আর বুঝতে বাকি নেই। গতকাল তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে এমনিতেই বোঝা যাচ্ছিল যে সে কত জঘন্য অপরাধী। দীপ্তির আর কি করার? মান-সম্মান সব গেছে। এই বাড়িতে থাকার কোনো মানে হয় না। আজ রাহাত বাড়ি ফিরলে সে বড়সড় একটা ঝগড়া লাগাবেই। রাহাতও চালাকি করে আজ দ্রুত অফিসে চলে গেছে। দীপ্তির ফোন ধরছে না। দীপ্তি রাহাতের কাছেও খুব ছোট হয়ে গেল।

তানজিমা নিলিমার হাতটা ধরে হাঁটছে। তাদের গন্তব্য উর্মিদের ঘর। ছোটভাইয়ার এতোক্ষণে অফিসে চলে যাওয়ার কথা। উর্মিকে ছোটভাবীর কাছে পাঠাতে হবে। আগে তানজু,নিলি আর রুমা তিনজন সবসময় একসাথে থাকতো। রুবায়েতের ওই ঘটনার পর থেকে রুমার মন প্রচন্ড খারাপ। সে এখন দীপ্তির মতোই দরজা আটকে ঘরে বসে থাকছে। বেচারীর এবারও বিয়েটা ভেঙে গেল। মেয়েটার বিয়ের ভাগ্য এতো খারাপ! যার সাথেই বিয়ে ঠিক হয় তারই কোনো না কোনো সমস্যা বের হয়। উর্মিদের ঘরের কাছাকাছি এসেই পা থমকে গেল দু’জনের।
উর্মির মা-বাবা মানে ছোট চাচা আর ছোট চাচীর মধ্যে ঝামেলা লেগেছে। তারা একে-অপরের সাথে তর্কে ব্যস্ত। তাদের এই তর্কাতর্কির মূল বিষয় গতকালকের দূর্ঘটনা।
ছোট চাচা বলছেন,” তোমার সমস্যা কি?”
আশা জবাব দিলেন,” আমার সমস্যা তোমাকে নিয়ে। আগ বাড়িয়ে রুবায়েতকে অপমান করতে গেলে কেন? বাড়ির সবাই তো ছিল সেখানে। তোমার কথা বলার কি প্রয়োজন ছিল?”
” কথা বলেছি তো এখন কি হয়েছে? জাত চলে গেছে? এতোবড় একটা ঘটনা ঘটলো বাড়ির বউয়ের সাথে। আর আমি প্রতিবাদ করবো না?”
” তোমার প্রতিবাদের জন্যই তো আমার সাথে দীপ্তির সম্পর্কটা নষ্ট হবে এখন। আর বাড়ির বউ কাকে বলছো? অরোনীর মধ্যে কি বাড়ির বউয়ের কোনো বৈশিষ্ট্য আছে? না কোনো কাজ করে আর না বাড়ির বউয়ের মতো চলা-ফেরা করে। তাকে তো দেখলে মনে হয় এই বাড়ির মেয়ে বুঝি সে। সারাক্ষণ পটের বিবি সেজে দুইতলায় বসে থাকবে। চোখে কাজল, মুখে স্নো মেখে সাজগোজ করবে। আর মাথাভরা একগাদা চুল ছেড়ে রেখে নায়িকাদের মতো হাঁটবে। রুবায়েতের আর কি দোষ? যেকোনো ছেলে এমন অবস্থা দেখলে পাগল হবে। জীবনে কখনও মাথায় কাপড় দিতে দেখেছো ওকে? যা হয়েছে সব ওর দোষেই হয়েছে। এভাবে চলা-ফেরা করলে তো এমন হবেই।”
স্ত্রীর কথা শুনে ছোট চাচার মেজাজ গরম হয়ে গেল।
” কি আবোলতাবোল বলছো? মাথা ঠিকাছে? তুমি বলতে চাইছো এই দূর্ঘটনার জন্য অরোনীই দায়ী? রুবায়েতের দোষ নেই?”
” অবশ্যই তাই। ওই মেয়েই তো রূপ দেখিয়ে রুবায়েতের মতো সভ্য ছেলের মাথাটা খেয়েছে।”
” রুবায়েত সভ্য ছেলে!” ছোট চাচা বিষম খেলেন। রুবায়েত সভ্য হলে অসভ্য জিনিসটা কি? আশা একনাগাড়ে বলে যাচ্ছেন,” কত সুন্দর করে আমাকে ছোটচাচী বলে ডাকতো। দীপ্তি বলেছিল রুমার সাথে এই ছেলের বিয়ে হলে সে নাকি চাচী শাশুড়ীদের ডায়মন্ড নেকলেস উপহার দিতো। আহারে! কি সুন্দর চিন্তা!”
ছোটচাচা এতোক্ষণে বুঝতে পারলেন। ডায়মন্ড নেকলেসের জন্যই আফসোসে মরে যাচ্ছেন উর্মির মা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,” চিন্তা করো না। আমি তোমাকে ডায়মন্ডের নেকলেস কিনে দিবো। তাও এসব বলা বন্ধ করো। শুনতে বিশ্রী লাগছে যে আমার স্ত্রী হয়ে তুমি একটা বদমাইশের পক্ষ নিয়ে কথা বলছো।”
আশা ধমক দিয়ে বললেন,” খবরদার মিথ্যা স্বপ্ন দেখাবে না। ডায়মন্ড নেকলেসের যেই দাম তোমার তিনমাসের বেতন একত্র করলেও তা উঠবে না। ইশ, বিয়েটা যে কেন ভাঙলো! রাফাতও যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করেছে। ছেলেটার গায়ে হাত তোলার কি প্রয়োজন ছিল? বাড়িতে এতো মানুষ। তাও রাফাতকে কেউ কিছু বলল না কেন?”
ছোট চাচা হেসে বললেন,” ঠিকই তো আছে। ওর মেজাজ খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক। দূর্ঘটনা ঘটেছে ওর বউয়ের সাথে। যদি তোমার সাথে এই দূর্ঘটনা ঘটতো তাহলে কি আমিও ছেড়ে দিতাম নাকি?”
আশা এই কথায় অপ্রস্তুত হয়ে মুখে হাত চেপে ধরলেন। কি অসম্ভব কথা! রুবায়েতকে তিনি নিজের ছেলের মতো দেখেন। আর রুবায়েত কি-না তার সাথে.. ছিছি!
” তোমার আক্কেল জ্ঞান কোনোদিন হবে না। কি বলতে কি বলো! আমার সাথে এসব কেন হবে? আমি কি অরোনীর মতো চুল ছেড়ে, চোখে কাজল লাগিয়ে ঘুরি নাকি?”
ছোট চাচা টিপ্পনী কেটে বললেন,
” একবার চেষ্টা করে দেখো। তোমাকে অরোনীর চেয়েও সুন্দর লাগবে। তখন আর রুমার বিয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। এমনিই মানুষ ডায়মন্ডের নেকলেস নিয়ে হাজির হবে।”
” নাউজুবিল্লাহ!”
তানজু আর নিলি এসব শুনে চাপা শব্দে হাসছিল। হঠাৎ উর্মি বের হয়েই ওদের দেখে ফেলল।
” এই তোমরা আমাদের ঘরে আড়ি পাতছো কেন?”
উর্মির কথায় ছোট চাচা আর চাচীর তর্ক থেমে গেল। তারাও মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন। খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি। নিলি আমতা-অমতা করে বলল,” আড়ি পাতবো কেন? তোকে নিতে এসেছি৷ মনে নেই কাল কি বলেছিলাম? ছোটভাবীর ঘরে যেতে হবে।”
উর্মি বলল,” আমি এখন ছোটভাবীর ঘরেই যাচ্ছি। চলো একসাথে যাই।”
তানজু আর নিলি সমস্বরে বলল,” চল।”
তিনজন খুব উৎসাহ নিয়ে দুইতলায় উঠেছে। দীপ্তির ঘরের দরজা আটকানো। তারা দক্ষিণ পাশে অরোনীর ঘরের সামনে এলো এবং যথারীতি অবাক হলো। কারণ ঘর তালা দেওয়া। আশ্চর্য! ছোটভাইয়া আর ভাবী কেউই কি বাসায় নেই?

রাফাত গতরাতেই ভেবেছিল অরোনীকে কিছুদিন বাপের বাড়ি নিয়ে রেখে আসবে। কিন্তু বাড়ির মানুষদের এই কথা জানালে কেউ না কেউ বাধা দিতোই। তাই রাফাত বুদ্ধি করে কাউকে কিছু না বলেই সকাল সকাল বের হয়ে গেছে অরোনীকে নিয়ে। মাত্র দুইঘণ্টার রাস্তা। ব্যাক্তিগত গাড়ি দিয়ে যেতে বেশি সময় লাগল না। অরোনীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই রাফাতকে অফিসে যেতে হবে। অরোনী মায়ের সামনেই রাফাতের শার্ট মুষ্টিতে ধরে রেখেছে। কিছুতেই রাফাতকে যেতে দিবে না সে। রাফাত ইতস্তত করে বলল,” দেখুন তো আন্টি, আমার কাজ আছে। অফিসে আজ যেতেই হবে। গত পরশুই ছুটি নিয়েছিলাম। কালকেও হাফ ডে নিয়েছি। এতো ঘন ঘন কি ছুটি নেওয়া যায়?”
শারমিন অরোনীকে ধমক দিয়ে বললেন,” সমস্যা কি তোর? একটা চড় মারবো। ছাড় ওকে।”
শারমিন জবরদস্তি অরোনীর হাত ছাড়িয়ে দিলেন। অরোনীর চেহারাটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। রাফাতের এতো মায়া লাগল! ইচ্ছে করল সব ছেড়ে-ছুড়ে সারাদিন অরোনীর সামনে বসে থাকতে। কিন্তু চাইলেই সব সম্ভব হয় না। কাজও করতে হবে। শারমিন বললেন,” তুমি নাস্তা করেছো বাবা?”
” জ্বী আন্টি। আমরা বের হয়ে দু’জনই রেস্টরন্টে নাস্তা করেছিলাম।”
” আচ্ছা, যদি সময় পাও তাহলে রাতে এসো।”
” আসবো আন্টি।”
তারপর রাফাত অরোনীর দিকে চেয়ে কোমল গলায় বলল,” বাই। চলে যাচ্ছি আমি।”
অরোনী তাকালোই না। অভিমানে তার চেহারা শক্ত। শারমিন রেগে বললেন,” এই মেয়ে একটা পাগল! মানুষ কি কাজ-কর্ম না করে সারাদিন তোকে নিয়ে বসে থাকবে? এতো সকালেও যে ছেলেটা এতোদূর এসেছে তোকে নিয়ে এটাই তো অনেক। এখন আবার উল্টো পথ ঘুরে অফিসে যাবে। কত কষ্ট! আর সে বসে আছে ঢং নিয়ে।”
অরোনী রাগ দেখিয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে রুমে চলে গেল। শারমিন অবাক হয়ে বললেন,” মেয়েটার কি হয়েছে? কথা বলে না কেন?”
রাফাত নরম কণ্ঠে বলল,” ওর মনটা খুব খারাপ আন্টি। এজন্যই আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি। ওকে ধমক-টমক দিবেন না। একটু ভালো-মতো কথা বলবেন। ওর সাথে গল্প করবেন।”
শারমিন চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,” কি হয়েছে বলো তো বাবা? কেন মনখারাপ মেয়েটার?”
রাফাত মাথা নিচু করে বলল,” অনেক কাহিনী। এখন বলার সময় নেই। আপনি অরোনীর সাথে একটু কথা বলার চেষ্টা করেন। আপনি তো মা। হয়তো আমাদের কাছে ও যেটা বলতে পারছে না সেটা আপনার কাছে বলবে। আর না বললেও সমস্যা নেই। ওর মনটা যেন ভালো হয় তাই আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। এখানে নিপা ভাবী আছে, অথৈ আছে, ওদের সাথে মিলে-মিশে থাকলে অরোনীর ভালো লাগবে।”
শারমিনের দুশ্চিন্তা কমল না। তবুও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,” ঠিকাছে বাবা। তুমি সাবধানে অফিসে যেও।”
” আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
রাফাত চলে যেতেই শারমিন দরজা বন্ধ করে অরোনীর ঘরে গেলেন। না জানি কি হয়েছে মেয়েটার!

চলবে

অরোনী, তোমার জন্য~১৬
লিখা- Sidratul Muntaz

শারমিন অরোনীর পাশে এসে বসলেন। অরোনী মাকে দেখেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। তার ভালো লাগছে না কথা বলতে। নিজের আশেপাশে কাউকেই সহ্য হচ্ছে না। তার ইচ্ছে করছে রাফাতের সাথে অফিসে গিয়ে বসে থাকতে। রাফাত কাজ করবে আর সে চুপচাপ পাশে বসে দেখবে। এতে কি রাফাতের খুব অসুবিধা হয়ে যাবে? অরোনী নিজেই বুঝতে পারছে না কেন এতো ছেলেমানুষী ইচ্ছে জাগছে তার মনে।
এদিকে শারমিন ভাবছেন অন্য কথা। রাফাত বলেছিল অরোনীর সাথে ভালো ব্যবহার করতে। আজকে ছেলেটার চেহারা দেখে মনে হলো খুবই চিন্তিত সে। অরোনী কি শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে খুব ঝামেলা করছে? খুব বেশি জ্বালাতন করছে সবাইকে? বাড়িতেও অরোনী সবাইকে খুব জ্বালাতো। তাই শারমিন ভয় পান। যখন অরোনীর জন্য বিয়ের প্রস্তাবটা এসেছিল তখনও খুব ভয় পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর রগচটা মেয়েটা কি ওতবড় পরিবারে গিয়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে সবার সাথে? তবে রাফাতের আগ্রহ দেখে শারমিন রাজি হয়েছেন। ছেলেটা এমন পাগলামি করেছে যে বিয়ে দেওয়া ছাড়া অন্যকোনো উপায়ই ছিল না৷ তবে অরোনী খুব স্বাধীনচেতা মেয়ে। নিজের যা ইচ্ছা হবে তাই করবে। কারো অধীনে চলবে না সে। আজ পর্যন্ত অরোনীকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বাবা তো পাঁচবছর আগেই মারা গেছেন। এরপর ভাইয়ের কাছে মানুষ হয়েছে অরোনী। অনিকেত সবসময় অরোনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। কারণ তার ছিল নিজের বোনের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। তার বোন কখনোই স্বাধীনতার অপব্যবহার করবে না। সত্যি অরোনী করেনি। দেখতে এতো সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও কখনও চরিত্রে দাগ লাগায়নি। ওর সমবয়সীরা সবাই প্রেম করতো। অরোনী কখনও প্রেম করেনি। সে খুবই রুচিশীল মেয়ে। তার রুচির সাথে মেলে এমন ছেলের সন্ধান পাওয়াই দুষ্কর। রাফাতকে প্রথম দেখে শারমিন ভেবেছিলেন এবার বুঝি যোগ্য কাউকে পাওয়া গেল। কিন্তু অরোনী বিয়েতে রাজি হলো না। অনিকেতকে সে এই কথা বলতেও পারেনি। কারণ অনিকেত অরোনীকে স্বাধীনতা দিয়েছিল ‘ভাইয়ের পছন্দমতো বিয়ে করতে হবে’ এমন শর্ত রেখে। অরোনীর কাছে শর্ত পালন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তবুও অরোনী শারমিনকে অনুরোধ করেছিল যেন তিনি বিয়েটা ভেঙে দেন। শারমিন রাজি হোননি। এক প্রকার জোর করেই বিয়ে দিয়েছেন। রাফাতকে তিনি অসম্ভব পছন্দ করেছিলেন। আচ্ছা, সেই অভিমান থেকেই কি মেয়েটা আজকে এসব করছে? অরোনী ছোট থেকেই বড্ড অভিমানী! হতে পারে জোর করে বিয়ে দেওয়ায় তার অভিমান এখনও কাটেনি।
শারমিন অরোনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” তুই কেমন আছিস মা? কতদিন পর তোকে দেখছি। এখনও কি আমার উপর অভিমান করে আছিস? জোর করে তোকে বিয়ে দিয়েছিলাম বলে?”
অরোনী কথা বলল না। মায়ের দিকে ঘুরে তাকালো। মেয়েটির চোখের ভাষা আগে শারমিন তাকালেই বুঝে ফেলতেন। এখন বুঝতে পারছেন না। কি আশ্চর্য! তিনি ভ্রু কুচকে বললেন,” কি হয়েছে তোর মা? এভাবে কেন যন্ত্রণা দিচ্ছিস ছেলেটাকে? সে তোকে নিয়ে কত টেনশন করছে জানিস? আমার উপর যদি তোর রাগ থাকে তাহলে আমাকে বল। ওকে কেন জ্বালাচ্ছিস? রাফাতের কিন্তু দোষ নেই। বিয়েতে যে তুই রাজি ছিলি না এটা কিন্তু রাফাত জানতোই না। আমি ওকে বলেছিলাম তুই রাজি আছিস। সেজন্যই ও এগিয়েছে। নাহলে ও তোকে বিয়েই করতো না।”
অরোনী কিছুক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ মাকে জড়িয়ে ধরল। মায়ের বুকে মাথা রাখল। শারমিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে থাকলেন। একটু অন্যমনস্ক হয়ে বললেন,” আমার উপর রাগ করে বিয়ের পর ভার্সিটি যাওয়াও বন্ধ করে দিলি। লেখাপড়া কি একেবারে ছেড়ে দিয়েছিস?”
অরোনী কিছু বলল না। কিন্তু এটা সত্যি যে বিয়ের পর সে একবারও ভার্সিটি যায়নি। রাফাত জোর করেও তাকে নিয়ে যেতে পারেনি। তখন অরোনী সবার প্রতি ভীষণ রেগে ছিল৷ সে ভেবেছিল রাফাতকে বিয়ে করে তার জীবন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, তার জীবন শেষ হয়নি। বরং নতুন রঙ পেয়েছে। সুরে, রূপে, সুভাষে ভরে উঠেছে। এজন্যই তো অরোনী একরাশ কৃতজ্ঞতা নিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেছে। কিছু মায়েরা বুঝি সত্যিই সন্তানদের ভালো বুঝতে পারেন৷ শারমিন তেমনই একজন মা। নিজের মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্র বিচারে তিনি ত্রুটি রাখেননি। অরোনীর চোখ যে জিনিস চিনতে পারেনি মায়ের চোখ সেই জিনিস চিনতে পেরেছে। ইশ, মা যদি অরোনীকে চালাকি করে বিয়েটা না দিতেন তাহলে কি হতো? রাফাতের মতো চমৎকার মানুষটিকে অরোনী হারিয়ে ফেলতো! এ কথা ভেবেই মনে মনে আৎকে উঠল সে। ভাগ্যিস বিয়েটা হয়েছিল! ভাগ্যিস! অরোনী খুশি হয়ে মায়ের গালে চুমু দিল। তারপর মিষ্টি করে হাসল।
শারমিন অবাক হয়ে বললেন,” ওমা, এই মেয়ের হাব-ভাব বোঝা তো বড় মুশকিল! একটু আগেই না মনখারাপ ছিল?”
অরোনী মাথা নিচু করে হেসে বলল,” এখন আর মনখারাপ নেই।”
শারমিনও হেসে বললেন,” পাগলী একটা! তোর কথা ইদানীং অথৈ খুব বলছিল। ভালোই হয়েছে তুই এসে পড়েছিস। আমরা সবাই মিলে অনেক মজা করবো। আজ বিকালে ফুচকা খেতে যাবো।”
” অথৈ কোথায় মা? ঘুম থেকে উঠেছে?”
” উঠেছে মনে হয়। দাঁড়া ডাকি। অথৈ?”
কয়েকবার ডাকার পর অথৈ এলো। তার চোখেমুখে বিষণ্ণতার ছাপ। মেয়েকে দেখে মনখারাপ হয়ে গেল শারমিনের। তবুও অরোনীর সামনে হেসে বললেন,” আজকেও সারারাত ঘুমায়নি। এজন্য এই অবস্থা।”
অরোনী অবাক হয়ে বলল,” কেন ঘুমাবে না? কি হয়েছে ওর? এই অথৈ, এদিকে আয়।”
অথৈ মনখারাপ করে হেঁটে এলো। এতোদিন পর বোনকে পেয়েও তার মুখে হাসি নেই। অরোনীও কিছুটা অবাক। ছোটবোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” কি হয়েছে তোর?”
শারমিনের হাসি মুখ একটু গম্ভীর হলো। তিনি জানেন কারণটা। অথৈ রেগে আছে শারমিনের সাথে। গতরাতে রাগ করে ভাতও খায়নি সে। তার দুইহাজার টাকা লাগবে। কি একটা ফ্রেন্ড গ্রুপ তৈরী হয়েছে স্কুলে। প্রত্যেক সপ্তাহে নাকি গ্রুপের একজন সদস্য ঠিক করা হবে। যে অন্যসব সদস্যকে ট্রিট দিবে। সোমবার অথৈ এর পালা। গ্রুপের ছয়জন ফ্রেন্ডস খাওয়াতে দুইহাজার টাকা লাগবে। অথৈ যখন টাকাটা চেয়েছে তখন শারমিন বলেছেন,” সোমবার তোর স্কুলে যেতে হবে না। ফ্রেন্ডদের বলে দিস পেটে ব্যথা ছিল।”
তারপর থেকেই অথৈ রেগে আছে। মেয়েটা ইদানীং খুব জেদ করছে। কিছুদিন আগেও বই কেনার জন্য তাকে টাকা দেওয়া হয়েছিল। তারপর আবার অনলাইনে কি একটা জিনিস দেখে কেনার জন্য বায়না ধরল। সেজন্যও তাকে একহাজার টাকা দেওয়া হলো। এখন তার আবার টাকা চাই। এতো বায়না করলে কি চলে? মেয়েটা বোঝে না তার বাবা নেই। ভাইয়ের সংসারে বড় হচ্ছে। ভাইয়েরও আলাদা পরিবার আছে। বউ-বাচ্চা আছে। অনিকেতের আয় খুব বেশি না। সংসারের জন্য ছেলেটা সারাদিন খাটে। তার কাছে কি হুটহাট টাকা চাওয়া যায়? তার বেতনের প্রায় সব টাকা হিসাবের। তাই মেয়ের আবদার মেটাতে শারমিন নিজের থেকে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করেন। কিন্তু এখন তাঁর হাতেও টাকা নেই। সব অথৈ এর পেছনেই খরচ হয়েছে। মেয়েটা তাও বুঝতে চায় না।
অরোনী এখন অথৈয়ের সাথে শ্বশুরবাড়ির গল্প শুরু করেছে। ফোন বের করে সবার ছবি দেখাচ্ছে। অথৈও খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছে। তার মুখে হাসি ফুটেছে। শারমিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বোনকে পেয়ে যদি একটু মেয়ের মাথা থেকে টাকার ভূতটা নামে!
শারমিন রুম থেকে চলে যাওয়ার সাথে সাথেই অথৈ বলল,” আপু একটা কথা বলবো?”
” কি কথা? বল।”
অথৈ এর একটু অস্বস্তি লাগছিল। তবুও বলে ফেলল,” তোমার কাছে কি টাকা আছে? আমার না দুইহাজার টাকা লাগবে।”
অরোনী চোখ বড় করে বলল,” তুই এতটুকু একটা মেয়ে, দুইহাজার টাকা দিয়ে কি করবি?”
অথৈ আসল কথা বলল না। মাকে যেটা বলেছে সেটা যদি আপুকেও বলে তাহলে আপুও মায়ের মতো বলবে। তাই অথৈ অন্যকিছু বলল,
” আমার অনলাইনে একটা জিনিস খুব পছন্দ হয়েছে। আমি ওটা কিনতে চাই। কিন্তু মাকে বললে তো মা বকবে। তাই তোমাকে বলছি।”
অরোনী মনখারাপ করে বলল,” কিন্তু আমি তো সাথে কোনো টাকা আনিনি। সকাল সকাল তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি। পরার মতো কয়েকটা জামা ছাড়া আর কিছু নেওয়াই হয়নি। আচ্ছা, তুই কি জিনিস কিনতে চাইছিস আমাকে বলতো। আমি অর্ডার করে দিবো তোর জন্য।”
অথৈ বলল,” থাক, লাগবে না।”

রাতে রাফাত বাড়ি ফিরে এলেই অরোনী তাকে দেখে দরজা আটকে দিল। সকালে তাকে ফেলে অফিসে চলে যাওয়ার শাস্তি। শারমিন বিরক্ত হয়ে বললেন,” মেয়েটা যে কেন হঠাৎ এমন পাগলামি শুরু করেছে আমি বুঝতে পারছি না। বাবা, তুমি ওর এসব নিয়ে চিন্তা কোরো না। ফ্রেশ হয়ে আসো। তারপর ডিনার করো। ও একটু পর এমনিই দরজা খুলবে।”
রাফাত জানালো সে একদম গোসল করতে চায়। অনেক দূর থেকে গাড়ি চালিয়ে এসেছে। এখন ক্লান্ত লাগছে। গোসল না করলে ক্লান্তি কাটবে না। শারমিন রাফাতকে একটা নতুন টাওয়েল বের করে দিলেন। কিন্তু রাফাতের ট্রাউজার,টি-শার্ট সব অরোনীর ব্যাগে। রাফাত সেগুলো চেয়ে দরজা ধাক্কালো। অরোনী একটু পর দরজা খুলল। কিন্তু রাফাতের জিনিসগুলো বাহিরে ছুঁড়ে ফেলেই ধাম করে আবার দরজা আটকে দিল। শারমিন ধমক দিতে গেলেন। রাফাত বলল,” থাক আন্টি। কিছু বলবেন না।”
রাফাত মেঝে থেকে কাপড়গুলো তুলে নেওয়ার সময় শারমিনের খুব খারাপ লাগল। তিনি স্তম্ভিত কণ্ঠে বললেন,” অরোনী কি বাড়িতেও তোমার সাথে এমন করে?”
রাফাত উত্তর না দিয়ে হাসল। শারমিনের খুব রাগ হচ্ছে। মেয়েটাকে শাসন করতে হবে। দিন দিন খুব বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। শ্বশুরবাড়িতে গেলে মেয়েরা নাকি ভালো হয়ে যায়। কিন্তু অরোনীর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ঘটনা উল্টো। এই মেয়ে আরও বেয়াড়া হয়েছে।
রাফাত ওয়াশরুমে চলে গেল গোসলের জন্য। শারমিন টেবিলে খাবার সাজালেন। আয়োজন অনেক বেশি। তবুও শারমিনের মনে হচ্ছে যৎসামান্য। বাসমতি চাল দিয়ে ভাত হয়েছে।পোলাও করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু রাতের বেলা জার্ণি করে এসে রিচফুড যদি রাফাত খেতে না চায়! তাই রিস্ক নিলেন না। এরপর হয়েছে গরুর কালাভুনা। মুরগীর একটা আইটেম। রাফাত চিংড়ী পছন্দ করে তাই চিংড়ীও হয়েছে। হাসের ডিম সিদ্ধ করে মশলা দিয়ে ভাজা হয়েছে। নীপা অনেক ভালো রান্না করে। এখানে সব আইটেম নীপার রান্না করা। একটা ডিশ শুধু রান্না করেছে অরোনী। একগাদা লবণ দিয়ে রেখেছে তাতে। মুখেও তোলা যাচ্ছে না। শারমিন বুঝতে পারছেন না এই মেয়েকে নিয়ে তিনি কি করবেন! সামান্য একটা রান্না এখনও করতে পারে না। লবণের পরিমাণ কি সে আসলেই বোঝে না নাকি ইচ্ছে করেই এমন করেছে কে জানে!
রাফাত গোসল শেষ করে বের হয়ে ডাইনিংরুমে যাচ্ছিল। তখন বেডরুম থেকে মা-মেয়ের কথোপকথন শোনা গেল। শারমিন অথৈকে ধমকাচ্ছেন। সে অরোনীর কাছে টাকা চেয়েছিল তাই। ধমক দেওয়ার কারণটা জেনে রাফাতের সামান্য মনখারাপ হলো। বাচ্চা একটা মেয়ে। এই বয়সে বন্ধুদের নিয়ে মেতে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সে কি আর ফ্যামিলি ক্রাইসিস বোঝে!

ডাইনিং টেবিলে এসে রাফাত অনেক অবাক হলো। কারণ পুরো টেবিল ফাঁকা। অথচ শারমিন একটু আগেই বললেন টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। রাফাত যেন বসে পড়ে। তিনি নিশ্চয়ই রাফাতের সাথে ঠাট্টা করবেন না! রাফাত কি অতিরিক্ত ক্লান্তির জন্য চোখে ভুল দেখছে? হতে পারে টেবিলে খাবার আছে কিন্তু সে দেখছে না৷ তার দেখায় ভুল হচ্ছে। নীপা এসে বলল,” তুমি ভেতরে চলে যাও ননদ জামাই।”
রাফাত একটু হকচকিয়ে গেল,” জ্বী ভাবী? কোথায় যাবো?”
নীপা হাসতে হাসতে বলল,” অরোনীর ঘরে যাও।তোমার জন্য তোমার বউ কত কষ্ট করে খাবার আগলে বসে আছে। গিয়ে দেখো।”
রাফাত পুনরায় অবাক হলো। একটু আগেই যে রাগ দেখাচ্ছিল সে এখন খাবার নিয়ে বসে আছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত না? রাফাত ভয়ে ভয়ে রুমের ভেতরে ঢুকল। অরোনীর চেহারা হাসি-খুশি। রাফাতকে দেখে আরও জোরে হাসল। রাফাতের শীতল অনুভব হচ্ছে। অনেকক্ষণ পর অরোনীকে হাসতে দেখে ভালো লাগছে। অরোনী ছোট্ট টেবিলে গাদাগাদি করে খাবার সাজিয়েছে। রাফাত যেন বসতে পারে তাই একটা চেয়ার আনা হয়েছে। টেবিলের মাঝে মোমবাতিও আছে। রাফাত চেয়ারে বসার পর অরোনী লাইট নিভিয়ে দিল। তারপর মোমবাতি জ্বালালো। রাফাত বলল,” কি শুরু করলে?”
অরোনী বলল,” দেখতে পাচ্ছো না? ক্যান্ডেলাইট ডিনার। নাও, এখন খাওয়া শুরু করো।”
” করবো। আগে বলো তুমি কেমন আছো?”
” তুমি খাওয়া শুরু করো। পরে বলছি আমি কেমন আছি।”
রাফাত সবগুলো আইটেমের দিকে তাকালো। এতোকিছু, সে কোনটা ছেড়ে কোনটা খাবে? অরোনী নিজের রান্না করা আইটেমটা দেখিয়ে বলল,” এটা শুধু আমি রান্না করেছি। আর বাকিসব নীপা ভাবীর রান্না।”
রাফাত হেসে অরোনীর ডিশটাই আগে প্লেটে নিল। অরোনী গালে হাত রেখে তাকিয়ে আছে। রাফাত নিঃশব্দে খাচ্ছে। অরোনী প্রশ্ন করল, ” রান্না কেমন হয়েছে?”
রাফাত ভ্রু কুচকে বলল, ” এতো লবণ কেউ দেয়?”
অরোনী হেসে ফেলে বলল,” লবণ বেশি হয়েছে। তাও তুমি এটাই খাচ্ছো। অন্যকিছু নিচ্ছো না কেন?”
রাফাত একটু থামলো। আসলেই তো, সে কেন অন্যকিছু নিচ্ছে না? লবণ বেশি হওয়ার পরেও কেন তার এটা খেতেই ভালো লাগছে? উত্তরটা কিছুতেই মাথায় এলো না।
রাফাতের খাওয়া শেষ হওয়ার পর অরোনী তাকে বারান্দায় নিয়ে এলো। গম্ভীরমুখে বলল,” তুমি আমাকে কোনো প্রশ্ন করছো না কেন রাফাত?”
রাফাত ভ্রু কুচকে বলল,” কি বিষয়ে প্রশ্ন করবো?”
” কালকে আমার সাথে কি হয়েছিল, কতটা হয়েছিল, তোমার কি একটুও জানার আগ্রহ নেই?”
রাফাত ভারী গলায় বলল,” এটা কি জানার আগ্রহ হওয়ার মতো বিষয়?”
” জানি না। কিন্তু তোমার তো জানা উচিৎ। তোমার স্ত্রীকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন পুরুষ স্পর্শ করেছে৷ তোমার কি জানা উচিৎ না সেই স্পর্শের গভীরতা কতটুকু ছিল? ”
” অরোনী প্লিজ, এই বিষয়ে আর একটাও কথা না।”
” কিন্তু আমি বলবো। ”
” তুমি যদি শেয়ার করার জন্য বলতে চাও তাহলে বলো। আমি মন দিয়ে শুনবো। কিন্তু যদি শুধু আমাকে জানানোর জন্য বলতে হয় তাহলে বলার দরকার নেই।”
অরোনী বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। কিছু একটা ভেবে অন্যমনস্ক গলায় বলল,” তোমাকে আজ আমি একটা গল্প শোনাতে চাই।”
” শোনাও।”
” গল্পটা একটি বাজে ছেলের। ”
” কোন বাজে ছেলে?”
“বাজে ছেলেটা আমাকে খুব ডিস্টার্ব করতো।”
” কখন ডিস্টার্ব করতো?”
” বিয়ের আগে করতো। এখন আর করে না। ”
” তারপর?”
” আমি ওর জ্বালাতনে এতো বিরক্ত হয়ে গেছিলাম যে এলাকা ছেড়েই চলে যেতে ইচ্ছে হলো।ছেলেটার অনেকগুলো বদভ্যাস ছিল। সে মারামারি করতো, ঝামেলা বাঁধাতো, সিগারেটও খেতো। একদল ছেলে নিয়ে মাস্তানি করে বেড়াতো। সে ছিল ভার্সিটির লাফরাঙ্গা টাইপ। ওইরকম একটা ছেলের চোখে কিভাবে যে আমি পড়ে গেলাম! সে আমার পেছনে আঠার মতো লেগে গেল। তার হাত থেকে বাঁচতে আমি কিছুদিনের জন্য লুকিয়ে থাকলাম। ভেবেছিলাম তার চোখের আড়ালে হলেই সে আমাকে ভুলে যাবে। কিন্তু ঘটনা উল্টা হলো। বাড়ি ফিরে আমি জানতে পারলাম আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে৷ সেই বাজে ছেলেটির সাথেই। কিন্তু আমি তো তাকে কিছুতেই বিয়ে করবো না। অথচ আমাকে জোর করে তার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হলো। আমার মনে হলো, আমার জীবনটা বুঝি ওখানেই থেমে গেছে। আর কখনও আমি নিজের মতো বাঁচতে পারবো না। এখন থেকে আমাকে বাঁচতে হবে মৃত মানুষের মতো। ভেবেছিলাম, সেও অন্য সবার মতো আমার রূপে মুগ্ধ হয়েছে। আমার সৌন্দর্য্য ভোগ করাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু বিয়ের পর চল্লিশ দিন পর্যন্ত সে যখন আমাকে একবারও অনুমতি ছাড়া স্পর্শ করল না তখন আমি বুঝলাম ভোগ না, আমি তার কাছে প্রায়োরিটি। যখন বাড়ির প্রত্যেকটি মানুষ আমার বিপক্ষে তখন আমি ভেবেছিলাম সেও বোধ হয় আমাকে পুতুলের মতো নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে। কিন্তু সে আমাকে তার চেয়েও বেশি স্বাধীনতা দিল। এতো ভালো করে এর আগে কেউ আমাকে বোঝেনি। নিজেকে খুলে রাখা বই মনে হলো তার কাছে। সে যেন আমার হৃদয়ের সব কথা জেনে নেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে। আমি মুখ ফুটে বলার আগেই সে আমার সমস্ত প্রয়োজন বুঝে ফেলে। এমনকি কিছু প্রয়োজন আমি নিজেও বুঝতে পারি না। যা সে বোঝে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি কি স্বপ্ন দেখছি? সত্যিই কি জীবন এতো সুন্দর? জানো রাফাত, কালকে যখন ওই বীভৎস ঘটনাটা আমার সাথে ঘটল আমি খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল ওই বাড়িতে থাকলে দম আটকেই মরে যাবো আমি। যতবার রুম থেকে বের হবো, স্টোর-রুমের দিকে যাবো, ততবার সেই খারাপ স্মৃতি ভেসে উঠবে। গা কাটা দিয়ে উঠবে। বার-বার জঘন্য অনুভূতিগুলো মস্তিষ্কে বিচরণ করতে থাকববে। আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে। জীবনটাকে দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছিল। আর এখন মনে হচ্ছে, ওই দূর্ঘটনাটাই একমাত্র দুঃস্বপ্ন ছিল৷ আর এইযে এই জীবনটা, আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন। এই জীবনে তুমি নামক মানুষটা আরও বেশি সুন্দর। বলো না, কেন সবকিছু এতো বেশি সুন্দর? কেন এতো চমৎকার? কিভাবে? বলো না রাফাত কিভাবে? তুমি এতো ভালো কেন? তুমি কি ম্যাজিশিয়ান? বলো না, কেন করলে এতোকিছু? কিভাবে করলে?”
অরোনী রাফাতের হাত ধরে ঝাকাচ্ছিল আর একনাগাড়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছিল। রাফাত হঠাৎ অরোনীকে একটানে কাছে এনে জড়িয়ে ধরে বলল,” অরোনী, তোমার জন্য।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here