আলো-৩০ শেষ

আলো-৩০ শেষ

মুশফিকুর রহমানের সামনে বসে আছে সবাই।
বাসার প্রতিটা সদস্য উপস্থিত আছে।
সাথে আছে আসিফ আর এ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম।

সবার সামনে চা নাস্তা। কিন্তু কেউ ছুঁয়ে ও দেখছে না।
আসিফকে শফিকুল ইসলাম কয়েকবার বলেছেন, এখানে সাইন করুন।

আসিফ চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে।

অহনার বুকের ভেতর কেমন যেন এক তোলপাড় চলছে। ও কিছুতেই আসিফের মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। কয়েকদিন যে সেভ করেনি তা তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি বলে দিচ্ছে। স্বাস্হ্য ও ভেঙে গেছে। চোখের নিচে কালি। দেখলেই বোঝা যায় অনিয়মের চুড়ান্ত করছে ছেলেটা।

তারপরও সে কঠিন মনোভাব বজায় রেখেছে।
সে নিজের মনকে নিজেই শাসন করছে, তাতে তোর কি ?
ও শুকিয়েছে, না মোটা হয়েছে, তা দিয়ে তোর কোন কাজ আছে?

প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে তোর সাথে ঝগড়া করতো, ভুলে গেছিস তুই। রাজপ্রাসাদের মায়া ছেড়ে তুই তো এক কাপড়ে চলে গিয়েছিলি, ও কি তোর মূল্যায়ন করছে?
যখন দিনের পর দিন থাকা খাওয়ার কষ্ট করছিস, তখন তোর ভাইয়াকে সে রীতিমতো অপমান করেছে।
তাহলে তোর এতো মায়া করার দরকার কি?
ওসব মায়া টায়া আপাতত বস্তা বন্দী করে রাখ।
আসিফ সাইন করার সাথে সাথে নিজের সাইন দিয়ে দিবি।
ঝামেলা শেষ।

মুশফিকুর রহমান নিরবতা ভেঙ্গে গমগমে কন্ঠে বলে উঠলেন, বাবা আসিফ শুধু শুধু সময় নষ্ট করে কি লাভ?
সই করো।

শশুরের কন্ঠস্বর শুনে আসিফ মুখ তুলে চাইলো।
তারপর কলম হাতে নিয়ে সই করার আগে একে একে সবার মুখের দিকে চাইলো। অহনার চোখে চোখ পড়া মাত্র বলে উঠলো, অহনা বাসায় চলো।
আমি তোমাকে নিতে এসেছি।

অহনা বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, চলো মানে?
কোথায় যাবো?
আমি তো আমার বাসায় আছি।

মুশফিকুর রহমানের ঠোঁট হালকা হাসিতে ছেয়ে গেছে। তিনি মেয়ের জন্য মনে মনে গর্ব বোধ করছেন।
গভীর মমতায় তার মন আদ্র হয়ে উঠলো।

আসিফ উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিল।
অহনা তুমি তোমার নিজের বাসায় যাবে।
চলো…

অহনা একবার সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, দুইটা মিনিট অপেক্ষা করো।
আমি পোশাক চেন্জ করে আসছি।

দুই মিনিট ও লাগলো না, এক মিনিটের মাথায় অহনাকে দেখা গেলো, আসিফের দেওয়া সেই লাল জামদানি পড়ে লাগেজ হাতে নিচে নেমে আসতে।

কেউ কিছু বোঝার আগেই ওরা দুজন হাত ধরাধরি করে বের হয়ে গেল।

মুশফিকুর রহমান কিছুক্ষণের জন্য বাক্যহারা হলেন।
নিজেকে সামলাতে তার সময় লাগলো।

অহনার মাকে দেখা গেল, শাড়ির আঁচল মুখে চেপে ধরে রেখেছেন। তিনি ঠোঁট টিপে হাসছেন। কিন্তু তিনি চান না অহনার বাবা তার এ হাসি দেখে ফেলুক।

রিকশা ছুটে চলেছে। অহনা পরম নির্ভরতায় আসিফের ঘাড়ে মাথা দিয়ে রেখেছে।
আসিফ তার গমগমে কন্ঠে কবিতা আবৃত্তি করছে…

মুক্তি নিবি?
চল তোকে আজ মুক্তি দিলাম।
একা একা তুই যখন দেখবি আকাশ
দেখবি ,আমি তোর আকাশ ছিলাম।

– রূদ্র গোস্বামী।

রাতে ভালো ঘুম হয়নি আলোর। চোখের নিচে হালকা কালির আভা। আজ সকাল এগারোটায় কাজি অফিসে ওদের বিয়ে।

সারা রাত ও টেনশন করেছে। রন্জুকে ঠকানো কি ঠিক হচ্ছে?
রন্জু ভাইয়ার চোখে সে সবসময় নিজের জন্য গভীর ভালোবাসা দেখেছে। কিন্তু সবার প্রকাশ ভঙ্গি তো এক না। রন্জু তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখাতে পারে না সেইভাবে।

আরেকটা মন বারবার বলেছে, তুই সৈকতকে কথা দিয়েছিস। দুজনে একসাথে ম্যাচিং করে কালো কাপল ড্রেস কিনছিস বিয়েতে পরার জন্য।
ছেলেটা কতো আশা করে কাজি অফিসে আসবে।
তোর জন্য অপেক্ষা করবে। এখন কেন এসব ভাবনা!

ও এসব দুশ্চিন্তা থেকে বের হয়ে ঘুমানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। না ঘুমালে চোখের নিচে বসে যাবে। সাজলেও ভালো লাগবে না।

ঘন্টার পর ঘন্টা চোখ বন্ধ করে থেকেও যখন ঘুম আসলো না। তখন উঠে গিয়ে মায়ের রুম থেকে ঘুমের ওষুধ এনে খেয়েছে। তারপরও চোখে ঘুম নেই।

শেষ রাতে একটু ঘুম এসেছে। টেনশনে সেই ঘুমটাও আরাম করে ঘুমাতে পারেনি। আটটার আগেই উঠে গেছে।

সকালের নাস্তাটাও গলা দিয়ে নামতে চাইছে না।
ও কোন রকমে একটা সিদ্ধ ডিম খেয়ে কড়া করে কফি নিয়ে নিজের রুমে চলে এসেছে।
এখন সে খুব মনোযোগ দিয়ে সাজুগুজু করছে।

ওর মা পাশেই বসে মেয়ের কান্ড কারখানা দেখছে, মুখ অন্ধকার করে।

আলো শাড়ি পরা শেষ করে বললো, মা মুখটা এমন অন্ধকার করে রেখেছো কেন?
তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে তোমার মেয়ে চির দিনের জন্য চলে যাচ্ছে। আরে পাগল বিয়ে করে তো আবার তোমার মেয়ে তোমার কাছেই ফিরে আসবে।
ওর তো আমাকে নিয়ে ওঠার মতো কোনো জায়গা নেই। আমি আসলে আমাকে থাকতে দিবে তো?
মাঝে মাঝে আমরা দেশের দর্শনীয় স্থান ঘুরতে যাবো, শুধু মাত্র তখন একসাথে থাকবো।

বাবা যতোদিন কিছু না জানে, ততোদিন এখানেই আগের মতো ঘাপটি মেরে থাকবো।

মা দেখো তো আমাকে কেমন লাগছে?
সব ঠিক আছে কিনা?

আলোর মা চোখের পানি মুছে হালকা হেসে বললো, আমার রাজ কন্যাকে পরীর মত সুন্দর লাগছে।
আজ যে দেখবে, সেই তোকে চোখে হারাবে।

তাহলে তোমার চোখে পানি কেন? একটু হাসো তো মা।

আলোর মা ম্লান হেসে মনে মনে বললো, কেন যে আমার চোখে পানি তুই যদি বুঝতি, তাহলে আজ তুই ঘর থেকে বের হতি না।
আমার মেয়েটা আজ এতো বড়ো দুঃখ পাবে।
হে আল্লাহ তুমি আমার মেয়ের ধৈর্য শক্তি বাড়িয়ে দাও।

আলো এক ঘন্টা ধরে নীলক্ষেত কাজি অফিসের সামনে অপেক্ষা করছে।
ও বারবার ঘড়ি দেখছে। এখনো সৈকত আসেনি।
চারদিকে লোকজন ঘুরে ঘুরে ওর দিকে তাকাচ্ছে।
ওর বড্ডো অসস্তি হচ্ছে, এভাবে একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে।

ও কয়েক বার সৈকতকে ফোন দিয়েছে। বারবার সুইচ অফ বলছে।
ও যে ভুলো মনা। নিশ্চয়ই রাতে মোবাইল চার্জ দিতে ভুলে গেছে অতিরিক্ত আনন্দে। কিন্তু এতোক্ষণ তো লাগার কথা না! ওর বন্ধুরা সাক্ষী হবার কথা।
বন্ধুদের কি কারো কিছু হলো?

আকাশে খুব মেঘ করেছে। যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে। ওর খুব খিদেও লাগছে। ওরা ঠিক করে রেখেছিল, বিয়ের পর আজ দুজনে মিলে সেই বল সিঙ্গারা খাবে ইচ্ছে মতো।

খিদেয় মাথা ঘুরাচ্ছে। একবার ভাবলো, ও একাই সিঙ্গারা খাবে। আবার আরেকটা মন বাঁধা দিয়ে বলছে, তুই সৈকতকে কথা দিয়েছিস, বিয়ের পর দুজন পেট ভরে সিঙ্গারা খাবি।
হয়তো এখনি চলে আসবে সে। একটু অপেক্ষা কর পাগলি।

এখন বেলা তিনটা বাজে। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। আজ হয়তো ঢাকা শহর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
বৃষ্টি শুরু হওয়া মাত্র সবাই দৌড়ে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে।

কিন্তু আলো এক ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
ওর চোখ দিয়ে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়েছে। ওর হাতে একটা চিরকুট।
সেটাও বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
ভালোই হয়েছে, বৃষ্টির পানি আর চোখের পানি এখন আর কেউ আলাদা করতে পারবে না।

বৃষ্টি শুরু হবার একটু আগে সৈকতের এক বন্ধু এসে চিরকুটটা দিয়ে গেছে।

যেখানে সৈকত গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছে।

তোমাকে আজ প্রিয় বলার যোগ্যতা হারিয়েছি।
পারলে আমাকে মাফ করে দিও অহনা।
আজ এগারোটার সময় আমাদের বিয়ে হবার কথা ছিল।
এগারোটার সময় আমি সত্যিই বিয়ে করেছি, তবে ফোনে।
পেয়েছি রাজ কন্যা সহ রাজত্ব।
স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় সেই রাজ কন্যার বসবাস।
আজকের ফ্লাইটে আমি আমেরিকা চলে যাচ্ছি।
আমার খুব দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হবার ইচ্ছে।

জানোই তো আমার পুরো পরিবার আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে। গতো সপ্তাহে যখন এই অফারটা পেলাম তোমার খুব কাছের কারো কাছ থেকে।
আমি সাথে সাথে লুফে নিলাম।
আমি জানি তোমাকে বিয়ে করে আমাকে অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে হবে।

আমাকে তুমি ভুল বুঝো না।
ভালো থেকো আমার ভালবাসা।
ইতি
তোমাকে পাবার অযোগ্য এক কাপুরুষ।

রন্জু অফিসে।
আজ কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছে না।
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ও বৃষ্টি দেখেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ওর ফোনটা বেজে উঠলো।

ফোন লিস্টে ওর মামার নাম্বার দেখে খুব অবাক হলো।
ও বিস্ময় গোপন করে ফোন রিসিভ করে সালাম দিলো। তারপর জানতে চাইল, মামা আপনার শরীর ভালো তো?

আমি ভালো আছি বাবা।
তুমি কি একটু নীলক্ষেত কাজি অফিসের সামনে যেতে পারবে বাবা?

আপনি বললে অবশ্যই যাবো। কিন্তু হঠাৎ এই বৃষ্টির মধ্যে কাজি অফিসে কি?

আমার মেয়েটা খুব কান্না করছে। আমি ওর সাথে খুব বড়ো একটা অন্যায় করেছি। তুমি ওকে সেখান থেকে বাসায় নিয়ে এসো।
মেয়েটা খুব কষ্ট পাচ্ছে।
তুমি ওর কাছাকাছি থেকে ওর কষ্টটা কিছুটা কমিয়ে দাও।

আপনি টেনশন করবেন না মামা।
আমি এখনি যাচ্ছি।

প্রবল বর্ষণে ঢাকা শহরের রাস্তা প্রায় ডুবে গেছে।
রন্জু অনেক কষ্ট করে গাড়ি চালিয়ে নীলক্ষেতের সামনে এসে দেখলো বৃষ্টির মধ্যে আলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর প্রায় হাটুর কাছাকাছি পানি জমে গেছে।
কালো ভেজা শাড়িতে অদ্ভুত মায়াবী লাগছে মেয়েটাকে। পুরো শাড়ি লেপটে আছে ওর শরীরে।
চারদিক থেকে লোকজন হা করে গিলছে এই রহস্যময়ী নারীকে!
সেদিকে ওর ভ্রুক্ষেপ নেই।

রন্জু ছাতা মাথায় গাড়ি থেকে বের হয়ে এসে আলোর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।

আলো খুব দ্বিধায় পড়ে গেছে, এই হাত ধরবে কি ধরবে না। ও ইতস্তত করে বললো, তোমার গাড়ির সিট ভিজে যাবে ভাইয়া।
আমি রিকশা নিয়ে বাসায় চলে যাবো।

রন্জু সাথে সাথে ছাতা অফ করে ভেজা শুরু করলো।
এবার তো সমস্যা নেই।
এসো।

আলো কাঁপা কাঁপা হাতে রন্জুর বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরলো।

আলোকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
জ্বর খুব বেশি।

রাতটা তার খুব খারাপ কাটল। একা-একা খানিককক্ষণ কাঁদল। সকাল থেকে জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে রইল। বাবা মা পাশে থাকার পর ও এমন নিঃসঙ্গ লাগতে লাগল ওর নিজেকে।
ঠিক সেই মুহূর্তে রন্জু তাকে দেখতে এল। আলো থমথমে গলায় বলল, তোমার জন্যেই আমার এই অবস্থা।

রন্জু বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, কেন, আমার জন্যে কেন?

তুমি তোমার ভালোবাসার জালে আমাকে শক্ত করে আটকে রাখতে পারোনি।

রন্জু হেসে ফেলল।

আলো গম্ভীর হয়ে বলল, আমার জন্যে কি এনেছো বলো ? নাকি খালিহাতে রোগী দেখতে এসেছো?

খালি হাতেই এসেছি আলো। এতো সকালে সব দোকান পাট বন্ধ। আমি সন্ধ্যায় আবার আসবো। তখন তোমার পছন্দের বেলি ফুলের মালা নিয়ে আসবো।

আলোর বাবা মা দুজনেই বাইরে বের হয়ে গেছে রন্জু কে দেখে।

রন্জু চেয়ার টেনে পাশে বসতে-বসতে বললো, তোমার শরীর এখন কেমন?

ভালো–তবে জ্বর আছে মনে হয়।

বেশি জ্বর?

বেশি জ্বর কি কম জ্বর সেটা তুমি আমার কপালে হাত দিয়ে দেখতে পারো না? নাকি আমার কপালে হাত রাখলে পাপ হবে?

রন্জু হেসে দিয়ে আলোর কপালে হাত রাখলো।

আলোর কাছে মনে হল কোন বরফ খন্ড ওর কপালে। ও চোখ বন্ধ করে ফেললো। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা পানি।

রন্জু রাত বারোটা পর্যন্ত আলোর সাথেই ছিল।
জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে ছিল আলো। এই অবস্থায় ও আর বের হতে পারেনি।

রাত বারোটা। রাস্তা নির্জন। রন্জু রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে নক্ষত্রের মেলা। কী অদ্ভুত সুন্দর সেই আলো! নক্ষত্রের আলোয় রন্জুর মন কেমন অন্য রকম লাগছে। বড়ো ইচ্ছে করছে আবারো আলোর কাছে ফিরে যেতে।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here