আলো-২৯

আলো-২৯

আসিফের ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। আঁধার তখনো কাটেনি, একটু একটু করে আলো ছড়াচ্ছে চারদিকে।অদ্ভুত নীরবতা, কোথাও একটু শব্দ নেই। কিছুক্ষণের ভেতরই হয়তো সূর্য উঠবে।

আসিফ নিঃশব্দে বিছানা থেকে নামল।
এখন আর শুয়ে থাকার কোন মানে হয় না।
দরোজা খুলে ছাদে দাঁড়ানো মাত্র আজানের সুমধুর সুর ভেসে আসলো।

সেতারা বেগম বাইরে বসে অজু করছিলেন। তিনি গ্রামের মানুষ, বদনায় করে পানি নিয়ে খোলা জায়গায় ওজু করতেই বেশি পছন্দ করেন। আসিফকে এতো ভোরে বেরুতে দেখে বেশ অবাক হলেন। হাসি মুখে বললেন কি রে বাজান আজ এতো সকালে উঠলি?
ঘুম হয়নি?

আসিফ উত্তর না দিয়ে হালকা হাসলো।
আসিফের মা এসেছে এক সপ্তাহ হলো। ডাক্তার দেখাতে এসেছে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু তিনি ফিরে যেতে পারছেন না।
তিনি এসে এ বাসায় এখনো বৌমাকে পাননি।
প্রতিদিন একবার করে বলেন, বৌমাকে নিয়ে আয় বাবা। আমি তোর বউ দেখবো না! তোর বউ দেখে তারপর বাড়ি যাবো ‌।

আসিফ তখন বিভিন্ন রকম কথা বলে মাকে শান্ত করে। এছাড়া আর কি বা করার আছে?
প্রায় পনেরো দিন হলো অহনা রাগ করে বাবার বাড়ি চলে গেছে।

ইদানিং প্রতিদিন ওদের ঝগড়া হয়। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত দুই জন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিউচুয়াল ডিভোর্সের।
কিন্তু মাকে সে কথা কিভাবে বলবে!

অহনা যেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গেল আসিফ হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলো। প্রতিদিন অশান্তি, ঝগড়া, চিৎকার, চেঁচামেচি, অফিসের বসকে নিয়ে সন্দেহ!
সব মিলিয়ে জীবনটা তিতা তিতা হয়ে গিয়েছিল।
সে খুশিতে অহনার সামনেই বলে বসেছিল আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ বাঁচালো।
তোমার সাথে সংসার করার চাইতে গাছ তলায় গিয়ে ঘুমানো অনেক শান্তির।

সেতারা বেগম ওজু শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। নামাজটা পড়ি বাপজান। নামাজ শেষ করে চা বানায় দিবনি। তারপর চা খেয়ে আজ বৌমাকে নিয়ে আয় বাজান।

মা ওর ইনভার্সিটি খোলা। তোমাকে কতোদিন বলেছি।

সেতারা বেগম হাসতে লাগলেন। যেন খুব একটা হাসির কথা শুনেছেন। হাসতে হাসতে বললেন, বিয়ের পর সংসার হলো আসল ইনভার্সিটি বাজান। মাইয়া মানুষের এতো পড়ালেখার কাম নাই। নিজের মনে কথাগুলো বলতে বলতে সেতারা বেগম ঘরে ঢুকে গেলেন।

ভোরবেলার স্নিগ্ধ বাতাসে অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করে। মানুষকে তরল করে ফেলে।
আসিফ মনে মনে বিড়বিড় করে বললো, আজ আমাদের একটা বিশেষ দিন মা। আজকে অহনা ফিরে আসলে সত্যি আমার খুব ভালো লাগতো।
আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হতো না।

কিন্তু আমি জানি ও আসবে না। আজ তিন দিন ধরে আমি ইনভার্সিটি যাই না মা। প্রতি দিন অহনাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা।
শুধু মাত্র ওকে এক নজর দেখার জন্য।
ও আমার সামনে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায়, আমার দিকে ফিরে ও তাকায় না।

আলোর এখন সৈকতের সাথে খুব ভাব।
প্রায় দিনই ওরা একসাথে বাইরে ঘুরে, খাওয়া দাওয়া করে। রন্জুর সাথে ও ঘুরে।
কিন্তু নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত ওর উপলব্ধি হয়েছে, সৈকত ওকে যেভাবে বুঝে, রন্জু ভাইয়া সেভাবে বুঝতে পারে না ওকে।

তাছাড়া রন্জুর সাথে ঘুরাঘুরি করার পর ওরা সব সময় থ্রি স্টার, ফাইভ স্টার হোটেলে যায় খেতে।
আলো এই সব খাবার খেয়ে একটুও মজা পায় না।
ওর কাছে মনে হয়, সৈকতের সাথে ফুটপাতের দোকানে বসে ভর্তা ভাত খাওয়ায় অনেক বেশি শান্তি।
মাঝে মাঝে ওরা মাওয়া চলে যায় রাস্তার পাশে ছাপড়া দোকানের ঝাল ঝাল ইলিশ মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খেতে।
ঘন্টার পর ঘন্টা রিকশায় ঘোরা, নৌকা ভ্রমণ।
এগুলো ওকে খুবই আনন্দ দেয়।

রন্জুর মধ্যে এসব নেই। ও বিজনেস নিয়ে মহাব্যস্ত।
ও দায়িত্ব পালনের মতো করে আলোর সাথে মিশে।
দামী দামী গিফট, আর নামকরা হোটেলে খাওয়ার নাম ওর কাছে প্রেম।

আলো ঠিক করেছে বিয়ে করলে সৈকতকেই করবে।

এদিকে বাসা থেকে রন্জুর সাথে বিয়ের কথা বার্তা চলছে‌। আলোর মা গয়নার ডিজাইন বই নিয়ে আলোর রুমে ঢুকলো। দেখতো মা তোর কোন ডিজাইন পছন্দ?
আজকে বিকেলে তোকে নিয়ে গয়না গুলো বানাতে দিয়ে আসি কি বলিস?

মা ওসব গয়না টয়না দেখে কোন লাভ নেই।
তোমার মেয়ে বিয়ে করবে এক রাস্তার ছেলেকে।
তার চাল চুলো কিছুই নেই ঢাকা শহরে।
এগুলো জানার পর কি তোমরা আমাকে গয়না দিয়ে মুড়িয়ে দিবে?

এসব কি কথা মা। আমাদের মেয়ে কেন চাল চুলো হীন ছেলেকে বিয়ে করবে! তাছাড়া তোর জন্য কতো ভালো ভালো প্রপোজাল আসছে।
আমরা অনেক আগেই রন্জুর সাথে তোর বিয়ের পাকা কথা দিয়ে রাখছি।
রন্জু ও তোর জন্য পাগল। সব জেনে শুনে তুই অন্য কোন ছেলেকে পছন্দ করতে পারিস না।

পারি মা।
পারবো না কেন?
ছোট বেলায় কি কথা হয়েছে। তার জন্য কি তাকে বিয়ে করতে হবে নাকি!

মা দেখোতো এই শাড়িটা কেমন? এই শাড়িটা পড়ে আগামী বৃহস্পতিবার আমরা বিয়ে করবো।
তুমি আবার বাবাকে বলে দিও না।

আমি বলতে যাবো কেন?
কিন্তু এটা কি রঙের শাড়ি কিনছিস?

কেন?
কালো রঙের।
কালো রং আমাকে সবচেয়ে বেশি মানায়।
তাই কালো শাড়ি পড়ে বিয়ে করবো।

আলোর সহজ সরল মা বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, কালো শাড়ি পড়ে কেউ বিয়ে করে নাকি!
বিয়েতে পড়বি লাল টুকটুকে আগুন রঙা শাড়ি।
আমি তোকে সবচেয়ে সুন্দর শাড়িটা কিনে দিব।

মা এখন তুমি যাও তো। আমার ঘুম পাচ্ছে।
আর দয়া করে বাবার কানে লাগিয়ে দিও না আমায় বিয়ের খবর। বাবা তার টাকা দিয়ে সব ভুন্ডুল করে দিবে।

দেখ মা।
তোর বোন অহনা সংসার করতে পারলো না।
শুধু মাত্র একটা গরীব ছেলেকে বিয়ে করেছে জন্য এডজাস্ট করতে পারলো না। জীবনে টাকা পয়সার খুব দরকার। টাকা পয়সা ছাড়া প্রেম জমে না মা।
তুই অহনাকে দেখে একটু শিখ।
একি ভুল তুইও করিস না মা।

মা অহনা আর আমি এক না।
আমি অনেক কষ্ট করে বড়ো হয়েছি। কষ্ট করতে আমি জানি। সুতরাং টাকা পয়সার কষ্ট আমাকে আমার জায়গা থেকে সরাতে পারবে না।

ও তাহলে তুই এই ছেলেকেই বিয়ে করবি?

এখনো বুঝতে সমস্যা হচ্ছে?
দেখছো না বিয়ের শাড়ি কেনা হয়ে গেছে।

আমি কি চিনি সেই ছেলে কে?

অবশ্যই চিনো মা। তুমি কতো আদর করে তাকে নাস্তা খাওয়াইছো।
হা হা হা।

হাসছিস কেন?
আমি কাকে আদর করে নাস্তা খাওয়াইছি?
আমার বাসায় রন্জু আর তোর টিচার ছাড়া কোন ছেলে আসে?

রন্জুকে তো তোর লিস্ট থেকে বাদ দিছিস।
তাহলে থাকলো তোর স্যার।

এইতো বুঝে ফেলেছো। কে বলে তোমার মাথায় বুদ্ধি নেই। বাবা শুধু শুধু তোমাকে বোকা বলে। আলো হাসছে, খুব হাসছে।

আলোর মায়ের চোখে পানি জমতে শুরু করেছে।
সে মন খারাপ করে দ্রুত আলোর রুম থেকে বের হয়ে গেল।

আসিফ সকাল থেকে অহনাদের বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। আজকে তাকে সকাল দশটায় এ বাসায় আসতে বলা হয়েছে।
বলেছেন স্বয়ং তার শশুর আব্বা।

এর আগেই একদিন ডেকে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সব ঠিক হয়েছে, আজকের এই তারিখে সকাল দশটায় ডিভোর্স পেপারে সাইন করা হবে।
যেহেতু মিউচুয়াল ডিভোর্স, তাই মুশফিকুর রহমান চান না আদালত পর্যন্ত গড়াক বিষয়টা।
তিনি তাদের পারিবারিক ল ইয়ারকে দায়িত্ব দিয়েছেন কাগজ পত্র তৈরি করে আজকে এ বাসায় নিয়ে আসতে। তিনি চান এই দিনে তার মেয়ে একটা বড়ো রকমের ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, এই দিনেই সেই ভুল থেকে মুক্তি পাক।

অহনার আদর খুব বেড়ে গেছে এ বাড়িতে। মুশফিকুর রহমান খুব খুশি। তার মেয়ে দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছে সে ভুল করেছিল।
এই যে ডিভোর্স দেওয়ার মতো একটা সঠিক সিদ্ধান্ত তার মেয়ে নিজের থেকে নিয়েছে, তিনি খুব খুশি মেয়ের ওপরে।

তিনি চান তার মেয়ে আবার নতুন করে জীবন শুরু করুক। পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াক।
তার মতন এমন প্রতিপত্তি শালী মানুষের মেয়ে ধুঁকে, ধুঁকে কষ্ট করে জীবন কাটাবে এটা তিনি প্রথম থেকেই মেনে নিতে পারছিলেন না।

অহনা জানালা দিয়ে প্রতিদিন দেখে আসিফ হ্যাংলার মতো ওদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় থাকে।
ওর খুব কষ্ট হয়। খুব ইচ্ছে করে আসিফের কাছে ফিরে যেতে। কিন্তু যখনি মনে হয়, ওর ভাইয়ের দেওয়া জিনিস গুলো ফিরিয়ে দিয়েছে, তখন ও আর আসিফকে ক্ষমা করতে পারেনা।
ওর কথা হলো, তোমার কেনার সামর্থ্য নেই।
আবার শশুর বাড়ি থেকে নিতেও সমস্যা। এতো ইগো কেন তোমার হ্যা?
আমার কথা চিন্তা করেও তো তুমি জিনিস গুলো রাখতে পারতে।

গরমে আমার পুরো শরীর লাল লাল চাকা চাকা হয়ে গেছে, সেটা দেখে ও কি তোমার মায়া হয় না!
একবারো কি ভেবে দেখেছো, এসি ছাড়া থাকার অভ্যাস আমার আছে কিনা!
আমার চাহিদা ঠিক মতো মিটাতে পারো না।
আবার সুন্দরী বসের সাথে বাইরে খেতে যাও।
আমার সাথে প্রতিদিন চিৎকার চেঁচামেচি করে ঝগড়া করো।
আর সুন্দরী বসের সাথে হেসে হেসে কথা বলো।
প্রতিদিন রাত দুপুরে তোমার বস তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যায়। তখন তোমার চেহারয় অন্য রকম এক রৌশনি খেলা করে।
অন্ধকার ছাদে দাঁড়িয়ে ও আমি সেটা স্পষ্ট দেখতে পাই।

সেই ভালো।
তোমার আর আমার পথ আলাদা হয়ে যাক।
তুমি তোমার মতো থাকো।
আমি আমার মতো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here