আলো-২৭,২৮
২৭
বাসায় বোম পড়লেও কেউ হয়তো এতো অবাক হতো না।
সবাই খাওয়া বন্ধ করে হতভম্ব হয়ে ফুপির দিকে তাকিয়ে আছে।
আলোর ইচ্ছা করল ফুপিকে কঠিন কিছু কথা শোনায়। শোনানো গেল না। কারণ সে তার স্যারের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে এখন থেকে কাউকে কষ্ট দিয়ে কথা বলবে না, চুরি করবে না। প্রতিজ্ঞা করা হয় প্রতিজ্ঞা ভাঙার জন্যে। আলোর প্রতিজ্ঞা ভাঙতে ইচ্ছা করছে না।
ও চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, ফুপি আপনার খাওয়া শেষ হয়েছে?
হুম খাইছি তো তোমাগো আগেই।
তাহলে এখন বিদায় হন।
এটা তুমি কেমন কথা বলো মা?
আমি আমার ভাইয়ের বাসায় আসছি। বিদায় হবো মানে কি?
এটা কি সত্যি আপনার ভাইয়ের বাসা?
অহনা তো তাহলে আপনার ভাগ্নি তাই না?
ভাগ্নি জামাইকে কি কেউ এভাবে বলে?
অহনার ফুপু চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো, সত্যি কথা বললেও দোষ! আমি কি মিথ্যা কথা বলেছি নাকি?
জামাই এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে আসছে। এই বাসার ফ্রিজে তো চার পাঁচ প্যাকেট মিষ্টি আছে।
আর ফলের কথা কি বলবো।
বাসায় যে আসতেছে, সেই দুই হাত ভরে ফল আনছে।
হুম আছে তো।
আমরা সবাই জানি ফ্রিজ ভর্তি মিষ্টি, ফল আছে।
আপনি, আপনার ছেলে মেয়ে নিয়ে ঘুরে ঘুরে খাচ্ছেন সেগুলো, সেটাও আমরা সবাই দেখেছি।
কিন্তু আপনি কি নিয়ে এসেছেন?
এবং সেটা কতোটুকু?
তুমি মেয়ে বড্ডো বেশি কথা বলো।
আমার ভাইয়ের বাসায় আমাকে কিছু নিয়ে আসতে হবে কেন?
খুব তো ভাই ভাই করছেন।
আপনার ভাই যখন ঘরে ফিরে শুনবে আপনি তার মেয়ে জামাইকে অপমান করেছেন। তখন কি আপনাকে ছেড়ে দিবে সে?
আপনার ভাই বাসায় ফেরার আগেই বিদায় হোন।
আমি যতোটুকু জানি, আপনার ছোট বোন ঢাকায় থাকে। ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি।
সেখানে নামিয়ে দিয়ে আসবে।
অহনার ফুপি কাঁদতে কাঁদতে বিদায় হবার পর, আসিফ ও উঠে দাঁড়াল। আমি তাহলে আসি আজ।
অহনার মা অবাক হয়ে বললো, আসি মানে?
তোমারা আজ এখানে থাকবে।
উনি গ্রামের মানুষ, কি বলতে কি বলেছে।
ওগুলো ধরে মন খারাপ করো না বাবা।
আসিফ মাথা নিচু করে ফেলল। আমি কিছু মনে করিনি। আসলে আমার নিজের বিছানা ছাড়া ঘুম আসে না।
সকালে অফিস আছে।
অহনাকে রেখে যাচ্ছি। ও থাকুক।
অহনা আসিফের হাত চেপে ধরলো। আমি থাকবো না। তুমি না থাকলে আমি ও থাকবো না।
অহনার মা, ভাই অনেক বলার পরেও ওদের যাওয়া আটকাতে পারলো না।
কেউ ঠিক মত খায়নি।
সবাই আধা খাওয়া অবস্থায় উঠে গেছে।
বাসার সবার মন খারাপ দেখে আলোর খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু ও মনে মনে খুব খুশি আপদ বিদায় করতে পেরে।
রাত বারোটা।
আসিফ ছাদে বসে আছে। অহনা ও আসিফের গা ঘেঁষে বসে আছে। কারো মুখে কোন কথা নেই।
অহনা বুঝতে পারছে আসিফ আজ খুব কষ্ট পেয়েছে।
কিন্তু কি বলে ওর কষ্ট কমাবে বুঝতে পারছে না।
ও ইতস্তত করে বললো, ঘুমাবে না?
হুম।
তুমি শুয়ে পড়ো। আমি আসছি।
সরি আসিফ, আমি বুঝতে পারিনি এমন কিছু ঘটতে পারে। বুঝতে পারলে তোমাকে নিয়ে যেতাম না।
আমি একাই চলে যেতাম।
বাদ দাও। যা হবার হয়েছে।
আমি গরীব মানুষ, সেটা ভুলে গিয়েছিলাম।
যেদিন আমার অনেক টাকা হবে।
অনেক কিছু নিয়ে শশুর বাড়ি যেতে পারবো, সেদিন তোমাদের বাড়ি যাবো।
তার আগে তুমি আমাকে কখনো রিকোয়েস্ট করবে না।
তবে তোমার যখন মন চায়, তুমি যাবে।
এ ব্যাপারে আমি কখনো কিছু বলবো না।
অহনার খুব কান্না পাচ্ছে। ওর ইচ্ছে করছে যে কোন কিছুর বিনিময়ে আসিফের মনটা ভালো করে দিতে।
ও ফিসফিসিয়ে বললো
আসিফ গান শুনবে?
আসিফ জানে অহনা খুব ভালো গান গায়।
ওর গানের গলা খুব মিষ্টি। কিন্তু আজ ও কিছুই বললো না।
চুপ করে যেভাবে বসে ছিল, সেভাবেই বসে রইল।
অহনা কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে খালি গলায় গাইতে শুরু করলো
হাত ধরে নিয়ে চলো
পথো চিনি না,
পথো চিনি না।
তুমি ছাড়া এ জগতে
কিছু বুঝি না
কিছু বুঝি না।
এই টুকু জীবনে
স্বয়নে, স্বপনে
প্রেম ছাড়া কিছু বুঝি না…
গানের কথাগুলো যেমন সুন্দর, অহনার কন্ঠ ও ঠিক তেমনি মিষ্টি।
আসিফের মন এক মুহুর্তে ভালো হয়ে গেল।
ও আবেগীয় কন্ঠে বললো, অহনা তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো তাই না?
না তোমাকে আমি মিথ্যা মিথ্যা ভালোবাসি।
মিথ্যে ভালোবেসে আমি রাজ প্রাসাদ ছেড়ে তোমার কাছে চলে এসেছি।
অহনার কথা বলার ধরন দেখে আসিফ শব্দ করে হেসে উঠে বললো, তোমার জ্বর-টর আসে নি তো? অফিস থেকে ফিরে তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিল জ্বর এসেছে। চোখ দুটো লাল হয়ে ছিলো।
না, জ্বর আসে নি। তুমি কি সেই বিকেলের জ্বরের খোঁজ এখন নিতে চাও?
হ্যাঁ। দেখি কাছে আস তো। জ্বর আছে কি-না দেখি।
অহনা ওর আরেকটু কাছে এগিয়ে এলো।
আসিফ অহনার কপালে হাত রাখল।
অহনা মনে মনে হাসলো।
বেচারা আমার শরীর ছুঁয়ে দেখার জন্য জ্বরের মত একটা বাজে অজুহাত তৈরি করেছে।
অহনা ফিসফিসিয়ে বললো তোমার যখনই আমাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করবে, ছুঁয়ে দেখবে। লজ্জা, দ্বিধা বা সঙ্কোচের কোন কারণ নেই।
ও অহনার কপালে হাত রেখে বলেছে— গা পানির মত ঠাণ্ডা, জ্বর নেই তো।
অহনা এবার শব্দ করে হেসে ফেললো।
হাসতে হাসতে বললো, আকাশে খুব মেঘ করেছে।
যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে।
চলো শুতে যাই।
আসিফ উঠে দাঁড়ালো।
অহনা যখন বিছানা ঠিক করছিল, আসিফ তখন গভীর মমতা মাখা কন্ঠে বললো, অহনা তোমার কি মাথা ব্যথা করছে? তোমাকে এক কাপ চা করে দেই।
অহনার সত্যি সত্যি মাথা ব্যথা করছে। তাছাড়া রাতে ওদের ঠিক মতো খাওয়া হয়নি। খিদেয় পেট চু চু করছে। ও হালকা হেসে বললো, দাও।
সাথে তোমার আনা বিখ্যাত টোস্ট ও দিও।
বেশ খিদে পেয়েছে।
তাহলে এক কাজ করি। ফ্রিজে তো রান্না করা মাংস আছে।
চালে ডালে ঝটপট খিচুড়ি করে ফেলি।
না না, এতো রাতে আর খিচুড়ি রান্না করতে হবে না।
চা বিস্কিট খেয়ে ঘুমাই।
সকালে যা করার দুজনে মিলে করবো।
ওকে।
মহা রানীর আদেশ চিরধার্য্য।
দুজনে চা খেতে খেতে অহনা খেয়াল করলো, আকাশের মেঘ কেটে আবার চাঁদ উঠেছে।
জানালার ফাঁক গলে চাঁদের আলো এসে পড়ছে ওদের গায়ে।
দেখেছো কি সুন্দর চাঁদের আলো?
একটু আগে কেমন মেঘ করেছিল। এখন আবার মেঘ কেটে চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে আকাশ।
আসিফ হালকা হেসে মজা করে বললো, গরীবের ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো আসে। তোমাদের রাজ প্রাসাদে চাঁদের আলো ঢুকতে পারে না।
কে বলেছে পারে না। জানালা খুলে দিলেই আলো আসে।
জানালা খুলে কয়জন বলো?
তোমাদের রুম তো ভারি ভারি পর্দা দিয়ে ঢাকা আর এসির বিজবিজ শব্দে ভরে থাকে।
প্রকৃতির এমন সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য কয়জনের হয়?
তাছাড়া তুমি ও আমার ঘরের চাঁদের আলো।
তোমার মতো এমন মিষ্টি বউ যার ঘরে আছে, তার চাঁদ দেখার দরকার হয় না।
হয়েছে হয়েছে, এতো মিষ্টি মিষ্টি কথায় পেট ভরবে না। ফ্লোরে শুয়ে আমার শরীর ব্যথা করে।
আগামী মাসে বেতন পেয়ে খাট কিনবে।
সব হবে অহনা। আমাকে একটু সময় দাও।
প্রথম প্রথম কষ্ট করা ভালো। কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে।
এসো দেখি আমার একটু কাছে আসো।
আবার কি?
অনেক রাত হয়েছে। এখন একদম দুষ্টুমি….
অহনা কথা শেষ করতে পারলো না।
আসিফ ওর ঠোঁট দুটো নিজের ঠোঁটে পুরে নিলো।
অহনা নিজেকে পুরোপুরি রুপে আসিফের বাহুডোরে ছেড়ে দিল।
আসিফের হলো বালিশ ঘুম। চোখ বন্ধ করা মাত্র নাক ডাকা শুরু করে। কিন্তু আজ অহনার কিছুতেই ঘুম আসছে না।
সে শুধু এপাশ ওপাশ করছে। কয়েক বার উঠে পানি খেয়েছে।
নির্জন রুমটাতে শুধু সে এবং তার অতি প্রিয় একজন মানুষ। সারারাত সে যদি সেই প্রিয় মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাহলেও কারোরই কিছু বলার নেই।
চাঁদের আলোয় আসিফকে কেমন রহস্যময় লাগছে।
অহনা একভাবে আসিফের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
সে জানে আসিফকে সে ভয়ংকর রকমের ভালোবাসে। এটা যে এক ধরনের অসুখ, সেটাও সে বুঝতে পারে। যত দিন যাচ্ছে অসুখটা ততই বাড়ছে। পৃথিবীর সব অসুখেরই কোনো না কোনো চিকিৎসা আছে।
কিন্তু সে জানে না তার এই পাগল করা ভালোবাসা অসুখের কোন চিকিৎসা আছে কি না।
সে অবশ্য চায় ও না, তার এই অসুখটা ভালো হয়ে যাক।
বরং সে এর বিপরীত টাই চায়। সে চায় তার অসুখটা আরো বাড়ুক। তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলুক।
সে শুধু আসিফকে ভালো বাসতে চায়।
পৃথিবীর সবকিছুর বিনিময়ে হলেও সে শুধু এই প্রিয় মানুষটির পাশে থাকতে চায়।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অহনার চোখ ভিজে উঠলো। তার কাছে মনে হল এই পৃথিবীতে সে সবচে সুখী মানুষ। এই সুখ টাকা পয়সা দিয়ে কেনা যায় না।
আলো-২৮
ভোরের নরম আলোয় অহনা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে।
আজো তাঁর খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে। ঘুম ভেঙেছে পাখির ডাকে। পাখির দল যে ভোরবেলা এত হৈ চৈ করে এ বাসায় আসার আগে অহনার জানা ছিল না।
পাখির ডাক নিয়ে বইয়ের পাতায় সে অনেক লেখা পড়েছে।
লেখকরা পাখির ডাক নিয়ে এত মাতামাতি কেন করেন ও তা বুঝতে পারছে না। পাখি নাকি মিষ্টি সুরেলা সুরে গান গায়। অথচ অহনার কাছে যন্ত্রণার মত মনে হচ্ছে। অলরেডি মাথা ধরে গেছে কিচিরমিচির শব্দে।
তবে রাতের অন্ধকার কেটে ভোর হবার দৃশ্যটা অসাধারণ। শুধু মাত্র এই দৃশ্য দেখার জন্যে রোজ ভোরবেলায় ওঠা যেতে পারে।
আসিফ দুই কাপ চা নিয়ে অহনার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
অহনা চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, ধন্যবাদ চায়ের জন্য।
পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে আমার মাথা ধরে গেছে।
আসিফ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, প্রতিদিন কি এমন ভোরে ওঠার অভ্যাস? নাকি এই খুপড়ি ঘরে তোমার ঘুমাতে সমস্যা হচ্ছে?
অহনা মিষ্টি করে হাসলো, এই কথার জবাব দিল না।
কি কথা বলছো না যে? রাতে ঘুম হয়নি?
হয়েছে। কিন্তু ভালো মতো হয়নি।
তুমি কিভাবে বুঝলে আসিফ ?
চোখ দেখে বুঝলাম। তোমার চোখের নিচে কালি পড়েছে।
অহনা ম্লান হেসে বলল চা টা খেতে বেশ ভালো হয়েছে। আবারও ধন্যবাদ।
আরেক কাপ দিবো?
দাও।
আসিফ খুব আগ্রহ করে আরেক কাপ চা বানিয়ে এনেছে।
অহনা শুধু মাত্র আসিফকে খুশি করার জন্যে আবারো চা খেতে চেয়েছে। আসলে ওর এখন চা খেতে একদম ইচ্ছে করছে না।
বেচারা এতো আগ্রহ করে আবার চা বানাতে চাইলো।
বেচারা কে না বলতে ইচ্ছে করলো না ওর। চায়ে এতো চিনি দিয়েছে যে যেদিক দিয়ে যাচ্ছে নাড়িভুঁড়ি সব মিষ্টি হয়ে যাচ্ছে।
আলো এসেছে নীলক্ষেতের ফুটপাত থেকে কিছু বই কিনতে। ও যখন শিশুতোষ গল্পের বই খুঁজছে, দূর থেকে সৈকতকে এদিকে হেঁটে আসতে দেখলো।
সৈকত স্যারকে দেখে ওর বুকের মধ্যে কেমন যেন ড্রাম বাজা শুরু হয়ে গেছে।
সৈকত কাছাকাছি এসে আলোকে দেখে একই সাথে খুবই অবাক এবং আনন্দিত হলো। সে উচ্ছাস গোপন করতে পারলো না। বিস্ময় প্রকাশ করে বললো,
আরে আলো তুমি এখানে?
আলো হেসে দিয়ে বললো, এইতো স্যার কিছু বই কিনতে আসছি।
বাহ্ খুব ভালো। বই পড়া খুব ভালো।
আলো একটা কথা বলি?
অবশ্যই স্যার।
জিজ্ঞেস করার কি আছে? সরাসরি বলুন না।
আমার সাথে এক কাপ চা খাবে। ঐ মোড়টাতে খুব ভালো চা বানায়। গরুর দুধের চা।
আর বল সিঙ্গারা।
আলো অবাক হয়ে বললো, বল সিঙ্গারাটা আবার কি জিনিস?
খুব ছোট ছোট সিঙ্গারা।
মার্বেল বলের সাইজ। তাই আমরা মজা করে বল সিঙ্গারা বলি।
অসম্ভব মজার। একটা সিঙ্গারা একবারেই মুখে পুরে খেয়ে ফেলতে হয়।
তাই নাকি।
শুনেই তো খেতে ইচ্ছে করছে।
চলুন দেখি আপনার বল সিঙ্গারা খেয়ে দেখি কেমন।
আলো দেখলো ফুটপাতে কোন রকম একটা ছোট্ট ছাপড়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একজন সমানে সিঙ্গারা ভাজছে। সহকারী হিসেবে দুই জন পিচ্চি আছে। এতো ভিড় যে তারা সিঙ্গারা দিয়ে কুলাতে পারছে না। কাস্টমারদের মধ্যে বেশিরভাগ ভার্সিটিতে পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীদের ভীড়।
বাইরে খোলা জায়গায় লাল প্লাষ্টিকের টুল পাতা।
পাঁচ সাত মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে ওরা দুটো টুল পেলো।
আলোর সত্যিই খুব মজা লাগছে সিঙ্গারা খেতে।
আগুন গরম ঝাল ঝাল সিঙ্গারা। সাথে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ।
ও এক বসায় বাইশটা সিঙ্গারা খেয়ে ফেললো।
চা খেয়েছে তিন কাপ।
সৈকত দশ পিচ সিঙ্গারা আর এক কাপ চা খেয়ে বসে বসে মুগ্ধ হয়ে আলোর সিঙ্গারা খাওয়া দেখছে।
আলো গরম সিঙ্গাড়া মুখে পুরে দিয়ে বললো, কি ব্যাপার স্যার আপনি খাচ্ছেন না কেন?
খান খান। অনেক মজা।
আমার তো আরো খেতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু পেট ভরে গেছে। আপনি খান।
আজকে বিল দিব আমি।
না না তা হবে না।
আজকে আমি বেতন পেয়েছি।
এই দেখো আমার কাছে অনেক গুলো টাকা আছে।
তাছাড়া তোমাকে আমি এখানে ডেকে এনেছি সিঙ্গারা খাওয়াতে। বিল আমিই দিব। তুমি অন্য একদিন দিও।
আলো হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বললো, অন্য আরেক দিন কি আবার আমাদের দেখা হবে নাকি?
হতেও তো পারে। তাছাড়া তুমি তো বই কিনতে মাঝে মধ্যে আসো এখানে।
আমাকে ফোন দিও। আমি চলে আসবো।
আমি তোমাকে ঢাকা শহরে সস্তায় সবচেয়ে মজার মজার খাবার কোথায় কোথায় পাওয়া যায়, সেখানে সেখানে নিয়ে যাবো।
ওকে মজার খাবার খেতে আমার কোন আপত্তি নেই।
কিন্তু আমাকে মজার মজার খাবার খাওয়াতে যেয়ে তো আপনার বেতনের সব টাকা আমার পেছনে শেষ হয়ে যাবে।
সৈকত লাজুক হেসে ফিসফিসিয়ে বললো, ভালো লাগার মানুষটার জন্য আমি পথের ফকির হতে রাজি আছি আলো।
স্যার কিছু বললেন? না না তোমাকে কিছু বলিনি।
চলো তোমাকে এগিয়ে দেই।
সৈকত একটা রিকশা ঠিক করে দিলো। ভাড়াও দরদাম করে ঠিক করে দিলো। রিকশা ছাড়া মাত্র লাফ দিয়ে উঠে বসলো আলোর পাশে।
আলো বিস্ময় প্রকাশ করে বললো কি ব্যাপার আপনি কোথায় যাবেন?
সৈকত বোকার মত হাসলো।
তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে সানগ্লাস চোখে দিতে দিতে বললো, ঢাকার আকাশ আজ ঘন নীল। বাতাস মিষ্টি মধুর। রোদের রঙ কাঁচা সোনার মত। অদ্ভুত সুন্দর একটি দিন।
এই দিনে প্রিয় মানুষটির পাশে বসে রিকশা ভ্রমণের মজাই আলাদা।
এমন চমৎকার সুন্দর একটি দিনেও আলোর মন খানিকটা বিষন্ন হলো। আলো আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বললো, আজ আমি আমার ফুপির বাসায় যাবো একটু।
অন্য একদিন আপনার সাথে রিকশায় ঘুরবো।
সৈকত ম্লান হেসে নেমে গেল।
ইটস ওকে। নো প্রবলেম।
আলো রিকশা ভাড়া দিয়ে যখন ফুপির বাসায় গেটের ভেতরে ঢুকলো, তখন দেখলো রন্জু ভাইয়া গাছের নিচে বসে সিগারেট টানছে। এ বাসায় প্রতিটা বড়ো বড়ো গাছের গুড়ি সিমেন্ট দিয়ে বাঁধনো।
বসার জন্য খুব সুন্দর।
আলো কখন গেট খুলে ঢুকে রন্জুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, ও খেয়ালও করেনি।
আজ কেমন আছো রন্জু ভাইয়া?
হঠাৎ করে আলোর কন্ঠ শুনে রন্জু কেঁপে উঠলো।
কিন্তু সেটা বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বললো এই তো মনে হচ্ছে ভালোই আছি। তুমি কোথা থেকে?
আলো রন্জুর পাশে বসতে বসতে বললো, আমি কোথা থেকে আসলাম সেটা না হয় পরে বলি।
আগে বলো তুমি সিগারেট খাচ্ছো কেন?
তুমি না অসুস্থ?
তাছাড়া সিগারেটের গায়ে লেখা আছে এটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
আলোর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রন্জু বললো, হুম সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু আমি নিয়োম মানলাম না।
কথাটা বলেই রন্জু হো হো করে হাসতে থাকলো।
যেন খুব মজার একটা কথা সে বলেছে।
কিছুতেই যেন তার হাসি থামাতে পারছে না।
হাসতে হাসতে ওর চোখে পানি চলে আসলো।
তারপর চোখের পানি মুছে বললো, আলো ভেতরে যাও। দেখোতো মাকে কিছু খাওয়াতে পারো কিনা।
আলো অবাক হয়ে বললো, কেন ফুপি খাওয়া দাওয়া করছে না?
একদম করছে না তা নয়। তবে খুব অনিয়ম করছে। অধিকাংশ সময় মন খারাপ করে কি যেন ভাবে।
খুব সম্ভবত অহনাকে নিয়ে টেনশন করছে।
আচ্ছা ঠিক আছে আমি দেখছি।
ফুপি আসবো?
আয় মা।
কেমন আছিস? আমার পাশে বোস।
আলো জানে তার ফুপি খাওয়াতে খুব পছন্দ করে। এটাই তার সবচেয়ে বড়ো দূর্বলতা। ও ফুপির গলা জড়িয়ে ধরে বললো, ফুপি কি রান্না করেছো? খুব খিদে পেয়েছে। আজ তোমার হাতে খাবো।
আমাকে মুখে তুলে খাওয়ায় দাও।
ওমা সে কি কথা!
তোর খিদে পেয়েছে আগে বলবি না। আগে জানলে তো তোর পছন্দের খাবার রান্না করতাম। আজকে তো তেমন কিছু রান্না ও করিনি। চল চল নিচে চল।
দেখি তোকে কি দিয়ে খাওয়ানো যায়।
যা আছে তাই দিয়েই খাবো। শুধু তুমি খাওয়ায় দিবা।
রন্জু ভেতরে ঢুকে দেখে ওর মা আলোকে মুখে তুলে খাওয়ায় দিচ্ছে। আর আলো ওর মাকে মুখে তুলে খাওয়ায় দিচ্ছে। একি প্লেট থেকে।
মেয়েটার মধ্যে কি যেন একটা আছে। যা অন্য কারো মধ্যে নেই।
নিজের মায়ের সাথে আমরা যা সহজে পারি না।
ও তা কতো অবলীলায় করে ফেলে।
আনন্দে রন্জুর চোখ ভিজে উঠলো।
কিন্তু এ পানি সে আলো বা মা, কাউকে দেখাতে চায় না।
ও আস্তে করে আবার বাইরে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই আলো ডেকে উঠলো
রন্জু ভাইয়া…..