অসম
পর্ব ২৪(বাকী অংশ),২৫
তানিয়া রহমান
পর্ব ২৪(বাকী অংশ)
শাড়ী পরে নিতু ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ার খুলে কাঙ্ক্ষিত ব্র্যান্ডের লিপস্টিক আর কাজল খুঁজতে লাগলো।অনুপম বলল- বা দিকের ড্রয়ারে হাত দাও সব পাবে
অনুপম বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফুরফুরে মেজাজে নিতুকে দেখছে,লিপস্টিকের ছোঁয়ায় কেমন করে ঠোঁটের রং বদলে যায়, কাজলে চেন্জ হয়ে যাচ্ছে চোখের ভাষা।
নিতু ড্রায়ার চালিয়ে চুল শুকিয়ে নিল,হাত খোপা করে ববি পিন গুজে দিয়ে বেলি ফুল জরালো,ডলসি গারবানা আর বেলির সৌরভে সারা ঘর মৌ মৌ করছে।
নিতু অনুপমের দিকে তাকিয়ে বলল – কি দেখছো
– এত সুন্দর কেন তুমি
– এ তোমার চোখের দোষ
অনুপম উঠে এসে নিতুর হাত উল্টে পাল্টে দেখে বলল- মেহেদী পরবে না, নিয়ে এসেছিতো
– কি যে বলনা,এমনিতেই আমার অনেক লজ্জা লাগছে
– লজ্জার কি আছে, মেহেদী ছাড়া বিয়ে হয় নাকি
– আমি পারব না
– আমি পরিয়ে দিচ্ছি
অনুপম মেহেদীর টিউব নিয়ে নিতুর হাতে আঁকতে শুরু করে দিল।
নিতু বলল – কতজনকে মেহেদী পরিয়েছ
– অনেককেই পরিয়েছি,তবে সিমিকে বহুবার পরিয়েছি
– সিমি কে
– আমার কাজিন
– প্রেম ছিল
– হুম ছিল
– বিয়ে করনি কেন
– তোমাকে করবো বলে
– ব্রেকআপ কিভাবে হোল
– ভার্সিটিতে উঠে ও নতুন একজনকে পেল,আমিও আরেকজনকে খুঁজে নিলাম
নিতু চুপ করে গেলে অনুপম বলল – আর কিছু জানার নেই
– আমার পিছনে এরকম সুপার গ্লুর মতো লেগে রইলে কেন
– ওরা ছিল মোহ আর তুমি হচ্ছ ভালবাসা, গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে বলল – এ জাল ছিন্ন করা আমার সাধ্য নাই
খুব সাদাসিধে ভাবে নিতু আর অনুপমের বিয়ে হয়ে গেল, নিতুকে যখন কবুল বলতে বলা হোল তখন তার মনে পরে গেল আজ থেকে পয়ত্রিশ বছর আগে এক কিশোরীর দুরুদুরু বুকে কবুল বলার কথা,সেদিনের সেই কিশোরী নিজে নিজে শাড়ী পরতে পারেনি,এমনকি সজতেও জানেনি।একই সময়ে একই ভাবে দুজন মানুষকে ভালবাসার মতো বিড়ম্বনা বোধহয় আর নেই। নিতুর গাল বেয়ে জল গরিয়ে পরলো।
নিতুর চোখের পানি দেখে অনুপমের মনের গহীনে যে ভালো লাগা কাজ করছিল তা উবে গেল। তুহিনকে ফিসফিস করে বলল – ওকে জোর করিস না, কান্না দেখতে ভাল লাগছে না
– বাদ দেতো, মেয়েরা এমনই, তোর মনে নেই তোড়া কি করেছিল,আমাদের মধ্যে এত ভাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকার পরও হাউমাউ করে কেঁদেছিল।
অনুপম ফুড পান্ডায় অর্ডার করে কাচ্চি, রোস্ট, বোরহানি আনিয়েছে,তুহিনের দুজন কলিগ যারা বিয়ের সাক্ষী আর কাজী সাহেবকে তোড়া খাবার পরিবেশন করলো।
গেস্ট বিদায় দিয়ে অনুপম লিভিং রুমের সোফায় বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে আনমনে ভাবছিল ” নেশাল যদি না বুঝতে চায় তবে কি নিতু ওকে ভুল বুঝবে”
তুহিন অনুপমের পাশে বসে বলল – কি এত ভাবছিস
– কিছু না
– হুট করে বিয়ে করলি কোন সমস্যা?
অনুপম চুপ করে রইল
– ইজ সি ক্যারিং
অনুপম কিছু সময় অবাক হয়ে তুহিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো তারপর হেসে বলল – আরে ধুর
– তবে সমস্যা কোথায়
– নেশাল সবকিছু জেনে রিয়্যাক্ট করছে,আর তুইতো জানিস আমি নিতুকে কারো কাছেই অসম্মানিত হতে দিব না
– হ্যাভ পেসেন্স
তোড়া আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে বলল- আপুতো ঘুমিয়ে গিয়েছে
অনুপম বলল – ও ভীষণ টায়ার্ড, আজ তিনদিন ধরে ঘুম খাওয়া নেই
তুহিন অনুপমের দিকে তাকিয়ে বলল – ওকে বন্ধু তোমার ওর টেক কেয়ার করো আমরা আসছি
– খেয়ে যা
– নারে, ছোট ছেলেটা অসুস্থ, আজ আশি
তোড়া আর তুহিন চলে যাবার পর অনুপম বেডরুমে এল,ফাস্ট এইড বক্স থেকে মেডিসিন নিয়ে নিতুর পায়ে আলতো করে লাগিয়ে দিতে লাগলো।
অনুপমের ছোঁয়ায় নিতুর ঘুম ভেঙে গেল, পা সরিয়ে নিয়ে বলল – কি করছো
অনুপম বিরক্ত হয়ে বলল- মেডিসিন লাগাচ্ছি,পা সরাচ্ছ কেন
মেডিসিন লগানো শেষ করে অনুপম নিতুর পাশে এসে বসলো, নিতু অনুপমের একটি হাত নিজের গালের সাথে চেপে ধরে বলল- রেখে দিবে আজ আমায়
– উ হুঁ, এত সাদামাটা ভাবে বোউ ঘড়ে তুলবো না,দুজনে জমিয়ে শপিং করবো, বাসর সাজাবো,কল্পনায় কতবার যে তোমাকে বোউ সাজিয়েছি এবার বাস্তবে দেখবো
– কল্পনা আর বাস্তব ভিন্ন অনুপম
– তুমি আমার কল্পনার চাইতেও সুন্দর, উঠো, খেয়ে রেডি হয়ে নাও,বেশি রাত হলে তোমাকে ঠ্যাঙ্গাবে
– আমাকে শাসন করার মতো কেউ নেই, ভীষণ একা আমি অনুপমের আঙুলে আঙ্গুল গলিয়ে নিতু বলল – সবার মতো তুমিও চলে যাবে নাতো
– আই কান্ট ইমাজিন, নিতুকে জরিয়ে ধরে বলল- আইম অলয়েজ উইথ ইউ, বিলিভ মি, অনুপম নিতুর কাঁধে নাক ডুবিয়ে দিল।
এই প্রথম নিতু অনুভব করলো এ ভালবাসাবাসিতে কোন পাপ নেই।
ব্লাক কালারের বি এম ডাব্লিউ খুব দ্রুত ছুটে যাচ্ছে বনানীর দিকে, রাতের ঢাকা সত্যি খুব সুন্দর, সোডিয়াম লাইটের আলোয় চারদিক ঝকঝকে, মেঘমুক্ত আকাশে তারার বিচ্ছুরণ, বাতাসে নিতুর ভেঁজা চলের গন্ধ।
নিতু বলল – ড্রাইভ স্লো প্লিজ
অনুপম বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আর চোখে নিতুকে দেখে গলা ছেড়ে গান ধরলো
আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব, হারিয়ে যাব আমি তোমার
সাথে। ——–
চলবে
অসম
পর্ব ২৫
তানিয়া রহমান
নেশাল নিজের অফিস রুমে বসে একটার পর একটা ফাইল সিগনেচার করে যাচ্ছে। এ কয়েকদিনের অমনোযোগীতার কারণে অনেক কাজ জমে গিয়েছে। দরজা ঠেলে অনুপম নেশালের রুমে এল, নেশাল একবার অনুপমের তাকিয়ে আবার কাজে মন দিল।
অনুপম চেয়ার টেনে নেশালের মুখোমুখি বসে বলল- তোমার সাথে কথা আছে
নেশাল ফাইল থেকে মুখ উঠিয়ে অনুপমের দিকে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বললো – বলুন
অনুপমের হঠাৎ মনে হোল দশবছর আগের সাদাত তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বলল – আমার আর নিতুর ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছি
– বাইরের কারো কাছ থেকে কোন কিছু শুনতে আমি ইন্টারেস্ট নই
– আমি বাইরের কেউ নই,সি ইজ মাই ওয়াইফ
– সরি! বুঝলাম না
– আমরা গতমাসে বিয়ে করেছি
নেশালের মনে হোল মাথা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, হাতে পায়ে ঝিম ধরে আসছে,ঠান্ডা অথচ স্থির স্বরে বলল – বিশ্বাস করছি না
অনুপম ফোন হাতে নিয়ে গ্যালারী থেকে বিয়ের নিকাহ্ নামার ছবি বের করে নেশালের হাতে দিয়ে বলল- কক্সবাজার আমাদের হানিমুন ট্যুর ছিল
নেশাল ছবির দিকে স্থির তাকিয়ে রইল
অনুপম আবার বলতে শুরু করলো – তোমাকে কোন সোশ্যাল হেরাজমেন্টে পরতে হবে না, আমাকে সপ্তাহ খানেক সময় দাও ওকে নিয়ে সুইডেন চলে যাচ্ছি।
নেশাল অনুপমের ফোন ফিরিয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে বলল – আপনি এবার আসুন
– যাচ্ছি কিন্তু তুমি ওকে কষ্ট দিও না, ও তোমাকে ভীষণ ভালবাসে
অনুপম চলে যাবার পর নেশাল আর কোন কাজে মন দিতে পারল না, ভিতরের অস্থিরতা বারতে বারতে একসময় বাঁধ ভাঙ্গলো।
নেশাল বাসায় এসে যখন নিতুর বেডরুমে এল নিতু তখন রেডি হচ্ছিল অনুপমের কাছে যাবার জন্য।
নেশালকে দেখে নিতু আৎকে উঠে বলল- কিছু বলবে
– বিয়ে করেছো
নিতু চুপ করে রইল
– সুইডেন চলে যাচ্ছ
– তুমি যদি মানা কর যাব না
– আমার মানা করার জন্যতো কিছু থামিয়ে রাখনি, সব সম্পর্কই যখন নষ্ট করে দিয়েছ তাহলে এখনো কেন সাদাত আহমেদের লেবাস ধারণ করে আছ
নিতু ধমক দিয়ে বলল – নেশাল
– একটা কথাও বলবে না তুমি, আমার পাপার এই ঘরে তোমাকে আর মানাচ্ছে না মিসেস অনুপম চৌধুরী
নিতু ধপাস করে বিছানায় বসে পরলো, বিড়বিড় করে বলল ” নেশাল তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলছে! মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো,এত এত পড়াশোনা তার ঝুলিতে কিন্তু আজ তারা বড্ড বেকার, তার কোন নিজস্ব আইডেন্টিটি নাই, মিসেস সাদাত, মিসেস অনুপম একই কক্ষে ঘুরে বেড়ানো দুটো ভিন্ন গ্রহ মাত্র। কোথায় যাবে সে,চারিদিকে এত সম্পর্ক অথচ তার কেউ নেই, হঠাৎ নিতুর মনে হোল খুলশি যাবে, বাবার বাড়ি, তার কোন ভাই বোন না থকাতে তার বাবার সমস্ত সম্পত্তি তাকেই পেয়েছে।”
প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র,পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে এক কাপড়ে নিতু বেরিয়ে এল।
ইমতিয়াজ দৌড়ে এসে গাড়ীর দরজা খুলে দিল।
নিতু বলল – চাবি দাও ইমতিয়াজ আমি ড্রাইভ করব
লাল রঙের প্রাডো শাঁ শাঁ করে ছুটতে লাগলো চিটাগং রোডের দিকে, নিতুর মাথাটা হ্যাং হয়ে আছে,তার নিজের ছেলে তাকে বের করে দিচ্ছে। গাড়ি যখন কাঁচপুর ব্রিজ ক্রস করছিল তখন সন্ধ্যা ফুরিয়ে রাতের শুরু, গ্রীন লাইনের তীব্র আলোয় নিতুর মাথাটা ঘুরে গেল, প্রাডো গাড়ী কয়েকটি ডিগবাজি খেয়ে উল্টো হয়ে পরলো খাদের কাছে।
চলবে