অসম
পর্ব ২২,২৩,২৪
তানিয়া রহমান
২২
অনুপম কাবার্ড খুলে শার্ট বের করলো,গায়ে জরিয়ে শার্টের কলার উঁচু করে দিল,ডাইনিঙে এসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে অনুপম তার বড় ভাই অভিনবকে বলল- কেমন আছ
রাশভারি কন্ঠে অভিনব বলল- ভালো, তোরতো কোন খোঁজ নেই
– বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গিয়েছিলাম
অভিনব গরুর মাংসের বাটি টেনে নিয়ে বলল – বোস,আমি খুব অল্প সময় নিয়ে এসেছি, অনুপম ভাইয়ের দিকে তাকালো, অভিনব আবার বলতে শুরু করলো- মা সানজানার সঙ্গে বিয়ের ডেট ফাইনাল করতে বলছে তোর কি মতামত
অনুপম একবার মা আর একবার ভাবীর দিকে তাকালো তারপর আস্তে আস্তে বলল- আমিতো ভাবী আর মাকে সব বলেছি
– কি বলেছিস
– ভাবী ভাইয়াকে বলনি
মুখে আরস্টতা নিয়ে অভিনব বলল- তোর কাছ থেকে শুনতে চাই
– ভাইয়া তুমিতো জান আমি তোমার সঙ্গে সহজ হতে পারিনা,মা তুমি বলনা
সেতারা অনুপমের চোখে চোখ রেখে বলল- সমস্যা তোর আমার নয়
অনুপম বুঝতে পারলো ঘটনা বহুদূর গড়িয়েছে, সবার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে মিনমিন করে বলল – আমি নিতুকে বিয়ে করবো
সেতারা ক্রোধ নিয়ে বলল – দেখেছিস কত বড় বেয়াদব
অভিনব হাত উঁচু করে সেতারাকে থামিয়ে দিয়ে অনুপমকে বলল- তুই কি বলছিস বুঝতে পারছিস
সেতারা বলল – ঐ মেয়ে একটা অসভ্য মেয়ে, দুদিন হয়নি হাসবেন্ড মারা গিয়েছে এর মধ্যে ওর মাথা চিবিয়ে নিচ্ছে
অনুপম সেতারার দিকে রাগী চোখে তাকালো তারপর অভিনবকে বলল- আমাকে জোর করে লাভ নেই ভাইয়া,তোমার কিছু জানার থাকলে ভাবীর কাছ থেকে জেনে নিও
অনুপম খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, বেসিনে হাত ধুয়ে নিজের রুমে চলে এল।
নিজের সঙ্গে নিজে বেশ কয়েকবার বোঝাপরা করে নেশাল নিতুর বেডরুমের দরজায় নক করে বলল – আসব?
নিতু ঘুমের আয়োজন করছিল নেশালের গলার স্বর পেয়ে বলল- এস
নেশাল ডিভানের একপাশে কাচুমাচু হয়ে বসলো,নিতু ছেলেকে এরকম অচেনা রুপে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল- কখন এসেছো
– আজকে অফিস যাইনি, তুমি আসবে তাই বাসায় ছিলাম
নিতুর ভিতরটা কেঁপে উঠল মনে মনে বলল ” নেশাল কি কিছু দেখেছে”মুখে বলল- তোমাকে এমন দেখাচ্ছে, কিছু কি হয়েছে
– আমরা কি বন্ধু নই
– অফকোর্স বন্ধু
– আমি কি সব বিষয় সব সময় তোমার সাথে শেয়ার করিনি
– করেছো
– তবে তুমি কেন এমন করলে
নিতু কিছু সময় চুপ করে রইল, এমন অসম্মানিত কোনদিন সে হয়নি মাথা নিচু করে বলল – আমাকে ঘেন্না করছো
– চাইছি পারছি না
– তুমি কি সব জানতে চাও
– না,পাপাকে কিভাবে এত সহজে ভুলে গেলে
– ভুলিনি
– ভুলেছো, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকে বলল- তুমি আমার আইডল ছিলে এটা ভাবতেও নিজের উপর থুথু দিতে ইচ্ছে করছে
নিতু জলভরা চোখে নেশালের দিকে তাকিয়ে ওর হাত ধরে বলল- তুমি যেমন ভাবছো তেমন নয়
নেশাল এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল – তোমার আমার সম্পর্ক এখানেই শেষ
আর এক মুহূর্ত সেখানে দাড়াঁনোর প্রয়োজন বোধ করলো না নেশাল,নিতু নেশালের চলে যাবার দিকে তাকিয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে শব্দ করে কান্না করে উঠলো।
চলবে
অসম
পর্ব ২৩
তানিয়া রহমান
আজ তিনদিন ধরে অনুপম নিতুর সঙ্গে কোন রকম যোগাযোগ করতে পারছে না, কল করলে ফোন বন্ধ বলছে। হসপিটালেও আসছে না,কোন উপায় না পেয়ে নিতুর বাসায় গিয়ে কলিং বেল বাজালো অনুপম,সুফিয়া হন্তদন্ত হয়ে এসে দরজা খুলে দিল, অনুপম বলল – নেশাল আছে?
– জ্বে না,অফিস গেছে
– হিমি?
– হে ও নাই, বাপের বাড়ি
অনুপম হাফ ছেড়ে বলল – নিতু ম্যাম আছে?
– আছে, বহেন আমি কইতাছি
– কিছু বলতে হবে না আপনি বরং আমাকে এক মগ কফি দিন
– আইচ্ছা
সুফিয়া চলে যাবার পর অনুপম নিতুর বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেল, দরজা খুলে লক্ করে দিল।
নিতু বিদ্ধস্থ অবস্থায় এলোমেলো চুলে হাটুতে মুখ গুজে মেঝেতে বসে আছে,নিতুকে দেখে অনুপম অনুমান করলো কিছু একটা হয়েছে,দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল- নিতু!
নিতু মুখ তুলে অনুপমের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিল।
অনুপম বলল – পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে আস আমি গাড়িতে ওয়েট করছি
নিতু গাড়িতে উঠে অনুপমের পাশে বসলো, অনুপম কোন কথা না শাঁ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
শেলটেকের দ্যা ডিউ এ্যাপার্টমেন্টের অষ্টম তলার ফ্ল্যাটে অনুপম নিতুকে নিয়ে এল,নিতু লিভিং রুমের চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে অনুপমকে বলল- এটা কাদের বাসা?
– বাইরে নেম প্লেট দেখনি
– খেয়াল করিনি
– এস বলছি
অনুপম নিতুকে বেডরুমে নিয়ে এল,জানালার ভারী পর্দা সরিয়ে নিতুকে বলল – এদিকে এস
নিতু জানালার কাঁচ ভেদ করে বাহিরে তাকালো,সুন্দর একটা ঝিলে কতগুলো হাঁস সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে, ফুটে থাকা পদ্মফুলের পাপড়ির উপর কতগুলি ফড়িং আর প্রজাপতি উড়ছে,নিতু বুঝতে পারলো একদিন কথায় কথায় অনুপমকে বলেছিল “ঝিলের ধারে বাড়ি থাকলে মন্দ হতো না ”
নিতু ম্লান হেসে বলল – তোমার ফ্ল্যাট
– উঁ হুঁ,আমাদের ফ্ল্যাট
– আমরা আর কোনদিন আমাদের হতে পারব না অনুপম
অনুপম নিতুকে ডিভানে বসিয়ে দিয়ে বলল – কি হয়েছে
নিতু হাউমাউ করে কেঁদে কেটে কি বলল অনুপম কিছই বুঝতে পারলো না, কান্নার বেগ কমে এলে অনুপম বলল – এবার বল
– নেশাল সব জেনে গিয়েছে
– তুমি বলেছ
নিতু না সূচক মাথা নাড়িয়ে বলল- সেদিন ও আমাদের দেখে ফেলেছে
– তুমি যে বললে বাসায় কেউ নেই
– আমি তাই জানতাম, কিন্তু নেশাল ছিল আমাকে ওয়েলকাম জানানোর জন্য
অনুপম চিন্তিত মুখে নিতুর হাত দুটোয় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল- আর কোথায় আঁচড় কেটেছো
নিতু ভাবলেশহীন ভাবে বলল – পায়ে
অনুপম প্লাজো তুলে আৎকে উঠে বলল- করেছো কি তুমি
নিতু কেঁদে দিয়ে বলল – মরে যেতে চেয়েছিলাম, পারিনি
প্রচন্ড ধমক দিয়ে অনুপম বলল – নিতু
নিতু কান্নার বেগ বারিয়ে বলল – আমার নেশালকে এনে দাও, ও বলেছে আমার সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক রাখবে না, তারপর অনুপমের হাত খামচে দিতে দিতে বলল – কেন তুমি আমার জীবনে এলে?আমার জীবনটা কেন নরক বানিয়ে তুললে?
অনুপম পাথরের মতো বসে নিতুর সব অভিযোগ শুনলো,অনুপমের ক্ষত বিক্ষত হাত থেকে যখন রক্ত বেরিয়ে এল নিতু তখন থামলো
অনুপম বলল – ব্যাস এইটুকু
নিতু ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল- বাঁধা দিলে না কেন
– অপরাধ যখন করেছি শাস্তিতো পেতেই হবে
অনুপম যখন নিজ হাতে নিতুকে খাইয়ে দিচ্ছিল তখন মধ্য দুপুর, নিতু অপলক দৃষ্টি নিয়ে অনুপমের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো রক্তের দাগ শুকিয়ে কোথাও কোথাও কালচে হয়ে গিয়েছে, নিতু চোখ সরিয়ে অন্য দিকে মুখ করে বলল – আর খাব না
– খেতে হবে নিতু, তোমাকে ভীষণ উইক দেখাচ্ছে
– পারব না, বমি হয়ে যাবে
অনুপম কথা বারালো না, নিতুর এঁটো ভাত খেতে শুরু করলো।
নিতু বলল – আমাকে কবে সুইডেন নিয়ে যাবে?
– ভিসার জন্য এ্যাপলাই করেছো
– আমার ভিসা করা আছে
– তবে আর কি টিকিট কনফার্ম করতে যতদিন লাগে
– আমার এই নোংরা শরীরে নেশালের সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না
অনুপম খাওয়া থামিয়ে কিছু সময় নিতুর দিকে তাকিয়ে রইল, খাবার ছেড়ে উঠে বেসিনে হাত ধূতে গেল, নিতু বলল – খাবে না?
– আগে তোমাকে পবিত্র করার ব্যবস্থা করি
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নিতু অনুপমের দিকে তাকালো
অনুপম বলল – তুমি হয়তো ভাবতে পার সুযোগ নিচ্ছি
– ভিখারির কাছ থেকে আর কিইবা সুযোগ নিবে
অনুপম চেয়ার টেনে নিতুর মুখোমুখি বসে বলল- আমরা আজ বিয়ে করবো,কিন্তু গতমাসের ডেট দিয়ে, নেশাল যা দেখেছে হাসবেন্ড ওয়াইফের জন্য লিগাল,আশা করছি ও যখন জানবে আমরা ইলিগ্যাল কিছু করিনি ও হয়তো তখন এতটা রিয্যাক্ট করবে না, তুমি রাজী হলে আমি তুহিনকে ব্যবস্থা করতে বলি
– নেশাল আমার কাছে ফিরবেতো
ধৈর্য ধরতে হবে, নিতুর নাক টিপে বলল- রংধনু দেখতে হলে বৃষ্টি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
– আমি রাজী
– ওকে! তুমি রেস্ট নাও,আমি আধঘন্টার জন্য বাইরে যাচ্ছি।
চলবে
অসম
পর্ব ২৪
তানিয়া রহমান
আধঘন্টারও বেশি সময় লেগে গেল অনুপমের ফিরে আসতে,দুটো শপিং ব্যাগ ডিভানের উপর রেখে নিতুর দিকে তাকালো, নিতু বিছানায় আধশোয়া হয়ে সানন্দা পড়ছে
,অনুপম বলল- নিতু!শাওয়ার নিয়ে শাড়ী পরে নাও,তুহিন, তোড়া ওরা এলো বলে
– শাড়ীতো নিয়ে আশিনি
অনুপম নিতুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল – পুরোনো শাড়ী পরিয়ে বিয়ে করবো নাকি,শপিং ব্যাগে সব আছে
নিতু ব্লু কালারের ব্যাগ খুলতে গেলে অনুপম বলল – ওটা আমার, রেড ব্যাগ তোমার
নিতু রেড কালারের ব্যাগ খুলে দেখলো নুড কালারের অসম্ভব সুন্দর একটা কাঞ্জিভরম, ম্যাচিং ব্লাউজ, পেটিকোট, কাচুলি সব আছে।
অনুপম কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল – পছন্দ হয়েছে
– খুউব
অনুপম ওয়াশরুম দেখিয়ে বলল- নিতু রানী কি নিজে শাওয়ার নিতে পারবে না–কি
অনুপমকে থামিয়ে দিয়ে নিতু বলল – এই একদম না
নিতু ওয়াশরুমে ঢুকে দ্বিতীয়বারের মতো চমকে গেল, যেসব ব্র্যান্ডের টয়লেট্রিজ ইউজ করে তার সব আছে এখানে, প্রতিটি জিনিসে স্পর্শ করে ভাবতে লাগলো – ভালবাসা বুঝি এমন করেই বুঝাতে হয়!
অনুপম শাওয়ার নিয়ে এসে পাঞ্জাবি পরে নিল, ব্লু কালারের পাঞ্জাবি পরে অনুপমের মনে হলো জেমস বন্ড যদি পাঞ্জাবি পরতো তাহলে হয়তো তার মতোই সুন্দর লাগতো।শিস দিতে দিতে মিররের সামনে দাড়িয়ে চুল ঠিক করে নিল,হাতা ফোল্ড করতে গিয়ে আঁচড়ের দাগ চোখে পরলো অনুপমের। ফোল্ড করা বাদ দিয়ে হাতা নামিয়ে দিল।
নিতু কোন রকম শাড়ী পেচিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এল, অনুপম আয়নার মধ্য দিয়ে নিতুর দিকে তাকিয়ে বলল – হেল্প করবো
– হুম,ইতস্ত করে আবার বলল – পিন লাগবে শাড়ী পরতে
– এনেছিতো, রেড শপিং ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে পিনের পাতা বের করে নিতুর হাতে দিয়ে বলল- মেয়েদের পোশাক মানেই হাজার ঝামেলা
নিতু হেসে বলল – কুচি ধরতে হবে