হাইওয়ে-৫,৬,৭

হাইওয়ে-৫,৬,৭
শানজানা আলম
পর্ব:৫

সাইনবোর্ডের পরেই বাগেরহাট শহর, বিশ মিনিটের বেশি লাগে না। পাঁচ মিনিট চুপ করে থেকে তন্বী বলল, আপনি আমার এত বড় হবেন, আশা করিনি, ভেবেছিলাম একটু বড় হতেও পারেন, নাও হতে পারেন।
আকাশ কথা না বলে হাসল।
-আচ্ছা মাওয়া পৌছাতে কতক্ষণ লাগবে?
-পথে যদি গাড়ি ট্রাবল না দেয়, তাহলে ৪/৫ ঘন্টা।
-ওহ!
-আমি ধীরে সুস্থেই যাই, গাড়ীর কন্ডিশন বেশি ভালো না। আচ্ছা যদি বাগেরহাট স্ট্যান্ডে গ্যারেজে একটু দাঁড়াই, আপনার সমস্যা আছে?
-না না, সমস্যা কিসের!
-আসলে স্ট্যান্ড তো, অস্বস্তি হতে পারে।
-আপনি গাড়ি চেক করুন, আমি একটু ষাট গম্বুজ আর দিঘিটা দেখে আসি। শহরের কাছেই তো!

আকাশ বলল, একা যেতে হবে না৷ এতটাও টুরিস্ট ফ্রেন্ডলি হয়ে ওঠেনি আর মাজারে অনেক উটকো লোকের ঝামেলা থাকে। দালাল টাইপের।
-ওহ, ভেবেছিলাম কাছেই যখন, দেখে আসি। বের হলেও কক্সবাজার সাজেক সিলেট। এদিকে তো আর আসা হয় না।

-আচ্ছা যাবার সময় আমি দেখিয়ে নিয়ে যাবো।

-না মানে আপনি আসলে আমাকে কী মনে করছেন, বুঝতে পারছি না, আমি কিন্তু একা ট্যুর করি!

-সে করেন যখন, কারো উপর আপনার দায়িত্ব থাকে না। আজ আপনার সব রকম নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার, আমি আপনাকে একা ছেড়ে দিতে পারি না।

-বাপরে, আপনি সব যাত্রীর এমন দায়িত্ব নেন নাকি!

-নাহ, আমি তো যাত্রীই নেই না, ড্রাইভার আছে তিনজন, ওরা একটু ব্যস্ত, একটা বিয়ে বাড়িতে গাড়ির সাথে ডিউটি করছে। আপনার আর্জেন্ট দেখে আমাকে ড্রাইভার হয়ে যেতে হলো!

-ওহ আচ্ছা। সরি, অনেক ঝামেলা করতে হলো।

-সরি বলার কিছু নাই। চাকরি হলে মিষ্টি পাঠিয়ে দিয়েন।

কথায় কথায় বাগেরহাট চলে এলো। সুলতানের গ্যারেজে জসিম বলে একটা ছেলে আছে, ওকে দিয়ে টায়ার গুলো চেক করিয়ে নিতে হবে। স্ট্যান্ড ছাড়িয়ে একটা গ্যারেজ দুটো বাস রাখা একপাশে। তন্বী নেমে পড়ল। আকাশ ভেতরে গিয়ে দেখল সুলতান শাহ শুয়ে আছেন।
আকাশকে দেখে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর ভাইডি, মেলা দিন পরে!
-এই তো সুলতান ভাই, জসিম কই?
-ওরে একটু দশানি পাঠাইছি, কাজে, চইলে আসবেনে।
-আচ্ছা। আমি তাইলে একটু ঘুরে আসি। টায়ার পাল্টাতে হবে।
-আইচ্ছা, গাড়ি থুয়ে যান। আসলে পরে দেখে দেবানি।
আকাশ বের হয়ে এসে দেখল তন্বী লাউয়ের মাচা দেখছে। গ্যারেজের এক পাশে লাউ গাছ লাগিয়ে মাচা করে দেওয়া হয়েছে। পাতাগুলো ইটের গুড়ি আর ধূলায় লালচে হয়ে আছে।

-তন্বী, আসুন।
-কাজ হয়ে গেল?
-ছেলেটা নেই, একটা কাজে গেছে। ও এসে চেক করবে। আমরা একটা অটো নিয়ে ষাট গম্বুজ আর দিঘি ঘুরে আসি। এখানে বসে থেকে লাভ নেই।

তন্বী ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলো। আকাশ অটো ঠিক করে উঠে পড়ল তন্বীকে নিয়ে।

চলবে

শানজানা আলম

হাইওয়ে -৬

প্রায় পনের মিনিট লাগল ষাটগম্বুজ পৌঁছাতে।
আকাশ অটোতে বসে জিজ্ঞেস করল, আপনার একটু দেরী হয়ে যাবে বোধহয়!
তন্বী হেসে বলল, সমস্যা নেই। পৌঁছালেই হবে। আর আজকে আমার কোনো টেনশন লাগছে না। কেমন যেন একটা অদ্ভুত নিশ্চিন্ত লাগছে, বিষয়টা অবশ্য স্বার্থপরের মত হচ্ছে, তবুও বলি, আমার মনে হচ্ছে, আজকে ঢাকা পৌছানোর দায়িত্ব আপনার। আমি নিশ্চিন্তে আছি তাই।
আকাশ হেসে ফেলল।
তন্বী বলল, না সত্যি। আপনাকে দেখে মনে হয়েছে, আপনার উপর চোখ বন্ধ করে নির্ভর করা যায়।
আকাশ একটু অবাক হলো, এমন অকপট স্বীকারোক্তি কেউ করতে পারে, ওর ধারনা ছিল না৷ একটা বিষয় বিতর্কিত হলেও সত্য, মেয়েরা বেশিরভাগ সময় নির্ভর করতে পছন্দ করে। মনে মনে চায় অচেনা পথে কেউ তার হাত ধরুক। চোখ বন্ধ করে যার হাত ধরে রাস্তা পাড়ি দেওয়া যাবে।
আর ছেলেরা খুব বেশি পছন্দ করে, কারো দায়িত্ব নিতে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ছেলেদের মানসিক পরিতৃপ্তি দায়িত্ব নেওয়ার মধ্যে অনেকটাই ঢুকিয়ে দিয়েছে। এটা অবশ্য বাইরে, ঘরে ফিরে আবার বেশিরভাগ ছেলেদেরই যত্ন পাওয়ার ইচ্ছেটা মজ্জাগত।

এই মুহুর্তে তন্বীর এমন অকপট স্বীকারোক্তি আকাশের দায়িত্বকে কয়েকগুনে বাড়িয়ে দিলো। বলা যায়, তন্বী নিজেই আকাশের হাতে নিজের দায়িত্ব তুলে দিলো।

অটো থেকে নেমে, আকাশ মানিব্যাগ বের করছিল। তন্বী বলল, কিছু মনে না করলে, আমি দেই?
আকাশ ভাড়াটা দিতে দিতে বলল, এই মাত্রই তো বললেন, আপনার দায়িত্ব আজ আমার! এত তাড়াতাড়ি কথা বদলে ফেললে হয়?

তন্বী হেসে ফেলল। এরপরে আর কথা চলে না।অটো থেকে নেমে হেঁটে মসজিদ কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়ল ওরা। টিকিট করে চারপাশটা ঘুরে দেখতে শুরু করল।

-আপনি তো মনে হয় এসেছেন আগে?
তন্বী জিজ্ঞেস করল।

-হ্যা, আসা হয় মাঝে মাঝে। বাইক নিয়ে বন্ধুদের সাথে।

-আচ্ছা। আপনার লাইফটা হিংসে হচ্ছে।

আকাশ হেসে বলল, হ্যা যেটুকু শুনছেন, হিংসা হওয়ার মতই। আর টেনশন বা চিন্তার বিষয়টা তো শোনানো যায় না। চাপও থাকে প্রচুর।

-কারো সাথে শেয়ার করতে পারেন। তাহলে আপনার চাপ কমবে।

-শেয়ার করার মত কেউ নেই।

আর কথা হলো না বেশি। আকাশ ঘুরে ঘুরে মসজিদের বিভিন্ন জিনিসগুলো দেখাতে শুরু করল।

-একটা বিষয় খেয়াল করেছেন, ইটগুলো কেমন চারকোণা আর পাতলা? ঠিক এখনকার মতো নয়?

তন্বী খেয়াল করে দেখল, সত্যি।

আকাশ বলল, এই সময়কার কোদলা মঠ বা আরো দুয়েকটা স্থাপনা আছে, সবগুলোর ইট এমন।

-আচ্ছা। এগুলো কি এখান থেকে দূরে?

-অল্প দূরে।

-যাওয়া যাবে?

-আজ নয়। পরে কোনো ছুটিতে আসবেন, আমি নিয়ে যাব।

-আচ্ছা।

ষাট গম্বুজ মসজিদে কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি। তবে স্থাপত্যশিল্প দেখে বোঝা যায় এটা পনের শতকে খানজাহান আলী নির্মান করেন। এটা নির্মান করতে পাথরগুলো আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে। মসজিদের নাম ষাট গম্বুজ হলেও সাত লাইনে এগারটি করে সাতাত্তরটি গম্বুজ রয়েছে, চারকোণে চারটি বড় গম্বুজ সহ মোট গম্বুজ একাশিটি।
অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, গম্বুজগুলো ষাটটি প্রস্তর নির্মিত স্তম্ভে বলে মসজিদের নাম ষাট গম্বুজ হয়েছে।

-এটা মূলত খানজাহান আলীর দরবার হল ছিল।

আকাশ বলল তন্বীকে উদ্দেশ্য করে।
মসজিদ প্রাঙ্গণ বলে তন্বী মাথায় ওড়না দিয়ে নিয়েছে। আকাশের কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে। এর আগে কোনো মেয়েকে নিয়ে এভাবে কোথাও যাওয়া হয়নি। মাথা ওড়না দেওয়ায় আকাশের তন্বীকে কেমন বউ বউ লাগছে। আচ্ছা শাম্মীকে নিয়ে কী….
আকাশের এমন অদ্ভুত লাগছে কেন, এখানে শাম্মীর কথা আসবে কেন! তন্বী কোনোভাবেই আকাশের প্রেমিকা বা বউ নয়। একটু সময় একসাথে ঘুরেছে বলেই এসব মাথায় চলে এলো, অদ্ভুত মানসিকতা। আকাশ নিজের মনকে সামলে নিলো। কোনো সম্পর্ক এত সহজ বিষয় না।

-পূর্বদিকের দেয়ালে এগারোটা দরজা, দেখেছেন?
তন্বীর প্রশ্নে আকাশ ফিরে তাকালো।

-হ্যা দেখলাম। উত্তর দক্ষিনে সাতটা করে।
সামনের মিনারে ঘোরানো সিঁড়ি দুটোর নাম রওশন কোঠা আর আন্ধার কোঠা।আজান দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল।

-আচ্ছা। আলো আর আঁধার, এমন অদ্ভুত নাম কেন জানেন?

-নাহ, সেটা জানি না। চলুন এবার বের হয়ে পড়ি। প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে।

-আরে বাপরে, এত সময় কীভাবে গেল!

-আমিও বুঝলাম না, ঘড়ির কাটা বোধহয় দ্রুত চলছে।

-দিঘিতে যাওয়ার সময় হবে না?

-আজকে সময় তো আপনার হাতে। গেলে একটু দেরী হবে আর কি!

-চলুন যাই, পরে।আর কখনো আসা হবে কিনা ঠিক নেই!

-কেন? আসা হবে না কেন?

-পঁচিশ বছরে এই প্রথম সুযোগ হলো আসার। পরের পঁচিশ বছর কেটে যাবে আবার আসতে। বিয়ে হয়ে গেলে তো কথাই নেই!

-ওহ, বিয়ে করছেন বুঝি?

হেঁটে হেঁটে বের হতে গিয়ে কথা হচ্ছিল দুজনের।

-আসলে আমি বিয়ে করতে চাই না। করতে চাই না মানে এখনি না। মেন্টাল প্রিপারেশনের দরকার আছে। আমি এখনি প্রস্তুত নই। বিয়ে দায়িত্ব এগুলো নেওয়ার মত তৈরি হইনি এখনো। হাস্যকর শোনালেও সত্যি। কিন্তু মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর পর সবাই আমার বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমি হা ও করতে পারছি না, না ও করতে পারছি না। যেহেতু ফুললি বাসার উপর ডিপেন্ড করে আছি। ভাইয়া ভাবী, আব্বা আম্মা সবাই চান বিয়ে করে নিই।

-ওহ আচ্ছা।

-আসলে আপনাদের এলাকার ধারণা হচ্ছে মেয়েদের যত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া যায়, বিন্নির জন্য ছেলে দেখছে খালুজান, জানেন। বিন্নি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে মাত্র। ছেলে প্রতিষ্ঠিত হলে ওর থেকে বারো চৌদ্দ বছরের বড় হবে। ও মানিয়ে নিতে পারবে কিনা কে জানে!

আকাশ ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি বোধ করল। শাম্মিও সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। আসলেই বেশি ছোট ওর থেকে।

-পারবে না কেন, সবাই পারে।

-তাও ঠিক, আমি পারব না। হাজবেন্ড বন্ধুর মত না হলে গল্প করে আরাম পাওয়া যাবে বলুন!

বউয়ের সাথে গল্প করে আরাম পেতে হবে, এমন চিন্তাই আকাশের হয়নি। বিয়ের কথা মনে হলে শারিরীক একটা চিন্তা মাথায় আসে আর আসে রান্না বান্না ঘর সংসারের চিন্তা।

কথা বাড়লো না আর। মাজারের সামনেই দিঘি। বেশ ভীড় হয়ে গেছে। ঘাটটা চওড়া এবং অসংখ্য মানুষ গোসল করছে। বাচ্চাদের গোসল করানো হচ্ছে। চারপাশে মেলার মত দোকানপাট ভরা।

-কথিত আছে, এখানে গোসল করলে, ছেলে মেয়েদের মাথা খোলে, মানে পড়াশোনায় ভালো হয়।

-ওহ৷ তাই নাকি! জানতাম না। চলুন চলে যাই।
আগরবাতির একটা কড়া গন্ধ নাকে লাগছে। কেমন একটা মাদকতা আছে। আর সবাই কেমন খালি গায়ে গোসল করছে, বিষয়টা অস্বস্তির।

আকাশ বের হয়ে গেল তন্বীকে নিয়ে। বাগেরহাট পৌঁছাতে আরো মিনিট পনের লাগল।

জসিম চলে এসেছে৷ তন্বীকে একটা চেয়ার দিয়ে আকাশ বলল, এখনে বসুন। এরপর জসীমের সাথে গাড়িটা নিয়ে কথা বলে চেক করিয়ে নিতে লাগল। পেছনের টায়ারটা বদলে নিতে হবে।

তন্বী বসে অপেক্ষা করতে লাগল। এখানে সবাই অপরিচিত। একমাত্র আকাশ ছাড়া। আকাশও কয়েকঘন্টার পরিচিত মাত্র। কিন্তু ওকে ভীষণ আপন লাগছে। যেন কত দিনের চেনা। ফুল হাতা শার্ট গুটিয়ে নিয়েছে কনুই অবধি। আগে কখনো কোনো ছেলেকে এভাবে কাছ থেকে দেখা হয়নি তন্বীর। আকাশের সব কিছুই ভালো লাগছে দেখতে। এমন কেন হচ্ছে তন্বী বুঝতে পারছে না। বার বার আঁড়চোখে ব আকাশকে দেখছে। খানিক বাদে মনে হলো, আঁড়চোখে দেখার দরকার কি, সরাসরি তাকালেই কে বকা দিচ্ছে। তন্বী এবার সরাসরি তাকিয়ে দেখতে লাগল। একটা মানুষকে দেখতে ভালো লাগতে পারে, বিষয়টা একেবারেই নতুন অনুভূতি। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। আকাশ এক ফাঁকে একটু পাশ ফিরেছিল,একটু অবাক হয়ে দেখল তন্বী ওকে দেখছে!

চলবে

শানজানা আলম
হাইওয়ে-৭

চলুন, বেরিয়ে পড়ি- তন্বীকে বলল আকাশ।
তন্বী উঠে দাঁড়াল। আকাশ গাড়ির কাছে গিয়ে একবার তন্বীর দিকে তাকল। মেয়েটা তাকে দেখছিল। কয়েক ঘণ্টায় বেশ কিছুটা পরিচিত হয়েছে৷ কিন্তু আবার এতটাও নয়। কী যেন মনের ভেতর চলছে এর! আকাশ বুঝতে পারছে না।
স্পিড একটু বাড়িয়ে আকাশ বাগেরহাট শহর ছাড়ল। প্রায় পোণে একটা বাজে। অনেক দেরী হয়ে গেল।

-কতক্ষণ লাগবে পৌছাঁতে?
-তিন ঘণ্টা!
-আচ্ছা। দুয়েকটা বাস তো চলছে দেখলাম!
-অনেক জায়গায় ধর্মঘট তুলে নিয়েছে।
-ওহ, দুদিন আগে তুললে আপনাকে আর এই ঝামেলায় পড়তে হতো না৷
-হুম, সেটা ঠিক। ধর্মঘট না তুলেই বা কী করবে, আসল লাথি লাগে এই কর্মচারীদের পেটে। বাস না চললে এদের বেতনও হয় না।
মালিক সমিতির তো আর কিছু না, অন্তত টাকার লোকসান ছাড়া কোনো সমস্যা হয় না।

-হুম। আচ্ছা আমরা দুপুরে কই খাব?

-ঘাটে গিয়ে খাই? ফেরীতে উঠতে পারলে ফেরীতে নয়তো আসেপাশের কোনো রেস্টুরেন্টে!

-দেরী হয়ে যাবে না?

-খিদে পেয়েছে আপনার?

-হুম, হালকা।

-আপনার সাথে তো খাবার আছে, সেটা খেয়ে নিন।

-নাহ, খিদে নষ্ট হবে। ভাত খাব।

-আচ্ছা।

-পথে কোনো রেস্টুরেন্ট পাওয়া যাবে না?

-হ্যা, হাইওয়ে রেস্তোরাঁ তো আছে, খাবার এভারেজ মানের। এই রুটে আসলে সবাই কাওড়াকান্দি ঘাটে গিয়েই খায়।
-ওহ, আচ্ছা। আমি সেসব রেস্টুরেন্টের কথা বলিনি, থাকেনা রাস্তার পাশে, ঝুপড়ি টাইপ!

-থাকে, রোমান্টিক গল্প উপন্যাসে আর নাটক সিনেমায়। বাস্তবে আমি দেখিনি।

-অহ, ইনসাল্ট করলেন!!

– নাহ, ইনসাল্ট করব কেন! এমনি বললাম আর কি! বাস্তবে ফিরুন। আমাদের ঘাটে পৌঁছাতে হবে। অলরেডি লেট করে ফেলেছি। বেশ অনেকটা পথ বাকি। আমার গাড়ির কন্ডিশন তো জানেন, একটু চাপে আছি। আল্লাহর নামে ঠিক মতো পৌঁছাতে পারলেই আলহামদুলিল্লাহ।

-পারবেন ইনশাআল্লাহ। আমার না চাপ লাগছে না । ওই যে বললাম, সব আপনার উপর চাপিয়ে বসে আছি।

আকাশ না তাকিয়ে হাসল। তন্বী আকাশকে মিররে দেখল। বাহ, সুন্দর হাসতেও পারে দেখছি! তন্বী, পুরোপুরি ক্রাশড হয়ে যাচ্ছ দেখি! ইগনোর করে ফেলো! নয়তো ডুবে যাবে!

তন্বী ফোন বের করে ফোনে মনোযোগ দিলো কিছুক্ষণ। কিন্তু আজ ভালো লাগছে না। আকাশের সাথে কথা বলতেই ভালো লাগছে।
এই ব্যাটা তো বুঝতেই পারছে না। কেমন রুক্ষ কথা বলছে! আরে একটা মোটামুটি সুন্দরী মেয়ে সহযাত্রী পেয়েছিস, একটু মন দিয়ে গল্প টল্প কর! তা নয়, কেমন যে রসকষহীন!
প্রেম ট্রেম করে না মে বি!

-আপনি বিয়ে করবেন না?

ফোনে চোখ রেখে আকাশের দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল তন্বী। তখনি একটা আওয়াজ হয়ে স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল।

-শিট!

আশেপাশে তাকিয়ে দেখল আকাশ।
সামনে পেছনে যতদূর চোখ যায় হাইওয়ে। সে গাড়িটা সাইড করালো।

-কি হলো? কোনো সমস্যা?

আকাশ একটু বিরক্তি নিয়ে তাকাল। পরক্ষণেই মনে হলো৷ ওর দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকানোর কিছু নেই। কুলিং ফ্যানের বেল্ট ছিড়েছে, গ্যারেজে নিতে হবে। ফোন বের করে ম্যাপে দেখল আকাশ। একটা গ্যারেজ আছে, কিলোমিটার দুই দূরে।

-হ্যা, সমস্যা তো বটেই। আপনার ভয় লাগছে না?

-নাহ, তেমন একটা না।

দুজনই গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে। বেশ রোদ আছে। একটু ছায়া দেখে তন্বী বসে পড়ল। আকাশ একটু অবাক হয়ে দেখল, মেয়েটার মধ্যে কোনো চিন্তার ছাপ নেই।
সে এক নাগারে ফোনে চেষ্টা করতে লাগল, গ্যারেজে যদি যোগাযোগ করতে পারে৷ জসীমকে ফোন করল, এখানকার গ্যারেজ চিনে কিনা, বা কোনো ফোন নম্বর যদি দিতে পারে।

চলবে

শানজানা আলম

হাইওয়ে-৮

তন্বী নিশ্চিন্তে বসে আছে দেখে আকাশের রাগ হচ্ছে। রাস্তায় ট্রাক চলছে কিন্তু বাস একেবারেই নেই। বাগেরহাট গ্যারেজের জসীমকে পাওয়া গেল অবশেষে। এখানকার গ্যারেজ পরিচিত না জসীমের৷ তবে সে বলল, খুলনা মোটরস থেকে এই লাইনের সবাই মাল আনে। সেখানে যোগাযোগ করে ফোন নম্বর জোগাড় করে দেবে।
অবশেষে আকাশের একটু হালকা লাগছে, মেয়েটা এত অদ্ভুত কেন! কোনো চিন্তা নেই।

তন্বী রাস্তার দিকে পেছন দিয়ে বসে আছে।

-আকাশ, আপনি কী রেগে আছেন?

না তাকিয়ে বলল তন্বী।

-না, কেন মনে হলো আমি রেগে আছি?

-আপনি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছেন। তাই।

-আমি একটু টেনশন বোধ করছি। টেনশনে থাকাই তো স্বাভাবিক।

-হুম, এর মধ্যে আমি হইচই করলে ভালো লাগত আপনার?

মোক্ষম যুক্তি। আকাশ ভেবে দেখল, আসলেই ঘটনা সত্য, এর মধ্যে তন্বী প্যানিক করলে আকাশ আরো দিশেহারা হয়ে যেত।

-বসুন এখানে। একটা ধুমায়িত শলাকা ধরান, চেইন স্মোকারদের টেনশনে ধোঁয়া ভালো কাজ দেয়! টেনশন রিলিফ হয়!
জসীম সাহেব কিছু একটা জানাক, তারপরে না হয় দেখা যাবে। না না জানালে আমি একটা অটো ধরে গ্যারেজে চলে যাব, মেকানিক নিয়ে আসব।

আকাশ একটু ইতস্তত করে বসে পড়ল। তারপর সত্যিই সিগারেট ধরালো।

-প্রথম দেখলাম কোনো মেয়ে সিগারেট খেতে বলছে!!

-আগে কয়টা মেয়ে দেখেছেন?

আকাশ ভেবে বলল, এত কাছ থেকে কাউকে দেখিনি। তবে সিগারেট পছন্দ করা মেয়ে খুব
কম।

-আমি পছন্দ করি বলিনি, আমার সমস্যা হয় না। আর আপনি ভোরবেলায় ফেরীতেই সিগারেট ধরালেন বলে ভেবে নিয়েছি আপনি রেগুলার স্মোক করেন। তাই বলেছি।

আকাশের একটু নিশ্চিন্ত লাগছে৷ তন্বী একেবারে অযৌক্তিক কথা বলেনি।

-তন্বী আপনি কিছু খেয়ে নিন! খিদে পেয়েছে বলেছিলেন।

-ড্রিংকস দিতে পারেন। আর কিছু না।

-পানি খান, কোক গরম হয়ে গেছে।

একটা ছেলে কাঠের বাক্সে আইসক্রিম নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তন্বী ডাকল, এই যে, এদিকে এসো।

ছেলেটি এসে দাঁড়াল।

-কী আছে এতে?

-আইসক্রিম।

-কই দেখি?

ছেলেটি বাক্স থেকে আইসক্রিম বের করে দিলো।

-তন্বী, এটা খাবেন না। এখনো বেশ কিছুটা পথ বাকি। পানি ভালো হয় না এগুলোর। টাইফয়েড হবে।

-আপনি মুরব্বিদের মত কথা বলছেন।

এই ছেলে, এই জায়গার নাম কি?

-চন্দ্র দিঘলিয়া।

-স্ট্যান্ড কতদূর?

-দুই কিলো হবে।

তন্বী আকাশের কথা শুনলো না, একটা কিনলো, এক কামড় দিয়ে ফেলে দিলো।

আকাশ অন্যদিকে তাকিয়ে হাসল। এই সময়ে জসীম ফোন করল। মেকানিকের সাথে কথা হয়েছে, আকাশের ফোন নম্বর দিয়েছে। আধঘন্টার মধ্যে আসবে।মেকানিকের নাম কয়েস। জসীম কয়েসের ফোন নম্বর দিয়ে দিলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here