হলুদ_বসন্ত,পর্ব_১১,১২

হলুদ_বসন্ত,পর্ব_১১,১২
Eshika_Khanom
পর্ব_১১

আদ্রাফ টানা কিছুক্ষণ সেই কবরের দিকেই চেয়ে রইল। আর আয়াত একবার কবরটা দেখে তো একবার আদ্রাফকে। কিছুক্ষণ পর আদ্রাফ আয়াতকে প্রশ্ন করল,
“জানো আয়াত এটা কার কবর?”

আয়াত না-বোধক উত্তর প্রকাশ করল। আদ্রাফ বলল,
“এটা আমার আরেক বন্ধুর কবর যাকেও আমি হারিয়ে ফেলেছি।”

আয়াত কিছু বলল না আর। আদ্রাফের চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অন্তরটা তার জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। তবে আয়াতের কাছে আদ্রাফকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্যে কোনো ভাষা নেই। সে তো আদ্রাফের সম্পর্কে ভালোমতো জানেই না। আদ্রাফ নিজে থেকেই বলতে থাকলো,
“নুহাশ তো পড়তে বিদেশে চলে যায়, দেশে থেকে যাই আমি আর জীম। জীমের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না দেখে আমি আর নুহাশ ওকে নানাভাবে সাহায্যে করতাম। ওর স্বপ্ন ছিল সবকিছুতে প্রথম থাকার। কিন্তু ভার্সিটির টপে সবসময়কার স্থানটা ছিল আমার, আর তার পরের স্থান ছিল ফরহাদের। খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল আমাদের মধ্যে। কিন্তু কখনোই বুঝতে পারিনি ও আমার বন্ধু নয়, এক বিষধর সাপ ছিল। জীমের টপার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি বলে ও আমার উপর প্রতিশোধ নেয় আয়াত।”

আয়াত আদ্রাফের দিকে তাকিয়ে বলে, “কি করেছিলেন তিনি?”

আদ্রাফ বলে, “আমার জীবনে অন্ধকার নামিয়ে আনে সেই প্রতিশোধ। একদিন আমায় ডেকে পাঠায় ফরহাদ নিজের বাড়িতে। আমিও ওর ডাকে ওর বাড়িতে যাই। প্রচুর মারামারি হয় আমাদের সেদিন। কিন্তু ওর প্রতিশোধের শক্তি এতোই বেশি ছিল যে আমি পরাজিত হয় মারামারিতে। একসময় নিজের সব শক্তি হারিয়ে পড়ে থাকি মেঝেতে। আর জীম আমার শরীরে একটা ইঞ্জেকশন পুশ করে সেই সময়। জানো সেটা কিসের?”

আয়াত প্রশ্ন করল, “কিসের?”

আদ্রাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ওইটায় ছিল এইচআইভি ভাইরাস। ”

তারপর চিৎকার করে বলতে থাকে আদ্রাফ,
“আমার জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছে এই শয়তান। বন্ধু নামের কলঙ্ক ছিল ও। আজ আমি এইডস আক্রান্ত ওর জন্যে, প্রিয়জনদের হারাবো আমি ওর জন্যে। আমার জীবনটাকে অভিশাপে পরিণত করেছে জীম।”

অশ্রু ঝরছে আদ্রাফের চোখজোড়া থেকে। আয়াত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সেই কবরের দিকে।মানুষ এতোটাই খারাপ হতে পারে? নিজের সৎমায়ের প্রতিও মনে কখনো এতো ঘৃণা জন্ম নেয়নি যতোটা ঘৃণা হচ্ছে এই মৃত মানুষটার প্রতি। ক্রোধ কতই না ভয়ানক হতে পারে যে বন্ধুও শত্রুতে পরিণত হয়। শীতল হাওয়া বইছে চারিদিকে, নিস্তব্ধ পরিবেশে দুইটা প্রাণ এখনোও দাঁড়িয়ে আছে সেই বিশ্বাসঘাতকের কবরের সামনে।
.
.
.
পুরো গাড়িতে আদ্রাফ এবং আয়াতের মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। আয়াতের বিশ্বাস ছিল আদ্রাফ কোনো অনৈতিক কাজে জড়িত ছিল না। তবে আদ্রাফের বর্তমানের অবস্থার জন্যে দায়ী এই মারাত্মক ঘটনা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে সে আগেই। আদ্রাফ প্রতিদিন মরছে আগাম মৃত্যুর হাঁকে। হয়তো ওর কষ্ট কেউই বুঝতে পারবে না। আসলে এটা অসম্ভব। ব্যস্ত রাস্তায় নিশ্চুপ দুই মানব পাশাপাশি বসে রয়েছে ও ফিরছে নিজেদের বাসস্থলে। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তি মানেই সে অনৈতিক কাজে জড়িত সেটা কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে প্রতিশোধ এতোই ভয়ানক রুপ নেয় যে এটি মানুষের জীবন বিপন্ন করে তোলে।

খেয়েদেয়ে যার যার ঘরে চলে গিয়েছে সবাই। অনেকে ইতিমধ্যে ঘুমিয়েও পড়েছে। তবুও একই বাড়িতে চোখে ঘুম নেই ছয় জোড়া নয়নের। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মৃতু্র প্রহর গুনছে আদ্রাফ। জানেনা সে আর কতদিন বাঁচবে। এইডস রোগ হয়েছে এক বছর ছাড়িয়ে গেল। মেডিসিন নিতে নিতে জিহবা বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় তার খুব জলদিই মরে যেতে। আবার নিজের ভালোবাসা এবং প্রিয়জনদের টানে থমকে যায় সে। আয়াতকে ছাড়া সে বাঁচতেই পারবেনা এই কথাটা চিন্তা করলেই নিজেকে বিদ্রুপ করতে থাকে আদ্রাফ। ও তো মরেই যাবে আবার আয়াতকে ছাড়া বাঁচবে না মানে কি? হাস্যকর লাগে নিজেকে। কেন সে টপার হয়েছিল? এতো ভালো রেজাল্ট তাকে কি এনে দিয়েছে? মৃত্যু! মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। প্রতিহিংসা জিনিস এমনই।

আয়াত চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছেনা। চোখ বন্ধ করলেই সেই কবরটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আচ্ছা জীম কি করে মারা গেল? জানা হয়নি তার। এতোকিছু যেহেতু আদ্রাফ নিজে থেকেই তাকে বলেছে তাহলে হয়তো জীমের মৃত্যু কিভাবে হলো তাও বলবে। যথা চিন্তা তথা কাজ। উঠে গেল আয়াত শোয়া থেকে। ফোনটা হাত নিয়ে আদ্রাফকে কল দিল। রিসিভ করল আদ্রাফ। অপর পাশ থেকে ভেসে এলো এক উদগ্রীব কণ্ঠস্বর। আদ্রাফ বলল,
“কোনো সমস্যা হয়েছে কি আয়াত? আমায় কল দিয়েছ যে?”

আয়াত বিনিময়ে বলল, “আপনি কষ্ট করে কি একটু বাগানে আসবেন?”

আদ্রাফ প্রশ্ন করল, “কেন?”

আয়াত বলল, “প্লিজ আসুন।”

কল কেটে দিল আয়াত। আদ্রাফ কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করল আয়াতের এভাবে ডাকার কারণ। খুজে পেল না উত্তর। চলে গেল সে বাগানে।

আদ্রাফ বাগানে গিয়ে দেখলো সেখানে দোলনায় বসে রয়েছে আয়াত। চোখে মুখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে অপেক্ষা করছে কারো জন্যে। আদ্রাফকে দেখে সে এক মুঠো হাসি তাকে উপহার দিল। ইশারা করে আদ্রাফকে তার পাশে বসতে বল। চুপটি করে আদ্রাফ তার পাশে বসলো। আয়াত নিজের হাত বাড়িয়ে দিল আদ্রাফের দিকে। আদ্রাফ এক হাত রাখলো আয়াতের হাতের উপর। আয়াত প্রশ্ন করল,
“আমি একটা প্রশ্ন করলে কি আপনি তার সঠিক উত্তর দিবেন?”

আদ্রাফ জিজ্ঞেস করল, “কি প্রশ্ন?”

আয়াত আদুরে স্বরে বলল, “আগে বলুন উত্তর দিবেন।”

আদ্রাফ হালকা হেসে বলল, “চেষ্টা করব।”

আয়াত নিজের হাসির পরিধি আরেকটু বাড়িয়ে বলল, “তাহলেই চলবে।”

“আচ্ছা।”

“জীম কিভাবে মারা গিয়েছেন?”

আদ্রাফের কপাল সংকুচিত হল। জিজ্ঞেস করল,
“তুমি জেনে কি করবে?”

আয়াতের দায়সারা উত্তর, “আমি জানতে চাই।”

আদ্রাফ প্রশ্ন করল, “কেন?”

আয়াত বলল, “আমার অধিকার আছে।”

আদ্রাফ বলল, “তুমি সবসময়ই এটা বলো।”

আয়াত চোখ রাঙিয়ে বলল, “আমি জানতে চেয়েছি।”

আদ্রাফ মৃদু হাসলো আয়াতের কান্ডে। তারপর বলল,
“তবে শুনো, আমার দেহে জীম এইচআইভি ভাইরাসে ঢুকানোর পর কতক্ষণ আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকি ওর বাড়িতে। আমায় একা ফেলে রেখে জীম বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। হয়তো জেদের বসে কাজটা করে ভয় পেয়েছিল। পালিয়ে যায় সে নিজের বাড়ি থেকে। রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল তখন সে কার এক্সিডেন্ট করে। জীমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং আমি যতটুকু জানি সে কয়েকদিন লাইফ সাপোর্টে ছিল। অবস্থার অবনতি হতে থাকে জীমের। এবং শেষে ও মারা যায়।”

“ওহ”

“আচ্ছা তুমি ঘুমোতে যাও, অনেক রাত হয়েছে। কাল আমার কাজ আছে আমি ঘুমোতে গেলাম। শুভ রাত্রি।”

আয়াতের তরফ থেকে কোনো উত্তর না নিয়েই আদ্রাফ চলে গেল বাড়ির ভিতরে। আয়াত দোলনায় একা একা বসে রইল। জীমের জন্যে তার মোটেও আফসোস হচ্ছে না। নিজের পাপের শাস্তি পেয়েছে সে। এবং আরও পাবে। কারণ সে দুর্বিষহ করে তুলেছে আদ্রাফের জীবন। অভিশাপে পরিণত করেছে তার জীবনকে। যে অভিশাপ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ মৃত্যু।

#চলবে

#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_১২
#Eshika_Khanom

“সাজেক উপত্যকা বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার অন্তর্গত সাজেক ইউনিয়নের একটি বিখ্যাত পর্যটন স্থল। রাঙামাটির একেবারে উত্তরে অবস্থিত এই সাজেক ভ্যালিতে রয়েছে দুটি পাড়া- রুইলুই এবং কংলাক। ১৮৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত রুইলুই পাড়া ১,৭২০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। আর কংলাক পাড়া ১,৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। সাজেক ভ্যালি “রাঙামাটির ছাদ” নামেও পরিচিত।”

এতোক্ষণ ধরে সাজেক ভ্যালি সম্পর্কে একটা বই থেকে জোরে জোরে রিডিং পড়ছিল আয়াত। আদ্রাফ বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পড়াটুকু শেষ হতেই আয়াত আদ্রাফের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটি হাসি দেয়। আদ্রাফ আয়াতকে ভেঙ্গিয়ো বিপরীতে আরেকটা হাসি উপহার দেয়। বিচ্ছিরি এমন মুখের ভঙ্গিমা দেখে আয়াত মুখ কুচকে আদ্রাফকে বলে,
“এতো সুন্দর করে একটা হাসি দিলাম আর আপনি এটা কি করলেন?”

আদ্রাফ নিজের গায়ে থাকা টিশার্টটি টানটান করে নিয়ে বলল,
“আমিও তোমার হাসির বিনিময়ে একটা হাসি দিলাম।”

মুখ ফুলিয়ে মাথা আদ্রাফের মুখের বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে নিল সে। আদ্রাফও কিছু বলল না, আপনমনে ফোন চালাতে লাগলো। কোনো জায়গায় ভ্রমণকালে আদ্রাফের গান শুনতে খুব ভালো লাগে। তাই তার ভালোলাগার কাজটিই যাত্রাপথে করতে লাগলো সে। অপরদিকে আয়াত খুব বোরিং ফিল করছিল। কতক্ষণ বিরক্তি নিয়ে সে আদ্রাফের দিকে তাকাচ্ছে তো কতক্ষণ জানালের পাশে মাথা হেলিয়ে বাহিরের দৃশ্য উপভোগ করছে। কিছু সময় পার হতেই আয়াত ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ঘোরে বারবার আয়াতের মাথা নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছিল। আদ্রাফ হালকা হেসে আয়াতের মাথা আয়ত্ত করে নিজের কাধে সন্তোপর্ণে এলিয়ে নেয়। এভাবেই গাড়িতে করে তারা চলতে থাকলো নিজের গন্তব্যে।

সাজেক যাত্রা পথের আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিঁচু পাহাড়ি রাস্তার সাথে চারিদিকে সীমাহীন সবুজের সমারোহ মাখা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ইতিমধ্যে মন কেড়ে নেয় সদা সর্বদা। রিসোর্টের প্রায় কাছাকাছি চলে আসায় আদ্রাফ আয়াতকে আস্তে করে ডাক দিতেই আয়াত জেগে যায়। আর চারপাশের দৃশ্যে চোখ বুলিয়ে ভাললাগার কিছু অনুভূতির জাগরণ করতে লাগে। তবে এসবের থেকেও আদ্রাফের কাছে আয়াতের হাস্যজ্বল মুখটাই সর্ব সুন্দর মনে হচ্ছে। তাইতো আদ্রাফ বাহিরের সৌন্দর্যে সময় নষ্ট না করে প্রিয়তমার হাসিতেই চোখ দুটো আবদ্ধ করতে ব্যস্ত।

আদ্রাফ এবং আয়াত পৌছে গেল সাজেকের রুন্ময় রিসোর্টে। আদ্রাফ রিসোর্টের ম্যানেজারের সাথে কুশলাদি বিনিময় করল। রিসোর্ট আগে থেকেই বুক করে নিয়েছে আদ্রাফ, তাই তাদের বেশি সমস্যা হলো না। আদ্রাফ দুইটি রুম নিয়েছে তাদের জন্যে। রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে একটি চাবি আয়াতের হাতে ধরিয়ে দিল। আয়াত প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিবদ্ধ করল আদ্রাফের উপর। আদ্রাফ আয়াতের মনের কথা বুঝতে পেরে বলল,
“তুমি আর আমি আলাদা রুমেই থাকব, যেভাবে বাড়িতে থাকতাম আমরা।”

আয়াত আদ্রাফের কথা শুনে হতাশ হয়ে তাকালো হাতে গচ্ছিত চাবির উপর। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“বিয়ে করেছি, হানিমুনে এসেছি, তাও আমরা স্বামী স্ত্রী আলাদা থাকবো। বাহ কি সুন্দর জীবন! আয়াত এতো সুন্দরভাবে জীবন পার করার জন্যে তুই এখনো নোবেল পাসনি? ছি! ছি! ছি!”

আদ্রাফ ভ্রু কুচকে আয়াতের দিকে নিজের মুখ কিছুটা এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল,
“কি বিড়বিড় করছেন মিসেস আদ্রাফ?”

আয়াত ভ্যাবলার মতো হেসে বলল, “নাহ কিছু না তো, কিছু না।”

আদ্রাফ হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,
“তবে কি নিজের রুমে যাওয়া হবে? আয়াত খুব ক্লান্ত লাগছে।”

আয়াত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। দুইজনেই নিজেদের রুমে গিয়ে একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে আরামের এক ঘুম দিল।

সাজেক ভ্যালিতে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেই। তবে রিসোর্টগুলোতে সোলার প্যানেল রয়েছে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত জেনারেটর চালু থাকে। সেক্ষেত্রে রাতে দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করা বিপদজনক। যেহেতু পাহাড়ি এলাকা। বিদুৎ না থাকায় চারিদিকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন। আয়াত একা একা রুমে গুটিয়ে বসে আছে। ভেবেছিল সাজেকে আসার পর কতই না মজা করবে! কিন্তু তার মজার মাথায় ঠাডা পড়েছে। আদ্রাফ এতোই ক্লান্ত যে আজ তাকে ঘুরতেই নিল না। সে এখন নিজের ফোনে বসে বসে ক্যান্ডি ক্রাশ গেমস খেলছে। ১০৭ লেভেল খেলার পর সে আর আগাতেই পারেনি তাই বিরক্তিতে খেলা ছেড়ে দিয়েছিল। আজ আবার সেই খেলাতেই নিমগ্ন সে। শীতের পরিবেশে সাজেক ভ্যালির রুপ থাকে অনন্য। জায়গাটি একেক ঋতুতে একেক রুপ ধারণ করে। কুয়াশা জমে রয়েছে। ঠাণ্ডায় মাঝে মাঝে শিউরে উঠছে সে। কিছু সময়ের পর দরজায় থেকে খটখট আওয়াজ শোনা গেল। ভয় পেয়ে গেল আয়াত, বিছানার এক প্রান্তে আরও গুটিয়ে নিল নিজেকে। দরজার অপর পাশ থেকে শোনা গেল এক অতি পরিচিত মোহনীয় কন্ঠস্বর। মৃদু কণ্ঠে সে ডাকছে,
“আয়াত, এই আয়াত, দরজা খোলো। তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?”

শান্তির এক নিঃশাস ফেলল আয়াত। চট করে উঠে গিয়ে চলে গেল দরজা খুলতে। যখনই দরজা খুলতে যাবে তখনই মাথায় এক অন্য ভয় চেপে বসলো। কাপা কাপা কণ্ঠস্বরে সে প্রশ্ন করল,
“কে?”

অপর পাশ থেকে ভেসে আসলো,
“আমি আদ্রাফ।”

ঠোঁটজোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিল আয়াত। পুনরায় প্রশ্ন করল, “কে?”

ওপাশে থাকা ব্যক্তি ভ্রু কুচকালো। বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আমি আদ্রাফ, তুমি দরজা খোলো।”

আয়াত পুনরায় প্রশ্ন করল, “কে?”

এবার আদ্রাফ বলল, “আয়াত তুমি দরজা খুলবে? ”

আয়াত অন্য পাশে থেকে বলল, “আগে বলুন কে?”

আদ্রাফ বলল, “আরে আমি আদ্রাফ, আমি আদ্রাফ।”

ওষ্ঠাধর প্রশস্ত করে একটা হাসি দিল আয়াত। ঝট করে খুলে দিল দরজা। দেখতে পেল, আদ্রাফ রাগী চোখে তাকিয়ে রয়েছে। আয়াত হাসিটা আরও বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আসুন, ভিতরে আসুন।”

আদ্রাফ ঘরটির ভিতরে ঢুকে বলল, “এতো সময় কেন লাগলো? এতোবার জিজ্ঞেস করলে কেন আমি উত্তর দেওয়ার পরও?”

আয়াত অসহায়ত্ব নিয়ে বলল, “যদি আপনার জায়গায় কোনো জ্বীন-ভূত আসতো?”

আদ্রাফ অবাক স্বরে বলল, “কি?”

আয়াত ভাব নিয়ে বুকে দুই হাত গুজে বলল, “আমি শুধু সতর্ক ছিলাম। নিশ্চয়তার জন্যে এমন করেছি।”

“এই তোমার, তোমার এই সতর্কতা কিভাবে মাথায় এলো?”

“ওমা ছোটবেলা শুনেননি?”

“কি শুনব?”

“রাতে গুমোট পরিবেশে মাঝে মাঝে জ্বীন-ভূতও দরজায় কড়া নাড়ে। এরপর আপনি দরজা খুললে আপনার ঘাড় মটকে দিবে।”

আদ্রাফ মাথায় হাত রাখলো। হতাশ হয়ে প্রশ্ন করল,
“এটা কোথা থেকে শুনেছ?”

“আমার ফ্রেন্ডের মুখে শুনেছি। ওকে নাকি ওর দাদী বলেছে।”

আদ্রাফ কোমড়ে দুই পাশে দুই হাত দিয়ে বলল,
“আর কি শুনেছ? আমিও একটু শুনি।”

আয়াত বলল, “রাতে জ্বীন-ভূত এসে দরজায় কড়া নাড়তে পারে। তাই আমাদের উচিত কে এসেছে তা তিনবার জিজ্ঞেস করে দরজা খোলা। যদি মানুষ হয় তবে তো সে উত্তর দিবে। আর জ্বীন-ভূত হলে একবারও উত্তর দিবেনা। বরং আপনার তৃতীয়বার প্রশ্নের সময় বিরক্ত হয়ে চলে যাবে।”

আদ্রাফ হেসে দিল আয়াতের কথা শুনে। তারপর হাসতে হাসতেই বলল,
“আর সেই ভূত যদি ধৈর্যশীল হয়?”

আয়াত আদ্রাফের কথা না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল, “মানে?

আদ্রাফ আয়াতের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” জ্বীন-ভূত যদি মিথ্যে উত্তর দেয় তিনবারই সবর সহকারে? যদি বিরক্ত না হয়ে চলে না যায়, এখানেই থাকে ঠায় দাঁড়িয়ে। তখন কি করবে?”

আদ্রাফ কথা শুনে আয়াত মহা চিন্তায় পড়ে গেল। এটা তো সে ভেবে দেখেনি। আদ্রাফের হাসির মাত্রা আরও বেড়ে গেল। আয়াতকে আর কোনো চিন্তা করার সুযোগ না দিয়ে তার হাত ধরে নিয়ে চলে গেল রিসোর্টের বাহিরে।

“জায়গাটা বেশ সুন্দর, ধন্যবাদ আমায় এখানে নিয়ে আসার জন্যে।” আদ্রাফের কাধে মাথা রেখে বলল আয়াত। আদ্রাফ বলল, “হুম। জায়গাটা বেশ সুন্দর, যথেষ্ট রোমাঞ্চকর। রাতের পরিবেশটা অনন্য এক রুপ নিয়েছে।” আয়াত নিশ্চুপ থেকে রইল। সময়টা বেশ উপভোগ করছে সে। আদ্রাফের কাধে মাথা রেখেই যদি সে এভাবেই সারাজীবন সময় পার করে নিতে পারতো তবে সে হতো সবচেয়ে সুখী।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here