হলুদ_বসন্ত,পর্ব_০৯,১০

হলুদ_বসন্ত,পর্ব_০৯,১০
Eshika_Khanom
পর্ব_০৯

রাতের খাবার বানানোর জন্যে পূর্ণ উদ্যমে রান্নাঘরে কাজ করছে আয়াত। পাক্কা গৃহিণীর মতো কাজ করছে। নিজের সম্পূর্ণ মনযোগ রান্নার মধ্যেই দিয়েছে সে। হঠাৎ করে রান্নাঘরে প্রবেশ করলো নুহাশ। ধীর পায়ে আয়াতের দিকে এগিয়ে নিল সে। তাদের মধ্যে আর কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব হবে। নুহাশ আয়াতকে তখনই বলল,
“আয়াত?”

কাজের বিঘ্ন ঘটে আয়াতের এক পুরুষালী কণ্ঠে। বুঝতে পারে কারো উত্তপ্ত কণ্ঠের আহবান। মস্তিষ্ক বলতে থাকে তাকে পিছনে ঘুরতে। মস্তিষ্কের ডাকে সাড়া দেয় আয়াত, সাথে সাথে সাড়া দেয় সেই ব্যক্তিরও। তবে সাড়া দেওয়ার আগে নিজের শরীরকে ভালোভাবে ওড়না দিয়ে আবৃত করে নেয়। আয়াতের কাণ্ড দেখে কিছুটা লজ্জিত হয় নুহাশ। নিজেকে জানাতে থাকে, নুহাশ তুই একবার নক করেও ঢুকতে পারতি। কিভাবে এ ভুল করলি? নুহাশের ধ্যানে বাগড়া দেয় আয়াত। জিজ্ঞেস করে,
“কিছু কি বলবেন নুহাশ ভাইয়া?”

ঝটপট তাকায় নুহাশ আয়াতের দিকে। দৃষ্ট মিলে যায় দুইজনের। নুহাশ চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর ধীরপায়ে একটা গ্লাস হাতে করে নিয়ে বলে,
“নাহ কিছু না।”

বলতে দেরি কিন্তু রান্নাঘর হতে বের হতে দেরি হলো না নুহাশের। আয়াত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল নুহাশের প্রস্থানের পথে। হঠাৎ করে তেল ছিটে হাতে এসে লাগায় “আউ” করে একটা ছোট শব্দ মুখ থেকে বের করল। পূর্ণ ধ্যান দিল আবার রান্নার কাজে।

অপরদিকে রান্নাঘর থেকে নুহাশকে বেরিয়ে যেতে দেখে আদ্রাফ বেশ অবাক হলো। কারণ নুহাশ তো সহজে রান্নাঘরের সামনেই আসতে চায় না। পানি লাগলেও না। আর ও রান্নাঘর থেকে বেরোচ্ছে? সত্যিই অবাক করার বিষয়। তবে এই নিয়ে বেশিক্ষণ চিন্তা করল না আদ্রাফ। বেরিয়ে গেল নিজের কাজে।

রাতে খাওয়ার সময় যখন আদ্রাফ জানতে পারলো যে আয়াত আজ রান্না করেছে তখন আয়াতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো সে। তখন মনে পড়ে গেলো কিছুক্ষণ আগের কাহিনী। আয়াত যখন রান্না করছিল তখনই তো তাহলে বোধহয় নুহাশ রান্নাঘরে ঢুকেছিল নিজের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে। একটা খটকা মনে নাড়া দিল। কতক্ষণ চুপ থেকে আবার সবার মতো আড্ডায় যোগ দিল।

খাওয়ার সময় দাদী নুহাশকে প্রশ্ন করলেন,
‘কিরে নুহাশ? আজ আমি তোকে একটা দায়িত্ব দেওয়ার সাথে সাথে তুই হারিয়ে গিয়েছিলি কেন?’

ভ্রুযুগল নাচিয়ে প্রশ্ন করলেন আদ্রাফের দাদী। আয়াত দাদীর কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে হেসে দেল। নুহাশ হালকা ভিরমি খেল। আদ্রাফ তখন আবার নিশ্চুপ। নুহাশ মনে মনে দাদীর কথার উত্তর সাজালো। উত্তর প্রস্তুত করেই যখন নুহাশ সেটা বলার জন্যে উদ্যত হলো ঠিক তখনই আদ্রাফ বলল,
‘দাদী তুমি ছোট থেকেই জানো ও কামচোর।’

খাবার খেতে খেতে অন্যদিকে না তাকিয়েই আদ্রাফ বলল কথাটা। আয়াত আদ্রাফের কথাটা শুনে ফিক করে হেসে দিল। আয়াতের হাসির শব্দ শুনে আদ্রাফ এবং নুহাশ দুইজনেই একসাথে আয়াতের দিকে তাকালো। চুপসে গেল আয়াত তাদের চাহুনী দেখে। আয়াতের চুপসে যাওয়া দেখে সবাই আবার হেসে দিল। এই হাসির মাঝে দাদী বলে উঠলেন,
“কিরে কেউ তো আমায় পাত্তা দে!”

সবাই দাদীর দিকে তাকালেন। দাদী আদ্রাফকে বললেন,
“আদ্রাফ সোজা কথা বল, কবে যাবি হানিমুনে?”

আদ্রাফ বলল, “কি দাদী? কি নিয়ে পড়লা? তুমি তো দেখি এখন আমায় জোর করে হানিমুনে পাঠাবে।”

দাদী বললেন, “হ্যাঁ দরকার পড়লে জোর করব। আমার সতীনের সাথে অন্যায় করতে দিব না।”

নুহাশ মাথা নিচু করে সব কথা শুনছে। এখন চাইলেও সে উঠে যেতে পারবে না। বারবার ওকে ডাকার পরও সে চলে গেলে এটা সাক্ষাৎ বেয়াদবি হবে। মাথা নিচু করে নিশ্চুপভাবে সে নিজের খাবার শেষ করতে লাগলো। আদ্রাফ বলল,
“আমি এখন হানিমুনের ঝামেলায় যেতে পারবো না দাদী।”

দাদী বললেন, “তুই যাবি না তোর ঘাড় যাবে।”

আদ্রাফ কান্না কান্না স্বরে বলল, “দাদী এটা কিন্তু ঠিক না! আমি মানি না।”

দাদী বললেন, “তুই মানবে সাথে নুহাশও মানবে।”

এটা শুনে নুহাশের গলায় খাবার ঠেকে গেল। কাশতে লাগলো সে। আয়াত জলদি উঠে পানি এগিয়ে দিল নুহাশকে। আদ্রাফ একবার নুহাশের দিকে তাকালো আবার তাকালো আয়াতের দিকে। নুহাশ পানি খেয়ে কিছুটা ধাতস্থ করে বলল,
“ও দাদী তুমি কি বল?”

দাদী বললেন, “আরে আমি তো এমনি কথার কথা বলেছি। আর এমনি তুই যাবি মানে তুই ওদের হানিমুনে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। এটা আমার আদেশ।”

নুহাশ করুন স্বরে বলল,
“বলে দাও তোমরা, কোথায় যাবা?”

আদ্রাফ ভাবলেশবিহীন হয়ে বলল, “আমি জানিনা।”

নুহাশ এবার আয়াতকে জিজ্ঞেস কর,
“আয়াত অন্তত তুমিই বলো।”

নুহাশের কথার প্রতিউত্তরে আয়াত লাজুকভাবে প্রশ্ন করল, ” আমি বলব?”

দাদী বললেন, “হ্যাঁ আয়াত ওই ফাজিলের কাছে প্রশ্ন করে লাভ নাই। শুধু শুধু সময় নষ্ট করেছি। তুইই বল।”

আদ্রাফ বিড়বিড় করে বলল, “হ্যাঁ জীবনের শেষ সময়ে আমাকে না ভালোবেসে সবাই আয়াতকেই ভালোবাসে।”

দাদী হাঁক দিয়ে বললেন,
“এই কি বললি?”

আদ্রাফ বলল, ” না না কিছুনা দাদী।”

আবার খাবারে মনোযোগ দিল আদ্রাফ। আয়াত খানিক সময় ভেবে বলল, “সাজেকে যাই? আমার এখানে যাওয়ার অনেক ইচ্ছে।”

আদ্রাফ এবং নুহাশ একসাথে অবাক হয়ে বলল,
“তুমি কখনো যাও নাই সাজেকে?”

আয়াত নিচু স্বরে বলল, “না আমি যাইনি সাজেকে। সমস্যা হলে যাব না।”

আদ্রাফ হেসে দিল। তারপর বলল,
“আরে সমস্যা নাই। তুমি যেতে চেয়েছ তবে চল। আর দাদী নুহাশকে লাগবে না, আমিই সব ঠিক করে নিচ্ছি। ”

নুহাশ মাথা নেড়ে সায় দিল। দাদীও আদ্রাফের কথায় সায় দিলেন। সবাই চুপচাপ নিজেদের খাওয়া শেষ করলেন।

খাওয়া শেষে সবাই যার যার রুমে চলে যায়। আদ্রাফ এবং আয়াত বাগানে যাবে ঠিক করে। শীতের রাতের পরিবেশে বাগানের সৌন্দর্য অন্যরকম। গাছে থোকা থোকা ফুল, কুয়াশার চাদরে ঢেকে যাওয়া বাগান এক অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি করে। দুইটি ভালোবাসার মনে তৈরি হয় হাহাকার। পাখিরা তাদের দোর বন্ধ করে আগলে রেখেছে নিজেকে ও নিজের প্রজাতিকে। কনকনে ঠাণ্ডায় কিছু ফুল আবার নুয়েও পড়েছে। সেই সাথে ঠান্ডায় মাথা নুইয়ে ফেলেছে আয়াত।হাতের কবজি প্রচুর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তার। মনে খেলা করছে কিছু শীতল অনুভূতি। আদ্রাফের মনে খেলা করছে নিজের ভালোবাসাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যা কখনোই সম্ভব নয়। জ্যাকেটের ভাজে নিজের সুপ্ত অনুভূতি সমূহ সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে নিজের মাঝে। পিনপতন নীরবতা বিরাজমান তাদের মাঝে। কুয়াশাও যেন তাদের মিলন না হবার দুঃখে আরও ঘন হয়ে যাচ্ছে। সকলের হৃদয়ের সুপ্ত অনুভূতি সমূহকে আরও মিলিয়ে নিচ্ছে এই কুয়াশা। এই দলে সাক্ষী বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তিও। যে দূর থেকে আয়াত এবং আদ্রাফের নিস্তব্ধ প্রেম দেখে যাচ্ছে। নিজেকে নিজের ভালোবাসার জন্য্ব কঠিন বানিয়ে ফেলছে। নীরবতা ভেঙ্গে আদ্রাফ আয়াতকে প্রশ্ন করল,
“আয়াত শুনছো কি?”

আয়াত যেন লুকোচুরি খেলার এক উত্তর দিল,
“হুম আছি।”

আদ্রাফ এক নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“আজ তুমি রান্না করছিলে যখন তখন কি নুহাশ এসেছিল?”

আয়াত বলল, “জ্বি।”

আদ্রাফ বলল, “কি করতে এসেছিল?”।

আয়াত বলল, ” আমায় পিছন থেকে ডাকলো। আমি কি জিজ্ঞেস করতেই কিছু না বলে ঝটপট বেরিয়ে গেল সেখানে থেকে।”

আদ্রাফ পুনরায় এক নিঃশ্বাস ফেলল আয়াতের উত্তরে। এরপর জিজ্ঞেস করল,
“নুহাশকে তোমার কেমন লাগে?”

আদ্রাফের প্রশ্ন শুনে পূর্ণদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো আয়াত। তারপর বলল,
“আমার কাছে তিনি আপনার প্রিয় বন্ধু আর কিছুই নয়। তাই তাকে বিচার করা আমার কাজ নয়।”

পুনরায় নিস্তব্ধ পরিবেশে নিস্তব্ধ এই দুই প্রাণ। আবার আদ্রাফ বলতে শুরু করল,
“জানো আয়াত আমার মন কি বলে?”

আয়াত প্রশ্ন করল,
“কি বলে আপনার মন?”

আদ্রাফ বলে, “এক সময় আমার কবরে ছেয়ে যাবে হলুদ বসন্ত। যদি আল্লাহ রহম করে, কোনো এক হলুদ বসন্তেই আমার প্রিয়তমার সাথে মিলন ঘটবে আমার। আমি সেই সময়েরই অপেক্ষা করব।”

আয়াত চুপ করে গেল। কোনো প্রতিউত্তর দিল না আর। চোখে বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণা চিকচিক করল। ভারী হয়ে গেল পরিবেশ।

আদ্রাফ এক ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হেসে আয়াতের পানে দৃষ্টি মেলে বলল,
“হয়তো আগমনী হলুদ বসন্তেই পড়বে আমার শেষ নিঃশ্বাস। ”

#চলবে

#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_১০
#Eshika_Khanom

আদ্রাফ এক ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হেসে আয়াতের পানে দৃষ্টি মেলে বলল,
“হয়তো আগমনী হলুদ বসন্তেই পড়বে আমার শেষ নিঃশ্বাস। ”

কথাটা বলা শেষ হলেই আয়াত ঝাপিয়ে পড়ল তার প্রাণপ্রিয়ের বুকে। অশ্রুধারার বর্ষণ পরিবেশটাকে আরও বেশি ভারী করে ফেলছে। একটি ভালোবাসার গল্পে শোভা পাচ্ছে হারিয়ে ফেলার ভয় ও বেদনা। এই শীতের মধ্যেও শুরু হলো বর্ষণ। হয়তো প্রকৃতিও আজ তাদের হৃদয়ের ব্যথায় ব্যথিত। প্রকৃতিও নিজের অশ্রুকে আটকে রাখতে পারেনি দুইটি ভালোবাসার মানুষের না পাওয়া ভালোবাসাকে দেখে। তাই তো এই শীতের মধ্যেও পড়ছে বৃষ্টি। অশ্রুর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে আছে প্রকৃতি, খোদা তায়ালা আর দূরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা এক মানব। নীরবে অশ্রু ফেলছে সে। আদ্রাফ এবং আয়াত পরস্পরের ভালোবাসা বিনিময় করছে কান্নার মাধ্যমে। কিন্তু সেই মানব, নুহাশের বুকে জমছে হাহাকার, বেদনা। নুহাশ কাঁদছে প্রচুর, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রচুর কাঁদছে। আদ্রাফ ও আয়াতের কষ্টের সাক্ষী সবাই হলেও নুহাশের কষ্টের সাক্ষী সে নিজে, প্রকৃতি এবং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কেউই হবেনা। কাঁদছে নুহাশ প্রিয় বন্ধুকে হারাবে বলে। কাঁদছে নুহাশ দুইটি ভালোবাসার মানুষের আর্তনাদে। কাঁদছে নুহাশ প্রিয় মানুষটি কখনোই তার আপন হবেনা তাই।

“অক্ষিতে অশ্রুর সঞ্চার ঘটে রোজ,
হিয়া বোঝে না প্রিয়- কোথা পাই খোঁজ?
নয়নে নয়নে বাধা সে প্রনয় বাধন-
আনন্দ বদলে আজ হয়েছে রোদন!”

থাকতে পারছেনা নুহাশ আর, সরে আসলো সে বারন্দা থেকে। অপরদিকে কান্নার মাধ্যমে নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করে নিজেদের ঘরে ফিরে গেলো দুইটি ভালোবাসার পাখি। নুহাশ বিছানায় বসে পড়ল, অঝোরে কাঁদতে লাগলো। আশেপাশে থেকে যেন কেউ বলে চলেছে,
“বেইমান হবি তুই নুহাশ, তোর সুযোগ এসে পড়েছে, অতি সন্নিকটেই সেই মূহূর্ত, কাজে লাগা নুহাশ কাজে লাগা।”

অপরদিকে হয়তো অন্য কেউ তাকে বলছে,
“নুহাশ তোর ইমান নষ্ট করিস না, দুইটি ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করিস না। ব্যথিত হৃদয়ের ব্যথা মাঝে মাঝে প্রকাশ না করাই উত্তম।”

জোরে জোরে কেঁদে উঠলো নুহাশ। জানেনা সে কি করবে, বুঝতে পারছেনা কি করা উচিত তার। বড্ড অবুঝ লাগে তার নিজেকে। জানা নেই নুহাশ কার কথা শুনবে। বেছে নিবে সে কার পথ? বেইমানির পথ নাকি যে পথে রয়েছে শুদ্ধতা, পবিত্রতা?
.
.
.
আজ অনেকদিন পর সাজতে বসেছে আয়াত। শেষ সেজেছিল নিজের বিয়েতে তবে স্বেচ্ছায় নয়। তবে নিজের ইচ্ছে থেকে এর আগে কবে প্রসাধনী ছুয়েছিল সেটা মনে পড়েনা তার। মাঝে মাঝে নিজের সৎমাকে ধন্যবাদ জানায় সে মনে মনে। কারণ সে এই পদক্ষেপ নিয়ে আয়াতকে একটা ভালো পরিবার উপহার করেছে। আবার আয়াত নিজেকে প্রশ্নও করে,”আদ্রাফ যখন থাকবে না তখন সে কি করে বাঁঁচবে?” এই কয়েকদিনে যে সে আদ্রাফকে খুব আগের চেয়েও খুব বেশি ভালোবাসে ফেলেছে। আদ্রাফের প্রতি ভালোবাসা তার মনে জেগেছিল নীরবে, আদ্রাফের কাণ্ডকারখানায় মুগ্ধ হয়ে পড়েছিল সে। প্রথম প্রথম প্রেম তো এভাবেই জাগে।নিয়তি তাকে এবং আদ্রাফকে অলৌকিকভাবেই মিলিয়ে দিয়েছে। আবার মিলিয়েও মিলায়নি। আসলে সবকিছু সবসময়ই পূর্ণতা পায় না। মাঝে মাঝে কিছুটা অপূর্ণতাও রয়ে যায়। আদ্রাফবিহীন নিজেকে ভাবলেই শিউরে উঠে সে। চোখ ভরে আসে নীরে। যদি তাকে সবাই আবার বিয়ে দিয়ে দিতে চায়? না করবেই না সে। কিছুতেই আর রাজী হবেনা। দাদীর খেয়াল রেখে এবং আদ্রাফের স্মৃতিগুলোকেই আঁকড়ে ধরে কাটিয়ে দিবে বাকিজীবন। পরপারেই মিলিত হবে ভালোবাসার সাথে। হয়তো জান্নাতের কোনো হলুদ বসন্তের মাঝে মিলন ঘটবে তার সাথে তার প্রাণপ্রিয়ের।

বাড়ির বাহিরে অপেক্ষা করছে আদ্রাফ আয়াতের জন্যে। আজ মেয়েটার সাথে বাহিরে যাবে, কিছু কেনাকাটা করে দিবে সাজেকে যাবে বলে। সেই উদ্দেশ্যেই আজ এতো প্রস্তুতি। চোখ দুইটি অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে আয়াতের জন্যে। অবশেষে তার অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো, আগমন ঘটলো আয়াতের। নিজে একটু সেজে নিলেও আবৃত করে রেখেছে নিজেকে খিমারের মাধ্যমে। পরিপূর্ণ পর্দাশীল নারীতে পরিণত সে। আদ্রাফ এই রুপ একদমই আশা করেনি। শুধু কাজলরাঙ্গা দুইটি নয়ন দেখা যাচ্ছে তার, যা আদ্রাফকে বিমোহিত করার জন্যে যথেষ্ট। আদ্রাফ এক ধ্যানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আয়াতের দিকে। বিপরীতে আয়াত পর্দার আড়ালে মুচকি হাসলো আদ্রাফের অভিব্যক্তিতে। পরবর্তীতে আদ্রাফ আয়াতকে গাড়ির মধ্যে বসিয়ে নিজেও বসলো। ড্রাইভার গাড়ি চালানো শুরু করল, দুইজন্যে রওয়ানা দিলো তাদের আজকের গন্তব্যে।

গাড়ির মধ্যে বসে রয়েছে আয়াত এবং আদ্রাফ। দুইজনেই নিশ্চুপ, আটকে পড়েছে জ্যামে। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান সড়কের ট্রাফিক অবস্থা বেশিরভাগ সময়ই অপরিবর্তনীয়। চোখ খুললেই যেন ট্রাফিকের দেখা পাওয়া যায়। হঠাৎ করে যেন আদ্রাফের মধ্যে এক কবি প্রতিভা প্রকাশিত হলো। আচ্ছা ভালোবাসলেই কি কবি প্রতিভা বেড়ে যায়? জানা নেই। আদ্রাফ বলতে শুরু করল,

“পড়েছি প্রেমে আমি গভীর ঐ দৃষ্টিতে
এমন মোহময়ী আর নেই সৃষ্টিতে।”

আয়াত অবাক হয়ে তাকালো আদ্রাফের দিকে তার মুগ্ধ মোহনীয় দৃষ্টি নিয়ে। আদ্রাফ মৃদু হাসলো আয়াতের চাহুনীতে। আদ্রাফ আবার বলতে লাগলো,

“সঞ্চারিনী ভেবে করো নাকো ভুল
এ প্রেম পেতে ঠিক হবে ব্যাকুল,
স্বর্গের অপ্সরাও মেনে যাবে হার
ও চোখের প্রেমেতে পড়বো বারংবার।”

থেমে গেল আদ্রাফ, গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আয়াতের পানে। আয়াত বরাবরের মতোই মুগ্ধ হলো আদ্রাফের আবৃত্তিতে। আয়াত কিছু বলতে যাবে তখনই আদ্রাফ আবার বলল,

‘শোনো হে শোনো কামিনী-
ও মায়বী চোখের অধিকারীনি-
জেনে নিও ডুবতে চাই আমি ঐ চোখে
দুঃসাহস কার মোরে রুখে?”

স্তব্ধ আয়াত, পুনরায় নিশ্চুপ আদ্রাফ। গাড়িতে বিরাজমান পিনপতন নীরবতা। সাহস নিয়ে নীরবতা ভেঙ্গে দিয়ে ড্রাইভার বললেন,
“সত্যিই স্যারের মতো সাহসী আর কেউ নাই। কার আর দুঃসাহস থাকবে যে তাকে বাধা দিবে?”

এটা বলেই মুখে তালা লাগালেন যেন ড্রাইভার। আদ্রাফ বলল,
“দুঃসাহস আমার এই রোগ দেখিয়েছে, রুখে দিয়েছে আমায়।”

আয়াত বিনিময়ে কিছু বলল না। মুখ থেকে বের করলো না কোনো শব্দ। নীরবে মাথা এলিয়ে দিল আদ্রাফের কাঁধে।
.
.
.
কিছু কেনাকাটা শেষে বাড়িতে ফেরার বদলে আদ্রাফ আয়াতকে অন্য এক স্থানে নিয়ে এলো। আয়াত বারবার জিজ্ঞেস করার পরও আদ্রাফ তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটা বলেনি। তাই মুখ ফুলিয়ে বসে রয়েছে আয়াত। আদ্রাফের অভিব্যক্তিও এতে খুব সামান্য। গাড়ি নামলো একটা নিরিবিলি জায়গায়। গাড়ি থেকে নেমে গেল আদ্রাফ এবং আয়াত। আয়াত দেখতে পেলো একটা খ্রিস্টান কবরস্থানের সামনে এসে তারা দাঁড়িয়েছে। বুক ধক করে উঠলো আয়াতের। আদ্রাফ তখনো চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোনো কিছু না বলেই আয়াতের এক হাত ধরে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো আদ্রাফ। কবরস্থানের গেট পার করে ভিতরে ঢুকতে পেল তারা। নীরব এক জায়গা সেখানে, পরিবেশটা কেমন যেন ছমছমে। শীতল হাওয়া বইছে সেখানে। শীতও সেখানে অন্যান্য স্থানের তুলনায় তীব্র যেন। কিছুটা ভয় লাগছে আয়াতের। এক হাত দিয়ে আদ্রাফের হাত খামচি মেরে ধরে রইল সে ভয়ে, আর অপর হাত দিয়ে আদ্রাফের জ্যাকেট শক্ত করে ধরে রইল। আদ্রাফের কোনো রিয়েকশন নাই। সেভাবেই আরও সামনে দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো তারা। অনেক মানুষ চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে আছেন এখানে। শত শত কবরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তারা। সময়ের সাথে সাথে তারাও এগিয়ে যাচ্ছে। কাকের কা কা ডাক যেন সেই সাথেই আরও বেড়ে যাচ্ছে। আয়াত দূর থেকে কবরস্থানের অপর পাশে দেখলো নতুন কাউকে কবর দিচ্ছে তার স্বজনেরা। চোখ ফিরিয়ে নিল সে। তার এতোই ভয় লাগছে যেন সে পারলে আদ্রাফের সাথে মিশে যায়, কিন্তু আদ্রাফ এখনো স্থির। এভাবেই হেঁটে হেঁটে একটা কবরের সামনে এসে দাঁড়ালো। আদ্রাফ টানা কিছুক্ষণ সেই কবরের দিকেই চেয়ে রইল। আর আয়াত একবার কবরটা দেখে তো একবার আদ্রাফকে। কিছুক্ষণ পর আদ্রাফ আয়াতকে প্রশ্ন করল,
“জানো আয়াত এটা কার কবর?”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here