হঠাৎ হাওয়া,পর্বঃ০২

হঠাৎ হাওয়া,পর্বঃ০২
সুমনা ইসলাম

নিরুকে হালকা সাজিয়ে ফারিয়া আর বাকি সবাই মিলে ওকে বসার ঘরে নিয়ে গেল। আশেপাশের প্রতিবেশীরা এসেছে নতুন বউ দেখতে। নিরুকে নিয়ে সোফায় বসাতেই তারা বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করতে শুরু করে দিল। নিরু হেসে হেসেই সবার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। মনে হচ্ছে সবারই পূর্ব পরিচিত সে। এভাবে কথা বলায় সবাই বেশ প্রশংসাও করছে। নিরুর এখন তার মায়ের বলা কথাগুলোই মনে পড়ছে। মা বারবার বলে দিয়েছিলেন যে,

“কেউ যেমন প্রশ্নই করুক না কেন সবসময় হেসে হেসে উত্তর দিবি। তাহলে দেখবি কেউ তোর প্রতি নারাজ হবেন না।”

মায়ের কথাগুলো মনে পড়তেই নিরুর পরিবারের কথা খুব করে মনে পড়ছে। রুমে থাকতে তো ফোন করাও হয়নি। মা-বাবা, ভাইয়া কেমন আছে কী করছে কে জানে।

হঠাৎ নিরুকে মন খারাপ করতে দেখে ফারিয়া ওর পাশে বসে বললো, “বাড়ির কথা মনে পড়ছে?”

নিরু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই ফারিয়া হালকা হেসে বললো, “বিয়ের প্রথম প্রথম আমারো এমন হতো। তবে এখন মানিয়ে নিয়েছি। মন খারাপ করো না। আজ দুপুরের পরেই তো ওবাড়িতে যাবে।”

বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে নিরুর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।

প্রতিবেশীরা চলে যেতেই ফারিয়া আবারো নিরুকে রুমে দিয়ে গেল। ফারহানকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নাস্তা করতে যেতে বললো। বেশ বেলা হয়ে গেছে।

ফারহানকে ডাকতে নিরুর বেশ ইতস্তত লাগছে। কী বলে ডাকবে তাই বুঝতে পারছে না। তবুও আস্তে আস্তে ডাকলো, “এই যে শুনছেন? উঠবেন না? আপু ব্রেকফাস্ট করতে যেতে বলেছে।”

ফারহান একটু নড়েচড়ে আবারো ঘুমিয়ে গেল৷ নিরু এবার ওর এক হাত ঝাঁকিয়ে বললো, “শুনছেন?”

ফারহান এবার চোখ মেলে বললো, “এভাবে ডাকলে কী না শুনে থাকা যায়?”

নিরু এবার বেশ লজ্জা পেল। ফারহানের হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে বললো, “উঠে ফ্রেশ হয়ে নিন। আপু ব্রেকফাস্ট করতে যেতে বলেছে।”

ফারহান উঠে বললো, “আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। মা-বাবার সাথে কথা বলেছো সকালে?”

“না। বসার ঘরে দেখিনি উনাদের।”

“আমি তোমার মা-বাবার কথা বলছি। উনাদের কথা মনে পড়েছে নিশ্চয়ই।”

নিরু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। ফারহান ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বললো, “তুমি কথা বলে নাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

নিরু বাবা-মার সাথে কথা বলা শেষ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো। ফারহান মাথা মুছতে মুছতে বারান্দায় এসে বললো, “কথা বলা শেষ?”

“হুম।”

“মন খারাপ?”

“উঁহু।”

“তাহলে এমন আনমনা হয়ে আছো কেন?”

“এমনি।”

ফারহান তোয়ালে টা দড়িতে মেলে দিয়ে নিরুর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, “কিছু তো হয়েছে। এখন আমরা স্বামী-স্ত্রী। তাই আমার মতে কোনো সিক্রেট রাখা উচিত না। তবুও এমন কিছু কথা থাকে যা শুধু নিজের মাঝেই রাখতে হয়। অতি আপনজনকেও বলা যায় না। প্রতিটি মানুষেরই তো প্রাইভেসি আছে। এখন যদি মন খারাপের কারণটা তোমার একান্তই না বলার মতো কোনো কথা হয় তাহলে বলো না। যদি সেরকম না হয় তবে বলতে পারো। মন ভালো করা আমার সাধ্যের মধ্যেও থাকতে পারে।”

নিরু একটু মলিন হেসে বলতে শুরু করলো, “আসলে ভাইয়ার সাথে কথা বলতে চাইলাম কিন্তু ভাইয়া আমার সাথে কথা বললো না। রাগ করেছে। ভাইয়া চেয়েছিল আমার বিয়ে যেন তার বন্ধুর বড় ভাইয়ের সাথে হয়। কিন্তু তার আগেই আপনাদের বাড়ি থেকে সম্বন্ধ যাওয়ায় বাবা-মা তার কথা মেনে নেয়নি। তাই ভাইয়া আমাকে বলেছিল যাতে আমি বাবা-মাকে এই বিয়েতে না করে দেই। কিন্তু আমি বাবা-মার কথার অবাধ্য হইনি। তার বন্ধুর ভাইয়ের সাথে বিয়েতে রাজি হইনি তাই ভাইয়া রাগ করেছে।”

নিরু একটু থেমে নিচুস্বরে বললো, “আসলে ভাইয়া ভেবেছে আমি আপনার সাথে সুখী হবো না কারণ আপনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। রেহান ভাইয়া সরকারি চাকরি করে তাই ভেবেছে তার কাছেই আমি বেশি সুখে থাকবো।”

ফারহান একটা লুকায়িত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “তাহলে তোমার বাবা-মায়েরও ওনার কাছেই বিয়ে দিতে চাওয়ার কথা। যেহেতু সরকারি চাকরি করে।”

নিরু একটু লজ্জিত হলো কিন্তু ফারহান তো ঠিকই বলেছে এখনকার মা-বাবারা সরকারি চাকরিওয়ালা ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে চান বেশি। নিরু একটু ইতস্তত করে বললো, “বাবা-মা আপনাকে পছন্দ করেছিল বেশি তাই তাদের না করে দিয়েছিল।”

ফারহান একটু শঙ্কিত স্বরে বললো, “তোমার বাবা-মা যদি তার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যেত তাহলে কী তুমি তাকেই বিয়ে করে নিতে?”

নিরু না সূচক মাথা নাড়ালো।

ফারহান ভ্রু খানিকটা কুচকে বললো, “কেন?”

নিরু লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বললো, “কারণ আমার আপনাকে পছন্দ হয়েছিল বেশি। আর তাছাড়া কোনো কারণ ছাড়াই রেহান ভাইকে পছন্দ নয় আমার। তার তেমন কোনো দোষ কিন্তু নেই। তবুও আপনার সাথে আমার বন্ধন জুড়ে আছে তাই হয়তো তার প্রতি কখনো আকর্ষণ সৃষ্টি হয়নি।”

নিরুর কথায় ফারহানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। সে তো ভেবেছিলো নিরুর মনে তার জন্য কোনো অনুভূতিই নেই। কিন্তু এখন তবুও জানতে পারলো পছন্দ করে। এই অনেক। ভালোলাগা থেকে না-হয় আস্তে আস্তে ভালোবাসাও হয়ে যাবে। ফারহান একদিনেই বুঝে গেছে যে মেয়েটা সংকোচ বোধ করলেও সোজাসুজি কথা বলে। লুকিয়ে রাখতে পারে না।

ফারহানের মামাতো বোন নুপুর ওদের ডাকতে আসায় ওরা দুজনে ব্রেকফাস্ট করতে চলে গেল। কথা বলতে বলতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সবাই ওদের জন্য অপেক্ষা করছে।

খাওয়া শেষে শাশুড়ি মায়ের সাথে হালকা কথা বলে রুমে চলে এলো নিরু। মূলত ওনার নির্দেশেই আসা। এখন রেস্ট করতে পাঠিয়ে দিয়েছেন যাতে দুপুরের অনুষ্ঠানের সময় অসুবিধা না হয়। দুপুরেই বৌভাতের অনুষ্ঠান। নিরু কিছুক্ষণ কথা বলেই বুঝতে পেরেছে ফারহানের মা মানে তার শাশুড়ি উপরে উপরে একটু কড়া হলেও মনটা বেশ ভালো। সবাইকে সহজেই আপন করে নিতে পারে না কিন্তু যাকে আপন করে নেয় তাকে ছাড়তে চায় না।

বিকালে ওবাড়িতে যেতে পারবে ভেবে ভালো লাগছে নিরুর। একদিনও হয়নি ওবাড়ি থেকে এসেছে তবুও মনে হচ্ছে কতযুগ হয়ে গেল মা-বাবাকে দেখা হয় না। ভাইয়াকেও বোঝাতে হবে। শুধু সরকারি চাকরি থাকলেই কেউ সুখী হয় না, মনের শান্তিও থাকতে হয়।

নিরু রুমে এসে রেস্ট করছে আর ফারহান গেছে ওর কিছু বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। একা একা বসে থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না নিরুর। বাইরে যেতেও মন সায় দিচ্ছে না। ভাবীরা আবার কী না কী বলে ফেলে। উনারা সবাই ফারহানের মামাতো, খালাতো, ফুফাতো ভাইয়ের স্ত্রী রা। ফারহান ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হওয়ায় বেশ ঝামেলাই হয়ে গেছে নিরুর। বড়রা শুধু লজ্জা দেয়।

নিরু বসে বসে এসব ভাবছে তখনি রুমে প্রবেশ করলো ফারিয়া। সে ফারহানের থেকে দু বছরের বড়। বছর পাঁচেক হলো বিয়ে হয়েছে। তবে এখনো কোনো সন্তান হয়নি। এ নিয়ে তার মন খারাপের শেষ নেই।

ফারিয়া নিরুর পাশে বসে বললো, “একা একা বোর লাগছে?”

নিরু হালকা হেসে বললো, “ওই একটু আরকি।”

ফারিয়া আলমারি থেকে একটা জামদানী শাড়ি আর গয়না বের করে বললো, “কালই এগুলো এখানে রেখে দিয়েছিলাম বৌভাতের জন্য। তোমার জামাকাপড় এখনো লাগেজ থেকে নামাওনি?”

“খেয়াল ছিল না।”

“ওহ, আমি আলমারিতে তুলে রাখছি।”

“না, আপু। আপনি কেন শুধুশুধু কষ্ট করতে যাবেন। আমি করে নেব।”

“তুমি বসো তো নিরু। আমি রেখে দিচ্ছি। এতে আবার কষ্ট কিসের? ফারহান কখন আসবে বলে গেছে?”

“দুপুরের আগেই চলে আসবে বললো।”

“দুপুর তো হয়েই এলো। কখন যে আসবে? বাবা যদি দেখে যে ও এখনো আসে নি তাহলে রাগ করবেন। মেহমানরা তো নামাযের পরেই চলে আসবেন।”

ফারহান রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো, “এখনো অনেক দেরি আছে আপু। সবেমাত্র বারোটা বাজলো। তুমি শুধুশুধুই এত টেনশন করো।”

ফারিয়া গোছানো শেষে আলমারিটা বন্ধ করে বললো, “চলে এসেছিস এখন আর টেনশন করবো না। তোরা থাক আমি যাচ্ছি। তোর দুলাভাই ডাকছিলো।”

ফারিয়া যেতেই ফারহান বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসলো। বড্ড গরম লাগছে। নিরু পাশের টেবিলে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, “নিন, পানি খান। একটু ভালো লাগবে।”

ফারহান উঠে বসে পানি খেয়ে গ্লাসটা নিরুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “এখন নিজেকে বিবাহিত বিবাহিত লাগছে৷ বাইরে থেকে আসতেই বউ পানি এগিয়ে দিল। এমন সৌভাগ্যই বা কয়জনের হয়।” বলেই মৃদু হাসলো।

নিরু লজ্জা পেল কিছুটা। পানির গ্লাসটা পুনরায় টেবিলের উপর রেখে বললো, “আপনি একটু বাইরে যান।”

ফারহান ভ্রু কুচকে বললো, “কেন?”

“আমি শাড়ি পড়বো। জামদানী শাড়ি তাই ওয়াশরুমে পড়তে অসুবিধা হবে।”

ফারহান দুষ্টু হেসে বললো, “আমি থাকলে কী অসুবিধা। তোমার বর ই তো।”

“লজ্জা লাগবে আমার। আপনি বাইরে যান।”

“আচ্ছা যাচ্ছি। কুচি ধরার প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকবে কিন্তু। প্রয়োজন তো অবশ্যই হবে। তবুও যাতে সংকোচ না করো তাই বলে রাখলাম।”

ফারহানের কথায় নিরু অন্যদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।
_____________________

বৌভাতের অনুষ্ঠান প্রায় শেষ হতে চললো। নিরুর বাবা আর ভাই এসেছে ওদের নিতে। সব মেহমানরা ধীরে ধীরে চলে যেতেই নিরু রুমে চলে এল। পড়নের শাড়িটা বেশ ভারী। এটা পড়ে আর থাকা যাবে না। তাই বাড়িতে যাওয়ার জন্য হালকার মধ্যে একটা শাড়ি পড়ে নিল।

ফারহান বাইরেই আছে৷ তার বাবার সাথে কী নিয়ে যেন কথা বলছে। কথা বলা শেষে রুমে এসে নক করতেই নিরু দরজা খুলে দিল। নিরুকে দেখে কতক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ফারহান। নিরুর দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে বললো, “তোমাকে আকাশি রঙে কী সুন্দর লাগছে বউ! মাশা আল্লাহ।”

নিরু লজ্জা পেয়ে নিচের দিকে তাকালো। ফারহান কিছুটা ঝুঁকে ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, “তুমি এত লজ্জা পাও কেন নিরু?”

এতে নিরুর লজ্জা আরো বেড়ে গেল। কেমন যেন অনুভূতি হতে লাগলো।

নিরুকে আগের মতোই থাকতে দেখে ফারহান বললো, “তোমার নামের মধ্যে কী যেন একটা আছে। ডাকলে শুধু ডাকতেই ইচ্ছা করে। নিরু… মনে হয় নামের মাঝে কোনো সম্মোহনী জাদু আছে। নাম শুনলেও কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হয়। মনে হয়, মেয়েটা শুধু একান্তই আমার, শুধুই আমার। নিরু… অন্যরকম শান্তি লাগে।”

নিরুর ঠোঁটের কোণে আপনা-আপনি হাসি ফুটে উঠলো।

চলবে__

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here