হঠাৎ হাওয়া,পর্বঃ০১
সুমনা ইসলাম
“আপনি না-কি আগেও একটা বিয়ে করেছিলেন?”
বাসরঘরে বসে নিজের সদ্য বিয়ে করা বউয়ের মুখে আচমকা এমন কথা শুনে খানিকটা চমকালো ফারহান। পরমুহূর্তেই চোখ-মুখ স্বাভাবিক করে বললো, “আশেপাশের লোকজনের মুখেই শুনেছেন নিশ্চয়ই?”
ফারহানের এমন কথায় একটু কাচুমাচু হয়ে বসলো নিরু। ফারহান তার সামনেই বরবেশে বসা। ফারহান রুমে আসার আগে যখন মুরুব্বীরা তাকে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছিলো তখন কিছু মহিলাকে ফারহানের আগে বিয়ে করা নিয়ে কানাঘুঁষো করতে শুনেছে সে। তাই কৌতূহলের বশেই এভাবে জিজ্ঞেস করে ফেলেছে।
নিরু হাত কচলাতে কচলাতে নিচের দিকে তাকিয়ে বললো, “আসলে… ওই কিছু মহিলারা বলছিলো তো আর বিয়ের আলোচনার সময়ও তো এমন কিছু শোনা যায়নি তাই একটু কৌতূহলের বশেই আরকি।”
নিরুকে এমন কাচুমাচু করতে দেখে ফারহান মৃদুস্বরে এসে বললো, “আপনি প্লিজ অস্বস্তি বোধ করবেন না। আর একদম নিশ্চিন্ত থাকুন যে আপনার স্বামী আগে কোনো বিয়ে করেনি। পরে একসময় না-হয় সবটা বিস্তারিত বলবো।”
“আপনার স্বামী” কথাটা শুনেই মুখটা লজ্জার আভায় ছেয়ে গেল নিরুর। সামনে বসা লোকটা তার স্বামী। বিয়ে হয়েছে তাদের। তবে অজানা আশঙ্কায় একটু অস্বস্তিও লাগছে।
নিরুকে অস্বস্তি বোধ করতে দেখে ফারহান উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আপনি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। এত ভারী শাড়ি পড়ে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে নিশ্চয়ই। আপনি ওয়াশরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে নিন। আর এটা ভাববেন না যে নিজের বিবাহিত বউকে আপনি করে বলছি কেন? বিয়েতে রাজি ছিলাম না-কি না? আসলে দু-এক বারের পরিচয়েই কাউকে তুমি করে বলতে একটু কেমন যেন লাগে। তাই আরকি। আস্তে আস্তে আপনি থেকে তুমিতে পরিণত হয়ে যাবে।”
নিরু লজ্জামিশ্রিত একটা হাসি দিয়ে লাগেজ থেকে একটা সুতি শাড়ি বের করে ওয়াশরুমে চলে গেল। ফারহানের ব্যবহার, কথা-বার্তা বড্ড বেশি-ই ভালো লাগছে তার। একপ্রকার মুগ্ধ হয়েছে বটে।
নিরু ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই দেখলো ফারহান একটা টি-শার্ট আর ট্রাউজার পড়ে বিছানায় বসে আছে। নিরুকে দেখেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললো, “ছাদে যাবেন?”
ফারহানের এমন নিঃসংকোচ আবদারে না করতে পারলো না নিরু। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিরু ফারহান। দুজনেই নিশ্চুপ। ঝিরিঝিরি বাতাসে নিরুর শাড়ির আচল হালকা হালকা উড়ছে। চুলগুলোও থেকে থেকে উড়ছে।
নিরবতা ভেঙে ফারহান বললো, “আসলে আপনার সাথে তো আমার তেমন ভালো করে কথা হয়নি তাই এসময়ে ছাদে আসা। খোলামেলা পরিবেশে বেশ জমিয়ে কথা বলা যাবে। আর চাঁদটাও কী সুন্দর জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে। আমি তো ভাবছি আজ সারারাত এখানে কথা বলতে বলতেই কাটিয়ে দেব। আপনি কী বলেন?”
নিরুও হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ালো।
ফারহান আবারো বললো, “কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করবেন না প্লিজ।”
নিরু মুচকি হাসলো।
ফারহান হঠাৎ নিচে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই নিরু বললো, “কোথায় যাচ্ছেন?”
“ওহ, মাদুর আনতে। সারারাত তো আর এভাবে দাঁড়িয়ে কাটানো যাবে না। পরে পা ব্যথা হয়ে যাবে। আর আমার বউয়ের কষ্ট কী আর আমি সহ্য করতে পারবো? মোটেও না।”
নিরু লজ্জামিশ্রিত হেসে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। লোকটা হঠাৎ করেই কেমন লজ্জর কথা বলে ফেললো।
কিছুক্ষণ পরে ফারহান ফিরে এসে মাদুরটা দেয়ালের সাথে ঘেষে বিছিয়ে বসে নিরুকেও বসতে ইশারা করলো।
নিরু বসতেই বললো, “এবার বলুনতো আমার সম্পর্কে আপনি কী কী জানেন?”
নিরু লজ্জা পেয়ে বললো, “তেমন কিছু না। আসলে আমি নিজে থেকেই জানতে চাইনি বিয়ের পরে জানবো বলে। আর বাবা-মা নিশ্চয়ই আমার খারাপ চাইবেন না।”
ফারহান এভাবে কথায় কথায় নিরুর লজ্জা পাওয়াটা বেশ উপভোগ করছে। লজ্জা পেলে দেখতে বেশ লাগে।
“আচ্ছা,বলুন তাহলে কী কী জানতে চান।”
নিরু নিচুস্বরে বললো, “আপনি বলুন।”
ফারহান স্বভাবতই মুচকি হেসে বলতে শুরু করলো, “আমি ফারহান। পুরো নাম ফারহান শাহরিয়ার। ক’দিন আগেই পড়াশোনা শেষ করে চাকরি জয়েন করেছি। মায়ের জোড়াজুড়িতেই বিয়ে করা আরকি। তাছাড়া আর কতকালই বা সিঙ্গেল থাকতাম! হাহা।”
ফারহানকে হাসতে দেখে নিরুও মুচকি হাসলো।
ফারহান হাসি থামিয়ে আবারো বলতে শুরু করলো, “সেভাবে বলার মতো তেমন কিছু খুঁজে পাচ্ছি না আপাতত। আস্তে আস্তে সবই জানতে পারবেন। তাছাড়া আপনার কিছু জানার আছে?”
নিরু খানিকটা সংকোচ নিয়ে বললো, “আসলে… বিয়ের ব্যাপারটা।”
“সে এক তিক্ত অনুভূতি। আমি চাই না এত সুন্দর পরিবেশটা এখন তিক্ততায় ছেয়ে যাক। একদিন ঠিকই বলবো। তবে আপনার যে কোনো সতিন নেই বা ছিল না এ নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন।” বলেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটালো ফারহান।
নিরু অবাক হয়ে দেখছে ফারহানকে। কী সুন্দর করে হাসে। ঠোঁটের কোণে সবসময় হাসি লেগেই থাকে।
“নিরু।”
ফারহানের ডাকে ঘোর কাটে নিরুর। লজ্জা পেয়ে মাথাটা একটু নিচু করে ফেলে।
ফারহান নিরুকে এভাবে লজ্জা পেতে দেখে বললো, “এত লজ্জা পান কেন? আপনারই তো আমি। যখন ইচ্ছা হবে তখনই তাকিয়ে থাকবেন, যতক্ষ ইচ্ছা ততক্ষণ।”
ফারহানের কথায় নিরুর লজ্জা যেন বহুগুণ বেড়ে গেল। এভাবে বলতে আছে না-কি! লজ্জার মাঝেও মুচকি হাসলো নিরু যা ফারহানের দৃষ্টিগোচর হলো না।
এটা ভাবতেও ভালো লাগছে নিরুর যে, প্রথম রাতেই লোকটা কী সুন্দরভাবে কথা বলছে৷ মনে হচ্ছে কতকালের চেনা পরিচিত একজন মানুষ। নিরুর লজ্জা ভাবটা বেশ খানিকটা কেটে গেছে।
“আমার সম্পর্কে কিছু জানার আছে আপনার?”
“আপনার সম্পর্কে প্রায় সবই জানা আছে আমার।”
নিরু বিস্মিত হয়ে বললো, “কীভাবে জানেন?”
ফারহান একটু রহস্যময় হেসে বললো, “সেভাবেই।”
নিরু ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “তা কী কী জানেন?”
“এই যে আপনি এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রবল ইচ্ছা আছে। আপনি টক জিনিস খেতে ভীষণ পছন্দ করেন, বিশেষ করে সেটা যদি হয় জলপাইয়ের আচার তাহলে তো কথাই নেই। তাছাড়া শাড়ি পড়তে ভীষণ পছন্দ করেন আর রিকশা নিয়ে ঘুরতেও। প্রতিদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নামায পড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে খোলা হাওয়ায় চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে থাকেন। স্নিগ্ধতা এসে ভর করে আপনার মুখখানিতে। ফল তেমন একটা পছন্দ করেন না শুধু কাঁচা আম বাদে। আর ফুলের মধ্যে ঘাস ফুল। আরো অনেক কিছু। আপাতত এত মনে করতে পারছি না।”
নিরু নিজের সম্পর্কে এতকিছু শুনে একপ্রকার অবাক চোখেই তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। সে তো নিজের সম্পর্কেও এত কিছু খেয়াল করেনি কখনো। পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে এত ভাবেনি। তাহলে সে জানলো কী করে এতকিছু।
নিরু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই ফারহান বললো, “প্লিজ জানতে চাইবেন না এগুলো কীভাবে জানলাম। নিজেই একসময় জানতে পারবেন।”
নিরু আর এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করলো না। তবে মনে মনে ঠিকই ভাবছে, “এত কিছু কীভাবে জানলেন উনি? তাহলে কী আমাকে আগে থেকেই চিনেন? কিন্তু আমি তো চিনি না। যেদিন আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন সেদিনই তো শুধু দেখেছিলাম।”
____________________
মসজিদ থেকে আযানের শব্দ ভেসে আসতেই ঘুম ভাঙলো ফারহানের। আবছা আলোয় ভালোভাবে চোখ মেলে আশেপাশে তাকাতেই বুঝতে পারলো তারা এখনো ছাদেই আছে। কথা বলতে বলতে মাঝরাতেই নিরু কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর ফারহানও নিরুকে আগলে ধরে পাড়ি জমিয়েছিল ঘুমের রাজ্যে। কেন যেন রুমে যেতে ইচ্ছা করছিল না। এখানেই ভালো লাগছিল।
পুনরায় আযানের ধ্বনি কানে আসতেই ফারহান আস্তে আস্তে নিরুকে ডাকতে লাগলো, “নিরু, নিরু।”
নিরু পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাতেই দেখলো সে ফারহানের কাঁধে মাথা দিয়ে তাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে আছে। তাৎক্ষণিক খানিকটা লজ্জা পেয়ে সরে বসলো নিরু। হাই তুলে বললো, “কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতেই পারিনি।”
ফারহান উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “রুমে চলো। নামায পড়বে না?”
“হুম, চলুন।” বলে নিরুও ফারহানের পিছু পিছু রুমে চলে এলো। বিছানা এখনো আগের মতোই সাজানো।
নিরু বিছানা থেকে ফুলগুলো সরিয়ে পাশের ঝুড়িতে ফেলে ফ্রেশ হয়ে নামায পড়ে নিল। ফারহানও মসজিদে চলে গেছে ততক্ষণে।
নিরু তার অভ্যাস অনুযায়ী বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। কাল বিয়ে থেকে শুরু করে এপর্যন্ত হওয়া সব ঘটনাই ভাবছে। এক পলকেই কীভাবে জীবনটা পাল্টে গেল। ফারহানের সাথে অনেকটাই ফ্রি হয়ে গেছে। একদিনের দীর্ঘ কথোপকথনেই বুঝতে পেরেছে খারাপ না মানুষটা।
সকাল সাতটা বেজে গেছে। ফারহান মসজিদ থেকে এসে আবার ঘুমিয়েছে। নিরু গোসল করে গোলাপি রঙের একটা শাড়ি পড়ে বসে আছে। রুমের বাইরে যাবে না-কি যাবে না এ নিয়ে ভাবছে। নতুন বউ হুট করেই তো আর কোথাও যাওয়া যায় না। আর কেউ তো ডাকতেও আসছে না। বাইরে থেকে মানুষজনের শব্দও আসছে।
নিরুর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার থেকে বয়সে বড় কিছু মেয়ে আসলো রুমে। এদের মধ্যে একজনকেই চেনে নিরু। সে হচ্ছে ফারহানের বড় বোন ফারিয়া। সে রুমে প্রবেশ করেই নিরুকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে সাজাতে লাগলো। নতুন বউ একটু সাজগোজ না করলে চলে না-কি? আর বাকিরা সবাই তার পাশে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের লজ্জাজনক কথা বলে যাচ্ছে। ওরকম কিছু না হলেও নিরুর বেশ লজ্জা লাগছে।
ফারহান তাদের কথার শব্দে ঘুমোতে না পেরে বেশ বিরক্তির স্বরেই বললো, “ভাবীরা একটু ঘুমাতে দাও প্লিজ।”
তাদের মধ্যে একজন মুখ চেপে হেসে বললো, “হ্যাঁ, ঘুমাও দেবরমশাই। এখনি তো ঘুমাবে। রাতে নিশ্চয়ই ঘুম হয়নি।”
ফারহান তাদের কথা শোনার আগেই ঘুমিয়ে পড়লেও নিরুর লজ্জার শেষ নেই। লজ্জায় একেবারে মাটিতে মিশে যেতে মন চাইছে। কীসব কথা বলছে উনারা।
চলবে__