স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। #দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-৩১)

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি।
#দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-৩১)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

গোধূলি লগ্ন। পশ্চিম আকাশের উপরি ভাগে হলদে মেঘ, নিন্মভাগে কমালাটে মেঘে ছেয়ে গেছে। মাঝে বৃত্তাকার হলেদেটে সূর্যটা ধীরে ধীরে হেলে পড়ছে। মেঘের ছায়া পড়ে সমুদ্রের পানি কমলাটে রূপ ধারণ করেছে গেছে। কী অপূর্ব লাগছে ঢেউ খেলানো কমলাটে জলরাশি দেখতে! কক্সবাজারের সুগন্ধা বিচে দাঁড়িয়ে মুগ্ধচোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম সূর্যাস্ত দেখছে মুশরাফা। নগ্ন পা নরম বালিতে ডুবানো। ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে পা, পরিধেয় বোরকা। মুশরাফার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তারিফ। তার দৃষ্টি ঘুরছে, একবার কিছুটা দূরে সমুদ্র জলে গা ভেজানো কিশোরী বোন জায়ফার দিকে যাচ্ছে, তারপর পাশে দাঁড়িয়ে আদরের বোনের খেয়াল রাখছে। কেউ আবার পাশ ঘেঁষছে না তো! জায়ফা ডেকে ওঠল , ‘ আপু, ভাইয়া আসো?’
আকাশ পানে তাকিয়ে মুশরাফা উত্তর দিল, ‘ আঁধার নামুক, তারপর আমি নামব। ভাইয়া, তুমি যাও।’

তারিফ চারদিকে তাকাল। আশপাশে ভালোই মানুষ। কয়েকটা ছেলেও আছে। বোনকে একা রেখে যাবার ইচ্ছে হলো না তার। বলল, ‘ ইচ্ছে করছে না এখন। ‘

মুশরাফা অবাকই হলো। আসবার সময় সমুদ্রস্নানের মননে থ্রী কোয়ার্টার পরে এসেছে তারিফ। অথচ এখন বলছে ইচ্ছে করছে না! মুশরাফা আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল। তারিফ স্থির দৃষ্টি তখন জায়ফাকে পরখ করছে। দূরে চলে যাচ্ছে না তো? কেউ ওর সাথে ঘেঁষছে না তো! ভাইয়ের ধর্মই বোধহয় বোনের রক্ষাকবচ হওয়া। মুশরাফা হাসল। এমন রক্ষাকবচ একজন পুরুষ সাথে থাকলে মেয়েরা সবসময় নিরাপদ থাকবে। ঠিক এইজন্যই বোধহয় ইসলাম নারীদের ভ্রমণে তাদের মাহরামকে সঙ্গী করবার আদেশ দিয়েছে। বাবা, ভাই, স্বামীর উপস্থিতিতে নারীদের নিঃশ্বাসে ভয় থাকে না।

আবার তাকাল আকাশপানে। মন ডুবাল ওই দূর আকাশে। এখানে জাওয়াদের সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো স্মরণে এলো! লোকটা তখন ওর উপর বিরক্ত ছিল, তাও কী সুন্দর ছিলো সময়গুলো! তখন তো অন্তরে বাহিরে লোকটা তার, তবে এখন জাওয়াদ থাকলে সময়গুলো কেমন সুন্দর হতো? অভাবনীয়! সেই মুহুর্তে হারাবার ইচ্ছে হলো মুশরাফার। পুরনো স্মৃতি আওড়িয়ে হাসল সে। সেই ক্ষণে একটা পুরুষ অবয়ব এসে দাঁড়াল তার পেছনে। ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি। বোনের দিকে নজর ঘুরাতে গিয়ে চোখ পড়ল তারিফের। ভ্রু কুঁচকাল। মুখভঙ্গি পরিবর্তন করে কিছু বলতে গেল পারল না। নিষেধাজ্ঞা এলো। সে পেছু গিয়ে সুকৌশলে কথা বলল। তারপর কিছুটা দূরে গিয়ে অন্যদিকে ফিরে তাকাল জায়ফার দিকে।

পুরুষটি মুশরাফার কাধে আলতো করে চাপড় দিল। তড়িৎ সরাল। মুশরাফা চমকে উঠল। তড়িৎ পিছু চাইল। কাউকে দেখতে পেল না। নজর ঘুরিয়ে ভাইকে চোখে পড়ল না। মুশরাফা ধরে নিল, কোন বখাটে ভীড়ের মহিলাদের গায়ে হাত দিচ্ছে। এটা কক্সবাজারের খুব কমন একটা বিষয়। হাত মুঠোবন্দি করল সে। সরে দাঁড়াল। আকাশের দিকে তাকালেও পঞ্চ ইন্দ্রিয় সজাগ রাখল। পরক্ষণেই পুরুষটি আবার পিছু এসে দাঁড়াল। ধীর স্বরে বলল,
‘ হেই বিউটিফুল লেডি, ডু ইউ মিস মিই?’

স্বরটা কানে লাগল খুব। বড্ড পরিচিত ঠেকল। মুশরাফা তড়িৎ ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। হৃদয়মাঝে বাস করা মানুষটার হাস্যজ্বল মুখখানা চোখে পড়তেই হতবিহবল হয়ে গেল! অবিশ্বাস, বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ! জাওয়াদ এখানে! আর তো আসবার কথা ছিল না, তবে! মুশরাফার যেন এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না জাওয়াদের উপস্থিতি। ওর চোখের বিস্ময় দেখে জাওয়াদ হেসে বলল, ‘ আস-সালামু আলাইকুম। কেমন আছেন মিসেস?’

এতক্ষণে বোধহয় মুশরাফার বিশ্বাস হলো জাওয়াদের উপস্থিত। গত চারদিনের বিরহে মন ব্যাকুল হয়ে আছে। বিয়ের পর এত লম্বা সময় ওরা দূরে ছিল না। ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ছিল মুশরাফা। মনে শূন্যতা লাগছিল ভীষণ। অভাব বোধ করছিল। এইক্ষণে সেই মানুষটাকে পেয়ে কী হলো কে জানে মুশরাফা লোকলজ্জা ভুলে আছড়ে পড়ল স্বামীর বুকে। যেন কতকাল বাদে দেখা! আবেগী সুরে বলল, ‘আমি আপনাকে ভীষণ ভীষণ ভীষণ মিস করছিলাম। আসবেন বলেন নি কেন? ‘

মুশরাফা রুমের বাইরে এতটা ফিল্মি কখনো হয়না। নিজের আবেগে বেজায় নিয়ন্ত্রণ তার। আজ হলো এত নিয়ন্ত্রণহারা হলো কিভাবে! জাওয়াদ অবাক চোখে স্ত্রীর পাগলামো দেখল। শব্দ করে হেসে দিল। নিকাবের উপর মাথায় আলতো হাত রেখে বলল, ‘সারপ্রাইজ দিতে চাইছিলাম।’

মুশরাফা ধরতে পারল জাওয়াদের আসবার কারণ। প্রথমত, তাদের ট্যুর শেষ দিকে। এ যাবতকাল ভাইবোনের খুব সময় কাটানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কক্সবাজার ইতঃপূর্বে এসেছে তারা। অনেক স্মৃতি জমা পড়েছে। তাই এখন একসাথে সময় না কাটাতে পারলেও চলবে।
মুশরাফা আলতো সুরে বলল, ‘ জাযাক-আল্লাহু খায়রান। ভাইয়া জানতো? ‘
‘কেউ জানতো না। কায়দা করে হোটেলের নাম জেনে চলে এসেছি। ভাইয়া ও সারপ্রাইজড। ‘
জাওয়াদ হাসল। চারদিক তাকাল। কিছু পর্যটক অবাক চোখে দেখছে তাদের। জাওয়াদ তাদের মাঝে শ্যালককে খুঁজল। দূরে অন্যদিকে ফেরাভাবে পেল। জাওয়াদ ফিসফিস করে বলল,
‘আমি তোমার সাথে সুর্যাস্ত দেখব বলে অতদূর থেকে এসেছি রাফা। দেখো, সূর্য ডুবে যাচ্ছে।’

মুশরাফা সরে গেল। লাজুক চোখে চাইল এক পলক। তাকাল আকাশ পানে। জাওয়াদ পাশে দাঁড়িয়ে চাইল আকাশ পানে। আলতো হাতে হাত রেখে পা ভেজাল ঢেউয়ে। দেখল সূর্য ডোবার পৃথিবীর অপূর্ব রূপ। সমুদ্রের শেষ সীমায় মিশেছে আকাশ। কমলাটে মেঘ তখন কালচে রুপ ধরেছে। সেই কালচে মেঘে গা ভাসিয়েছে হলদেটেছে সূর্য। একটু একটু করে কালচে মেঘে ডুবে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে বিলীন হলো আকাশ থেকে। কী সুন্দর! সুবহানাল্লাহ! এই সৌন্দর্য একবার দেখে শেষ করবার নয়, এ সৌন্দর্য প্রতিবারই মুগ্ধ হবার।

জাওয়াদকে দেখে উঠে এলো জায়ফা। বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল, ‘ভাইয়া আপনি কখন এলেন?’

জাওয়াদ বালির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ না তুলে হেসে বলল, ‘ কিছুক্ষণ হলো। তা ভালো আছো তুমি?’
জায়ফা হাসল, ‘হ্যাঁ ভালো আছি। ‘
থেমে ঠাট্টার সুরে বলল,
‘ভাইয়া আপনি তো দেখি বউকে চোখে হারাচ্ছেন। ‘

জাওয়াদ ও ঠাট্টার সুরে বলল,
‘ একটাই বউ আমার। শান্তি টান্তি গত ব্যাপারে স্যাপার জড়িয়ে আছে। শুধু চোখ না, নাকে মুখে সবদিক দিয়ে হারাচ্ছি।’

জায়ফার সন্তুষ্টির হাসি দিল। বিগত দিনে বোনের বিরহ স্বচোক্ষে দেখেছে। বিরহ বোধহয় দু’দিকেই ছিল। নয়তো ভাইয়া এভাবে সারপ্রাইজ দিতে আসতো! কী সুন্দর বন্ডিং এদের! বোনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ আল্লাহ! বাঁচলাম। আর তোমার স্যাড ফেইস দেখা লাগবে না। ভাইয়া এসে গেছে, এবার খুশি?’
মুশরাফা হেসে ফেলল। চোখ রাঙিয়ে বলল, পাজি মেয়ে!’

জায়ফা আবার সমুদ্রের দিকে চলে গেল। তারিফ ও নেমে গেছে এখন। জায়ফাকে বলা জাওয়াদের কথাগুলো আওড়াল। একটাই বউ আমার…
থেমে বলল, ‘ওমন করে তো কখনো আমাকে বলেননি?’

জাওয়াদ মুশরাফার হাত ধরে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে বলল, ‘ সব কথা সবাইকে বলতে হয় না। বললে মাথার উপর আসন পেতে ভাষণ দিতে শুরু করে। ‘

ঘড়ির কাটায় রাত আটটা। কটেজের হলরুমে আড্ডায় বসেছে সবাই। এক কোণে একটা ডিভানে বসে ফোনে মগ্ন জায়ফা। আজ সারাদিনে তোলা ছবিই দেখছে সে। অন্যদিকে মন নেই তার। ডাবল সিটে বসে আছে জাওয়াদ আর তারিফ। আরেকটি সিঙ্গেল ডিভানে বসে আছে মুশরাফা। তিনজনের মাঝে চলছে নানান হাসি আড্ডা। মধ্যমণি মুশরাফা। সে হাস্যজ্বল মুখে গল্প করে যাচ্ছে। তারিফ বোনকে দেখছে। আজ বোনটাকে একটু বেশিই প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে। কী ভীষণ খুশি! জাওয়াদের উপস্থিতির জন্যই! ওদের বন্ডিং দেখতে ভালো লাগে তারিফের। কেমন শান্তি লাগে। কী সুন্দর জুটি! কত ভালোবাসা ওদের মাঝে!
আড্ডার মাঝে অনুভব করল ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। ম্যাসেজ আসছে একের পর এক। তারিফ ফোন হাতে নিল। ‘মৌ’ সেভ করা নাম্বার থেকে আসছে ম্যাসেজ। তারিফ পড়ল না, দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন রেখে দিল। কপালের চিন্তার ভাজ স্পষ্ট।

কথা বলবার ফাঁকে শ্যালকের চিন্তিত মুখ পরখ করল জাওয়াদ। ভ্রু কুঁচকাল কেবল। কিছু জিজ্ঞেস করল না। এশার আজান হবার পর মুশরাফা রুমে চলে গেল। তারিফের ফোন বেজে উঠল সেই ক্ষণে। সে ফোন নিয়ে চলে গেল বারান্দায়। জাওয়াদ রুমে যাবার সময় তার কানে এলো কিছু কথা,
‘ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড মৌ, আমি আমার বোনকে পরিবার না দেয়া অবধি নিজ পরিবার পূর্ণ করতে পারব না। তুমি তো সব জানো, একটু বুঝো আমায়? বেশি না জাস্ট একমাস সময় দাও আমায়! আমি এর চেয়ে গ্র‍্যান্ড করে বিয়ে করে আনব তোমায়। আমি হ্যাপিলি নতুন জীবন শুরু কর‍তে চাই। প্লিজ একটু বুঝো!’

জাওয়াদ থেমে গেল। তারিফ নত মুখে, আলতো স্বরে বুঝিয়ে যাচ্ছে, ‘ কে কী বলছে, কী ক্ষতি হচ্ছে কিছু পরোয়া করছি না আমি। আমার চিন্তা জাস্ট তোমাকে নিয়ে। প্লিজ কান্নাকাটি করো না, আমি সব ঠিক করার চেষ্টা করছি। মম ড্যাড মুশিকে মেনে নিলেই অনুষ্ঠান শুরু করে দিব। প্লিজ ডোন্ট বি প্রাস্টেটেড! প্লিজ বেব! ‘

অপাশ থেকে কী বলছে শুনা যাচ্ছে না। জাওয়াদের ধারণা হলো, মৌ তারিফের হবু স্ত্রী। খুব সম্ভবত বোনের জন্য বিয়ে আটকে দিয়েছে তারিফ। সেই ক্ষনে তারিফ আলতো সুরে বলল,
‘ মুশি আমার খুব আদরের বোন, মৌ! আমার বিয়েতে আমার বোনটা থাকবে না। আমার মুশিকে ছাড়া বরযাত্রী নিয়ে বিয়ে করতে যাব, এটা আমি ভাবতেই পারছি না। আমার বোন, বোনজামাই আমার ফ্যামিলির একটা অংশ। ওদের ছাড়া আমার ফ্যামিলি কমপ্লিট হবে না। আমি ইনকমপ্লিট ফ্যামিলি নিয়ে বিয়ে করতে যেতে পারব না। সব ঠিক হলে তবেই বিয়ে করব। এন্ড তোমাকেই করব।’ কী ভীষণ তেজস্বী স্বর!

জাওয়াদ চমকাল। অভিভূত হলো এক ভাইয়ের পাগলামো দেখে। বোনের জন্য গোটা একটা বিয়ে ভেঙে দিচ্ছে! আসোলেই মুশরাফা ভাগ্যবান, তারিফের মতো ভাই পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

জাওয়াদ পা বাড়াল। উঁকি দেয়া বা আড়িপাতাকে ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জাওয়াদের মনে পড়ল দুটো হাদিস।
সাহল ইবনে সাদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
এক ব্যক্তি নবী (সাঃ)-এর ঘরের দরজা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিলো। নবী (সাঃ) তখন লোহার একটি চিরুনী দিয়ে তাঁর মাথা আচড়াচ্ছিলেন। নবী (সাঃ) তাকে দেখে বলেন, আমি যদি জানতে পারতাম যে, তুমি (উঁকি মেরে) আমাকে দেখছো, তাহলে আমি এই চিরুনী দিয়ে তোমার চোখে আঘাত করতাম। (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ)

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সাঃ) বলেনঃ যদি কোন লোক তোমার ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে দেখে এবং তুমি তার প্রতি কংকর নিক্ষেপ করো, তা তার চোখে বিদ্ধ হলে তাতে তোমার কোন দোষ হবে না। -(বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ, আহমাদ)’

বিনা অনুমতিতে কারো ঘরে প্রবেশ, ব্যক্তিগত আলাপে আড়িপাতা, কারো ঘরে উঁকি দেয়া নিষেধ ইসলাম। ভদ্রতার বিচারে ও ভীষণ খারাপ কাজ এগুলো। ব্যক্তিত্বকে নিচু প্রমাণ করে। শুনবার ইচ্ছে হলেও জাওয়াদ দাঁড়াল না। চলে গেল রুমে। তারিফ প্রেয়সীকে বুঝিয়ে যাচ্ছে। বিয়ের হাজারো জল্পনা কল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় কেঁদেকেটে, রেগেমেগে একাকার মৌ। ওকে সান্ত্বনা দেবার জন্য তারিফ বলল,
‘তুমি জাস্ট আমায় বুঝো। আর কিছুই লাগবে না। একটা কাজ করো, তোমার ফ্রেন্ডসদের নিয়ে ট্রিপ প্ল্যান করো। আমি স্পন্সর করব। চিল করো, এদিকে সবটা ঠিক হলে আমি বলব, তখন ফিরে এসো। প্লিজ শান্ত হও মৌ! ‘


আঞ্জুমান ভিলার পরিবেশ থমথমে। ড্রয়িংরুমে বসে আছেন তোফাজ্জল হোসেন। সম্পর্কে, তারিফের হবু শ্বশুর। চোয়ালে রাগ, কপালে বিরক্তি। পাঁচদিন বাদে বিয়ে। বিয়ের সব এরেঞ্জমেন্ট, রিলেটিভ ইনভাইটেশন সব শেষ। এদিকে জামাই ফোন দিয়ে জানাচ্ছে তার পক্ষে এই মুহুর্তে বিয়ে করা সম্ভব নয় । কলটা দু’দিন আগে গিয়েছে। শুনেই কপালে ভাঁজ পড়ল তোফাজ্জল হোসেনের । একমাত্র মেয়ের বিয়ে। হাজার লোক দাওয়াত দেয়া শেষ, লক্ষ লক্ষ টাকার খরচ হয়ে গেছে। এখন বিয়ে না হলে মানসম্মান কিছু থাকবে! প্রথমে তিনি ঠান্ডা মাথায় বুঝানোর চেষ্টা করেছেন, কালকের পুরো দিন সময় নিয়েছেন। তারিফকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু ছেলের এক কথা, সে এখন বিয়ে করবে না। একমাস পরে করবে। কেন করবে না? কারণ তার ফ্যামিলি প্রবলেম। কী সমস্যা সেটাও বলছে না। ওই কলের পর ফোন বন্ধ। কী সমস্যা জানতে সকাল সকাল এসে হাজির হয়েছেন তিনি।

ফারুকীর চোখমুখ ফ্যাকাসে। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। ছেলের এই পাগলামোর কারণ জানলেও মানতে পারছেন না তিনি। সব এরেঞ্জমেন্ট শেষ এখন এ কী পাগলামো! সিলেট যাবার দিন যে কথা হলো, তারপর আর কথা হয়নি সেভাবে। তারিফ, জায়ফা দুজনের ফোন বন্ধ। কোন খোঁজ নেই। চিন্তায় অস্থির তারা। সিলেটে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন তারা সিলেট ছেড়ে গেছে। কোথায় আছে, কীভাবে আছে কোন খোঁজ নেই। তারপর দুদিন আগে তোফাজ্জলের মতো তারাও একটা ফোন পেয়েছেন। যাতে তারিফ স্পষ্ট তার মতামত জানিয়েছে, মুশিকে না মানা অবধি সে বাড়ি ফিরবে না বিয়ে ও করবে না।

তারপর আবার ফোন বন্ধ। ট্রেস ও করা যাচ্ছে না। কাল থেকে প্রোগ্রাম শুরু, আত্মীয় স্বজন আসতে শুরু করেছে। কী জবাব দিবেন! মানসম্মান সব গেল! এমন পাগলামোর মানে হয়! নিজেরাই বুঝ পাচ্ছেন না, বেয়াইকে কী বুঝ দিবেন ভেবে পেলেন না ফারুকী! তারিফ গোপনীয় নাম্বার থেকে কেবল মৌ এর সাথে যোগাযোগ করছে। আর কেউ তাকে ধরতে পারছে না। সবাই অনবরত তারিফকে চেষ্টা করছে। কিন্তু নাগালে পাচ্ছে না। ফারুকী জায়ফাকে কল দিলেন তাও বন্ধ। কল গেলে ট্রেস করে নিজে গিয়ে হাজির হবে। তারপর কান টেনে নিয়ে আসবেন ছেলেকে।

তোফাজ্জল সাহেব রাগারাগি করে চলে গেলেন। হুমকি দিলেন, তারিফ দু’দিনের মধ্যে না এলে তিনি অন্য ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিবেন।

চোখে সর্ষে ফুল দেখলেন ফারুকী। রেগেমগে আগুন। পারলে ছেলেকে এখুনি খু/ ন করেন। ফোর্স লাগিয়ে দিয়েছেন ছেলেকে খুঁজে আনতে।

ফারুকীর চোয়ালে রাগ থাকলেও লায়লার চোয়ালে রাগ নেই। তিনি বিমর্ষ হয়ে আছেন। তার খুব একটা ভাবাবেগ হচ্ছে না। যেন তিনি ও চাইছেন বিয়েটা এখন না হোক। মুশরাফার ভিডিও দেখবার পর মানসিক শান্তি উবে গেছে তার। তারপর চিন্তায় ঘুম উবে গেছে। মেয়েটাকে এক পলক দেখবার জন্য মন চটপট করছে। কিন্তু ছেলে মেয়েগুলোও উধাও। কারও মাধ্যমে দেখতে পারছেন না। মায়ের মন কাঁদছে বারবার। লায়লা একবার মুশরাফার নাম্বার ডায়াল করেছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মুশরাফার ফোন ও তখন বন্ধ পাওয়া গেছে। চার্জহীনতায় বন্ধ হওয়া টের পেলেন না, তিনি ধরে নিলেন সব ছেলের চক্রান্ত।

লায়লা দুঃখ ভারাক্রান্তে ভাবতে বসলেন। নাজমুল সাহেব থেকে শুরু করে সবাইকে জিজ্ঞেস করা শেষ কেউ জানে না ওরা এখন কোথায়। সবাই জানে সিলেট গেছে। তারপর আর কথা হয়নি। ভাবতে ভাবতে লায়লার মনে পড়ল জাওয়াদের কথা। আচ্ছা, ছেলেটাকে বললে ছেলেটা কি দেখাবে এক পলক তার মেয়েকে? তার কাছে ফিরতে দিবে? লায়লা এক বুক আশা নিয়ে বিয়ের সময় নেয়া জামাতার নাম্বারটা ডায়াল করলেন প্রথমবার। দ্বিতীয়বার রিসিভ হলো। জাওয়াদ ‘হ্যালো’ বলতেই লায়লা বললেন, ‘জাওয়াদ বলছো?’
‘জ্বি, আপনি কে বলছেন?’

নিজেকে মুশরাফার মা দাবি করতে পারলেন না লায়লা। ভীষণ অপরাধবোধ হলো তার। তিনি তো মা হয়েও হন নি! তিনি ধীরে বললেন,
‘লায়লা আঞ্জুমান। ‘

জাওয়াদ অমনোযোগী ছিল। তৎক্ষনাৎ মনে পড়ল না শ্বাশুড়ির নামখানা। অস্ফুটে বলল, ‘কোন লা…

আকস্মিক থেমে গেল। নামের মানুষটাকে স্মরণে আসতেই কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল ফোনের দিকে। এই মহিলা তাকে কল করেছে!

লায়লা মুখ থেকে আনমনাই বেরিয়ে এলো, ‘ আমি রাফার মা।’
বলেই লায়লা চমকালেন বেশ! এই পরিচয়টা নতুন তার কাছে। কতকাল কাউকে এভাবে পরিচয় দেয়া হয়নি। হঠাৎ যেন স্মরণে এলো, মুখে এলো। গলাটা কাঁপল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here