#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি।
#দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-২৩)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।
‘মা’ এক অক্ষরের ছোট্টো একটি শব্দ। কিন্তু এর গভীরতা এক সমুদ্র। ক্ষুদ্র এই শব্দের মাঝে জড়িয়ে আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মমতা, ভালোবাসা, আবেগ। মা মানেই আগলে রাখা একটি কোল, মা মানেই সুখের এক গাঢ় ছায়া। মা মানেই এক বুক মায়া। মা মানেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। মা মানেই দুঃ/খব্যাথায় আস্ত একটা সান্ত্বনা। মা মানেই মাথার উপর একটা ভরসার হাত। দূর থেকে মায়ের পানে চেয়ে মায়ের সংজ্ঞা আওড়াল মুশরাফা। বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস নামল। মন বলে উঠল, ‘আমার মায়ের সংজ্ঞাটা ভিন্ন কেন? আমার মা নি/ষ্ঠুর না কি আমিই সন্তান হিসেবে অযোগ্য? অযোগ্যই হবো হয়তো, নয়তো কোন মা তার সন্তান সামনে আসবার পর ও একটাবার কোমল চোখে তাকান না, হেসে দুটো কথা বলেন না, আলতো হাতে বুকে টেনে নেন না? কোন মা’ই করেন না এমন। কেবল আমার মা করেন। মায়ের একটু স্নেহের জন্য মনটা তৃষ্ণার্ত হয়ে ছিল। আজ মাকে দেখবার পর তা যেন বেড়ে গিয়েছে দিগুণ। এই মানুষটাকে সে অকারণেই অসীম ভালোবাসে, হাজার ঘা’য়ের পরও সেই ভালোবাসা কমেনা। মায়ের স্নেহ পাবার আকাঙ্খা ও থাকে অবিচল। সেই আকাঙ্ক্ষা, সেই ভালোবাসা সবাই টের পায়, কেবল যার শানে তার এত আয়োজন সে টের পায় না। হয়তো তিনি টের পান না, হয়তো বা তিনি টের পেতেই চান না। হয়তোবা।
বিয়ের পর মায়ের সাথে আর দেখা হয়নি। মাস সাতেক পর আজ দেখা হলো। তার ফ্যাশন-সচেতন মায়ের শরীরের আজ অসুস্থতার ছায়া, মুখটা ভেঙে গেছে। তিনি কি অসুস্থ? মুশরাফার ইচ্ছে হলো মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে, মা তোমার কী হয়েছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
কিন্তু সে পারছে না, বাস্তবতার শি/কলে বা/ধা সে। কল্পনায় অনেক কিছু পারলেও বাস্তবতায় অনেক কিছুই করা যায় না, পারা যায় না। মুশরাফা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ সরাল। চাপা সেই শ্বাস জং ধরা কষ্টরা বেরিয়ে এলো যেন। কী চাপা আ/র্তনাদ! কী নিদারুণ ক/ষ্ট! আহ্! ধরণী এত কঠিন কেন! মা’হীনতাত অনুভূতি এত ক/ষ্ট কেন! ওর দুঃখবিলাসী মুহুর্তে পাশ থেকে একটা স্বর ভেসে এলো,
‘ অবশ্যই তুমি পাবে, যা তোমার থেকে চলে গেছে, তার চেয়ে ও উত্তম। (আনফাল -৭০)’
পরিচিত স্বরটা কানে এসে ধাক্কা লাগতেই ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল মুশরাফা। জাওয়াদের কোমল চাহনি এসে লাগল চোখে। জাওয়াদ খেয়াল করছিল এতক্ষণ! মুশরাফা কিঞ্চিৎ অবাক হলো। তীর্যক চোখে চেয়ে দৃষ্টি ফেরাবার সময় জাওয়াদ আশ্বাসী সুরে আবার বলল,
‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকিল, নি’মাল মাওলা ওয়া নি’মান-নাসির।
অর্থ্যাৎ, আল্লাহ তাআলাই আমাদের জন্য যথেষ্ট, তিনিই হলেন উত্তম কর্মবিধায়ক; আল্লাহ তাআলাই হচ্ছে উত্তম অভিভাবক এবং উত্তম সাহায্যকারী। ‘
কুরআনের আয়াতের চেয়ে উত্তম মোটিভেশান পৃথিবীতে দুটো নেই, কারণ তা স্বয়ং আল্লাহ বলেছেন। আল্লাহর বাণী শুনলেই মনের অমাবস্যা আর ঠায় হয়না। মুশরাফার মন থেকে হতাশা দূর হতে শুরু করেছে। ওর প্রসন্নতার মাত্রা বাড়াতে জাওয়াদ ওর হাত ধরে কোমল স্বরে বলল, ‘ আমার রাফা আল্লাহর উপর বিশ্বাস করে। অল্পতে হতাশ হওয়া তার স্বভাব নয়। আমার রাফা ধৈর্য ধরে আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিদান নিতে অভ্যস্ত। ‘
‘আমার রাফা আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখে। আমার রাফা ধৈর্য ধরে আল্লাহ কাছ থেকে প্রতিদান নিতে অভ্যস্ত। ‘ কী চমৎকার শুনাল কথাগুলো। ‘আমার রাফা’ শব্দ দুটো ঝঙ্কার মতো বাজল কানে। এভাবে তো বলে নি কখনো জাওয়াদ। মুশরাফার মনটা প্রসন্নতায় ভরে উঠল, মনে সাহস এলো। আগের স্বরূপে ফিরল। নিকাবের নিচে ঠোঁট জোড়ায় চওড়া হাসির রেখা বসল। নিকাবের ফাঁকে চোখ হাসল। আল্লাহর উপর ভরসা আর জমিনে এমন একজন সঙ্গী থাকা মানে মন খারাপ হওয়া বারণ, সুখী হওয়ার অযথা কারণ। বিয়ের পরের দু/র্বিষহ ক/ষ্টের বিনিময়ে সৃষ্টা জাওয়াদকে এত চমৎকার সঙ্গী হিসেবে ওর কাছে পেশ করেছেন। মা’হীনতার কষ্টটা যেন তৎক্ষনাৎ মন থেকে সরে গেল। দুষ্টু হেসে আওড়াল,
‘আপনার রাফা!’
ওর দুষ্টুমি ভরা স্বর শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জাওয়াদ। ওর হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘নাহ, আমাদের বিল্ডিংয়ের নাইনথ ফ্লোরের আঙ্কেলের রাফা।’
মুশরাফা ভেবেছিল জাওয়াদ স্বীকারোক্তি মূলক একটা বাক্য ছুঁড়বে আর সে জব্দ করার ফন্দি আঁকবে। এখন দেখল, জাওয়াদকে জব্দ করতে গিয়ে নিজেই জব্দ হয়ে গেল। মুশরাফা কপট রেগে বলল,
‘আমি উপর তলার আঙ্কেলের? নিজের বউকে কেউ অন্যের বলে?’
জাওয়াদ ওর রাগ দেখে হাসল। মুখে যত ইচ্ছে রাগুক, কিন্তু মলিনতা না টানুক। এটা খুব পোড়ায় জাওয়াদকে। জাওয়াদ ঠোঁট চেপে হেসে বলল, ‘কেউ না বললেও আমি বলি।’
মুশরাফা চোখ রাঙাল, ‘ কী খারাপ আপনি!’
জাওয়াদ হাসতে হাসতে বলল, ‘আমি খারাপ আর তুমি বোকা।’
বলে উঠে দাঁড়াল। ডাক্তার চেকাপ করছেন। কেবিনের বাইরে জটলা বেধে অপেক্ষা করছে সবাই। চারদিকে চোখ বুলিয়ে জাওয়াদ ফরিদার উদ্দেশ্যে বলল,
‘মা, বাবা এসেছেন মামাকে দেখতে। নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি উনাদের আনতে যাচ্ছি। আমি আসা অবধি আপনি কি রাফার খেয়াল রাখতে পারবেন?’
ফরিদা তৎক্ষনাৎ বললেন, ‘যাও, আমি আছি।’
অমূল্য রতন আমানত রাখবার মতন করে জাওয়াদ বলল, ‘রেখে যাই তাহলে। আমার জাস্ট পাঁচ মিনিট লাগবে। এই পাঁচ মিনিটে এমন কিছু যেন না হয়, যে আমার রাগ করতে হয়।’
জাওয়াদের কথার ইঙ্গিত বুঝে হাসলেন ফরিদা, ‘ আমি আছি,যাও তুমি।’
জাওয়াদ পা বাড়াল। কয়েক কদম এগিয়ে আবার পিছু ফিরে চাইল। স্ত্রীকে এই ভয়ানক মানুষগুলোর মাঝে রেখে যাবার ইচ্ছে হচ্ছে না ওর।
ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে জাওয়াদকে পরখ করছিল তারিফ। ইতঃপূর্বের সাক্ষাতে জাওয়াদকে রাগী, বে/য়াদব ছাড়া কিছুই মনে হয়নি তারিফের। জাওয়াদের আচরণ দেখে বোনের জীবন নিয়ে চিন্তার ভাজ পড়েছিল তার কপালে। সেদিন ওর সামনে বোনকে ওভাবে ধ/মকাতে দেখে তারিফের কেবলই মনে হতো মুশরাফা জাওয়াদের কাছে সুখী নেই। যেই ছেলে বাইরের মানুষের সাথে এত দুর্ব্যবহার করে, সে ঘরের মানুষের সাথে কেমন ব্যবহার করবে তা তারিফ অনুমান করতে পারে। সে নিশ্চিত হয়,পরিবারহীন মেয়েটার উপর ছেলেটা অ/ত্যা/চার করে, গায়ে ও হাত তুলে হয়তো। তার ভাবনা, ওর পরিবার নেই, কেউ বিচার করবার নেই। আপন মানুষ না থাকায় মুশরাফা ও সব সহ্য করে আসছে। আর যাই হোক ওদের সম্পর্কে সম্মান নেই। এই ভাবনা ওকে মুশরাফার দিকে আরও বেশি ঠেলছিল। বোনটাকে জাওয়াদের কাছ মুক্ত করে পরিবারের ফিরিয়ে আনবার তাড়াই বেশি ছিল। তার বোনটা বাবার বাসায় কষ্ট পেয়েছে, এখন স্বামীর বাসায় ও কষ্ট পাচ্ছে। অবহেলিত হচ্ছে। নাহ্, এমনটা হতে দেয়া যাবে না। তার অবুঝপনায় মুশি অনেক কষ্ট পেয়েছে, ভাই হয়ে ও সে এড়িয়ে গেছে। খেয়াল রাখেনি। এবার খেয়াল রাখবে, মুশির জীবনের সব কষ্ট ভুলিয়ে তাকে নতুন জীবন দিবে। আজ হাসপাতালে দেখবার পরে তারিফ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, আজই মুশরাফাকে নিয়ে যাবে বাসায়। বে/য়াদব ছেলেটার কাছে আর যেতেই দিবে না।
কিন্তু আজ জাওয়াদ সম্পর্কে ধারণা বদলে গেছে, বদলে গেছে বোনের সুখ সম্পর্কে ও। স্ত্রীর সামান্য অপমানে জাওয়াদের রুদ্ররূপ ধরে প্রতিবাদ করেছিল, হুমকি দিয়েছিল জাওয়াদের মুখখানা দেখে একমুহূর্তের জন্য ও নিজেই ভয় পেয়েছে। এত ভ/য়ংকর দেখাচ্ছিল ছেলেটাকে, সাফার দিকে যে-ভাবে তাকিয়েছে পারলে চোখ দিয়েই মে / রে ফেলে। এত মানুষের সামনে নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছে, রাফা তার স্ত্রী। তার স্ত্রীকে অপমান অধিকার সে নিজেকে ও দেয়নি। সাফার সাহস কিভাবে হয় ওকে অপমান করার? সে যেন এই সাহস না করে।’
জাওয়াদের রূদ্ররূপে তারিফ রাগের সাথে স্ত্রীর জন্য ভালোবাসা ও দেখেছে। স্ত্রীকে সব কষ্ট থেকে আগলে রাখবার শপথ যেন ভেসে উঠছিল। এমন শাসন, হুমকি, স্বীকারোক্তি সবাই দিতে পারে না। সেই দিতে পারে যার মাঝে ভালোবাসাবোধ আছে। জাওয়াদের রুদ্ররূপ প্রমাণ করেছে, ছেলেটা তার বোনকে আগলে রাখে। তারপর যখন মুশরাফা ওকে আটকাতে গেল। তারিফ স্পষ্ট দেখেছে মুশরাফা ওর হাত খামচে ধরবার পর জাওয়াদের আকস্মিক শান্ত হয়ে যাওয়াটা। মুশরাফা চোখে চোখে কী কথা হয়েছে কে জানে, তারপর জাওয়াদের থমকে গিয়েছিল। জাওয়াদের রুদ্ররূপ স্ত্রীর কাছে গিয়ে কোমল হয়ে গিয়েছে। সাফার সাথে বলা রাগত্ব, উচ্চস্বরটা আকস্মিক নিচু হয়ে শীতল হয়ে গিয়েছিল। একসময় থেমে গিয়ে অন্যপথে পা বাড়িয়েছিল। মুশরাফা হাত ধরায় জাওয়াদের থেমে যাওয়া দেখে তারিফ স্পষ্ট বুঝেছিল ছেলেটা স্ত্রীকে সম্মান করে, স্ত্রীর কথা শুনে। তার রাগটা বাইরের সবার কাছেই, স্ত্রীর কাছে সে কোমল। স্ত্রীর অপমানেই সে ক্ষুব্ধ, নয়তো সে শান্ত।
তারপর যখন মুশরাফার বোরকা আটকে গেল, জাওয়াদ নিজেই ঠিক করে দিল তখন তারিফ বুঝে নিয়েছিল জাওয়াদ মুশরাফার পর্দাকে তাদের মতো কটাক্ষ করে দেখে না, সে সম্মানের সাথে দেখে, মানে। স্ত্রীর পর্দাকে সমর্থন করে। তারপর যখন ওরা চেয়ারে কথা বলছিল। কথার মাঝে আকস্মিক জাওয়াদ হেসে উঠেছিল, চোখ হাসছিল মুশরাফার ও। দুজনের খুনসুটির মুহুর্তে ভীষণ সুখী দেখাচ্ছিল ওদের, ভালোবাসা ও উঁকি দিয়েছে। সেই দৃশ্য দেখে তারিফ বুঝেছিল দুজনার মাঝে সুখ এবং ভালোবাসা ও আছে। জাওয়াদকে সে যেমন ভেবেছে সে তেমন হয়, জাওয়াদ কোমল, প্রণয়ী, সম্মানদাতা।
নিজের ভাবনার হার হলো তারিফের। তবুও তার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে, মনে শীতলতা, স্বস্তি। একটা ভাইয়ের জন্য নিঃসন্দেহে এটা সুখের খবর। তারিফ বিড়বিড় করল, যতটা ভেবেছিলাম, ততটাও খারাপ নয় ছেলেটা। ভালোই। জাওয়াদকে পরখ করবার মাঝেই ওর পিছু ঘুরে স্ত্রীকে দেখার দৃশ্য দেখে হাসি পেল ওর। গিয়ে বলতে ইচ্ছে করল, ‘ওকে আগলে রাখার জন্য এই মহলে তোমার ছাড়া আরও এক পুরুষ আছে, যে তার বোনের অসম্মান হতে দিবে না। মুশির ভাই থাকতে তোমার চিন্তিত হবার কারণ নেই। তারিফ তার মুশিকে আগলে রাখবে, নিশ্চিন্তে যাও।
কিন্তু বলতে পারল না, কী যেন বাধল তাকে।
জাওয়াদ মা বাবাকে নিয়ে ফিরল কিছুক্ষণ পরেই। করিডোরে লায়লাকে দেখে মায়মুনা অবাক হলেন। উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন, ‘তোর শ্বাশুড়ির সাথে মুশরাফার দেখা হয়েছে? কথা হয়েছে? ওই বদ মহিলা কিছু বলেছে আমার বউমাকে?’
জাওয়াদ হাসল,
‘বদমহিলা তোমার বউমাকে কিছু বলেনি।
মাকে দেখে তোমার বউমা আবেগে আপ্লূত হয়ে মন খারাপের থালা নিয়ে বসেছে। ‘
মায়মুনা ক্ষুব্ধ হলেন,
‘কোথা থেকে এই গন্ডারের চামড়াওয়ালা মেয়ে এনেছিস? শোধবোধ নেই। আমি হলে ফিরে ও তাকাতাম না। ‘
জাওয়াদ হাসল। প্রতিবার করল না। কিছু মুখভঙ্গি সুন্দর, ভালোবাসায় আবৃত। মায়মুনা গিয়ে ফরিদার সাথে কুশল বিনিময় করে পুত্রবধূর কাছে গেলেন। মুশরাফা মায়ের মুশরাফা তখন নিশ্চুপ বসে আছে। হাসছে না, কাঁদছে ও না। মনটা খানিকটা প্রফুল্ল হলেও চোখে প্রকাশ পাচ্ছে না। মায়মুনা ওর নিরবতাকে বিষন্নতাই ধরে নিলে। পাশে গিয়ে প্রশ্ন করলেন,
‘ এভাবে বসে আছো কেন?’
মায়ের শূন্যতা না কি অন্য কিছু কে জানে, মায়মুনাকে কাছে পেয়েই মুশরাফা উনাকে জড়িয়ে ধরল। বোধহয় এক মায়ের অভাবটা অন্যমাকে দিয়েই পূরণ করতে চাইছিল। মায়মুনা ছেলের পানে চাইলেন। জাওয়াদ মাকে ইশারায় বলল, ‘মাকে মনে পড়ছে ওর।’
মায়মুনা এই ক্ষণে গভীর মমতা অনুভব করলেন পুত্রবধুটির জন্য। আবেশে আগলে নিলেন। মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আলিঙ্গন ছেড়ে বসালেন চেয়ারে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ মন খারাপ করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ঠিক হয়ে যাবে’ বলে মায়ের বদলে একটা মা’ই উপহার দিলেন মায়মুনা। মুশরাফা গভীর মনে শ্বাশুড়ির মাতৃত্ব রূপ উপভোগ করল। মনটা ভরে এলো। শ্বাশুড়িমাকে ও পেয়ে গেছে সে। শ্বশুরপক্ষের অপূর্ণতা গুলো পূর্ণতা হয়ে ধরে দিয়েছে একে একে। অপূর্ণতা হয়ে রয়ে গেছে কেবল বাবার পক্ষ। তা বোধহয় পূর্ণতা পাবে না। চাপা শ্বাস ফেলে বলল, ‘এত কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন? ভিডিও কলে মামীর সাথে কথা বলে নিলেই পারতেন।’
মায়মুনা বললেন, ‘ ভাইসাহেব থেকে মেয়ে চেয়ে নিয়েছি ঘরে। উনি এখন প্রধান কুটুম আমাদের। ওসব কল টলে কী আর আত্মীয়তা রক্ষা হয়? ‘
মুশরাফা শ্বাশুড়ির কথায় হাসল। নম্র স্বরে বলল, ‘ ইফতার করেছেন, মা?’
‘ ইফতার করে বেরিয়েছি। তুমি করেছো? ‘
‘হ্যাঁ, উনি ইফতার এনেছেন।’
নাজমুল সাহেবকে দেখে পুত্রবধুর কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন জয়নাল আবেদীন। মুশরাফা হেসে সালাম দিল,
‘আসসালামু আলাইকুম বাবা।’
জয়নাল আবেদীন প্রসন্ন হাসলেন। স্নেহের সুরে বললেন, ‘কেমন আছো, মা?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ। বসুন বাবা।’ বলে নিজের সিট ছেড়ে দিল। শ্বাশুড়ির হাতের দিকে নজর গেল। আঙুলে ওয়ান টাইন ব্যান্ডেজ বাধা দেখে উদ্ধিগ্ন হয়ে বলল, ‘আপনার হাতে কী হয়েছে মা?’
‘আজ তরকারি কাটতে গিয়ে কেটে গেছে।’ ধীরে বললেন মায়মুনা। মুশরাফা হাত নিজের কাছে এনে দেখল।
তারপর আফসোসের সুরে বলল,
‘ইশ! কদ্দুর কেটে গেল! আল্লাহ ভালো করুক। কাল থেকে যা রান্না করার আমাকে বলবেন, আমি রেঁধে দিব। আপনার রান্নাঘরে যাবার দরকার নেই। ‘
মুশরাফার চট করে কী যেন মনে পড়ল, তড়িৎ ডেকে উঠল, ‘ মা?’
ডাকটা একটু জোরেই শোনা গেল। দূরে বসা লায়লার কানে গিয়ে বাজল। চমকে তাকালেন লায়লা। মুশরাফা তাকে ডাকছে! তার অবচেতন মন যেন তাকেই ডাকার সঙ্কেত দিল। ডাকটা ভেতরে ঝঙ্কার তুলে দিল, কতদিন পর! ঠিক তখনই মায়মুনা জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, বলো।’
মুশরাফা ও কী যেন বলল। মায়মুনা জবাব দিলেন। লায়লার বোধগম্য হলো মুশরাফা তাকে নয় অন্য কাউকে ডেকেছে। মেয়ের জীবনে এখন তিনি ছাড়া আরও মা আছেন। মেয়ের মুখে অন্য কারো উদ্দেশ্যে ‘মা’ সম্বোধন শুনে ভ্রু কুঁচকে এলো তার। মায়মুনাকে করা মুশরাফার যত্ন দেখে তার মনে কোণে এক কোণ নড়ে উঠছিল। এসব তো তার পাওয়ার কথা ছিল। মায়মুনার দায়িত্ব তো তার পালন করার কথা ছিল। লায়লা স্থির চোখে পর করে গেলেন মুশরাফার বউ শ্বাশুড়ির খুনসুটি। অক্ষিকূটে ঈষৎ ঈর্ষা দেখা গেল তার।
মুশরাফা জাওয়াদের তখনকার অমীমাংসিত কথার সূত্র ধরে শ্বাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলল, ‘মা আমাদের বিল্ডিংয়ের নয়তলায় কে থাকে?’
জাওয়াদ ঠোঁট চেপে হাসল। মায়মুনা বললেন, ‘ আমাদের উপরেই তো ছাদ। ছাদে কে থাকবে? কেউ থাকে না। কেন?’
মুশরাফা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এতক্ষণে জাওয়াদের ‘বোকা মেয়ে’ কথার সারমর্ম বুঝতে পারল। তড়িৎ তাকাল জাওয়াদের দিকে। জাওয়াদ হাসছে। লোকটা জেনেশুনে ওকে ধাঁধায় ফেলেছে! বাবা অন্যদিকে যেতেই জাওয়াদ ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
‘ খালি ছাদে জ্বিন থাকে। তুমি তবে জ্বিন আঙ্কেলের।’
মুশরাফা চোখ ছোটো ছোটো করে বলল, ‘আপনি জেনেশুনে বলেছেন, তাই না?’
জাওয়াদ ও প্রশ্রয়ের সুরে বলল, ‘কেউ থাকলে বলতাম না। আমি আবার এত উদার নই।’
মুশরাফা রাগ দেখাতে গিয়েও হেসে ফেলল। কৌতুকেও তার অধিকার ছাড়বে না।
এশার আযান পড়বার পর জাওয়াদ ফরিদার উদ্দেশ্যে বলল,
‘ কাল থেকে সবার উপর অনেক ধকল গিয়েছে। ফাবিহা আপুরা ও এতদূর থেকে এসে সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করেছেন। মামী আপনি সবাইকে নিয়ে বাসায় চলে যান।’
ফাবিহা বলল, ‘ না, আমরা সবাই চলে গেলে বাবার কাছে কে থাকবে?’
জাওয়াদ তড়িৎ উত্তর দিল, ‘আমি থাকব। আপনারা যান। ফাইজাকে ও নিয়ে যান, মেয়েটা কাল থেকে কান্নাকাটি করে অসুস্থ হয়ে গেছে। না খেয়ে রোজা রেখেছেন সবাই, রেস্ট না নিলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’
ফরিদা ভ্রু কুঁচকালেন, ‘ সবার চেয়ে পরিশ্রম তোমার হয়েছে। কাল রাত থেকে দৌড়াদৌড়িতে আছো। তোমরা সবাই বাসায় চলে যাও। আমি থাকব হাসপাতালে। ‘
জাওয়াদ হাওয়ায় উড়িয়ে দিল, ‘ আমার কোন সমস্যা হবে না। আমি একাই মামার দেখাশুনা করতে পারব। আপনারা বাসায় চলে যান। ‘
কাল মাঝরাতে বাবা অসুস্থতার খবর শুনে গ্রাম থেকে শহরের পথে রওনা দিয়েছে। সাত ঘন্টা জার্নি করে এসেছে। ঘুম হয়নি, এসে ও দৌড়াদৌড়ি করেছে। না খেয়ে রোজা রেখেছে। ক্লান্তি আর দুর্বলতায় শরীরটা নুয়ে আসছে ফাবিহা- রেদোয়ানের। এখন একটু বিশ্রামের সত্যি দরকার। না হলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। এই ভেবে ফাবিহারা রাজি হলেন। সাফা জায়ফাকে নিয়ে চলে গেছে বাসায়। লায়লা আর তারিফ তখনো হাসপাতালে আছে। হাসপাতাল থেকে লায়লার বাসার দূরত্ব বেশ। দু’ঘন্টার পথ। আজ ফিরে আবার কাল সকাল ফেরাটা অনেক কঠিন হয়ে যাবে ভেবে লায়লা সিদ্ধান্ত নিলেন ভাইয়ের বাসায় যাবেন। ফরিদা সহজে রাজি হলেন না। জাওয়াদ জোর করলে রাজি হলেন। রাতেই আবার ফিরে আসবেন বলে রাখলেন।
যাবার কালে ফাবিহা বলল, ‘ রাফাকে আমাদের সাথে নিয়ে যাই। কাল সকালে চলে আমাদের সাথে চলে আসবে না হয়?’
জাওয়াদের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করল ফাবিহা।
জাওয়াদ উত্তরের ভারটা স্ত্রীর উপর তুলে দিল। মুশরাফার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ তুমি গেলে যেতে পারো, যাবে?
মুশরাফা জাওয়াদের পানে তাকাল। জাওয়াদের চোখ যেন বলে উঠল, তোমার ওখানে যাওয়াতে আমার কোন সমস্যা নেই। তবে হ্যাঁ, তোমার মায়ের উপস্থিতিতে তুমি থাকলে আমার ভীষণ চিন্তা হবে, আমি শান্তিতে থাকতে পারব না। আরেকটা কথা, আমি যদি কোনভাবে জানতে পারি যে, তোমার মা তোমাকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ অপমান করেছে তবে আমি তোমার মায়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে দু’বার ভাবব না।’
জাওয়াদের চোখের ভাষা পড়ে নিয়ে মুশরাফা চোখ ফেরাল। ইচ্ছেদের দমিয়ে ধীর স্বরে বলল, ‘বাসা শিফট করেছি তো, সব এলোমেলো হয়ে আছে। বাসা গোছাতে হবে। আমি বরং বাসায় চলে যায়। কাল সকালে আসব আবার।’
ফাবিহা আবার জোর করতে গেলে জাওয়াদই বলল, ‘ গত কদিন বাসা শিফটিং এ অনেক ধকল গেছে ওর উপর। ওর বিশ্রাম দরকার। আপনাদের বাসায় অনেক মানুষ, থাকার জায়গা নিয়ে ও প্রবলেম হবে। তারচেয়ে ভালো ও মা বাবার সাথে বাসায় চলে যাক। প্রফার রেস্ট নিতে পারবে। আপনারা চলে যান।’
উপস্থিত মহলের বুঝতে বাকি রইল না মুশরাফার না যাবার কারণ লায়লার উপস্থিতি। ব্যাপারটা ঘা বসাল লাগল লায়লার বুকে। মায়ের ভয়ে মেয়ে মায়ের সাথে থাকতে চাইছে না! সাধারণত মেয়েরা মায়ের কাছে থাকতে চায়, মায়ের কাছ ছেড়ে যেতে চায় না। আর তার মেয়ে তার কাছেই যেতে চাইছে না! মেয়ে তাকে ভয় পায়? পৃথিবীতে মানুষ সবচেয়ে বেশি নিরাপদ বোধ করে মায়ের কাছে। আর তার মেয়ে তার কাছে সবচেয়ে অনিরাপদ মনে করে? তার প্রতি মেয়ের দ্বিধা কাজ করে? এই ভয়, দ্বিধা, অনিরাপত্তা শব্দটা তিনটি তার মাতৃত্বের আঘাত করল, তিনি মানতে পারলেন না কেন যেন।
এতগুলো বছর পর এই ক্ষণে এসে প্রথমবারের মতো মনে হলো তিনি মায়ের সংজ্ঞা ধরে রাখতে পারেন নি। মাতৃত্বকে লালন করতে পারেন নি।
জাওয়াদ হাফ ছেড়ে বলল, ‘তবে তাই হোক। মা বাবার সাথে রাফা আমাদের বাসায় চলে যাক। মামী, বাকিদের নিয়ে বাসায় চলে যান। আমি হাসপাতালে একা থাকব।’
মুশরাফা তড়িৎ বলল, ‘ একা থাকলে নামাজ পড়বেন কিভাবে?’
জাওয়াদ খানিক ভেবে বলল, ‘কেবিনে পড়ে নিব।’
আকস্মিক তারিফ বলে উঠল, ‘ আমি হাসপাতালে থাকব।’
মুশরাফা চমকে তাকাল। এই দা-কুমড়া একসাথে থাকলে কী হবে ভেবেই কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল। বাসায় গিয়ে ও দু’দন্ড শান্তি পেল না। কেবল মনে হলো জাওয়াদ তারিফকে একা পেয়ে নাস্তানাবুদ করবে। তারিফ ও চুপ থাকবার পাত্র নয়। কী হবে এদের? কোথাও আবার মাঝ রাতে হাসপাতালবাসী মিডনাইট রে/সলিং শো দেখবার সুযোগ পায় না কি কে জানে? দৃশ্যগুলো কল্পনা করতেই গা শিউরে উঠল মুশরাফার।
রাত বারোটায় ফোন বাজতেই অন্তরাত্মা কেঁ/পে উঠল মুশরাফার। এই বুঝি কেউ দুঃসংবাদ দিল! দোয়া পড়ে ফোন কানে দিল। অপাশ থেকে জাওয়াদ ক্ষুব্ধ স্বর ভেসে এলো।
চলবে….
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা