স্বর্ণাভ সুখানুভূতি-২ #নিবেদন,পর্ব-৬,০৭

#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি-২
#নিবেদন,পর্ব-৬,০৭
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
০৬

ফোনের পর্দায় ‘লায়লা নামটা ভাসতেই কলিজায় কাঁপন ধরল নাজমুল সাহেবের। চেহারায় কালো ছায়া নামল, চোখে দেখা দিল আতঙ্ক। ভয়ের রেশে ফোন হাতেই রয়ে গেল, রিসিভ করা হয়ে উঠল না। একবার বেজে কেটে গেল। তার এহেন আচরণে পাশের সোফায় বসা জাওয়াদ প্রশ্ন বিদ্ধ চোখে তাকাল। পরেরবার বাজতেই বলল,
‘কোন সমস্যা হয়েছে, মামা?’

নাজমুল সাহেব অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘লায়লা ফোন দিয়েছে। ‘
কথাটার পরেই নিরবতায় গা ঢাকল জাওয়াদ। মুখে ভর কর গম্ভীর্যের লহর। কিছু সময় বাদে বলল,
‘ রাফা যে এখানে আছে বলবেন না।’

নাজমুল সাহেব নিরব সম্মতি দিলেন। লায়লা ফোনের পর ফোন দিয়ে যাচ্ছেন। অজানা আতঙ্কটা বাড়ছে ক্রমশ। ফোন না ধরলে বাড়বে বৈ কমবে না। নাজমুল সাহেব ফোনটা তুললেন।
‘ হ্যালো ভাইয়া।’

‘ এতবার কল দিলি?’ এই বোনটির প্রতি মনে বিতৃষ্ণা জেগেছে নাজমুল সাহেবের ও। কুশল বিনিময় করার ইচ্ছে হয়ে উঠে না। নিষ্ঠুররা ভালোই থাকে। লায়লা উৎফুল্ল স্বরে বললেন,
‘চমৎকার একটা খবর আছে । তারিফের বিয়ের কথা চলছে। দু’দিন বাদেই এনগেজমেন্ট। ‘

নাজমুল সাহেব নিরস গলায় বললেন, ‘ভালো তো। করে ফেল।’
‘করে ফেল মানে কী! আমি গাড়ি পাঠাব, আপনি ভাবি ফাইজা সবাই কাল চলে আসবেন। আজ পাত্রী দেখতে গিয়েই হুট করেই ডেট দিল সাফার বাবা। আপনাকে জানাবার সুযোগটাও পাইনি। কাল সকালেই চলে আসবেন কিন্তু!’

নাজমুল সাহেব আনমনেই বলে ফেললেন, ‘যাবো কিভাবে, আমার মেয়েটাকে তো বলিস নি।’

লায়লা না বুঝেই বললেন, ‘ আপনাকে সেই বিকেল থেকে ট্রাই করছি। ফোন বন্ধ। আপনাকে না পেয়ে ভাবিকে কল দিলাম, ভাবি ধরল না। তারপর ফাবিহাকে কল দিয়েছি। ফাবিহা, ওর হাজবেন্ড, শ্বাশুড়ি সবার সাথে কথা হলো আমার। সবাই আসবে জানিয়েছে। ‘ ফাবিহা আজ সকালেই চলে গেছে।

নাজমুল সাহেব ত্যক্ত নিঃশ্বাস ফেললেন। ভাতিজির শ্বশুরবাড়ি অবধি দাওয়াত চলে গেছে এদিকে নিজের মেয়ের খবর নেই। তিনি গম্ভীরমুখে বললেন, ‘ফাবিহা, ফাইজা ছাড়াও আমার আরেক মেয়ে আছে। ‘

এতক্ষণে ধরতে পারলেন লায়লা। খানিক চুপ রইলেন। তারপর বিরক্তিভরা স্বরে বললেন,
‘ ওই মেয়েকে বলার কথা মুখে ও আনবেন না ভাইয়া। আমি খাল কেটে কুমির আনতে পারব না। কিসব আলখাল্লা পরে থাকে। স্টান্ডার্ড বলতে কিছু নেই। আমার ক্লাব, সোসাইটির সব হাই প্রোফাইল গেস্ট আসবে। সবার মাঝে ওকে ক্ষ্যত লাগবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি কারো কাছে পরিচয় দিতে পারব না। ওর না আসাই ভালো, থাকুক জ/ঙ্গী/দের মতো জ/ঙ্গলে লুকিয়ে। ‘ কেমন ব্যাঙ্গাত্মক শুনাল লায়লার স্বর। নাজমুল সাহেবের গা রি রি করে উঠল শুনেই। রেগে বললেন,
‘থাক, তুই তোর হাই প্রোফাইল নিয়ে। যেখানে আমার মেয়ের অসম্মান হয়, সেখানে আমি যাব না।’

বলেই ফোন রাখলেন নাজমুল সাহেব। পরপরেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন জাওয়াদের দিকে। গুরুগম্ভীর ভাব ফুটে উঠেছে ওর মাঝে, চোখের শিরায় রাগের আভাস।
ফোন স্পিকারে ছিল না। তবে ভলিউম কিছু বাড়ানো ছিল। ফলে পাশে বসা জাওয়াদের কানে স্পষ্টভাবে পৌঁছেছে লায়লার কথা। নাজমুল সাহেব তাকাতেই বলল,
‘ নিজ সন্তানকে পরিচয় দিতে অনিহা হয় যেই মায়ের, সেই মাকে দরকার নেই রাফার। এ ব্যাপার যেন রাফার কানে না যায়, একটু খেয়াল রাখবেন প্লিজ! ও জানলে কষ্ট পাবে।’

জাওয়াদ উঠে দাঁড়াল। রুম থেকে বের হবার সময় সাথে করে আনা উৎফুল্লতা নিমিষেই উবে গেছে। সেই স্থান দখল করেছে একরাশ ঘৃণা আর রাগ। শ্বাশুড়ির প্রতি ক্ষোভের মাত্রা যেন বেড়ে গেল আরও। অনিকের বাসায় ছুটল।

অফিস থেকে ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছিল অনিক। বন্ধুকে দেখে তড়িৎ উঠে বসল। প্রফুল্ল মনে বলল,
‘ তুই আজ বাসায় যাবি বললি না? এখানে কী?’

জাওয়াদ বিন ব্যাগে বসতে বসতে বলল, ‘বিয়ে হলো একটা চক্রান্ত বুঝলি। একবার সেই চক্রান্তের আটকা পড়লে আর ছাড়াছাড়ি নেই। ‘

অনিক এক গাল হাসল, ‘বিয়ে চক্রান্ত না কি বউ চক্রান্ত! ‘

সে কথার উত্তর দিল না জাওয়াদ। প্রসঙ্গ বদলে বলল, ‘ আন্টিকে বলিস, আমরা দুদিন পর তোদের বাসায় যাব।’

অনিককে ভীষণ খুশি দেখাল। ঝটপট ফোন হাতে নিয়ে মায়ের নাম্বার ডায়াল করতে করতে বলল,
‘ অবশেষে বললি তুই। মা প্রতিদিন ফোন দিয়ে বলেন, জাওয়াদকে বল বউ নিয়ে ঘুরে যেতে। তারপর আমি বলি, মা আমি ওকে বলছি, ও বলেছে সুযোগ করে জানাবে। সেই সুযোগের অপেক্ষায় মা বসে আছেন। অবশেষে এলো সুযোগ। মা ভীষণ খুশি হবে।’

বস্তুত, অনিকের মা রোকসানা বেগম জাওয়াদের বিয়ের পর বেশ কয়েকবার জাওয়াদকে দাওয়াত করছেন। প্রথম দিকে সম্পর্ক ভালো ছিল না বলে বাহানার আশ্রয় নিয়ে জাওয়াদ আমন্ত্রণনামা বাতিল করেছে। সম্পর্ক ঠিক হবার পর বিভিন্ন ঝামেলায় যাবে যাবে করে ও যাওয়া হয়নি। রোকসানা শেষে কল দেয়া বন্ধ করেছেন। ছেলেকে তাড়া দিচ্ছেন নিয়ে যেতে। অনিক রোকসানাকে খবরটা জানাতেই খুশিতে আটখানা হয়ে গেলেন তিনি। ছেলের মুখে মহীয়সী নারীর গল্প শুনেই দেখার ইচ্ছে জেগেছে তার। ফোন রেখে অনিক বলল,
‘ প্রস্তুতি নিয়ে রাখিস। মা কিন্তু দু’দিনের আগে ছাড়বেন না তোদের। ‘

‘ অন্য কোন সময় গিয়ে থাকব। রাফার পরীক্ষা কদিন বাদে। এখন থাকতে গেলে ওর পড়ার ক্ষতি হবে। আমরা লাঞ্চ করেই রওনা দিব। আন্টিকে ব্যস্ত হতে নিষেধ করিস।’

‘যাহ, ব্যাটা একদিন না পড়লে কিছু হবে না।’

‘ আমাদের বাসায় গিয়ে কাজে ডুবে থাকে। পড়ার সময় পায় না। আগে পড়েনি, এখন সাজেশন কাভার করতে হবে। এখানে অবসর আছে, পড়া কমপ্লিট করুক।’
‘ তুই ত দেখি, বউয়ের পড়া নিয়ে বেশ সিরিয়াস। ‘ হেসে টিপ্পনী কাটল অনিক। জাওয়াদ মজা করে বলল,
‘দায়িত্ব বুঝোস মামা? সব দায়িত্বের খেলা। আমার পড়ালেখাকে কখনো আমার দায়িত্ব মনে হয়নি। আমার মেধাটেধা ও এত ভালো ছিল না।
বাবা ঠেলেছেন, আমি ক্লাস বেয়ে উঠেছি। আমার দায়িত্ব সবসময় বাবা মা বয়ে এসেছেন। কিন্তু রাফা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। যেদিন মামীর কাছে ওর সেকেন্ড ইয়ারের রেজাল্ট জেনেছিলাম। ওইদিনই কেন যেন আমার মনে হয়েছিল, ওর পড়ার দায়িত্বটা আমার নেয়া উচিত। ও যখন আমার, আমার সংসারের দায়িত্ব কাধে নিতে পেরেছে, তবে ওর সার্বিক দায়িত্ব আমার কাধে নেয়া উচিত। বিয়ের ট্যাগ লাগার পর ওর রেজাল্ট খারাপ হওয়া বা পড়ালেখা বন্ধ হওয়া ঠিক হবে না। আমার কারণে ওর পড়ালেখার ক্ষতি হোক এটা আমার দায়িত্ববোধ হতে দিচ্ছে না। আমি চক্রান্তে ফাইসা গেছি।’

অনিক হাসল। মুগ্ধঘন হাসি। ‘আমি মাঝে মাঝে তোকে আগের জাওয়াদের সাথে মেলাতে যাই। কিন্তু পারি না। ‘

‘পারা লাগবে না। চল উঠ, বাইরে থেকে ঘুরে আসি।’

দুই বন্ধু বের হলো। ঘুরেটুরে ফেরার পথে জাওয়াদ আইসক্রিম নিল দুটো আলাদা প্যাকেটে। একটায় বড়ো দুটো বক্স, অন্যটায় দুটো কোণ আইসক্রিম। রাত দশটায় ফিরল। ফাইজা ডাইনিং টেবিলে বসে কিসের লিস্ট করছিল। জাওয়াদ হেসে বলল,
‘কী করা হচ্ছে পিচ্ছি?’

ফাইজা খাতা থেকে চোখ তুলল। হেসে বলল, ‘লিস্ট করছি।’ জাওয়াদ আইসক্রিম থাকা প্যাকেটটা ওর হাতে দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ধরো। তোমার আইসক্রিম। ‘
ফাইজা কৃতজ্ঞ সুরে বলল, ‘থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া।’
‘তা কিসের লিস্ট করছিলে?’

‘ জায়ফা বলছিল, ফুপ্পি না কি কাল ওকে আর আমাকে নিয়ে যাবে শপিং এ। এনগেজমেন্ট উপলক্ষে শপিং করে দিবে। তাই লিস্ট করছি, কী কী কিনতে হবে। পরে আবার না ভুলে যাই।’ চঞ্চল গলায় কথা বলে থামল ফাইজা। পরপরেই বলল,
‘আপনারা কবে যাবেন ভাইয়া?’

নিষ্পাপ ভঙিমায় বলল ফাইজা। চাপা শ্বাস ফেলল জাওয়াদ। কেমন যেন অপমান বোধ হলো ওর। ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বলল, ‘আমাদের অন্যজায়গায় দাওয়াত আছে। যাওয়া হবে না। তোমরা চলে যাও।’

বলে হাঁটা ধরল। আবার ফিরে এসে ধীর স্বরে বলল, ‘তোমার আপুর সাথে তারিফের বিয়ে এনগেজমেন্ট সম্পর্কিত কোন আলোচনা করো না। ও যেন না জানে। মনে থাকবে?’

ফাইজা মাথা নাড়াল। জাওয়াদ রুমে ফিরল। মুশরাফা তখনো পড়ছিল। ওর দিকে চোখ পড়তেই মায়া হলো জাওয়াদের। কত অভাগা মেয়ে! পুরো পরিবার থাকা সত্ত্বেও নিঃস্ব সে। গর্ভধারিণী মা তাকে পরিচয় দিতে ও লজ্জা পাচ্ছেন। তার একমাত্র ভাইয়ের বাগদান, বাসায় এত বড়ো অনুষ্ঠান অথচ ওর কাছে দাওয়াত অবধি এলো না। এমন কপাল কজানার হয়! ভাবনার মাঝেই জাওয়াদ এগিয়ে গেল মুশরাফার দিকে। মুশরাফা পড়া থামিয়ে বলল,
‘ কোন ফাজলামো এলাউ না। ‘

সে কথার পরেই জাওয়াদের মুখে প্রফুল্লতা দেখা গেল। একটা কোণে আইসক্রিম বের করল। ওর মুখের সামনে ধরে সেধে বলল, ‘খাবে?’

মুশরাফা হা করল। মুখের কাছে নিয়ে আবার ফিরিয়ে আনল আইসক্রিম। কামড় বসাল আইসক্রিমে। মুশরাফা রেগে তাকাল,
‘আপনি আবার আমাকে বিরক্ত করতে এসেছেন?’

‘এসেছি। তো কী করবে?’ নির্বিকার জাওয়াদ।
‘আমি আপনার সাথে কথা বলব না। ‘
‘বলা লাগবে না। এটা খাও। তোমার তো আমার এঁটো খাওয়ার অভ্যাস।’ নিজের খাওয়া আইসক্রিম দিল মুশরাফার দিকে। মুশরাফা নিল না। জাওয়াদ ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘আরে নাও, নাও। শুনেছি আইসক্রিম খেলে না কি নকলের মেধা প্রখর হয়। খেয়ে দেখো, যদি আমাকে জানালার কাছে না দাঁড়াতে হয়।’

মুশরাফা চোখ রাঙাল। বিপরীতে জাওয়াদ শব্দ করে হাসল । মুশরাফার উপচে পড়া রাগের মাঝেই আকস্মিক চুমু খেল ওর মাথায়। মুশরাফার বিস্মিত চাহনির বিপরীতে আলতো সুরে বলল,
‘ হাসবুনাল্লাহু ওয়া নে’মাল ওয়াকিল, নে’মাল মাওলা ওয়া নে’মান নাছির। (অর্থ : আল্লাহ তাআলাই আমাদের জন্য যথেষ্ট, তিনিই হলেন উত্তম কর্মবিধায়ক; আল্লাহ তাআলাই হচ্ছে উত্তম অভিভাবক এবং উত্তম সাহায্যকারী।)’

দোয়াটা মুশরাফা শিখিয়েছে ওকে। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ, দুঃশ্চিন্তা ও পেরেশানীতে আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে এ দোয়া পড়ার জন্য তাঁর উম্মতদেরকে উৎসাহিত করেছেন। জাওয়াদ এর পরেই চলে গেল বারান্দায়। মুশরাফা ভাবুক মনে বসে রইল। জাওয়াদের পরিবর্তিত আচরণের কারণ বুঝে উঠতে পারল না। হলো কী লোকটার!

আজ অফিস শেষে বাসায় ফিরেছে জাওয়াদ। নিজ বাসায়। ফেরার পথে কাঁচা বাজার ঘুরে এসেছে। দরজাটা মা’ই খুলেছে। জাওয়াদ এক গাল হেসে বিনম্র সালাম দিল, ‘আসসালামু আলাইকুম মা।’
মায়মুনা অভিমানী সুরে বললেন,
‘ শ্বশুরবাড়ির পথ ধরতেই পরিবারকে ভুলে গিয়ে, এখন আসছে মা ডাকতে। মা ডাকবি না আমায়। ‘
বলেই ভেতরে চলে গেলেন। জাওয়াদ মৃদু হেসে ভেতরে ডুকল। রগড় করে বলল,
‘ সেই জন্মের পর থেকে মা ডাকছি। এক ডাক আর ভালো লাগছে না। এবার থেকে আমি বরং তোমাকে ‘মাম্মি’ বলে ডাকব। ঠিক আছে মাম্মি?’

মায়মুনা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন, বাঁকা চোখে। জাওয়াদ বলল, ‘মাম্মি পছন্দ হচ্ছে না? আচ্ছা বাদ। তাহলে ‘আম্মা’ ডাকি। আম্মা? ও আম্মা, আম্মা রে। না কি মিসেস আবেদীন ডাকব?’

মায়মুনা রেগে যেতে গিয়ে হেসে ফেললেন। ছেলেটা এত ফাজিল হয়েছে! হেসেই বললেন, ‘ফ্রেশ হয়ে আয়।’

মায়ের মুখ থেকে অভিমানের চটা সরে পড়তে দেখে প্রাণবন্ত হাসল জাওয়াদ। এই নারীর চোখে নিজের জন্য রাগ, বিতৃষ্ণা, কিংবা অভিমান কোনটাই ভাসতে দেখলে সহ্য হয়না ওর। প্রাণাধিক ভালোবাসে কি না। হাতের বাজার ব্যাগ রান্নাঘরের দরজায় রেখে রুমে গেল।

মায়মুনা রান্নাঘরে ডুকলেন। বাজার ব্যাগে উঁকি দিতেই চমকে গেলেন। আগে যেই ছেলেকে হাতে পায়ে ধরে ও কখনো বাজারে পাঠানো যেত না। বউ ঘরে আসতেই সেই ছেলে নিজ থেকে বাজার ব্যাগ হাতে তুলে । দায়িত্ব মেনে সপ্তাহে দু’দিন বাজার করে। বেছে বেছে তাজা শাক, সবজি, মাছ নিয়ে আসে। কী ছেলে কী হয়ে গেল! নারীসঙ্গ একটা ছেলেকে যেমন সংসার বিমুখ করতে পারে, তেমনি সংসারমুখী ও করতে পারে। চোখের সামনে ছেলের পরিবর্তন দেখলে খুশি লাগে মায়মুনার। পরিবর্তনটা খারাপ না। বউ ঘরে থাকলে ও ছেলে তার মাকে ভুলে না। এই যে বাজার ঘুরে ঘুরে ছেলেটা কাঁচা পেঁপে খুঁজে নিয়ে এসেছে। তার মনে আছে, তার মায়ের ডাল দিয়ে কাঁচা পেঁপের তরকারি পছন্দ। বাবার পছন্দের ট্যাংরা মাছ ও আছে। বাজার সরিয়ে চা বসালেন মায়মুনা। কাকন জিহানকে পড়াতে বসেছে নিজের রুমে। জিশান, যায়েদ, জয়নাল আবেদীন এখনো ফিরেনি। এখন অবসরে তারা মা ছেলেই আছে।

চা করে ছেলের রুমে গেলেন। জাওয়াদ সবে ফ্রেশ হয়ে এসেছে। মাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
‘আসো মা। আমি মাত্রই চায়ের জন্য যাচ্ছিলাম। ‘

মায়মুনা ভেতরে গিয়ে চায়ের কাপ তুলে দিলেন ছেলের হাতে। জাওয়াদ কাপ নিয়ে বলল,
‘বসো। কদিন গল্প করা হয়না আমাদের।’

মায়মুনা বসলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘তোর বউ কবে আসবে?’
‘ গেছে যখন কদিন থাকুক।’

আকস্মিক জাওয়াদ বলে উঠল, ‘মা তোমার কাছে একটা জিনিস চাইলে দিবে?’
‘কী জিনিস?’ আগ্রহী দেখাল মায়মুনাকে। জাওয়াদ ধীর স্বরেই বলল,
‘ রাফার জন্য একটা মা লাগবে। তুমি কি ওর মা হবে? ‘

মায়মুনা ভ্রু কুঁচকালেন। বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘এ কেমন কথা! আমি ওর মা হতে যাব কেন? ওর মা নেই?’
‘না।’
‘আমার জানামতে ওর মা বেঁচে আছে, তবে নেই কেন?’
‘ পৃথিবীতে থাকা মানেই আমাদের কাছে থাকা নয়। তিনি জীবিত আছেন, তবে তার জীবনে রাফার জায়গা নেই। ‘

‘মানে কী?’

জাওয়াদ রহস্য করল, ‘একটা আশ্চর্যজনক কথা শুনবে মা? ‘
‘কী?’
‘ রাফার একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে, অথচ আমাকে দাওয়াত করেনি। ‘
মায়মুনার রাগ বাড়ল,
‘ তুই তাদের একমাত্র জামাই। তোকে দাওয়াত করেনি কেন? তোর বউ কিছু বলেনি?’

জাওয়াদ শান্ত স্বরে বলল, ‘সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার কিন্তু ওখানেই মা। দাওয়াত কিন্তু রাফা ও পায়নি।’

‘মানে?’

‘মানে রাফার ভাইয়ের বিয়ের কথা রাফা ও জানে না। ‘

‘এটা কিভাবে সম্ভব! ওর ভাইয়ের বিয়ে ওই জানে না!’

জাওয়াদ তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বলল, ‘ জানবে কিভাবে ওর সাথে তো ওর পরিবারের যোগাযোগ নেই। ‘

মায়মুনা কিছু বুঝতে পারছেন না। অবিশ্বাস্য চোখে বললেন, ‘ ওর সাথে ওর পরিবারের সম্পর্ক ভালো নেই কেন?’

জাওয়াদ মুশরাফার বিভীষিকাময় অধ্যায় তুলে ধরল মায়ের সামনে। শুনেই গা শিউরে উঠল মায়মুনার। রান্নাঘরের কাজ করার সময় এক আধবার ওর হাতের দাগ চোখে পড়েছিল তার। এতদিন কারণ জানতে না পারলেই এই ক্ষণে সমীকরণ মিলে গেল। চোখে বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল,
‘এ কেমন মা! একটা মা এত নিষ্ঠুর কিভাবে হয়?’

‘মায়ের এত নিষ্ঠুরতার পর রাগা এখনো মাকে ভালোবাসে। মায়ের জন্য কাঁদে, মায়ের জন্য দোয়া করে, মাকে কাছে চায়।’ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল জাওয়াদ। মায়মুনা বিরক্ত হলেন,
‘ এত অত্যাচারের পর মায়ের কথা মনে পড়ে কিভাবে?’

‘ পাবারই কথা, ও তো মায়ের আদর পায়নি। আগে মা থেকে ও ছিল না। যা একটু মামীর ভালোবাসা পেয়েছে। বিয়ের পর ভেবেছিল, তুমি তাকে মায়ের কমতি ভুলিয়ে দিবে। কিন্তু তুমি ও ওকে মেনে নিলে না। তোমার রাগে ও ওর মাকে দেখেছিল বলেই হয়তো মাকে বেশি মনে পড়েছে। ‘ রয়েসয়ে কথার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছাল জাওয়াদ।

ছেলের কথায় মায়মুনা নিরব রইলেন। জাওয়াদ বলল,
‘মা বিশ্বাস করো, আমি অপমানিত হতে হতে হাফিয়ে গেছি। আর পারছি না। এবার ব্যাপারটা সমাধান করা উচিত।’

মায়মুনা ভ্রু কুঁচকালেন, ‘ তোকে ও কিছু বলেছে?’

‘রাফার মা আমার সামনে মামাকে কল দিয়ে দাওয়াত দিলেন, একটা বার রাফার কথা বললেন না। মামা যখন ওর কথা বললেন তখন কী বললেন জানো? বললেন, রাফাকে নিয়ে গেলে না কি তার নাক কাটা যাবে, কারো সামনে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবেন না। আমার স্ত্রীকে তার মা অস্বীকার করছে, এটা আমার জন্য অপমানজনক মা। ওরা সরাসরি আমাকে অপমান করেনি, করেছে রাফাকে। প্রতি পদে পদে। এখন ওর সম্মান মানেই তো আমার সম্মান। ও যখন নিষ্ঠুর মহিলাকে ভেবে কাঁদে তখন আমার অপমান লাগে, ভীষণ রাগ হয়। এটা ভালো লাগছে না । তুমি আমাকে উদ্ধার করো না মা?’ অনুরোধ ঝরে গেল জাওয়াদের স্বরে।

মায়মুনা নড়েচড়ে বসলেন,’ আমি কী করব?’

জাওয়াদ চায়ের কাপ রেখে মায়ের হাত ধরে বলল, ‘ মায়ের কমতি আছে বলেই মাকে মনে পড়ে। তুমি যদি সেই কমতি পূরণ করো, তবে ওর মাকে মনে পড়বে না। তোমাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে পারবে। মা একটু ওর মা হয়ে দেখাও না? প্লিজ মা!’

মায়মুনা ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। উত্তর দিলেন না। জাওয়াদ আবার আকুতি করল,
‘ মেয়েটা ভেতরে-ভেতরে খুব কষ্ট পায়। ওর একটা মা ভীষণ প্রয়োজন। তুমি তো মা, মায়েদের ‘মা’ হতে তো কষ্ট হবে না। প্লিজ মা, ওর মা হয়ে যাও? বেশি কিছু না, একটু ভালো করে কথা বললেই হবে। মায়েদের মতো আলতো হাতটা মাথায় দিয়ে আগলে নিও। পারবে মা?’

মায়মুনা নিরুত্তর হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাঁটা ধরতেই জাওয়াদ বলল, ‘কিছু বললে না মা?’

হাঁটতে হাঁটতেই মায়মুনা উত্তর দিলেন, ‘বিয়ে শাদীর ব্যাপার স্যাপারের মাঝে এখন ও বাসায় থেকে অপমানিত হওয়া লাগবে না। কাল গিয়ে তোর বউকে নিয়ে আয়। ঘরের মেয়ে ঘরে থাকুক।’

মায়মুনা চলে গেল। জাওয়াদ হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। মা তার কথার উত্তর দিল না কেন! উত্তর কি সত্যিই দেন নি!

চলবে…

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

স্বর্ণাভ সুখানুভূতি-২
নিবেদন। (পর্ব-৭)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

‘তোমার জন্য দুটো সংবাদ আছে। একটা সুসংবাদ আরেকটা দুঃসংবাদ। কোনটা আগে বলবো?’

মুশরাফা বই থেকে চোখ সরিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকাল। জাওয়াদের পানে চেয়ে ভ্রু কুঁচকাল। তারপর ভেবেচিন্তে বলল, ‘দুঃসংবাদটাই আগে বলেন।’
‘মানুষ আগে সুসংসাদ শুনতে চায়, তুমি দুঃসংবাদ শুনতে চাইলে কেন?’
‘যাতে দুঃসংবাদের দুঃখ, সুসংবাদে বিলীন হয়ে যায়। বলুন দেখি আপনার দুঃখবর।’
‘দুঃসংবাদ হচ্ছে, আমরা কাল ঘুরতে যাচ্ছি।’

মুশরাফা ভেবেছে জাওয়াদ সেদিন মজা করছিল। এখন দেখছে সে সিরিয়াস। সে অসহায় চেয়ে বলল, ‘ যাওয়াটা কি জুরুরি? ‘
জাওয়াদ গম্ভীরমুখে বলল, ‘ভীষণ জুরুরি। যেতেই হবে, বাধ্যতামূলক একবারে।’

‘ ওখানে এক সপ্তাহ থাকলে আমার পরীক্ষা প্রস্তুতি নিতে পারব না। আমরা কি ইদের পর যেতে পারি না?’

জাওয়াদ অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘ তুমি অনিকের বাসায় গিয়ে এক সপ্তাহ থাকবে? আমি তো লাঞ্চ করে ফিরব। আচ্ছা তোমার যখন থাকার ইচ্ছে তবে তোমাকে আন্টির কাছে রেখে আসব।’

মুশরাফা চমকাল বেশ। বিস্মিত স্বরে বলল, ‘মানে?’
জাওয়াদ হেসে বলল, ‘আমরা লাঞ্চের দাওয়াতে অনিকের বাসায় যাচ্ছি। ‘
মুশরাফার চোখে অবিশ্বাসের চাপ। চাপা খুশি ও দেখা যাচ্ছে,
‘আমরা সত্যিই সিলেট ট্রিপে যাচ্ছি না?’
‘ এতটাও বিবেকহীন নই আমি।’

মুশরাফা চমৎকার হাসল। ওর খুশিটা ওর হাসিতেই প্রকাশ পেল। চপল স্বরে বলল, ‘ জাযাকাল্লাহু খায়রান। আল্লাহ আপনাকে অনেক অনেক অনেক পুরষ্কার দিক।’
জাওয়াদ ও হাসল, ‘ওয়া আনতুম। দুঃসংবাদ তো শুনলে এবার সুসংবাদ শুনো।’
‘দুঃসংবাদ এমন হলে সুসংবাদ নিশ্চয়ই আরও ভালো হবে। বলুন দেখি!’ মুশরাফাকে কৌতুহলী দেখাল।

জাওয়াদ ধীরে বলল, ‘ সুসংবাদ হলো, কাল অনিকের বাসা থেকে তোমার বাসায় ফিরছো।’

মুশরাফা ভেবেছে ওর বাবার বাসার কথা বলছে জাওয়াদ। বিস্ফোরিত চাহনি দিল, ‘আমার বাসায়?’
‘না, আমাদের বাসায়।’ হেসে বলল জাওয়াদ।

এই বাক্যে ভুল ভাঙল মুশরাফার। ঠোঁটের হাসি বিলীন হলো। সে বাসায় ফিরলেই বিষাক্ত অনুভূতিতে ছেয়ে থাকে মন। প্রতিনিয়ত শ্বাশুড়ির অবহেলা, জা-য়ের কটাক্ষ সহ্য করতে হয়। এই বাসায় মুক্ত পাখির মতো উড়ছে সে। সবার ভালোবাসা পাচ্ছে। সবাই ওর আপন। সেই নীড়ে জাওয়াদ আর বাবা ছাড়া আপন কেউ নেই। তারাও সারাদিন বাইরে থাকেন। বাসাভর্তি লোকের মাঝে ও একলা পড়ে যায় মুশরাফা। চাপা শ্বাস ফেলে বলল,
‘হঠাৎ! সবেই তো এলাম।’
‘তোমার শ্বাশুড়ি ফিরতে বলেছেন। এসে জিজ্ঞেস করে নিও। আর শুনো? সকালে ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি হয়ে নিও। আমি এসে নিয়ে যাব।’
‘এটা সুসংবাদ হয় কিভাবে? ‘

জাওয়াদ অর্থবহ হাসল। ‘এর চেয়ে সুন্দর খবর আর দুটো নেই। এই সুসংবাদ তোমার জীবনের নতুন সূচনা নিয়ে আসবে ইন শা আল্লাহ। ‘

মুশরাফা এক মুহুর্ত উদাস হলো। পরক্ষণেই ভাবল, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। নিশ্চয়ই এতে কোন মঙ্গল লুকিয়ে আছে। এই মঙ্গল দেখে নেয়া অবধি হতাশ হওয়া উচিত হবে না। মুশরাফা নিজেকে স্বাভাবিক করে ফেলল। হেসে বলল, ‘ইন শা আল্লাহ। আমার আল্লাহ আমার জন্য ভালো কিছু রেখেছেন।’

‘ এবার ঘুমাও।’ জাওয়াদ বারান্দায় ছিল। রুমে এসেই লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। মুশরাফা ধীরে বলল,
‘শোবার আগে বেশ কয়েকটি সুন্নত কাজ আছে। তারমধ্যে একটি হলো, বিছানা ঝেড়ে ফেলা। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যদি তোমাদের কোনো ব্যক্তি বিছানায় (ঘুমাতে) যায়, তখন সে যেন নিজ বিছানাটা ঝেড়ে নেয়। কারণ, সে জানে না যে, বিছানার উপর তার অনুপস্থিতিতে পীড়াদায়ক কোনো কিছু আছে কিনা।
সুন্দর না হাদিসটা?’

জাওয়াদ বিচক্ষণ মেয়েটার কথার কেন্দ্রবিন্দু ধরতে পারল। শোয়া থেকে উঠে বসল। আশপাশ চোখ বুলিয়ে শলা খুঁজল। মুশরাফা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘ খাটের হেডবোর্ডের পিছনে।’
জাওয়াদ শলা খুঁজে পেল। বিছানা ঝাড়ু দিতে দিতে বলল, ‘ আর সুন্নত কী কী আছে?’

মুশরাফা বলে গেল, ‘ বিছানা ঝেড়ে নেয়া।
ঘরের দরজা বন্ধ করা।
নিজ হাত গালের নিচে রাখা, এবং ‘আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া’ পড়ে ঘুমানো।
ডান কাত হয়ে শোয়া।
অযু করে শোয়া।
সতর ঠিক রেখে ঘুমানো।
উপুড় হয়ে না শোয়া
আলো বন্ধ করে ঘুমানো। ‘

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল, ‘ ইসলামে এত ছোটো ছোটো বিষয় নিয়ে ও আলোচনা আছে?’
‘ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানব জীবনের ছোটো থেকে বড়ো সব সমস্যার সমাধান আছে এতে। প্রতিটা হাদিসের পিছনে আছে কল্যানময় দিক। এই জন্যই ইসলাম সুন্দর। ‘
‘আসোলেই সুন্দর। ‘ হেসে বলল জাওয়াদ।

ঝাড়ু দেয়া শেষ। অসলতা ভর করেছে জাওয়াদের মাঝে। ঝাড়ুটা আগের জায়গায় রাখতে ইচ্ছে হলো না। ছুঁড়ে ফেলতে ধরল অন্যদিকে। আকস্মিক স্ক্রিনে চোখ পড়তেই মুশরাফা বাঁকা চোখে চেয়ে থাকতে দেখল। কী ভেবে উঠে আগের জায়গায় রাখল ঝাড়ু। ব্যাপারটা দেখে মুশরাফার হাসি পেল। আটকে রাখা দায় হলে, শব্দ করেই হেসে ফেলল। পরক্ষণেই শব্দ থামিয়ে নিঃশব্দে হেসে গেল। জাওয়াদ প্রথম ভ্রু কুঁচকাল, পরক্ষনেই নিজেও হেসে ফেলল। আলতো স্বরে বলল,
‘আর পড়তে হবে না। অনেক রাত হয়েছে। এবার ঘুমাতে যাও। আমি ফজর সময় কল দিয়ে জাগিয়ে দিব। কেমন?’

মুশরাফা প্রশান্তির হাসি টানল মুখে। একটা সময় এই লোকটাকে নামাজের জন্য কত ডাকাডাকি করতে হতো, ডাকলে ও সেকি রাগ। এখন সে নিজে উঠে ওকে ও জাগায়। সময় বদলায়।


জানালার পর্দা ঠেলে সোনালী রোদ্দুর আঁচড়ে পড়ছে মেঝেতে। দেয়াল ঘড়িটা ঢংঢং করে শব্দ করে জানাল দিচ্ছে, সময় সকাল দশটার ঘরে পা দিয়েছে। মুশরাফা সময় দেখে দ্রুত হাত চালাল। জাওয়াদ রওনা দিয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝে এসে পড়বে। আসার আগে গোছগাছ করে নিতে হবে। কোন জামাটা বাদ পড়ল সেই খেয়াল না রাখলে ও কোন বইটা বাদ পড়ল তার খেয়াল ঠিকই রাখল। ওর গোছানোর মাঝে রুমে এলেন মমতাময়ী মামী ফরিদা। কেমন বিমর্ষ স্বরে বললেন,
‘ তুই সত্যি সত্যি চলে যাবি?’

মুশরাফা ব্যাগের চেইন টেনে বলল, ‘ মিথ্যা মিথ্যা যেতে বলছো?’ ওর স্বরে কৌতুক। ফরিদা অভিমানী স্বরে বললেন,
‘কতদিন পর এসেছিস, দুদিন যেতে না যেতেই আবার চলে যাচ্ছিস।আর কটাদিন থেকে যেতে পারতি না?’

‘থাকার ইচ্ছে তো আমারও ছিল। কিন্তু হুট করে মা চলে যেতে বললেন। বিয়ে যখন দিয়েছো আজ না হয় কাল সংসারে যেতেই হবে। মঙ্গল বোধহয় আজ যাওয়াতেই। মন খারাপ করো না মামী। আবার আসব।’ মামীর কাধ জড়িয়ে বলল মুশরাফা। এই মামীকে ছেড়ে যেতে বুকে কাঁপন তার ও ধরছে, চোখের আড়াল হলে গলা পাকিয়ে কান্না তার ও আসবে। কিন্তু তাও সে অনুভূতি প্রকাশ করল না মামীর সামনে।

ফরিদার গলায় কান্না ভীড় জমিয়েছে। নিজের মেয়ের থেকে ননাশের এই মেয়েটার বাস তার মনের বেশি অংশ জুড়ে। কদিন না দেখলেই মন পুড়ে, কাছে ফেলে চোখের আড়াল হলে কান্না পায়। প্রতিবার এলেই যাবার কালে কাঁদেন তিনি। কান্নার ঢোক গিলে বললেন,
‘কবে আসবি? রমজানে আসতে দিবে তোকে?দেখবি সেই ইদের পর আসার সুযোগ পাবি। কতদিন আরও।’
মুশরাফা হেসে বলল, ‘রমজানে আমার দুটো পরীক্ষা পড়েছে। এ পথ দিয়েই তো যাব। ফেরার পথে এখানে নেমে যাব, ইন শা আল্লাহ। কদিনের ব্যাপার। ‘

ফরিদা কিছুটা শান্ত হলেন। মেয়ের মাথায় চুমু খেলেন। আকস্মিক বলে উঠলেন,’আচ্ছা, তুই ওখানে সুখে আছিস তো?’
সুখ বলতে মুশরাফার চোখে জাওয়াদের চেহারা ভাসল। সে প্রসন্ন হেসে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমাকে ভীষণ সুখে রেখেছেন। ‘

ফরিদা সতর্ক করলেন, ‘কোন সমস্যা হলে বলবি আমাদের। মা বাবা নেই মানে যে যা খুশি করবে তা করবে, আর তুই সহ্য করবি এমন ভাববি না। আমরা তোর কোন কষ্ট সহ্য করব না। জানাবি আমাদের, বাকিটা আমরা দেখব। আমাদের মেয়েকে সারাজীবন বসিয়ে খাওয়ানোর মতো অবস্থা আল্লাহ দিয়েছেন আমাদের। ‘

মুশরাফার মন বলে উঠল, কঠিন সময়টা তো আগেই পার করে এসেছি মামী। ওমন এক আধটু কষ্ট সহ্য করতে বা পারলে জাওয়াদের এত ভালোবাসার ভাগি হওয়া ও হতো না। অনেকটা সহ্য করেছি যখন, আরেকটু সহ্য করি, জাওয়াদের মতো তার মায়ের ভালোবাসাও আমার ভাগ্যে জুটবে ইন শা আল্লাহ। আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে থাকেন। তোমরা যখন জানোনি, আর জানবে ও না কোনদিন।
মুশরাফা হাসল খুব করে। এমন মামী কজনার ভাগ্যে জুটে? নিঃসন্দেহে সে ভাগ্যবতী। মনে মনে ‘আলহামদুলিল্লাহ ‘ ও পড়ল। তারপর মামীকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে বলল,
‘আল্লাহ আছেন আমার সাথে। আমার সুখটা তিনিই আমার ভাগ্যে দিবেন। তুমি চিন্তা করো না মামী। শুধু দোয়া করো।’ চোখের কোণে পানির উপস্থিতি দেখল না মামী।

মমতার মুহুর্তে ভাটা পড়ল ফোনের শব্দে। জাওয়াদ ফোন দিয়েছে। মুশরাফা নিজেকে স্বাভাবিক করে ফোন তুলল। জাওয়াদ জানাল, বাসার কাছে চলে এসেছে সে। মুশরাফা যেন তৈরি হয়ে থাকে। মুশরাফা গায়ে জিলবাব জড়াল। জাওয়াদ এলো খানিক বাদেই। ফরিদা দেখেই বললেন,
‘ অনিকের বাসা থেকে এখানে দিও যেও ওকে। আর দুটো দিন থেকে যাক। ‘
জাওয়াদ আশপাশ চোখ বুলিয়ে ধীর গলায় বলল,
‘ আপনজনের অবহেলা খুব কষ্টের। ভাইয়ের বিয়ের খবর না শোনা থেকে খবর শুনে দাওয়াত না পাওয়াটা বেশি অপমানজনক মামী। অতীতের কষ্ট যথেষ্ট হয়েছে, আর বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। আমি চাইছি না আমার স্ত্রীর কোন অপমান হোক, কিংবা তার পরিবার তার কান্নার কারণ হোক।’

জাওয়াদের শান্ত স্বরে বলা কথায় ধারালো অধিকারবোধ আর যত্নবোধ দেখতে পেলেন ফরিদা। এক মায়ের জন্য এটা ভীষণ আনন্দের। ফরিদা সুপ্রসন্ন হাসলেন। জাওয়াদ মুশরাফাকে নিয়ে বের হলো।

‘আমি ব্যাগ রাখছি। তুমি গিয়ে বসো। ‘ ডিকির দিকে এগিয়ে বলল জাওয়াদ। পেছনের দরজা খুলতেই চমকে গেল মুশরাফা। মায়মুনা বসা সিটে। খোলা মুখে গম্ভীরতার রেখা। মুশরাফার দিকে তাকালেন ভ্রু কুঁচকে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মুশরাফার মনে আতঙ্ক চাপল, এই বুঝি ধমকে উঠবেন। উনি যাচ্ছেন আমাদের সাথে? জাওয়াদ তো একবারো বলল না। ওখানে গিয়ে যদি সবার সামনে খারাপ ব্যবহার করেন?
অনাকাঙ্ক্ষিত মুখখানা দেখে মুশরাফা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। ইতস্ততভাবে সালাম দিল, ‘আসসালামু আলাইকুম মা?’

মায়মুনা মনে মনে সালামের উত্তর নিলেন। কোন কথা বললেন না। মুশরাফা উঠল না। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। জাওয়াদ ব্যাগ রেখে এসেছে। মুশরাফার কাছে এসে দাঁড়াতেই একবারে নিঁচু স্বরে বলল,
‘ মায়ের যাবার কথা বললেন না তো। ‘
‘ যাওয়ার কথা ছিল না। আন্টি ফোন দিয়ে জোর করলেন বলে যেতে রাজি হয়েছেন।’

অনিকের মা কেমন হবে কে জানে? অন্তত কাকনের মা কিংবা পাশের বাসার আন্টির মতো না হোক। মুশরাফা উদাস চোখে চাইল। বলল, ‘ওহ!’
ওর উদাসীনতায় কী যেন খুঁজে পেল জাওয়াদ। গলা নামিয়ে বলল, ‘আজ তোমার মা তোমাকে কিছু বলবে না ইন শা আল্লাহ। যাও, নিশ্চিন্তে বসো।’

‘তোমার শ্বাশুড়ি’ এর জায়গায় ‘তোমার মা’ বলায় ভ্রু বেঁকে গেল মুশরাফার। জাওয়াদের দিকে তাকাতেই হাসল। চোখের ইশারায় বসার নির্দেশ দিল। মুশরাফা না বুঝেই শ্বাশুড়ির দিকে তাকাল। মায়মুনা অপাশ চেপে জায়গা দিয়ে বললেন, ‘ বসো।’

মুশরাফা তড়িৎ বসে পড়ল। গাড়ি চলছে। বউ শ্বাশুড়ি নিরবতায় গা ঢেকে বসে আছে। এক ছাদের নিচে থাকলে ও তার মাঝে হাজার মাইলের দূরত্ব, সেই দুরত্বে সৃষ্টি হয়েছে জড়তা। আকস্মিক সেই জড়তা কেটে উঠে গল্পে মত্ত হতে সক্ষম হচ্ছে না বউ শ্বাশুড়ি কেউ।

অনিক ফোন দিয়েছে। সে কাল রাতেই চলে গেছে বাসায়। জাওয়াদ ওর সাথে কথা বলছে। ফোন রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে বউ শ্বাশুড়ির অবস্থা দেখল। জড়তামাখা দুটো মুখ দেখে হাসি পেল ওর। সোজা হয়ে বসে মুখ চেপে হাসল। এবার এই দুই নারীর ভাব হলেই হয়।

আধঘন্টা পথ পাড়ি দেবার পর মায়মুনা আকস্মিক বলে উঠল, ‘সামনে দাঁড় করিয়ে একটা পানির বোতল নিস তো জাওয়াদ। ‘

মুশরাফা বাইরের আবহাওয়া দেখছিল। শ্বাশুড়ির কথা শুনে ঘাড় ঘুরাল। বলল,
‘ পানি খাবেন মা? আমার কাছে পানির বোতল আছে। দিব?’
মায়মুনা হ্যাঁ না কিছু বললেন না। নিরব সম্মতি ভেবে নিয়ে মুশরাফা তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে বোতল বের করল। ওর মুখে অপ্রস্তুত ভাব। বোতলের ক্যাপ খুলে শ্বাশুড়ি দিয়ে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ নিন মা। আপনি মুখ লাগিয়ে ও খেতে পারেন। ‘

এই বুঝি মায়মুনা পানির বোতল ছুঁড়ে মারলেন, এই আশঙ্কায় মুশরাফার হাত কাঁপছে। ওকে এতটা অপ্রস্তুত হতে কখনো দেখেনি জাওয়াদ। ওর কাঁপা হাতের দিকে তাকিয়ে মুখ চেপে হাসল জাওয়াদ, ‘তোমার হাত কাঁপছে রাফা। তুমি কি মাকে ভয় পাচ্ছো?’

মুশরাফা রাগ নিয়ে তাকাল জাওয়াদের দিকে। এমনিতেই অস্বস্তিতে আছে, লোকটা আরও অস্বস্তিতে ফেলেছে। জাওয়াদ এবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ মা দেখো ও কেমন ভুমিকম্পের মতো কাঁপছে। পানি পড়ে গেলে তোমার গা ভিজে যাবে, বোতলটা নাও প্লিজ।’

মায়মুনা চোখ রাঙালেন। জাওয়াদ হেসেই বলল,
‘তুমি পানি খেয়ে আমায় দিও, মা। আমার গলাটা শুকিয়ে আসছে।’

মায়মুনা বোতলটা নিলেন। বাইরের দিকে মুখ করে পানি খেলেন। মুশরাফা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বাকি পথ আর কথা হলো না। দুই ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছল অনিকের বাবার বাড়ি। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে মায়মুনা অনুভব করলেন পা ব্যাথা। অনেকক্ষণ বসে থাকায় পায়ের পেশিতে ব্যাথা করে উঠল। পা ফেলতে পারছেন না। মুখ কুঁচকালেন। মুশরাফা তা দেখে শ্বাশুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আমার উপর ভার দিয়ে হাঁটুন, মা।’ একটা হাত নিজের কাধে নিয়ে উঠাল শ্বাশুড়িকে। আন্তরিকতা ঝরে পড়ল ওর স্বরে থেকে।

জাওয়াদ গাড়ি থেকে মিষ্টি ফলফলাদি নামিয়ে এসে মায়ের অবস্থা সম্পর্ক জানল। ব্যতিব্যস্ত হতেই মায়মুনা চিন্তা করতে নিষেধ করলেন। কিছুক্ষণ বসে থাকলে এমন হয়, পরে ঠিক হয়ে যায়। মুশরাফা বলল,
‘আপনি আগান, আমি মাকে নিয়ে আসছি।’

জাওয়াদ দুই হাতে প্যাকেট নিয়ে মায়ের পাশে হাঁটছে। অনিক নিচে এসেছে। কুশল বিনিময়ের পর জাওয়াদ ওকে কয়েকটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল। এক হাত খালি হলে ও মাকে ধরল না। মুশরাফার কাধে বয়েই মাকে তিনতলা সিড়ি বাইতে দিল।

কিছু কঠোরতার বিপরীতে এক সাগর কোমলতা পাওয়া যায়। মায়ের ও পাওয়া উচিত, পাওয়া উচিত বোধহয় মুশরাফার ও। পিছন দাঁড়িয়ে মাকে আগলে রাখা স্ত্রীর পথ চলাটা কী চমৎকারটাই না দেখাল জাওয়াদের চোখে। ও হাসল প্রসন্ন।

চলবে…

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here