স্বর্ণাভ সুখানুভূতি।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-৩০)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।
দু’পাশে সবুজ ঘাসের মাঠ, মাঝে পিচঢালা রাস্তা, উপরে নীলাভ আকাশ। চলতি পথে আবার উঁচু টিলা এসে পড়ছে। দুই পাশে গাছের সারি। চারপাশটা সবুজে ঘেরা, উপরে নীলাভ আকাশ, আকাশের বুকে রবির উপস্থিতি। এক ফালি সোনালী রোদে ছেয়ে আছে টিলার ঘাস, গাছের বুক। মৃদু বাতাসে দুলছে পাতা। কী চমৎকার পরিবেশ! উইন্ডো সিটে বসে মুগ্ধ চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে মুশরাফা। তারিফের বিলাসবহুল কারটি ছুটছে আম্বরখানা হয়ে এয়ারপোর্ট রোড়ের দিকে। গন্তব্য রাতারগুল। মুশরাফার চোখে বিস্ময়।আল্লাহ কত নিপুণ হাতে এই ভুবন সাজিয়েছেন! আকাশের কত রঙ, পৃথিবীর কত ঢং! কী সুন্দর আল্লাহ সৃষ্টি! সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ সৃষ্টি দেখাতেও সাওয়াব আছে। মুশরাফা বিস্ময় নিয়ে দেখে গেল। তার পাশে বসে আছে জায়ফা। সামনে ড্রাইভিং সিটে তারিফ বসেছে। ড্রাইভার থাকলে মুশরাফা হয়তো অস্বস্তি বোধ করবে। বোনের স্পেচের জন্যই মূলত ড্রাইভিং এর দায়িত্ব নিজে তুলে নিয়েছে। স্টেয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে তারিফ বলল,
‘ মুশি, আগে সিলেট এসেছিলি? ‘
বাইরে থেকে চোখ ঘুরিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল মুশরাফা। ধীরে বলল, ‘ দুইবার এসেছি।’
‘জাওয়াদের সাথে? ‘
‘না, মামার সাথে। ‘
‘মামা এত ঘুরাঘুরি কখন করতো!’ বিস্মিত হলো তারিফ। মুশরাফা বলল,
‘সেই ছোটোবেলা থেকে যখনই আমি মন খারাপ করে মামার বাসায় যেতাম, তখনই মামা আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হতেন। আমার মন ভালো না হওয়া অবধি মামা এ জায়গায় ও জায়গায় ঘুরতেন। শর্ত থাকতো, যোগাযোগ বিছিন্ন থাকবে সবার কাছ থেকে। তোমাদের কেউ জানতে পারবে না। তা ছাড়া প্রতি ইদে পুরো পরিবার মিলে ট্রিপ দেয়া হতো। ‘
বলতে গিয়ে হেসে ফেলল মুশরাফা। কত স্মৃতি ভীড়ল চোখের তারায়। তারিফ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক, বোনের জীবনে বিষাদের সাথে সাথে আনন্দ ছিল!
জায়ফা বলল, ‘হানিমুনে কোথায় গিয়েছিলে?’
‘কক্সবাজার।’
জায়ফা চিপসের প্যাকেট খুলল। বোনের সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘স্ন্যাকস ছাড়া ট্রিপ জমে না। নাও।’
মুশরাফা গ্লাস তুলে দিয়ে মুখ থেকে পর্দা নামাল। তারপর চিপস মুখে নিল। সেই ক্ষণে ফোন ভাইব্রেট হলো। কল আসবার বার্তা। মুশরাফা ব্যাগে হাত দিয়ে কলারের নাম না দেখেই মিউট করে দিল। সে জানে কে কল দিয়েছে। জাওয়াদ। সকাল থেকে এই একটা মানুষের কল আসছে অনবরত। প্রতিবারই কল বেজে কেটে যাচ্ছে। না মুশরাফা ধরছে, আর না কেটে দিচ্ছে। ফোনের দিকে তাকাচ্ছে ও না। কেবল অভিমানে মুখ ফেরাচ্ছে। ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু দুদিন আগে অর্থ্যাৎ আসবার দিন। ডিনার করতে গিয়ে তারিফ যখন সবাইকে নিয়ে সিলেট আসবার প্ল্যান করছিল তখন জাওয়াদের মতামত জানতে চাইলে জাওয়াদ স্পষ্ট জানাল, সে ট্রিপে যাবে না। তারিফ, মুশরাফা খুব জোর করল, কিন্তু জাওয়াদ রাজি হলো না। সবার জোরাজোরি বিপরীতে নিজের মতামত রাখল। তা হলো, এই ট্রিপটা ভাই-বোনের। ভাই বোন একান্তে সময় কাটাক।
বিরস মনে একাই রওনা হলো ওরা। গতকাল মুশরাফারা গিয়েছিল চা বাগান। সবুজ ঘেরা চা বাগান ধরে হাঁটতে গিয়ে জাওয়াদকে ভীষণ মনে পড়ছিল মুশরাফা। লোকটা এল না কেন! এলে কী হতো! সেই ক্ষণে ফোন দিয়ে অনুরোধ করল, ওদের সাথে যোগ দিতে। জাওয়াদ তার কথাতেই অনড়। সে আসবে না মানে আসবে না। অভিমানে ফোন রেখেছে মুশরাফা। তারপর থেকে চাপা অভিমান বজায় রেখেছে মুশরাফা। তাকে ছাড়া থাকবার অভ্যাস যেহেতু আছে, থাকুক। ইতিমধ্যে ফোন বেজে কেটে গেল। আবার বাজল ফোন। মুশরাফা ফোন মিউট করে ব্যাগে রেখে দিল। তারপর ভাইবোনের সাথে আড্ডায় মশগুল হলো। মিনিট চল্লিশ বাদে ওরা পৌঁছে গেল রাতারগুল চৌরাঙ্গী ঘাটে।
গাড়ি পার্ক করে নৌকা ভাড়া করতে গেল তারিফ। গাড়ি থেকে নামার পর মুশরাফার চোখে চমৎকার একটা দৃশ্য পড়ল।
এক কঙ্কালসার শরীরের মহিলা বসে আছেন মাটিতে। তার হাতে দুটো বন রুটি আর একটা কলা। সদ্য কিনে এনেছে বোধহয়। বছর তিনেকের একটা মেয়ে কোলে তার, পাঁচ বছরের একটা মেয়ে পাশেই দাঁড়ানো। গায়ে, ধুলোমাখা ছেঁড়া জামা। দেখে মা-মেয়ে মনে হচ্ছে। তিনজনকেই ভীষণ ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে। বাচ্চা দুটো হাহাকার নিয়ে তাকিয়ে আছে খাবারের দিকে। মা বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে দুটো পাউরুটি দুজনকে দিলেন। কলার খোসা ছাড়ালেন। মুখে তুলতে গিয়েও তুললেন না। অর্ধেক ভেঙে দুই সন্তানের হাতে দিলেন। নিজে না খেয়েই উঠে গেলেন। ত্যাগের এই ধর্মকেই বোধহয় মাতৃত্ব বলে। মুশরাফা আনমনে হাসল। ওর স্মরণে এলো একটা হাদিস।
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
‘একদা এক মহিলা তার দু’টি কন্যা সাথে নিয়ে আমার কাছে আসল। মহিলাটি আমার কাছে কিছু ভিক্ষা চাইল। তখন আমার কাছে একটি খেজুর ছাড়া আর কিছু ছিল না। আমি তা তাকে দিয়ে দিলাম। সে তা দুই ভাগ করে তার দুই কন্যাকে দিলো এবং নিজে তা থেকে কিছু খেল না। তারপর সে উঠে চলে গেলো। এমন সময় রাসূল (সাঃ) বাড়িতে প্রবেশ করলেন। আমি ঘটনাটি তাঁর কাছে পেশ করলাম। তখন তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি কন্যাদের ব্যাপারে সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং তাদের সাথে উত্তম আচরণ করে, তাহলে এই কন্যাগণ তার জন্য জাহান্নামের অন্তরাল হবে’ (বুখারী , মুসলিম, মিশকাত)
কী সুন্দর প্রতিদান! এই সমাজ কন্যাদের বোঝা মনে করে, অথচ কন্যাদের মূল্যায়ন করবার বিনিময়ে আল্লাহ জান্নাত রেখেছেন। কী চমৎকার কথা! মুশরাফার হাসি চওড়া হলো।
•
নৌকায় চড়ে বসবার সময় কক্সবাজারে জাওয়াদের সাথে বোটে উঠবার স্মৃতি স্মরণে এলো মুশরাফার। অভিমানী শ্বাস ফেলে বসল। মাঝি বৈঠা বাইছে। নৌকা ঢুকে পড়ছে রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টে। মাঝে মিঠাপানির জলাশয়, দুই পাশে সবুজ গহীন বন। সবুজ আবহে ছেয়ে গেছে চারপাশ। কোথাও আবার এলোমেলো গাছের সমাহার। জলে কোথাও রোদ্দুর, কোথাও ছায়ার এক চমৎকার লুকোচুরি চলছে। জলের গায়ে ভেসে বেড়াচ্ছে কতগুলো নৌকা। এলোমেলো গাছের ফাঁক মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মিঠাপানির গহীন জঙ্গলে। গাছের ঢালে কী একটা পাখি ডাকছে মধুর সুরে। মাঝি বৈঠা টানবার ফাঁকে ভাটিয়ালি গান ধরেছে। কী মনোরম পরিবেশ! সুবহানাল্লাহ! মুশরাফা মুগ্ধ চোখে অবলোকন করছে।
যেতে যেতে নৌকা গিয়ে ঠেকল ওয়াচ টাওয়ারের সামনে। তারিফ মুশরাফার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ ওয়াচ-টাওয়ারে উঠবি?’
মুশরাফা তড়িৎ উত্তর দিল, ‘অবশ্যই উঠব।’
তারিফ অনন্যচিত্তে বোনদের নৌকা থেকে ওয়াচ টাওয়ারে উঠাল। সিড়ি বেয়ে একবারে উপরতলায় উঠল। উপর তলায় গিয়ে বারান্দার রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়াল ওরা। চোখ ঘুরাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল। ওয়াচ টাওয়ার থেকে এক পলকে পুরো রাতারগুল দেখা যায়। উপর থেকে মনে হয় এক টুকরো জলাশয়, যার মাঝে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে সবুজ পাতার ছড়ানো গাছ। কোথাও গাছের জন্য জল দেখা যাচ্ছে না, কোথাও আবার শুধুই জল, গাছের দেখা নেই। সেই জলে ফুটে উঠেছে রোদ্দুরে ভেজা নীলাভ আকাশ। কোথার আবার গাছের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে লাল, নীল হরেক রঙা কতই না নৌকার ভেসে যাওয়া। নিচের দিকে তাকালেই শূন্য নৌকার সারি চোখে পড়ছে। কেউ বা নামছে, কেউ বা উঠছে। তারিফ আর জায়ফা এই সুন্দর প্রকৃতিকে ক্যামেরা বন্দী করতে ব্যস্ত। মুশরাফা ব্যস্ত মুগ্ধ চোখে পরখ করতে।
বলা হয়, রাতারগুল এসে ওয়াচ-টাওয়ারে না ওঠলে ভ্রমণ অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। রাতারগুলের সবচেয়ে সুন্দর ভিউ ওয়াচ-টাওয়ার থেকেই দেখা যায়। কথাটা প্রতিবার ওয়াচ টাওয়ারে উঠবার পর মনে হয় মুশরাফার। এই ক্ষণেও মনে হলো। সে যেন বিভোর হয়ে গেল প্রকৃতিতে। ধ্যান ভাঙল তারিফের ডাকে।
‘মুশি!’
‘হ্যাঁ, ভাইয়া?’
‘ফোন আনিস নি সাথে?’
‘হ্যাঁ।’
‘জাওয়াদ বলল, ফোনে পাচ্ছে না তোকে।’
মুশরাফা ভাইয়ের সামনে ব্যাগ থেকে ফোন হাতে নিল। পাওয়ার অন করে দেখল ৫০+ মিসডকল। মুশরাফা বিস্ময়ের ভান করে বলল,
‘ফোন সাইলেন্ট ছিল, তাই টের পাইনি। ‘
তারিফ ভ্রু কুঁচকাল একবার। কিছু টের পেল কি না কে জানে। নিজের ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ কল হোল্ডে আছে। নে, কথা বল।’
মুশরাফা দ্বিরুক্তি করবার সাহস পেল না। বিনা বাক্যে ফোন হাতে তুলে নিল। তারিফ অন্যদিকে চলে গেল। মুশরাফা কানে দিয়ে চুপ করে রইল, কিছুই বলল না। জাওয়ার কেশে নিজের উপস্থিতি জানান দিল, মুশরাফা তাও কিছু বলল না। জাওয়াদ এবার কোমল স্বরে সালাম দিল,
‘আস-সালামু আলাইকুম। ‘
মুশরাফা উত্তরটা মনে মনেই দিল। মুখে রা করল না। জাওয়াদ ধীরেই বলল, ‘ ফোন উঠাচ্ছো না কেন?’
মুশরাফা উত্তর দিল না। জাওয়াদ হাসল। ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে বলল,
‘আমাকে রেখে ভাই বোনের সাথে ঘুরতে চলে গেছো। বাসায় আমি একলা পুরুষ মানুষ কিভাবে বেঁচে আছি, খোঁজ অবধি নিলে না। দয়ামায়া একটু বেশি থাকায় আমি কল দিলাম, তাও তুলছো না। তোমার মতিগতি তো ভালো ঠেকছে না রাফা!’
রেখে এসেছে মুশরাফা! সাথে আসার জন্য পা ধরবার বাকি ছিল। আসেনি সে, এখন বলছে রেখে এসেছে সে! মুশরাফা ফোঁস করে উঠল, চোখে রাগ মিশিয়ে তাকাল ফোনে। রা করল না। জাওয়াদ দুঃখীর ভান করে বলল,
‘তুমি ওদিকে আমাকে ভুলে মহাসুখে ঘুরে বেড়াচ্ছো। এদিকে তোমার স্মরণে, তোমার বিরহে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। তোমাকে মিস করতে করতে হাঁপিয়ে গেছি। কী সমীকরণ! আহা! ‘
মুশরাফার রাগ বাড়ছে, কিন্তু সে প্রকাশ করছে না। নিজে আগুন লাগিয়ে নিজেই ফুঁ দিচ্ছে লোকটা! অসভ্য! জাওয়াদ আবার বলল,
‘চুপ করে আছো কেন? স্বামীহীনা ট্রিপের গল্পসল্প করো! নৌকায় উঠবার সময় কক্সবাজারে বোটে উঠার কথা মনে পড়েছে কি না সচ্চ মনে বলো, আমি কিছু মনে করব না। ‘
লোকটা ঠিক জানে কোথায় কোথায় মুশরাফার ওকে মনে পড়বে। জেনে-বুঝে সে ইচ্ছে করে আসেনি, এখন আবার কথা তুলেছে ওকে রাগাবার জন্য! মুশরাফা এতক্ষণে মুখ খুলল। রাগ, অভিমান মেশানো স্বরে বলল, ‘ নিষ্ঠুর।’
মুশরাফার মুখনিঃসৃত ওই একটা শব্দই যেন হাজার বাক্য নিয়ে সব রাগ অভিমান ফুটিয়ে তুলল। স্ত্রীর অভিমানে নত না হয়ে জাওয়াদ হেসে ফেলল। যেন-তেন হাসি নয়, একবারে উচ্চৈঃস্বরের গা দুলানো হাসি। যেন মুশরাফা মজার কোন কৌতুক শুনিয়েছে। হাসতে হাসতে বলল,
‘আমি নিষ্ঠুর!’
ওর হাসি শুনেই মুশরাফার অভিমান বেড়ে গেছে। লোকটার কাছে তার অনুভূতি হাস্যকর মনে হচ্ছে! কিছুটা রাগ নিয়ে বলল, ‘ শুধু নিষ্ঠুর না, নিষ্ঠুরতার সীমানা পেরিয়ে যাওয়া মানুষ আপনি।’
জাওয়াদের ঠোঁট থেকে হাসি সরছে না। কিছু মানুষের রাগ ও সুন্দর। সে বলল, ‘ আপনার মনে রাখা উচিত, ১০০টা কল নিষ্ঠুরতার সীমানা পেরুনো লোকটার ফোন থেকেই গেছে, সীমানায় থাকা কারো থেকে নয়।’
‘ ওমন উতলার দরকার নেই, যে সঙ্গী হতে নারাজ।’ অভিমান ঝরে গেল কথায়। জাওয়াদ হেসে বলল,
‘ রাগ অভিমান বিরহ তো দেখি জমে ক্ষীর হয়ে গেছে! আনন্দের খবর।’
ওর হেয়ালিপনায় মুশরাফা চাপা শ্বাস ফেলে ফোন রেখে দেবার প্রস্তুতি নিল। সেই ক্ষণে জাওয়াদ বলল,
‘ এ্যাই, তোমাদের ট্রিপ কবে শেষ হবে? ফিরে এসো তাড়াতাড়ি। কদিন যাবত ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছে না। আমার ঘুম দরকার। তুমি দিন দিন নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছো, আমার চিন্তা তো হচ্ছে না, অন্তত আমার ঘুমের চিন্তা করো! ‘
জাওয়াদ বলল, আমার ঘুম দরকার। মুশরাফার মনে হলো, সে শুনেছে ‘আমার তোমাকে দরকার।’ সে কি ভুল শুনেছে? নাহ্, সে মনের কথা শুনেছে। মুশরাফা আকস্মিক হেসে ফেলল। নিঃশব্দের হাসি। হাসি থামিয়ে গম্ভীরতার ভান করে বলল, ‘আপনি আসলেন না কেন!’
জাওয়াদ যেন নিজের কাতরতা প্রকাশ করতে অপারগ। সে হেয়ালিসুরে বলল, ‘ তুমি না আমাকে ছাড়া এক সপ্তাহ থাকবে? এখন থাকো! সুযোগ পেয়েও দুই দিন যেতে না যেতেই এত উতলা হয়ে পড়েছ কেন? ‘
‘আপনি সেটার প্রতিশোধ নিচ্ছেন!’ মুশরাফার বিস্ময় স্বর। জাওয়াদের দৃঢ় স্বরে বলল,
‘ না।’
‘তাহলে!’
জাওয়াদের স্বর কোমল হলো, ‘ আমি তোমাদের ভাই বোনকে সময় দিচ্ছিলাম। আমি চাইছিলাম এই সময়টা তোমাদের ভাইবোনের হোক, কিছু স্মৃতি জমা পড়ুক। নিজেদের মতো ইঞ্জয় করো। ‘
‘আপনি থাকলে ইঞ্জয় করতে পারতাম না?’
জাওয়াদ ধৈর্য নিয়ে বুঝাল, ‘ সিঙ্গেল আর কাপল ট্যুরে পার্থক্য আছে। ট্যুরে এক, দুইটা কাপল গেলে আনন্দ কমে যায়, যতটা না আলাদা থেকে ইঞ্জয় করা যায়। আমি গেলে আমি, তুমি, ওরা সবাইকে অস্বস্তিতে পড়তে হতো। আমরা আলাদা টাইম কাটাতে পারব না, ভাইয়া থাকবে। এখন আমি বড়ো শ্যালকের সামনে বউয়ের হাত ধরে বিচে তো হাঁটতে পারব না সারাক্ষণ, তাই না? বিছানাকান্দিতে এক পাথরে দুজন পা ভিজিয়ে বসে থাকতে পারব ভাইয়ার সামনে? অস্বস্তি হবে না? আলাদা হলেও বিষয়টা খারাপ দেখাবে। এই ট্যুরের মধ্যমণি তুমি, তোমাকে ওরা সবখানে চাইবে। আমি গেলে তুমি অনেকটা সময় আমার সাথে ব্যয় করবে। ভাইয়ারাও আমাদের আলাদা সময় দিবে। তুমি যদি আমার সাথে থাকো তবে তাদের সাথে গিয়ে লাভ কী হবে বলো? আগে পিছে থাকা আর পাশাপাশি থাকা এক নয়। তুমি এখন ভাইয়া আর জায়ফার সাথে যতটা সময় কাটাতে পারছো, আমি গেলে তার অনেকাংশই পারবে না। সবচেয়ে বড়ো কথা, ভাইবোনের কেয়ার পাবে না তুমি। আমি চাই তুমি ভাই বোনের কেয়ার পাও।’
মুশরাফা শুনল জাওয়াদের কথা। বিস্মিত হলো, ‘এইজন্যই আসেন নি আপনি?’
‘হ্যাঁ, সিলেট নিয়ে আমার অনেক প্ল্যান আছে। এই ট্রিপটা নিজেদের মতো ইঞ্জয় করো। কদিন বাদে আমরা সিলেটে কাপল ট্যুর দিব। সিলেটে তোমার আমার ঘুরা হয়েছে, কিন্তু আমাদের ঘুরা হয়নি। যখন সিলেট যাব, খুব ঘুরব, অনেক স্মৃতি নিয়ে ফিরব। এখন গেলে ইঞ্জয় তো করতে পারব না, উলটো অস্বস্তিতে পড়ব। তোমার ভাইকে সম্মান দিতে গিয়ে আমার প্রেম টেম আসবে না। বউ নিয়ে গিয়েও ব্যাচেলর ফিল হবে। ভাইয়া সাইড দিলেও অস্বস্তি লাগবে। তারচেয়ে ভালো, তোমরা ঘুরে আসো। বুঝেছো?’
মুশরাফা পুরো ব্যাপারটা ভাবল। ধরতে পারল আসলেই জাওয়াদ থাকলে ভাইয়ার সামনে কোয়ালিটি টাইম পার করতে ওর অস্বস্তি হবে, সময় কাটাতে পারব না, জাওয়াদ থাকলে ভাইয়ের এত যত্ন পাবে না। ভাই বোনের সাথে সময় কাটাতে পারবে না। চমৎকার ভিউগুলো জাওয়াদের হাতে হাত রেখে দেখতে পারবে না, খুনসুটি করতে পারবে না। সিনেমাটিক অনেক কিছু হয়, বাস্তবতায় হয় না। কারণ বাস্তবতায় চক্ষুলজ্জা আছে। লোকটার বুদ্ধি ভালো। মুশরাফা মুগ্ধ হলো, শ্রদ্ধা এলো। মৃদু হাসল। ওর চোখ দুষ্টু হাসল। ওকে খোঁচাচ্ছিল না? সে ধীরে বলল,
‘আমি আপনাকে ভীষণ মিস করছি।’ সরল স্বীকারোক্তি।
জাওয়াদ ও হাসল। কোমল স্বরে বলল, ‘ তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।’
‘আমার আপনাকে আসতে বলতে ইচ্ছে করছে। ‘
‘তুমি এত অবুঝ হলে কীভাবে?’
‘আপনার জন্যই তো!’
জাওয়াদ শব্দ করে হাসল। আদুরে সুরে বলল, ‘মন খারাপ করো না, কেমন?’
‘আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।’ মুশরাফাও প্রেমময় সুরে বলল। মেয়েটা সবসময় অনাকাঙ্ক্ষিত সময় ভালোবাসা প্রকাশ করে। এমনিতেই বউহীনা বিরহের প্রহর কাটছে, পুরো বাসা, মন সব খাঁ খাঁ করছে। অশান্তি লাগছে। তারউপর এই মেয়ে দহন বাড়াচ্ছে। জাওয়াদ কপালে বিরক্তির ভাজ টেনে কল কেটে দিল। মুশরাফা বিজয়ী হাসল। ওর মন ভালো হয়ে গেছে, এখন জাওয়াদ বিরস মনে বিরহ পালন করবে। আসতেও পারবে না থাকতেও পারবে না।
সিলেট ঘুরে ওরা কক্সবাজার গেল। জাওয়াদ মুশরাফার দুজনার কাছে দুটো সারপ্রাইজ এলো সেদিনই। জাওয়াদের ফোনে এতকাল বাদে প্রথম শ্বাশুড়ির কল এলো।
চলবে…
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা