#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি।
#দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-২৪)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
দা-কুমড়া সম্পর্কের দুইজন মানুষ বসে আছে পাশাপাশি চেয়ারে। যাদের মাঝে কখনো পরিচয় ছিল না, ছিল না সখ্যতা। যাদের আলাপনের শুরু হয়েছে রাগ, ক্ষোভ আর শত্রুতা দিয়ে। দুজনেই জানে তারা একে অপরকে কতটা অপছন্দ করে। তবুও তারা পাশাপাশি। একজন স্ত্রীর জন্য, আরেকজন বোনের জন্য। দুজনার মাঝে সেতুবন্ধন করেছে ‘মুশরাফা’ নামের এক নারী। তারিফের আজ হাসপাতালে থাকবার পরোক্ষ কারণটা মুশরাফা। প্রত্যক্ষভাবে জাওয়াদ। সে ইতিমধ্যেই বুঝে গেছে নিজের অহং ধরে রাখলে বোনকে সে পাবে না, অহং ঝেড়ে এই ছেলের কাছে নত হলে তবেই বোনকে পাবে। বোনকে আড়াল করে দাঁড়ানো বোনের স্বামীকে মোকাবিলা করতে হবে আগে। বোনের চিন্তা করবার জন্য ও অগ্নিপুরুষের অনুমতি লাগবে, তাকে মানাতে হবে। নয়তো সে বোন দিবে না। এখন বড়োভাই হয়ে ছোটোবোনের স্বামীকে পটাতে হবে। কী দিনকাল আসল! তারিফ আনমনেই হেসে উঠল। সে হাসির শব্দ হলো না।
তবুও জাওয়াদ টের পেল। সবেই সবাইকে বিদায় দিয়ে উপরে এসেছে। দু’দন্ড বিশ্রাম নিয়ে নামাজে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত তার। চাপা এক তিক্ততার জন্য মুশরাফার পরিবারের কাউকে সহ্য হয়না জাওয়াদের। দেখলেই কেমন রাগ হয়, কপালে বিরক্তির ভাজ পড়ে। কথা বলতে রুচিতে বাধে। গতদিনকার তারিফের ব্যবহারের পর তারিফের প্রতি জন্মে নেয়া ক্ষোভ বেড়ে গিয়েছে। আজ কিছু বললে এই লোককে ছেড়ে দিবে না। মামা অসুস্থ, তাদের এই দ্বন্দ্বে মামার উপর প্রভাব না পড়ে এই ভয়ে তারিফ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার মনস্থির করেছে জাওয়াদ। ঘড়িতে সময় দেখে উঠে দাঁড়াল।
অযু করে এসে কেবিনে ঢুকে দেখল তারিফ নাজমুল সাহেবের পাশে বসে আছে। মনোযোগ দিয়ে ওষুধপত্র ঘাটাঘাটি করছে, পরবর্তী ওষুধ কখন তা নিরক্ষণের চেষ্টা করছে।
শ্যালক থেকে চোখ ফিরিয়ে জায়নামাজ হাতে নিয়ে এগুলো জাওয়াদ। নামাজ পড়বার জন্য কেবিনের মেঝে আয়াকে দিয়ে মুছে নিয়েছে একটু আগে। জায়নামাজ বিছাবার সময় তারিফ ফাইল থেকে চোখ না উঠিয়ে বলল,
‘ ইফ ইউ ওয়ান্ট ঠু গো সামহয়ার। ইউ ক্যান গো। আই এম উইথ আঙ্কেল।’
তারিফের ভানটা এমন, যেন সে মৃদুস্বরে প্রেসক্রিপশন পড়ছে। অথচ তার বলার ইঙ্গিতটা ছিল জাওয়াদের মসজিদে যাবার অনুমতিসূচক। তা বেশ ধরল পারল জাওয়াদ। বুঝে ও গ্রাহ্য করল না । আদতে, তারিফকে ওর বিশ্বাসযোগ্য কিংবা দায়িত্বশীল মনে হয় না। যার উপর দায়িত্ব দিয়ে সে নিশ্চিন্তে কোথাও চলে যাবে। এই লোক কেয়ারলেস। যে নিজের বোনের কেয়ার করতে পারে না, তার কাছ থেকে মামার কেয়ার আশা করাও বোধহয় বোকামি হবে। জাওয়াদ ঝুঁকি নিল না। তারিফের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে কেবিনেই নামাজে দাঁড়াল। সব চিন্তা একদিকে রেখে সময় নিয়ে রুকু সেজদা করছে। তারিফ মামার পাশে বসে তীক্ষ্ম চোখে পরখ করছে বোনজামাইকে। টুপি মাথায় দিয়ে রুকু সেজদা করা জাওয়াদকে এখন একবারে ভিন্ন লাগছে। একাগ্রতা, ধার্মিকতা ফুটে উঠেছে তার চোয়ালে। কী প্রশান্ত লাগছে ছেলেটাকে!
প্রথম দেখার পর এই ছেলেকে বেশ আধুনিক মনে হয়েছে। কোন দিক থেকেই তাকে ধার্মিক মনে হয়নি। স্মার্ট, সুদর্শন একটা যুবক কিভাবে তার বোনের মতো ধার্মিক মেয়েকে স্ত্রী রূপে গ্রহন করেছে তা নিয়ে বেশ কৌতূহল জেগেছিল। কিন্তু এই ক্ষণে এসে মনে হচ্ছে ছেলেটার মনে ও আল্লাহভীরুতা আছে। বেশভূষায় নয় সে মন থেকে ধার্মিক। নিজ পরিবার মুশরাফার মূল্য না বুঝলেও এই আধুনিক ছেলেটা খুব করে বুঝেছে মুশরাফার মূল্য। বুঝে বলেই মুশরাফার এত গুরুত্ব তার জীবনে। আর যাই হোক তাদের পরিবারের মতো মুশরাফার পর্দায় এত ব্যাঘাত হবে না ওখানে, ছেলেটা হতে দিবেনা। এটুকু বিশ্বাস এই কিয়ৎক্ষণে জন্ম গিয়েছে তারিফের।
বেশ সময় নিয়ে চাররাকাত এশারের ফরজ নামাজ শেষ করল জাওয়াদ। সালাম ফিরিয়ে তাসবিহ পড়তে পড়তে সচেতন চোখে পরখ করল নাজমুল সাহেবকে। কোন সমস্যা হচ্ছে না তো! তাকে নির্বিঘ্নে ঘুমাতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবার নামাজে দাঁড়িয়েছে। এই কাজটা তারাবির প্রতি দুই রাকাত নামাজের পর পর করল। ইবাদতের সাথে দায়িত্ব ও পালন করে যাচ্ছে সমানতালে, একনিষ্ঠভাবে। কোনটাতে হেরফের হচ্ছে না। ঘন্টাদেড়েক সময় নিয়ে এশার, তারাবির নামাজ শেষ করল। নামাজ শেষ করে ফোন হাতে নিয়ে কাউকে ডায়াল করল। ধরতেই সুন্দর করে সালাম দিন। বিনম্র স্বরে জানতে চাইল, ‘ কী করছো মা?’
অপাশ থেকে কী উত্তর এলো শুনতে পেল না তারিফ। কেবল জাওয়াদের কথা শুনতে পেল, ‘খেয়েছো?’
‘মা, রাফা তো বাসায় একা। তুমি কি ওর কাছে থাকবে?’
তারপর মায়ের উত্তরে হাসল জাওয়াদ। নির্দ্বিধায় বলল, ‘ ভয় পাবে না, রাফা ভীষণ সাহসী। একা বোধ করবে কেবল। তারপর একা থাকার সুযোগ নিয়ে কাঁদতে বসে যাবে। ‘
অপাশ থেকে প্রশ্ন এলো। উত্তরে জাওয়াদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ সেজদায় ছাড়া রাফার কান্নার কারণ একটাই, মা। এই অধ্যায়টা সবসময় ওকে কাঁদায়।
আজ মাকে দেখেছে না? কান্নার নতুন কারণ লাগবে না, এটাই যথেষ্ট। আমি ও নেই আজ। মা, প্লিজ তুমি একটু ওর কাছে থাকবে? ‘
এক স্বামীর ভালোবাসা, চিন্তা, উদ্ধিগ্নতা ঝরে গেল এই কথায়। অপাশ থেকে ইতিবাচক জবাব আসতেই জাওয়াদ প্রসন্ন হাসল। তারপর বলল, ‘ জাযাকিল্লাহু খায়রান মা। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। আমি যে ফোন দিয়ে বলেছি, এটা বলো না। তাহলে ও তোমার প্রতি খুশি হবে। ‘
মায়ের সাথে জাওয়াদের আলাপ চলছে। তারিফ অবাক হয়ে শুনছে তাদের কথা। ছেলেটাকে যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে তারিফ। ক্ষণে ক্ষণে সুন্দর একটা ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠছে, নতুন রূপে ধরা দিচ্ছে। বিস্ময়ের সাথে চাপা কষ্ট ও হলো বোনের কষ্টের খবর জানতে পেরে। মুশি মায়ের জন্য এত কষ্ট পায়! ওর কাছে তো মা বোন বাবা সবাই আছে। মুশির কাছে তো তাদের কেউ নেই। মায়ের আদর পায়নি ছোটো বেলা থেকে। মাকে কাছে ও পায়নি। মাকে একবেলা না দেখলে অস্থির হয় তারিফের মন। ভীষণ ভালোবাসে মাকে। ঢাকার বাইরে গেলে ভিডিও কলে কথা হয় তাদের, কত খুনসুটি মা ছেলের। একদিনেই জমা পড়ে হাজার স্মৃতি। অথচ মুশরাফার পুরো জীবনেও মায়ের সাথে সুন্দর স্মৃতি নেই। মাকে তো সে ও ভালোবাসে। অথচ দেখা হয়না কতকাল! ইশ!
কত কষ্টে পার করেছে এতগুলো বছর! বুক কাঁপল তারিফের। মন কতগুলো সংকল্প করে বসল।
•
রাত তখন বারোটা। কেবিনের এক্সট্রা বেডে আধশোয়া হয়ে বসে ফোন দেখছে জাওয়াদ। তারিফ বেডের অন্যপাশে চুপচাপ বসে আছে। দৃষ্টি জাওয়াদের দিকে আবদ্ধ। ইতস্তত ভাব সারা মুখে। কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। মূলত জাওয়াদের সাথে কথা কিভাবে শুরু করবে তাই ভেবে পাচ্ছে না সে। জাওয়াদ না তাকিয়ে বুঝতে পারল তারিফ ওর দিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে। জাওয়াদ বিরক্ত হলো। লোকটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেন! আশ্চর্য! তারিফ গলা ঝেড়ে কেশে নিজের উপস্থিতি জানান দিল। জাওয়াদ ফোনে মত্ত রইল। চোখ তুলে তাকাল না। তারিফ আরেকটু কাছে এসে বসল। তারপর ধীরে বলল, ‘লিসেন?’
জাওয়াদ শুনল না, শোনার চেষ্টা করল না। তারিফকে এড়িয়ে বেড থেকে নেমে গেল। সোজা কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। তারিফ চাপা শ্বাস ফেলে বলল,
‘ যে আমার থেকে একবার চোখ সরিয়েছে আমি তার দিকে দ্বিতীয়বার তাকাই নি। অথচ সেই আমি এত অবহেলার পর ও এই ছেলের পিছু ঘুরছি! আমার গার্লফ্রেন্ড ও আমাকে এতটা ঘুরায় নি, এই ছেলে আমাকে যতটা ঘুরাচ্ছে। বড়ো ভাই হয়ে ছোটো বোনের জামাইয়ের পিছু ঘুরছি আমি! পটাচ্ছি? কী দিনকাল আসছে ! আল্লাহ! ‘
আজকের পর জাওয়াদকে নাগালে পাওয়া যাবে না। সুতরাং আজ রাতের মধ্যেই জাওয়াদের সাথে কথা বলতে হবে। দাম্ভিক তারিফ নিজের অহং ঠেলে জাওয়াদের পিছু নিল। জাওয়াদ গিয়ে করিডোরের চেয়ারে বসেছে সবে। তারিফ পাশে বসল। কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
‘ আই ওয়ান্না টক ঠু ইউ।’
দাম্ভিক তারিফের নতস্বর শুনে ঠোঁট চেপে হাসল জাওয়াদ। বিড়বিড় করে বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি আমি পটছি না। ‘
জাওয়াদ না শোনার ভান করে উঠে দাঁড়াল। মুশরাফাকে কল দিয়ে করিডোর ধরে এগুলো। স্বামী আর ভাইয়ের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরাশনের দোয়া পড়ছে মুশরাফা। কপালে চিন্তার ভাজ। আল্লাহকে ডাকছে, এদের সম্পর্ক ভালো হলে হোক, না হলে ও যেন আগের মতো থাকুক। নতুন করে আলাপন না হয়। এদের আলাপন মানেই বাকবিতন্ডা। ওর মনটা পড়ে আছে হাসপাতালে। কী হচ্ছে ওখানে? ওর ভাবনার মাঝেই ফোন বাজল। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। কাঁপা হাতে ফোন তুলল। ওর ভয় বাড়াতে জাওয়াদের ক্ষুদ্ধ স্বরে ভেসে এলো,
‘তোমার ভাইয়ের সমস্যাটা কী? আমার কিন্তু রাগ লাগছে। ‘
মুশরাফার চোয়াল ভয়ে নীল হয়ে গেল। বিড়বিড় করে দোয়া ইউনুস পড়তে লাগল। বার কয়েক পড়ে কাঁপা স্বরে বলল, ‘কী করেছে ভাইয়া?’
জাওয়াদ কপট রেগে বলল,
‘আমার সাথে প্রেমিকের মতো আচরণ করছে। তাকে বলে দাও, আমি তার বোনের প্রতি ইন্টারেস্টেড, তার প্রতি নয়। ‘
মুশরাফা হতভম্ব হয়ে গেল জাওয়াদের কথা শুনে। প্রেমিকের মতো আচরণ! এ কেমন কথা! মুশরাফা বুঝল না কথার মর্মার্থ। সে ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ প্রেমিকের মতো আচরণ মানে? কেমন আচরণ করতেছে ভাইয়া?’
জাওয়াদ মুখ খুলতে গিয়ে ও চুপ হয়ে গেল। রাফাকে বললে সে ব্যাপারটা আন্দাজ করে ফেলবে। পরে চমকানো যাবে না। সে ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
‘প্রেমিকরা যেমন আচরণ করে তেমন। ‘
‘ইতঃপূর্বে প্রেম না করায় প্রেমিকের আচরণ কেমন তা আন্দাজ করতে পারছিনা। বলুন।’
‘বলতে পারব না, আমার লজ্জা লাগছে। ‘
মুশরাফা বিস্মিত স্বরে বলল,
‘লজ্জা লাগবে কেন? আশ্চর্য!’
জাওয়াদ সে কথার উত্তর দিল না। বলল, ‘
তোমার ভাইয়ের লক্ষণ সুবিধার লাগছে না। ‘
জাওয়াদের স্বরটা প্রথমে রাগ থাকলে ও এখন আর নাই। কেমন দুষ্টুমিতে ভরা। মুশরাফা ধরে নিল জাওয়াদ ওকে বিভ্রান্ত করার জন্য ভাইয়ের বিরুদ্ধে এসব বলছে। মুশরাফা চাপা শ্বাস ফেলল, যাক এদের দ্বন্দ্ব বাধেনি। যে সতর্কতার সাথে বলল,
‘আপনি শুধু শুধু ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করবেন না।’
জাওয়াদ চোখ কপালে তুলল,
‘আমি শুধু শুধু ঝগড়া করি! এ্যাই, আমাকে তোমার ঝগড়াটে মনে হয়?’
মুশরাফা হেসে বলল, ‘আগে মনে হতো না, এখন মনে হয়। যেন তেন ঝগড়াটে নয় একবারে গাঁয়ের বউদের মতো দক্ষ ঝগড়াটে।’
জাওয়াদ হকচকিয়ে উঠল, ‘কী! আমি গাঁয়ের বউদের মতো ঝগড়া করি!’
মুশরাফা ঠোঁটে হাসি আটকে বলল, ‘ করেনই তো। যখন আমার পরিবারের কথা আসে, বা তাদের কেউ সামনে পড়ে তখন আপনার চেহারা পালটে যায়। চোখ ছোটো ছোটো করে, নাকের ডগা ফুলিয়ে, চোখ রাঙিয়ে, গলা উঁচু করে ঝগড়া শুরু করেন। আজ যখন আপনি সাফাপুর ছোট্টো একটা কথায় ঝগড়া করছিলেন তখন আমার আপনাকে গাঁয়ের বউদের মতো লাগছিল। আপনি চমৎকার ঝগড়া করতে পারেন। আজকের ঝগড়ার রেটিং দিতে বললে আমি ১০ এ ৭ দিব।’
জাওয়াদের কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। মাথা ঘুরছে। কী বলছে রাফা! ওকে কিসের সাথে তুলনা করছে, গায়ের বউদের সাথে! ভেবেই চোখ মুখ কুঁচকে এলো জাওয়াদ।
সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল, ‘ যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর। তোমার পরিবার এত কিছু করল তাতে কোন দোষ নেই। আমি দুটো প্রতিবাদ করলেই দোষ!’
মুশরাফা সে কথা গ্রাহ্য করল না। এখন কৌতুকের মনোভাব তার। গম্ভীর হওয়ার নয়। সে সুকৌশলে কথা এড়িয়ে বলল, ‘আপনার ৩নাম্বার কেটেছি কেন জানেন?’
জাওয়ার রাগ নিয়ে বলল, ‘ আমাকে রাগিও না রাফা। ‘
মুশরাফা হেসে বলল, ‘এই তো আবার শুরু করেছেন। এখন গায়ে একটা শাড়ি জড়ালে, আপনি ওদের মতোই কোমরে কাপড় বেধে আমার সাথে ঝগড়া করে ষোলকলা পূর্ণ করতেন। একটা কথা বলতেই হয়, ঝগড়ায় বেশ দক্ষতা আছে আপনার। অভিজ্ঞ ঝগড়াটে। ‘
জাওয়ার স্পষ্ট ধরতে পেরেছে মুশরাফার এসব বলার কারণ। ওর মারমুখী আচরণ মুশরাফার পছন্দ নয়। তাই উদ্ভট কথা বলে ওকে বিব্রত করার চেষ্টা করছে, যাতে পরবর্তীতে সে এমন আচরণ করার আগে দুইবার ভাবে। জাওয়াদ চাপা শ্বাস ফেলল। এবার সত্যি রাগ হচ্ছে। আর কিছুক্ষণ কথা বললে রাগ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মুশরাফাকে ভালোমন্দ বলে দিবে। জাওয়াদ মুখে হাত বুলিয়ে রাগ সংবরণের চেষ্টা করে বলল, ‘ পরে কথা বলব তোমার সাথে। রাখছি।’
মুশরাফা সতর্ক করল, ‘খবরদার ফোন রাখবেন না। এখন ফোন রাখলে আগামী দুইদিন আপনার সাথে কথা বন্ধ। আমি কিন্তু সিরিয়াসলি বলছি। ‘
শেষ দিকে মুশরাফার স্বর গম্ভীর শুনাল। এই মেয়েকে বিশ্বাস নেই। এখন ফোন রাখার পর দেখা যাবে সত্যি সত্যি কথা বলা বন্ধ করে দিবে। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। আজ হলো কী ওর? মজা করে, কিন্তু কখনো এতটা রাগায় না রাফা। তাদের শান্তিচুক্তি হয়েছিল যে, দুজনের একজন যখন রেগে যাবে অপরজন চুপ হয়ে যাবে। রাগত ব্যক্তি দূরে সরে থাবে। রাগ ঝরে গেলে আবার ফিরে আসবে। এতে বিপরীত মানুষ বাধা দিবে না। আজ তবে শান্তিচুক্তি ভাঙল কেন? কী করতে চাইছে রাফা। কৌতুহল জাগল মনে। নিশ্চুপ ফোন কানে ধরে রাখল। কোন রা করল না। কল ডিসকানেকটেড না হতে দেখে হাসল মুশরাফা। কৌতুকের সুরে বলল,
‘ তা যা বলছিলাম, আপনার ঝগড়া তিন নাম্বার কেটেছি কেন জানেন? জানেন না। জাজ হিসেবে আমার দায়িত্ব আপনাকে জানানো। শুনুন তবে, ১ নাম্বার কেটেছি, কাপড়ের জন্য গ্রামীণ নারীদের ঝগড়া মূল উপাদান হলো শাড়ি। শাড়ি পরে কোমরে আচঁল বেধে ঝগড়া করেন তারা। শাড়ি ছাড়া ঝগড়া জমে না। নেক্সট টাইম ঝগড়া করার সময় আমার কাছে আসবেন আমি শাড়ি পরিয়ে দিব।
আরেকনাম্বার কেটেছিল, পানের জন্য। গাঁয়ের মহিলারা পান চিবোতে চিবোতে ঝগড়া করে। ঝগড়া করার ফাঁকে পিক ফেলে। তারপর আবার ঝগড়া করে। পান হলো ঝগড়া দ্বিতীয় উপাদান। নেক্সট টাই। ঝগড়া করবার সময় পানি মুখে নিবে।
শেষ নাম্বারটা কেটেছি ইংরেজি বলার জন্য। ঝগড়ার মাঝে আমি লম্বা লম্বা ইংলিশ বাক্য ঝাড়েন। গ্রামের বউরা ঝগড়া আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে, তার ইংরেজি বলে না। নেক্সট টাইম ঝগড়া করার সময় ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করবে না। ‘
মুশরাফার কথায় স্পষ্ট তিরষ্কার। সম্পর্কের সুদিনের পর এই প্রথম স্ত্রীর প্রতি মাত্রাহীন রাগ জন্মেছে জাওয়াদের। জাওয়াদ গম্ভীরমুখে বলল, ‘ফর দ্যা ফার্স্ট টাইম ইউ হার্টিং মি, রাফা। ‘ ফোন রেখে দিল জাওয়াদ। মুশরাফা হাতে নিয়ে হাসল। প্রসন্ন মনে টাইপ করল,
‘ এই যে আমি এতগুলো কথা বললাম। আপনার ভীষণ রাগ লেগেছে, তাই না? আমি আপনাকে রাগানোর জন্যই বলেছি। আমি দেখতে চেয়েছিলাম রাগের কোন পর্যায়ে গিয়ে আমার প্রতি আপনার রাগ নিয়ন্ত্রণহীন হয়, আপনি শয়তানের কুমন্ত্রণায় পা দিয়ে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন, শান্তিচুক্তি ভঙ করেন। হৃদয়গ্রাহী ব্যাপার হলো রাগের চূড়ায় পৌঁছালেও আপনি শান্তিচুক্তি ভঙ করেন নি, আর না আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন। রাগের মাঝেও আপনার মস্তিষ্ক আমার ব্যাপারে সচেতন ছিল। আমি নিয়ন্ত্রণ রাগের বশবর্তী হয়ে আমাকে জবাব না দিয়ে রাগ মাড়িয়ে আমাকে এড়িয়ে গেছেন। কারণ, আপনি জানেন আপনার এই রাগ আমার ক্ষতি করবে, আমাদের সম্পর্কের ক্ষতি করবে। এটি আমার হৃদয় ছুঁয়েছে। এই পুরো ব্যাপারটায় আমি আপনার ভালোবাসা অনুভব করেছি। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিক। ‘
সেন্ড বাটন ক্লিক করে আবার লিখল,
‘রাগের এই নিয়ন্ত্রণটা শুধু আমার ক্ষেত্রে নয় সবার ক্ষেত্রে প্রয়োগ হওয়া চাই। আপনার রাগ যেমন আমার জন্য ক্ষতি, তেমনি অন্যের জন্য ও ক্ষতি, আপনার জন্য ও ক্ষতি। ভরা মজলিশে কাউকে দুটো কটু কথা শুনিয়ে দেবার, অপমান করবার মতো রাগ আপনার আমলনামাকে ধ্বংস করতে যথেষ্ট। বান্দার হক নষ্ট কিন্তু এটাকেই বলে। কেউ আপনার সাথে খারাপ বিহেব করেছে মানেই যে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে হবে তা কিন্তু শিক্ষা দেয়নি ইসলাম। ইসলাম ক্ষমা করতে বলেছে, সুন্দর ব্যবহার করতে বলেছে। বিনিময়ে আল্লাহ তাকে সঠিক বুঝ দিবেন। আপনি আজ কাউকে ক্ষমা করলে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করবেন।
আমি বলছি না আপনি প্রতিবাদ করবেন না, অবশ্যই করবেন। কিন্তু তা কারো মনে আঘাত দিয়ে নয়, বরং আপনার ভালো কাজ দিয়ে। ভালো কাজের চেয়ে উত্তম প্রতিশোধ দুটো নেই। কারো কোন একটি বিষয় আপনার খারাপ লাগলে আপনি তাকে কোমল স্বরে শুধু বলবেন, কাজটা কি ঠিক হলো আপনার? বা আপনি কাজটা ঠিক করেন নি। দেখবেন এই প্রশ্ন তাকে আপনার ব্যাপারে ভাবতে বাধ্য করবে। তাও না করলে আপনি সেই মানুষকে একান্তে ডেকে নিয়ে, কিংবা ফোনে বা চিঠিতে আপনার মনের দুঃখ বলবেন। এতে আপনার মনে শান্তি আসবে, সে শিক্ষা পাবে তবে আপমানীত হবে না। জনসম্মুখে কাউকে চোখ রাঙালেও অপমান দিগুণ হয়, বন্দার হকের গুনাহের মাত্রাও বাড়ে।
রাগ প্রকাশে নয়, রাগ দমন করাই বীরের কাজ। ঝগড়া করে গ্রামীণ নারীরা, কারণ তাদের মাঝে ধর্মীয়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব থাকে। মূর্খরাই ঝগড়া করে। সুশিক্ষিত বুদ্ধিমানরা কখনো ঝগড়া করে না। তারা চুপ থাকে, নিরব হয়ে কাজের মাধ্যমে জবাব দেয়। আমার চোখে আপনি বীর, সুশিক্ষিত, বুদ্ধিমান। আমি সবসময় আপনাকে উত্তমদের কাতারে দেখতে চাই। মূর্খ্যের কাতারে নয়। আমি চাই আপনি সব কিছু থেকে শুদ্ধ হন, আমার চোখে সেরা মানুষ হন। আল্লাহর কাছে উত্তম বান্দা হন। ‘
লম্বা দুটো ম্যাসেজের লেখে হাফ ছাড়ল মুশরাফা। চোখেমুখে অনুতাপের চাপ তার। লোকটাকে শিক্ষা দিতে গিয়ে অপমানটা বেশি হয়ে গেছে। আল্লাহ তাকে মাফ করুক। অপরদিকে জাওয়াদ গম্ভীরমুখে বসে আছে। রাগ সংবরণের চেষ্টায় তা’আউজ পড়ছে। পকেটে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট হলো দু’বার। জাওয়ার হাতে নিল না, দেখল না। সে নিশ্চিত মুশরাফার কাছ থেকেই কল বা ম্যাসেজ এসেছে। চাপা অভিমান হলো ওর, কথা বলবেনা আর। থাকুক মেয়েটা তার কৌতুক নিয়ে। যার প্রতি করা অবিচারের প্রতিবাদ করল, সেই তাকে খারাপ প্রতিপন্ন করছে। শাড়ি পরতে বলছে! মেয়েটা পারল এত অপমান করতে?
মিনিট দশেক এভাবে বসে রইল। তারপর সময় দেখার জন্য ফোন বের করল। তখনই মুশরাফার পাঠানো ম্যাসেজ নোটিফিকেশন চোখে পড়ল। অভিমান থেকেই ম্যাসেজ ওপেন না করে ফোন রেখে দিচ্ছিল। সেই ক্ষণে আরেকটা ম্যাসেজ এলো,
‘ স্যরি! আমি এতসব শুধু আপনাকে বুঝানোর জন্যই বলেছি। আর কিছু নয়।’
জাওয়াদ কৌতূহলী হলো এটুকু লেখা দেখে। কী ভেবে ওপেন করল। প্রথম দুটো ম্যাসেজ পড়তেই মুশরাফার রাগের কারণ উন্মোচন হয়ে গেল। এতগুলো মানুষকে অপমান করে জাওয়াদ বান্দার হক নষ্ট করেছে, যা ইসলাম বিরোধী। এটা বুঝানোর জন্য এবং স্বামীকে শিক্ষা দানের জন্য মুশরাফার এত আয়োজন। জাওয়াদ তৃতীয় ম্যাসেজ ওপেন করল,
‘ আপনি হাসপাতালে এতগুলো মানুষের সামনে একটা মানুষকে ওভাবে অপমান করছিলেন দেখে আমি মেনে নিতে পারিনি। আমার কেবলই মনে হয়েছে, আমার ইসলাম এটা শিক্ষা দেয়না। ইসলাম মানুষকে সম্মান করতে শেখায়, অপমান করতে নয়। উনারা ইসলাম জানেনা তাই তারা মানুষকে সম্মান করে না। আমি আপনি তো জানি, আমাদের উচিত সম্মান বজায় রাখা।
স্যরি! আমি মন থেকে ওসব বলিনি। ট্রাস্ট মি! আপনাকে হার্ট করতে গিয়ে আমি ও হার্ট হয়েছি। আপনি কি বেশি রাগ করেছেন? কথা বলবেন না আমার সাথে?’
যে তিক্ত কাজের পেছনে সৎ উদ্দেশ্য থাকে, সে কাজে কষ্ট পেতে নেই রাগ করতে নেই। জাওয়াদের রাগটা হয়েও হলো না। এই ক্ষণে এসে তারও মনে হলো, আসোলেই তখন ওতগুলো মানুষের সাথে সাফাকে অপমান করা উচিত হয়নি। তার স্ত্রীকে অপমান করেছে বলে সে ও কারো স্ত্রীকে অপমান করেছে। সাফার হাজবেন্ড ছিল, তার কেমন লেগেছে! তারমতো খারাপ লেগেছে না? বলা হয়, একান্তে ডেকে খু/ ন করা থেকে প্রকাশ্যে চ/ ড় মারার কষ্ট বেশি। ছোটো বড়ো কতগুলো মানুষের সামনে সাফাকে কত কী বলে ফেলেছে জাওয়াদ। লজ্জায় মেয়েটা খানিক বাদেই হাসপাতালে থেকে চলে গেছে। কতগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়েছে সে। বান্দার হক নষ্ট করেছে।
ওদের প্রতি ক্ষোভ ছিল। ক্ষোভটা পরেও প্রকাশ করা যেত কিংবা অন্যভাবে। এগ্রিসিভ হওয়া ঠিক হয়নি। প্রতিবাদটা করা উচিত ছিল মুশরাফার মতো। মেয়েটা খেজুর দিয়ে কিভাবে প্রতিবাদ করেছিল। প্রতিবাদ বোধহয় একেই বলে। অনুতাপ হলো জাওয়াদের বান্দার হক নষ্টের ভয় ও হলো। ব্যাপারটা অনুধাবন করানোর জন্য স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ ও হলো। মুশরাফা কল দিল। সুক্ষ্ম অভিমান থেকে ফোন ধরল না। মুশরাফা আবার কল দিল, ভিডিও কল। জাওয়াদ এবার রিসিভ করে ফোন সামনে আনল। কিন্তু কোন রা করল না। মুশরাফা দুঃখী চেহারা ভাসল সামনে। অনুতাপের সুরে বলল,
‘স্যরি!’
জাওয়াদ চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল। মুশরাফা বলল, ‘রেগে থাকলে আপনাকে সুন্দর দেখায়। মাশা আল্লাহ!’
জাওয়াদের ভাবাবেগ হলো না। মুশরাফা আকস্মিক চঞ্চল গলায় বলল,
‘ আমি কী সুন্দর একটা জামাই পাইছি! আল্লাহ! ফোনটা মুখের সামনে ধরেন তো? দেখি ভালো করে।’
চঞ্চলতা চঞ্চল্যে হেসে ফেলল জাওয়াদ। পাজি মেয়ে রাগতেও দিবেনা।
চলবে…
অল্প সময়ে পরিকল্পনা ছাড়া লিখেছে এই পর্বটা। লেখার পর দেখি মনমতো হয়নি। কাহিনি আগায়নি। ভেবেছি দিব না। আবার লিখব। পরে ভেবে দেখলাম এতে পাঠকের অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয়ে যাবে। তাই এই খাপছাড়া পর্ব দিয়েছি। সেই সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে হয় এটা ডিলিট দিয়ে নতুন করে লিখব নয়তো ২৪ এর আরেকটা অংশ লিখব ইনশা আল্লাহ।
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা