স্বপ্নচারিণী,পর্ব_১৩

স্বপ্নচারিণী,পর্ব_১৩
সামান্তা সিমি

থতমত খেয়ে গেল ছেলেটা।বোধহয় এরকম কথাটা আশা করেনি।চারজন মেয়ের কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টি যেন তাঁর অস্বস্তি আরো বাড়িয়ে তুলল।

“—আসলে আমি এতকিছু ভেবে বলিনি।আর নিশান ভাইয়া এত বড় একজন মানুষ। কে না চিনে উনাকে।
আচ্ছা এসব ছাড়ুন।আমার নাম সাফি।আপনারা?”

মনীষা কিছুটা বিরক্ত হয়েই সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।সাফি অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল,

“—আপনাদের বাড়িটা খুব সুন্দর। আমি একটু চারপাশটা ঘুরে দেখতে চাই।আপনারা আমাকে হেল্প করবেন?”

কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই পেছনে ফেরল ছেলেটা।নিশান দাঁড়িয়ে আছে স্থির চাহনি দিয়ে।ছেলেটাও একইভাবে তাকিয়ে আছে।দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে চোখে চোখেই ওরা অনেক কথা বলে ফেলছে।
বাঁকা হেসে নিশান বলল,

“—চলুন মিস্টার সাফি।আমি আপনাকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাব।আশা করি খুব এনজয় করবেন।”

ছেলেটাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই একপ্রকার জোরপূর্বক হাত টেনে বাইরে নিয়ে গেল নিশান।যূথী ভ্রুকুটি নিয়ে ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।নিশান ভাইয়ার ব্যবহারটা কেমন যেন অদ্ভুত লাগল।

* রিসিপশনের অনুষ্ঠান প্রায় শেষ।হলরুমে কয়েকজন শুধু বসে গল্প করছে।
মনীষা,বিদীষা,নীলিমা যে যার যার রুমে ঘুমে বেঘোর।এদিকে যূথী একবার দোতলায় একবার ড্রয়িংরুমে সাফাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান।পিচ্চি মেয়েটা তখন গেইম খেলবে বলে যূথীর মোবাইলটা নিয়ে গেছে।এখন তাঁর পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছে না।যূথী ভাবল একবার গার্ডেনে দেখে আসবে।হয়তোবা ওখানে বসে অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলায় ব্যস্ত।

বাগানে গিয়েও হতাশ হলো যূথী।এখানেও নেই।কে জানে তাঁর সাধের মোবাইলটার কি দশা করে রেখেছে।ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য পেছনে মোড় নিতেই থেমে গেল যূথী।একটা অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ আসছে।মনে হচ্ছে কেউ যেন একটু পর পর যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠছে।
শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে বাগান পেরিয়ে ডান সাইডের খোলা জায়গাটায় পৌঁছালো।
সামনের দৃশ্যটা দেখে মাথায় বাজ পরল যূথীর।বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে।
নিশান সেই সাফি নামের ছেলেটাকে একটা মোটা লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটাচ্ছে।সাফির অবস্থা খুব শোচনীয়।ঠোঁটের এক সাইড কেটে রক্ত ঝরছে।কপালের একপাশটাও কালচে হয়ে আছে।অন্যদিকে নিশানের ফর্সা মুখটা রক্তলাল। মনে হচ্ছে রাগের সপ্তম চূড়ায় উঠে গেছে।
স্তব্ধ হয়ে গেল যূথী।মাথায় শুধু একটা কথা-ই ঘুরছে।নিশান ভাইয়া কেনো সাফিকে এভাবে মারছে।ছেলেটার যন্ত্রণা দেখে যূথী ভয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরছে।কি করবে সে এখন? দৌড়ে গিয়ে সাফিকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে কি?নাকি বাড়ির লোকদের ডেকে আনবে?
নিশানের পাশেই আরেকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে।চোখের সামনে এতকিছু দেখেও ওই ছেলেটা কিছুই বলছে না।
যূথী এগিয়ে যেতে নিবে তখনই সাফিকে উদ্দেশ্য করে নিশানের বলা কিছু কথা শুনে থেমে গেল।

“—তোকে জানে মেরে ফেলব আজ।বাঘের গুহায় ঢুকেছিস তুই।এ বাড়ির মেয়েদের ক্ষতি করার কথা ভাবলি কিভাবে?এখানে পা রাখার আগে তোর একবার আমার নামটা উচ্চারণ করা দরকার ছিল। বল কে পাঠিয়েছে তোকে?”

কথাগুলো বলে আবার মারতে লাগল নিশান।সাফি কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত অবস্থায় নেই।ছেলেটা বোধ হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে।
নিশানের বলা কথাগুলো যূথীর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সাফি কখন এ বাড়ির মেয়েদের ক্ষতি করল?

নিশান হাতের লাঠিটাকে দূরে ছুড়ে মেরে পাশের ছেলেটাকে বলল,

“—সাইফ!! আপাদত একে হসপিটাল নিয়ে যাও।জ্ঞান ফিরলে পেট থেকে কথা বের করার চেষ্টা করবে।এই হারামিকে কেউ একজন টাকা খাইয়ে এখানে পাঠিয়েছে।আর হিমেশের ফোন বন্ধ পাচ্ছি কেনো? ওকে বলবে আর্জেন্ট যেন আমার সাথে যোগাযোগ করে।”

নিশান দুইকদম সামনে এগিয়েই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যূথীকে দেখতে পেল।মুহূর্তেই তাঁর সমস্ত রাগ গিয়ে পরল যূথীর উপর।এতক্ষণে তাহলে সব দেখে ফেলেছে মেয়েটা।

“—এখানে কি করছো তুমি?”

চোখের সামনে নিশানকে দেখতে পেয়ে হুঁশ ফিরল যূথীর।সে সামনের দৃশ্যটায় এতই বিভোর হয়ে ছিল যে নিশান কখন সামনে এসেছে তা দেখতেই পায় নি।নিশানের লাল চোখগুলো দেখে যূথীর ভয় দ্বিগুণ বেড়ে গেল। তাঁর কেনো জানি মনে হচ্ছে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার অপরাধে নিশান তাঁর গালে ভয়ানক এক চড় বসিয়ে দিবে।লোকটার ওমন শক্ত হাতের একটা চড়েই তো সে কুপোকাত হয়ে যাবে।

“—ভা…ভাইয়া! আপনি ও..ওই ছেলেটাকে এভাবে মারছিলেন কে..কেনো?”

নিশানের শক্ত জবাব,

“—তাঁর উত্তর জেনে তো তোমার কাজ নেই। এখানে কি করছো তুমি? নিজের ঘরে যাও।আর একটা কথা শুনে রাখো।এখানে যা যা দেখেছো সব কিছু ব্রেইন থেকে ডিলিট করে দাও।বাড়ির কেউ যেন কিচ্ছু জানতে না পারে।বাই চান্স যদি জেনে যায় তাহলে তোমার অবস্থাও ওই ছেলেটার মতই হবে।গট ইট?”

মাথা নেড়ে দৌড়ে চলে গেল যূথী।এখনো তাঁর চোখে একটু আগের ঘটনাটা ভাসছে।কিছুক্ষণের জন্য যূথী ভুলে গেছিল নিশানের প্রফেশনের কথা।হয়তোবা সাফি কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করেছিল আর নিশান ভাইয়া সেটা বুঝে ফেলেছে। তবুও কি একজন আরেকজনকে এভাবে মারতে পারে? আজকের পর যূথীর চোখে নাফিস ইমতিয়াজ নিশান একটা আতঙ্ক হয়ে থাকবে।

_______________________

* সন্ধ্যার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইলে গান শুনছে যূথী।তাঁর মন কিছুটা খারাপ।মনীষা,বিদীষা,নীলিমা কেউই বাড়িতে নেই।সেই বিকেলে ওরা ওদের মা’য়ের সাথে শপিংয়ে গিয়েছে আর এখনও আসার নাম নেই।ওরা যে কত শপিং করতে পারে।টাকা থাকলে এমনই হয়। অবশ্য ওরা যূথীর জন্যও একগাদা জামা কাপড় নিয়ে আসবে।গত একমাসে ওদের খুব ভালোভাবেই চিনে ফেলেছে।
মেয়েগুলো বাড়ি না থাকলে খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
হঠাৎ যূথীর মাথায় একটা প্ল্যান আসলো।ওরা আসার আগেই যদি মজাদার কিছু নাস্তা বানিয়ে ফেলা যায়!এটাই ভালো হবে।সময়টাও কাটবে আর ওদেরও সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে।ড্রয়িংরুমেও নিশ্চয় এখন কেউ নেই।আরামসে কাজ করা যাবে।যেই ভাব সেই কাজ।
গলায় চিকন একটা সুর তুলে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চলল যূথী।কিন্তু তাঁর সব প্ল্যানে এক বালতি পানি ঢেলে ড্রয়িংরুমে নিশান বসে আছে।
মন ভেঙে গেল তাঁর।এই লোকটার কি এখানেই বসে থাকার দরকার ছিল? আজকেই কি তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসার দরকার ছিল? অন্যদিন তো বাড়ি আসে রাত বারটা নয়তো একটায়।
এখন কিচেনে যেতে হলে নিশান ভাইয়াকে আগে ক্রস করতে হবে।আজকাল নিশান ভাইয়ার ছায়া দেখলেও যূথী আতংকিত হয়ে যায়।ওইদিন বাগানে যে রূপ দেখেছে এরপর তো সামনে যেতেই ভয় লাগে।
এখন মনে হচ্ছে যদি তাঁর কাছে অদৃশ্য কোনো শক্তি থাকত তাহলে সেটা ব্যবহার করে নিশান ভাইয়ার সামনে দিয়ে নাচতে নাচতে কিচেনে যাওয়া যেত।
বুকে ফুঁ দিয়ে যূথী সিড়ি দিয়ে নামতে লাগল।ঠিক করে নিয়েছে নিশান ভাইয়ার দিকে না তাকিয়েই এক দৌড়ে কিচেনে চলে যাবে।

সোফায় বসে পেপারের পাতা দেখছিল নিশান।শহরে ক্রাইমের ছড়াছড়ি। পেপার হাতে নিলেই বুঝা যায় কত মানুষের আহাজারি, কত কান্না। বড় বড় ক্রিমিনালদের ধরার পরও অপরাধের মাত্রা কমছে না।উল্টে যেন দ্বিগুণ আকার ধারণ করেছে।

সিঁড়ি দিয়ে কারো হাঁটার আওয়াজ পেতেই সেদিকে তাকাল নিশান।যূথী নেমে আসছে।বাঁকা হাসি ফুটে উঠল তাঁর মুখে।আজকাল তো যূথীকে কাছেই পাওয়া যায় না।সে বাড়িতে থাকে খুব অল্প সময় যার জন্য মেয়েটার সাথে কথা বলা দূরে থাক দেখাই হয় না প্রায়।
যূথী ড্রয়িংরুমের মাঝখানে আসলে ডেকে উঠল নিশান।

“—কোথায় যাচ্ছো?”

থেমে গেল যূথী।যে ভয়টা পাচ্ছিল তা-ই হয়েছে।পুলিশ মানুষদের এই এক সমস্যা। যখন তখন জেরা করা শুরু করে দেয়।দুনিয়ার যত প্রশ্ন সব তাঁদের পেটের ভেতরে থাকে।
নিশানের দিকে না তাকিয়েই যূথী জবাব দিল,

“—কিচেনে যাচ্ছি। ”

“—কথা বলার সময় চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হয় জানো না? ওদিকে ফিরে আছো কেনো?”

দাঁতে দাঁত ঘষল যূথী।এই লোক সবসময় তাঁকে হেনস্তা করে কি সুখ পায় কে জানে।একটু ভালোভাবেও তো কথা বলা যায় নাকি! যখনই দেখে তখনই শুধু ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলবে।যত্তসব!

“—এই যে চোখে চোখ রাখলাম।এখন ঠিক আছে?”

মুচকি হেসে নিশান বলল,

“—এক কাপ কফি নিয়ে এসো।”

“—পারব না।অন্য কাজ আছে আমার।”

“—আরেকবার বলো তো কথাটা!”

“—না….মানে..আপনি অপেক্ষা করুন। আমি নিয়ে আসছি।”

রাগে গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকল যূথী।কোথায় ভাবল মনের মত করে কিছু নাস্তা বানাবে।তা আর হলো কই।বাড়িতে এমন এক জল্লাদ থাকতে কোনো কাজ শান্তিমতো করা যায় নাকি।
হঠাৎ তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।লোকটা তাঁকে অলওয়েজ এত জ্বালায় তাহলে বিনিময়ে তাঁরও তো কিছু করা উচিত।
শয়তানি হাসি দিয়ে চটপট এক কাপ কফি বানিয়ে ফেলল।
কোনো রকমে হাসি কন্ট্রোল করে নিশানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

“—এই নিন আপনার কফি।”

ভ্রু কুচকে নিশান বলল,

—এত তাড়াতাড়ি। গুড জব!

যূথী নীরব ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
কফিতে এক চুমুক দিয়েই নিশানের চোখ রসগোল্লার মত হয়ে গেল।কি করেছে এই মেয়ে! কফিতে এত পরিমাণ চিনি দিয়েছে যে বমি আসার উপক্রম। যূথীকে ঠোঁট টিপে হাসতে দেখে নিশানের আরো রাগ উঠে গেল।

“—কি বানিয়েছো এটা? কফি নাকি শরবত?”

“—আসলে নিশান ভাইয়া ইচ্ছে করেই চিনি একটু বাড়িয়ে দিয়েছি।আপনি সবসময় এত রেগে থাকেন তাই ভাবলাম যদি চিনি বাড়িয়ে দেই তাহলে হয়তোবা আপনার মুখ দিয়ে কিছু মিষ্টি কথা বের হবে।”

আরেক দফা অবাক হলো নিশান।যূথীর কথা শুনে কি রিয়্যাকশন দেখাবে বুঝে উঠতে পারছে না।যে মেয়ে কিনা তাঁর চোখের দিকে তাকালেই কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দেয় সে-ই কিনা এত কথা বলা যাচ্ছে। তাও তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। খুব হাসি পাচ্ছে নিশানের।তবুও চেহারায় রাগ ফুটিয়ে বলল,

“—আমার সাথে ইয়ার্কি করছো?এর ফল কি হবে ভেবে দেখেছো কি?”

নিশানকে এগিয়ে আসতে দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেল যূথী।মনের জিদ মিটাতে গিয়ে এতক্ষণ সাহস জুগিয়ে অনেক কথা বলে গেছে।এখন কি হবে?
আরো কিছুটা এগিয়ে আসতেই ফোন বেজে উঠল নিশানের।এই সুযোগে যূথী কিচেনে দৌড়ে চলে গেল।জোর বাঁচা বেঁচে গেছে আজ।যে ফোন করেছে তাঁকে হাজারটা ধন্যবাদ জানিয়ে নাস্তা বানানোয় মন দিল যূথী।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here