স্বপ্নচারিণী,পর্ব_১২

স্বপ্নচারিণী,পর্ব_১২
সামান্তা সিমি

বাড়ির মেইন ডোরের সামনে সবাই সারি বেঁধে মাহির এবং কারিমার জন্য অপেক্ষা করছে। যূথী দাঁড়িয়ে আছে বড়মা’র পাশে।তাঁর চোখ ঘুমে ঢুলুমুলু করছে।তখন নিশানের রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েই বিছানায় শুয়ে পরেছিল।দশমিনিট মাত্র ঘুমাতে পেরেছে।এরপরই বড়মা তাঁকে ডেকে এখানে নিয়ে এসেছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুলে সজ্জিত গাড়িটা দেখা গেল।মাহির প্রথমে নেমে কারিমাকে হাত ধরে নিয়ে আসছে।ওদের দুইজনকে একসাথে দেখে যূথীর চোখ ধাঁধিয়ে গেল।দু’জন যেন একদম মেইড ফর ইচ আদার।
নীলুফা চৌধুরী তাঁর ছেলের বউকে বরণ করে নিলেন।
ভীড়ের মধ্য থেকে হঠাৎই মনীষা নীলিমা বেরিয়ে এসে যূথীর হাত ধরে টেনে সিড়ির দিকে নিয়ে গেল।
এতক্ষণ যূথী ঘুমের কারণে চোখে অন্ধকার দেখলেও এখন চারপাশের গঞ্জনায় মাথা ধরে যাচ্ছে।
যূথী চেঁচিয়ে বলল,

“—এভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছো কেনো তোমরা?”

নীলিমা ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

“—মাহির ভাইয়ার রুমের দরজার সামনে দাঁড়াতে হবে।ওর থেকে আরো কিছু টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সময় চলে এসেছে।চলো চলো।”

যূথী হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না।এই তিনবোন তো আসলেই কূটনীতিবাজ।আজ বেচারা মাহির ভাইয়ার কি হাল হয় কে জানে।ওরা এত সহজে ভাইয়াকে ছাড়বে বলে মনে হয় না।
কিছুক্ষণ পর কয়েকজন মহিলা কারিমাকে মাহিরের রুমে বসিয়ে দিয়ে গেল।রুম আগে থেকেই ফুল মোমবাতি দিয়ে সাজানো।
মেয়েদের গ্রুপটা পাহারাদারের মত রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যূথী বারবার বলছে,

—“তোমরা যে কি করছো! আগে আমরা নতুন বউয়ের সাথে কথা বলে আসি চলো।পরে না হয় এসব করা যাবে।”

“—নো নো যূথী।আগে টাকা তারপর সব।আর ভাবীর সাথে আমরা অনেক কথা বলেছি।তুমি না হয় কাল পরিচিত হবে।আমরা তো প্ল্যান করে ফেলেছি মাহির ভাইয়া থেকে এখন যে টাকাটা আদায় করব সেটা দিয়ে সব বোনেরা মিলে একটা পার্টি অ্যারেঞ্জ করা যাবে।”(মনীষা)

তখনই বিদীষাকে দেখা গেল দৌড়ে সিড়ি দিয়ে উপরে আসছে।।হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

“—গাইজ! সাবধান হও।মাহির ভাইয়া ইজ কামিং।”

দূর থেকে কূটনী বোনগুলোকে দেখে মাহির যা বুঝার বুঝে নিয়েছে।তাঁর খুব হাসি পাচ্ছে। এই মেয়েগুলো যে কি! বিয়ের শপিংয়ের জন্য অলরেডি তাঁর একটা কার্ড শেষ করে ফেলেছে।এখন আবার টাকা নেওয়ার ধান্দায় ওঁত পেতে আছে।অবশ্য এরাই হৈচৈ করে বাড়িটাকে মাথায় করে রাখে।প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানে ওরা নেচে গেয়ে আনন্দ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।
চেহারায় যথাসম্ভব রাগী ভাব এনে মাহির ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

“—কিরে এরকম ভিক্ষুকের মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন?দরজা থেকে সরে দাঁড়া।ভিক্ষুকদের জায়গা এটা নয়।রাস্তায় চলে যা।”

মাহিরের কথা শুনে চারজনের চোখ বড় বড় হয়ে গেল।যূথী মনীষাদের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বলল,

“—আমি ভিক্ষুক না মাহির ভাইয়া।দেখো আমি ওদের দলে নেই।”

“—আমি সেটা জানি যূথী।তুমি আমার পেছনে এসে দাঁড়াও।এদের তিনোটাকে আমি দেখছি।”

মনীষা তেড়ে এসে বলল,

“—ভিক্ষুক বলো আর যা-ই বলো।আগে টাকা দাও তারপর এই রুমে ঢুকতে পারবে।”

“—একটা টাকাও দিব না আমি।কি করবি হ্যাঁ?”

মনীষার চেঁচানো কন্ঠ,

—“আমরাও দেখি তুমি কি করে রুমে ঢুকো।”

ছোটখাটো একটা যুদ্ধ লেগে গেল।যূথী এক কোনায় দাঁড়িয়ে ওদের তর্ক শুনে যাচ্ছে। কেউ কারো থেকে কম না।মাহির ভাইয়া একটা বলে তো তিনবোন আরো তিনটা বলে তাঁকে থামিয়ে দেয়।
হঠাৎই,

“—-কি হচ্ছে এখানে?”

ভারী গলার আওয়াজ শুনে সবাই পিছনে তাকাল।ভ্রু কুচকে নিশান দাঁড়িয়ে আছে।চোখগুলো ফোলা ফোলা।দেখেই বুঝা যাচ্ছে ঘুম থেকে উঠে এসেছে।মনীষা,বিদীষা, নীলিমা এতক্ষণ রণচণ্ডী রূপে যুদ্ধ করলেও নিশানকে দেখে একদম ভেজা বেড়াল হয়ে গেল।আর এদিকে মাহিরের মুখে তো অবর্ণনীয় হাসি ঝুলছে।
নীলিমা ভীত গলায় বলল,

“—ভা…ভাইয়া! তুমি এখানে? তোমার না জ্বর?”

নিশান দাঁত কটমট করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।তাঁর মন চাইছে সবগুলোকে আছাড় মেড়ে সিড়ি থেকে ফেলে দেয়।

“—থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দিব তোদের। এখানে কি নাটক শুরু করেছিস?তোদের চিৎকার শুনে ঘুম থেকে উঠে এখানে আসতে হয়েছে আমার।এক মিনিট সময় দিলাম।এরমধ্যে জায়গাটা ফাঁকা চাই।কুইক!

মনীষা,বিদীষা,নীলিমা কোনোদিকে না তাকিয়ে যূথীকে ফেলেই দৌড়ে চলে গেল।মাহির দাঁত কেলিয়ে বলল,

“—দ্যাটস্ হোয়াই আই লাভ ইউ বিগ ব্রো।কূটনী গুলো আমাকে যেভাবে আক্রমণ করেছিল।তুমি না আসলে আমার দফা রফা হয়ে যেত।গুডনাইট এভরিবডি।”

মাহির দরজা বন্ধ করার পর যূথী আড়চোখে তাকিয়ে দেখে নিশান এগিয়ে আসছে।সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেল সে।

“—রাত কয়টা বাজে দেখেছো?এখনো ঘুরঘুর করছো কেনো?”

“—যাচ্ছি তো।”

যূথী কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার পেছনে তাকাল।নিশান একইভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে।ঘাড় ফিরিয়ে নিল যূথী।এমন কঠিন মানব সে আর দুটো দেখেনি।মেয়েগুলো একটু আনন্দ করতে চেয়েছিল সেখানেও এসে গেছে বাগড়া দিতে।নিজে তো বিয়ে করবে না।এখন ওরা তো মাহির ভাইয়ার বিয়েতেই যা মজা করার করবে তাই না! কিন্তু না এই আজব লোকটার সেটাও সহ্য হবে না।মনে মনে কথাগুলো বলে মুখ ভ্যাংচালো যূথী।

________________

মাহির এবং কারিমার রিসিপশন উপলক্ষে বাড়ি সেজে উঠেছে খুব জাঁকজমক ভাবে।সন্ধ্যা হতেই অতিথিদের আগমন শুরু হয়ে গেছে।সাউন্ড বক্সে হালকা আওয়াজে একের পর এক রোমান্টিক গান বেজেই চলেছে যা পরিবেশটাকে আরো মাতিয়ে তুলছে।
ড্রয়িংরুমের একপাশে মনীষাদের সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছে যূথী।ওদের বিপরীত পাশে একটা চেয়ারে বসে নিশান পলকহীন চোখে যূথীকে দেখছে।ব্যপারটা লক্ষ্য করার পর থেকেই যূথীর ছটফটানি যেন বেড়ে গেছে ।তাঁর মন চাইছে নিশানকে গিয়ে কড়া করে দুইটা কথা শুনিয়ে দেয়।এভাবে কেউ কারো দিকে তাকিয়ে থাকার মানে কি?কিন্তু আফসোস সে তো ওই লোকের চোখের দিকেই ভালোভাবে তাকাতে পারে না তাহলে কথা শুনাবে কিভাবে।
মেইন ডোরের দিকে নজর দিতেই যূথীর চোখমুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।লতিফা চাচী এসেছে।যূথী দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। সেই যে গ্রাম থেকে এসেছে এরপর আর লতিফা চাচীকে দেখেনি সে।

“—চাচী তুমি বিয়েতে কেনো আসলে না?”

লতিফা বেগম যূথীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“—তোর চাচাকে একা ফেলে কিভাবে আসি বল?বড় আপা তো রেগে আছে আমার উপর।তারজন্যই আজকে আসা। কাল সকালেই আবার ফিরে যাব।তোর এখানে থাকতে কেমন লাগছে বলতো?”

যূথী তৃপ্তির সহিত উত্তর দিল,

“—অনেক ভালো আছি চাচী।এ বাড়ির মানুষ গুলো এত ভালো! ওদের কাছের কেউ না হয়েও সবাই মেয়ের মত আপন করে নিয়েছে আমাকে।”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন লতিফা বেগম।আজ এখানে আসার আরো একটা উদ্দেশ্য আছে তাঁর।সেটা নিয়েই বড় আপার সাথে কথা বলবেন।

________________

“—যূথীর জন্য একটা ভালো ছেলে পেয়েছি আপা।ঢাকাতেই নাকি থাকে।আমি ঠিকানা নিয়ে এসেছি।”

করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় এমন একটা অপ্রত্যাশিত কথা শুনে থেমে গেল নিশান।অভ্যাসমত রাগটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
দরজার সামনে যেতেই দেখল তাঁর মা এবং খালামণি সোফায় বসে আছে।একটু আগের কথাটা তাহলে খালামণিই বলেছে।
দুইবোন নিশানকে এখনো খেয়াল করেনি।

“—আপা তুমি ওই ছেলেটার সাথে যূথীর দেখা করার ব্যবস্থা করে দাও।”

নিশানের হাতের মুঠো শক্ত হয়ে আসছে। তাঁর সামনে কেউ যূথীর বিয়ের ব্যপারে কথা বলছে এটা সে কোনোভাবেই মানতে পারছে না।যূথী শুধু তাঁর।এই মেয়েটাই তাঁর বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ।

“—স্টপ খালামণি! ওখানেই থেমে যাও।এই ব্যপারটা নিয়ে যেন আর কোনো কথা না হয়।”

নিশানের এমন গর্জন শুনে চমকে উঠল দুইবোন।নীলুফা চৌধুরীর মুখে ভয়ের ছায়া দেখা যাচ্ছে। তাঁর ছেলে যদি লতিফার বলা কথাগুলো শুনে থাকে তাহলে তো তুফান বইয়ে দেবে।
তিনি ধমকের সুরে বললেন,

“—এটা কেমন ব্যবহার নিশান।কথাবার্তা কি শান্তভাবে বলা যায় না?”

“—যেখানে যূথীর বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে সেখানে আমি কিভাবে শান্ত থাকব মা? তুমি থাকতেও খালামণি কিভাবে এসব নিয়ে আলোচনা করতে পারে?”

লতিফা বেগম ঘটনার অর্থ কিছুই বুঝতে পারছেন না।নিশান কেনো হঠাৎ এভাবে রেগে উঠল?

“—বড় আপা আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না।আর নিশান তুই এরকম চটে গেলি কেনো বাবা?”

নীলুফা চৌধুরী লতিফা বেগমকে শান্ত থাকার ইশারা করে নিশানকে বললেন,

“—তোর খালামণি এখনো পুরো ঘটনা জানেন না।আমি এখনই সব খুলে বলতাম ওকে।তাঁর আগেই তুই এসে এমন হুমকি দেওয়া শুরু করলি।এখন যা এই রুম থেকে।আমি সব সামলে নেব।”

নিশান চলে যেতেই লতিফা বেগম উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“—কিসের ঘটনার কথা বলছিলে আপা?”

“—নিশান যূথীকে ভালোবাসে।বিয়ে করতে চায় ওকে।তার জন্যই তোর কথা শুনে এভাবে রেগে গেছিল। ”

লতিফা বেগম যেন আকাশ থেকে পড়লেন।কথাটা হজম করতে তাঁর বেশ সময় লাগছে।

“—কি বলছো আপা? এটা তো খুবই ভালো খবর! যূথীও কি রাজি আছে?”

মুখ গম্ভীর করে নীলুফা চৌধুরী বললেন,

“—যূথী এখনো এই ব্যপারে অবগত না।আমিও চাইছি না সে এই মুহূর্তে এটা নিয়ে কোনো প্রকার চাপে থাকুক।আর বাড়ির লোকও তো কিছু সমস্যা তৈরি করবে এখানে।বিশেষ করে বিথী।বিয়ে টিয়ের ঝামেলা শেষ হোক তারপর ধীরে সুস্থে জানানো যাবে।”

“—কিন্তু আপা।নিশানের আর যূথীর বয়সের পার্থক্যটা অনেক বেশি। এদিকটা নিয়ে ভেবে দেখেছো?”

নীলুফা চৌধুরী মুচকি হেসে বলে উঠলেন,

“—ভালবাসার কাছে বয়স হার মেনে যায় জানিস তো!যূথীকে বড্ড ভালোবাসে আমার ছেলেটা।নিশানকে তো চিনিস। একরোখা ধরনের স্বভাব।এই মানুষ গুলো যখন কাউকে ভালোবাসে তখন জান দিয়েই ভালোবাসে।চিন্তা করিস না।দেখবি সব ঠিকঠাকই হবে।”

বড় আপার কথায় ভরসা পেলেন লতিফা বেগম। যতই ঝামেলা হোক বড় আপা যেহেতু রাজি আছেন তাহলে আর কোনো চিন্তার কারণ নেই।

* একটা টেবিলে গোল হয়ে বসে আছে যূথী এবং তিনবোন। মোবাইলে সেলফি তুলার ক্লিকের ফটফট আওয়াজে যূথীর কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। ওরা যে কত ছবি তুলতে পারে!সুন্দরী মানুষরা মনে হয় এমনি হয়।নিজেদের সৌন্দর্যটাকে তাঁরা উপভোগ করতে চায় বেশি বেশি।
হঠাৎই সবার মনযোগ আকর্ষণ করল কালো শার্ট পরা গোবেচারা ধরনের একটা ছেলে।যে এই মুহূর্তে ওদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।

“—আপনারা বুঝি নিশান ভাইয়ার বোন?”

ছেলেটার প্রশ্ন শুনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল ওরা।মনীষা জিজ্ঞেস করল,

“—আপনি কে?”

“—আমি কনে পক্ষেরই একজন।কই উত্তর দিলেন না তো! আপনারা নিশান ভাইয়ার বোন? ”

বিনীত ভঙ্গিতে ছেলেটা প্রশ্ন করল।
মনীষা সন্দেহর চোখে বলল,

“—কনেপক্ষের হলে নিশান ভাইয়াকে কিভাবে চিনেন? ভাইয়া তো বিয়েতে যায় নি!তাহলে আপনার তো এভাবে জিজ্ঞেস করার কথা যে আমরা মাহির ভাইয়ার বোন কিনা!

থতমত খেয়ে গেল ছেলেটা।বোধহয় এরকম কথাটা আশা করেনি।চারজন মেয়ের কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টি যেন তাঁর অস্বস্তি আরো বাড়িয়ে তুলল।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here