স্কুল জীবনের প্রেম,পর্ব_১

স্কুল জীবনের প্রেম,পর্ব_১
লেখা_জান্নাতুল নাঈমা

১৪ই ফেব্রুয়ারী। ২০০৯ সাল। ঘড়িতে সময় তখন সকাল ৯টা বেজে ৩৫ মিনিট। আমি তাসমিয়ার পথ আটকে দাঁড়াই। ভ্যালেনটাইনস ডে তাই উদ্দেশ্য তাসমিয়াকে প্রপোজ করা। ফটাফট লাল গোলাপ তাঁর দিকে এগিয়ে চোখ বুজে বলে ফেললাম আই,লাভ,ইউ।
.
বিংশ,একবিংশ শতাব্দীর প্রায় সকল
ছেলে,মেয়েরাই ইঁচড়েপাকা হয়।সত্তযুগ কলিযুগের পার্থক্য বয়জেষ্ঠ্যরা বিংশ,একবিংশ শতাব্দীর ছেলে-মেয়েদের কান্ড কারখানা দেখেই উপলব্ধি করতে পারছেন।

আমাকেও দাদী বলতো আমি নাকি অকালেই বেশ পেকে গেছি। এলাকায় সারাদিন তান্ডব চালানোই ছিলো আমার কাজ। চ্যায়ারম্যানের ছেলে থাকায় কেউ কিছু বলতে পারতো না। অমুকের পেয়াড়া গাছের পেয়াড়া সব উধাও, তমুকের আম গাছে রাত পেরিয়ে সকাল হতেই আম নাই,অমুক বাড়ির টিনের চালে মাঝরাতে ইটের ঢিল পড়েছে, তমুকের কবুতরের বাচ্চা গুলো চুরি হইছে পরেরদিন খবড় আসছে বিজয় সহ আরো ছেলেপুলেরা পিকনিক করছে কবুতর ভূনা। এলাকায় সপ্তাহে দুই,তিনটা বিচার শালিশ ডাকলে আসামি আমার বন্ধুরা হতো। আর আমি তেঁতুল গাছের ডালে বসে মজা নিতাম।
সাতবছর বয়স থেকে এতো লীলা করে বেড়াচ্ছিলাম যাতে সকল মানুষ আমার প্রতি বিরক্ত ছিলো। শুধু বিরক্ত না মহাবিরক্ত আর অসুন্তুষ্ট ছিলো।
আবেগ, অনুভূতির ব্যাপারে ছিলাম বড্ড কাঁচা। মানুষ কে কষ্ট পেতে দেখে মনের ভিতর কি যে পৈশাচিক আনন্দ হতো আমার বলার বাহিরে। দাদী আমাকে সে সময় কটা বানর বলে ডাকতো। আমার কটামি গুলো অন্যসব বাচ্চা বা অন্য বালকদের মতো ছিলোনা।আমার প্রত্যেকটা কটামির জন্য পরিবার সহ এলাকার মানুষ দের বেশক্ষতি হয়ে যেতো। আর আমি তাতেই মহা আনন্দ পেতাম। আমার এসব স্বভাবের জন্য অভিশাপ কতোজন দিছে কে জানে। সেই অভিশাপের বোঝা বইতে বইতে আজ এ অবদি পৌঁছেছি। আবেগহীন, ঘাপসাড়া ছেলেটা আজ এ বয়সে এসে কতোটা আবেগপ্রবন।সকলকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেওয়া,একটা কোমল হৃদয় ভেঙে চুড়মাড় করে দেওয়া ছেলেটা আজ কতোটা অসহায়ত্বরের স্বীকার। কতোটা আবেগ প্রবণ, কতোটা ভেঙে গুড়িয়ে গেছে তাঁ কি এলাকার মানুষ জন বা কোমলপ্রান সেই মানুষ টা জেনেছে???
জানলেই বা কি হবে নিয়তির খেলা যে বড্ড ভয়ানক।প্রকৃতি যে বড্ড নির্দয় ভাবে প্রতিশোধ নেয়।
যে পরিবর্তন সে আনতে চেয়েছিলো সে পরিবর্তন তো ঠিকই এলো কিন্তু সঠিক সময় কেনো এলোনা??
এর পিছনে যার অবদান সে কি কখনো জানতে পারবেনা?? মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিতে জানে না কথাটা সেসময় হেসে ওড়িয়ে দিলেও আজ যে বুকের ভিতর খুব পোড়ায়,,,
.
যাইহোক আসল কথায় আসি।।
.
সবে ক্লাস নাইনে পা দিয়েছি তখন। পুরো জানুয়ারি মাস একদমই ক্লাস করিনি।কিন্তু ফেব্রুয়ারী মাসের ১তারিখ থেকে ১৩তারিখ অবদি একটা দিনও ক্লাস মিস দেইনি।অবশ্য আরেকটা অদ্ভুত জিনিসও ঘটেছে আমার সাথে। নাহ শুধু আমার সাথে না আমার পুরো এলাকার মানুষ সহ আমার পুরো পরিবারের সাথে। প্রথমমত আমি এলাকায় তান্ডব কমিয়ে দিয়েছিলাম,দ্বিতীয়ত তেরোদিন যাবৎ আমি বই নিয়ে বসতাম। ক্লাসের সব পড়া কমপ্লিট করেই ঘুমাতাম। তেরোদিনে স্যাররাও আমার প্রতি বেশ সন্তুষ্ট। এর পিছনে বড় অবদান হলো তাসমিয়ার।
ওকে দেখার নেশায়ই আমি ক্লাসে উপস্থিত থাকতাম। আমি ক্লাস করেছি ঠিকি কিন্তু স্যার,ম্যাম কি পড়িয়েছে কিচ্ছু জানিনা। কারন আমি ক্লাসে উপস্থিত ছিলাম ঠিকই তবে আমার মন,মস্তিষ্ক, চোখ সবটাই স্থির ছিলো তাসমিয়ার দিকে।যখন পড়া ধরতো রাতের মুখস্থ পড়া গুলো গড়গড় করে বলে দিতাম এতেই কাজ হয়ে যেতো। ছুটির পর ক্লাসের ফার্স্ট বয়য়ের থেকে কি কি পড়া দিয়েছে সব টুকে নিতাম।
.
আমার মনে হয় এই তেরোদিনে আমি তাসমিয়ার পা থেকে মাথা অবদি যেভাবে মুখস্থ করেছি। ওর নিজের মা, বাবাও বোধহয় ওকে জন্মের পর থেকে নিয়ে আজ অবদি আগাগোড়া এভাবে দীর্ঘসময় নিয়ে দেখেনি। ক্লাসের সবচেয়ে ভদ্র এবং শান্তশিষ্ট মেয়ে তাসমিয়া,সবচেয়ে সুন্দরীও বটে। গোলাপি ফর্সা গায়ের রং ছিলো ওর, চুলগুলো ক্লাসের বাকি মেয়েদের থেকে অনেকটাই লম্বা ছিলো। রোজ ইয়া লম্বা বেনুনী করে আসতো বেনুনির শেষ অংশে ফুলওয়ালা রাবার বাঁধা থাকতো।সাদা ড্রেসটায় কালো লম্বা চুলগুলো কি মারাত্মকই না লাগতো। তাঁর থেকেও বেশী আকর্ষণীয় লাগতো সামনের চুল ফোলানোটা। কপালে কুশি চুলগুলো লেপ্টে থাকতো উফসস অস্থির। মুখের গড়ন টা ছিলো একদম আকৃতি কক্করের মতোন চোখ গুলো বড় না হলেও ছোট ছিলো না,ভ্রুজোরা চিকন পাতলা ছিলো, নাকটা ছিলো চোকা,ঠোঁট জোরা ছিলো লাল গোলাপি। মোট কথা সে আহামরি সুন্দরীই ছিলো।

বাকি মেয়েরা ক্লাসে সারাক্ষন পাখির মতো কিচিরমিচির করতো।কিন্তু সে একদিকে যেমন চুপচাপ স্বভাবের অন্যদিকে মারাত্মক লেভেলের নম্র,ভদ্র ছিলো। ভয়েস টা ছিলো একদম কোকিলের সুরের মতো। একদম পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চা টাইপ ভয়েস। স্যারদের পড়া দেওয়ার সময়ই প্রথম তাঁর ভয়েস শোনার ভাগ্য হয়েছিলো তখন। নয়তো যা চুপচাপ ছিলো পড়াশোনা না থাকলে না তাঁকে দেখার ভাগ্য হতো আর না তাঁর ভয়েস শোনার ভাগ্য হতো আর না আমার স্কুল জীবনের প্রেমটা সফল হতো। সত্যি কি সফল???প্রণয় ঘটলেই কি প্রেম ভালোবাসা সফলতা পায় নাকি পরিণয়েরও প্রয়োজন।
.
যাকগে তারপর বলি- তাসমিয়া চুপচাপ এসে ক্লাসে বসতো স্যারদের পড়ানো মনোযোগ সহকারে শুনতো ক্লাস শেষে সোজা গেটের সামনে চলে যেতো। কখনো অটো, কখনো বা রিকশা করে বাসায় চলে যেতো। আমি যে তেরোটা দিন ওকে ক্লাস থেকে শুরু করে বাসা অবদি পৌঁছানোর সময়টা ফোলো করছি সেসব ওর জানা ছিলো না।
থাকবে কি করে আশেপাশের কোন দিকে তাঁর খেয়াল থাকলে না জানবে। তারপর এসে গেলো ১৪ই ফেব্রুয়ারী তাঁকে প্রোপজ করার পর সে মিনমিনে স্বরে বললো-
“এসব কি বলো বিজয় তুমিতো আমার ক্লাসমেট, বন্ধু। আমরা একসাথে পড়ি আমাদের মধ্যে এসব কিছু না আনাই ভালো।তাছাড়া আম্মু বলেছে কোন ছেলে প্রপোজ করলে আমি যাতে কখনো একসেপ্ট না করি। তাই আমি তোমার প্রপোজ তোমাকেই ফেরত দিলাম”
আমি তখন বুদ্ধি করে বললাম “আচ্ছা ফেরত দিলা কিভাবে দিলা আমি যে কষ্ট করে আই লাভ ইউ বললাম এখন এইটা কি তুমি ফেরত দিছো”??
আমার কথা শুনে তাসমিয়া চোখ পিটপিট করে চেয়ে দেখলো আমাকে। বুঝলাম মেয়েটা বোকাসোকা তাই আবার বললাম “আমার আই লাভ ইউ আমাকে ফেরত দাও নয়তো ক্লাসে যেতে দিবো না আর মাএ দশমিনিট আছে তারাতারি ফেরত দাও”
তাসমিয়া কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো- “কি বলো বিজয় কিভাবে ফেরত দিবো? তুমি আমাকে না যেতে দিলে আমি আম্মুকে বলে দিবো”
আমিও বললাম “আমার আই লাভ ইউ আমাকে ফেরত না দিলে আমিও আব্বুকে বলে দিবো।আমার আব্বুকে চিনোতো এই এলাকার চেয়ারম্যান। এক ধমক দিয়ে তোমাকে কাঁপিয়ে তুলবে”
আমার কথা শুনে তাসমিয়া মুখটা কান্নার ভঙ্গি করলো আর বললো- “কিভাবে ফেরত দিবো”
আমি বললাম-“চোখ বুজে বলো আই লাভ ইউ। বলে দাও আমি নিয়ে চলে যাই”
তাসমিয়া সত্যি তাই করলো। আর আমিও সরে দাঁড়ালাম।
.
সেদিনের পর বেশ কিছুদিন চলে যায়। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আমার আব্বা আমাকে এন্ড্রোয়েড ফোন কিনে দেয়। নতুন ফোন পেয়ে আমার তখন উড়াউড়ি অবস্থা। এক বড় ভাইকে দিয়ে ফেসবুক একাউন্ট খুললাম। বড় ভাইয়ের পরামর্শে ফেসবুকে অহরহ মেয়েদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম। একসেপ্ট করতে না করতেই আলাপ জুরে দিলাম।
বয়সে বড়, ছোট বাচ বিচার নাই যার তাঁর সাথে যা তা আলাপ শুরু করলাম। বয়সটাই ছিলো চোখে রঙিন চশমা দেখার মতো। যা দেখি তাই ভালো লাগতো, যাকে দেখতাম তাকেই ভালো লাগতো। অবশ্য তাসমিয়া আলাদা ছিলো আমার চোখে,
সত্যি বলতে প্রথম ফোন পেয়ে তাসমিয়ার বিষয়টা মাথা থেকে একদমই চলে গেছিলো। বেশ কদিন স্কুল ও মিস দিয়েছিলাম। কিন্তু পরের মাসে বন্ধু জুনায়েদ বাইক কিনলো ফোনের নেশা কেটে নেশা লাগলো বাইকে। আব্বার কাছে আবদার করতে সে জানালো এস এস সির পর বাইক দিবে। কিন্তু বাইক নেশা এতোটাই প্রখর হয়ে গেছিলো যে জুনায়েদের সাথে সম্পর্ক আরো পাকা পোক্ত করলাম। ওর সাথে চলাফেরা বাড়িয়ে দিলাম। একদিন জুনায়েদ এসে বললো “বিজয় স্কুল ছুটির পর এক মেয়ে কে ফলো করতে হবে” আমাকে বুঝিয়ে দিলো বাইক নিয়ে মেয়েটার পিছন পিছন ছুটতে হবে মেয়ের বাড়ি কোথায় তাই জানতে হবে। আমি ওর এক কথায় রাজি হলাম কারন সব নেশার বড় নেশা মেয়ে নেশা।
তখন যা মনে করতাম আর কি,,,বড় ভাইদের থেকেই শেখা সব। জুনায়েদ আর আমি স্কুল ছুটি হতেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম জুনায়েদ আঙুলে ইশারা করতেই আমি ওর ইশারার দিকে তাকালাম।
তাসমিয়ার সেই মিষ্টি মুখটা দেখতেই আমি চমকে জুনায়েদের দিকে তাকালাম । জুনায়েদ যে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট বেশ বুঝলাম। বাইক স্টার্ট দিতে পিছন বসে বললাম -“ওটাতো তাসমিয়া আমার গার্লফ্রেন্ড”
জুনায়েদ যেনো চমকে গেলো পিছন ঘুরতে চেয়েও পারলো না সামনে আগাতে লাগলো তবে স্পিড একটু কমিয়ে দিয়েছে। বিস্ময় গলায় বললো- “কি বলিস ঘটনা সত্য নাকি”
আমি কোনপ্রকার ভনিতা ছাড়াই বললাম-“একদম সত্য তুই ওকে জিগ্যাস করিস ১৪ফেব্রুয়ারিতে ও আমাকে আই লাভ ইউ বলছে কিনা”
জুনায়েদ বিশ্বাস করলো আমিও স্বস্তি পেলাম।
সেদিন তাসমিয়ার বাসার রাস্তা অবদি গেলাম, তাসমিয়াকেও দেখে আসলাম। পরেরদিন সকাল সকাল স্কুল এসে তাসমিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু মেয়েটা এলো সেই ৯ঃ৪০ এর দিকে। ক্লাসে ঢোকার পথে পথ আটকে দাঁড়ালাম। তাসমিয়া অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাতেই বললাম -“তোমার নাম্বারটা দাও পথ ছেড়ে দিবো”
তাসমিয়া বেশ বিরক্ত হলো বুঝলাম তবুও সে সময় এসবের ধার আমি ধারতাম না। পুরোই থ্রেড দিলাম “নাম্বার না দিলে স্কুলের সবাইকে বলে দিবো তুমি আমাকে আই লাভ ইউ বলছো বেহায়া মেয়ে মানুষ তুমি”
তাসমিয়ার চোখ দুটো পানিতে টলমল হয়ে গেলো।
কান্না করে দিবে প্রায় মিনমিনে স্বরে বললো- “আমার মোবাইল নাই বিজয়। তুমি এমন করো কেনো তুমিই তো আই লাভ ইউ ফেরত চাইছো”??
আমি বললাম ” আমি যে ফেরত চাইছি তার কোন প্রমান আছে??আর মোবাইল নাই সমস্যা নাই। তাহলে আমার নাম্বার নিয়ে যাও যার মোবাইল আছে তাঁর টা দিয়েই ফোন দিবা সময় করে”

বোকা মেয়েটা বুদ্ধি করে বলতেও পারলো না যে সে যে আই লাভ ইউ বলেছে তাঁর ও তো প্রমান নাই কোন আমি ছাড়া হাহাহা।

যাকগে,,, তাসমিয়া ভয় কন্ঠে বললো- “আম্মু আমাকে বকা দিবে”
আমি বললাম – “চুপি চুপি ফোন দিবা”
তাসমিয়া অবাক চোখে চেয়ে বললো-“কিভাবে”??
সময় কম থাকায় আমি তারাতারি ওর ব্যাগ থেকে খাতা বের করে আমার নাম্বার লিখে দিলাম।
আর বললাম -” তোমার আম্মু যখন গোসলে যাবে তখন ফোন দিবা বা তোমার আম্মু যখন ঘুমিয়ে যাবে তখন দিবা।না দিলে কিন্তু তোমার বেহায়াপনা সবার কাছে রটিয়ে দিবো”

ঐ সময়ে তাঁকে আমার ৯০দশকের মেয়ে মনে হচ্ছিল। আর আমি তাঁর থেকে দশধাপ আগানো ছিলাম। তাঁর মনটা এতোই কোমলীয় ছিলো যে সহজেই যা খুশি বুঝিয়ে মানিয়ে নিতে পারতাম।
কিন্তু আজ,,,হাহাহা।
.
পরেরদিন শক্রবার জুম্মার নামাজ শেষে বাড়ির সামনের কাঁচা রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি ঠিক সে সময়ই আমার ফোনে কল এলো। অচেনা নাম্বার দেখেই কেটে দিলাম। মুচকি হেসে গাছের আড়ালে চলে গেলাম। সেদিনই প্রথম কোন মেয়ের সাথে আমার ফোন আলাপন হলো।
তাঁরও প্রথম কোন ছেলের সাথে ফোনে আলাপ হলো। তা তাঁর ভয়াতুর ভয়েস শুনেই বুঝেছিলাম। প্রথম মা,বাবা পরিবার পরিজন থেকে লুকিয়ে আমায় ফোন করেছিলো।
আর আমি প্রথম তাঁর সাথে ফোনে কথা বলেছিলাম।
সেদিন আমাদের প্রায় দশমিনিট পঁচিশ সেকেন্ড কথা হয়। কথার শুরুতে সে বলে দিয়েছিলো সে যখন কেটে দিবে আমি যেনো আর কল ব্যাক না করি। আমি যেনো বুঝে নেই তাঁর মা এসে পড়েছে। ঠিক তাই করলাম।
.
পরের দিন স্কুলে তাঁকে দেখলাম অন্য রূপে। তাঁর চোখে, মুখে ভর করেছিলো একরাশ লজ্জা।সেদিনই প্রথম আমার সামনে আসার পর তার গালজোরা টমেটোর মতো লাল বর্ন ধারন করেছিলো। আমিও বুঝে নিয়েছিলাম যা বোঝার।
.
তারপর থেকে তাসমিয়া মাঝে মাঝে আমাকে লুকিয়ে ফোন দিতো। প্রথম দু,তিনদিন আমার জোর করায় দিতো। পরের দিনগুলো ও নিজে থেকেই দিতো।

অল্প বয়সে আবেগটা বেশী থাকে কিনা।তাসমিয়ার ক্ষেএে অভ্যাসটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।
প্রেম,ভালোবাসার শুরুতে দুদিন ছেলে-মেয়ে কথা বললেই তাঁরা সেটাকে আজীবনের অভ্যাস গড়ে তুলতে চায়। কারন দুদিনে তাঁদের মনে যে রং লাগে সে রং এর নেশায় পড়ে যায় তাঁরা। যেমন-মদ বা নেশা জাতীয় দ্রব্য আপনি প্রথম দিন খেলে আপনার কষ্ট হবে,দ্বিতীয় দিন খেলে কষ্টের পরিমান কমে একটু ভালো লাগা আসবে,তৃতীয় দিন অনেকটাই ভালো লাগবে এভাবে আপনি মদের নেশায় আসক্ত হয়ে যাবেন আপনি চাইলেও সেটা আর ছাড়াতে পারবেন না। আপনার মস্তিষ্ক বলবে এটা ত্যাগ কর কিন্তু আপনার ভিতরের আরেকটা ইন্দ্রিয় শক্তি চুম্বকের মতো টানবে মদ্য পান করতে। যেখানে নেশা দ্রব্য প্রথম পান করলে আপনি কষ্ট পাচ্ছেন তবুও সেই নেশায় আসক্ত হচ্ছেন।

সেখানে ছেলে মেয়েরা প্রেমের নেশায় প্রথমই যে ভালোলাগার অনুভূতি পায় সেই নেশা কাটাবে কি করে??

তাসমিয়াও নেশায় পড়েছিলো তাঁর সাথে আমিও।
ও আমার কথায়, আমার মুখের আর আমি ওর সবটায়।
.
যাকগে মেইন পয়েন্টে আসি-
আমি কখনো আগে ফোন দিতাম না তাসমিয়াই আগে মিসড কল দিতো আর আমি ব্যাক করতাম।তখন আমাদের কথা ১৫,১৬মিনিটেই সীমাবদ্ধ ছিলো।মেয়েটাকে সামনে থেকে যতো চুপচাপ মনে হয় ফোনে ততোটাই চন্চ্ঞল।
তাঁর প্রত্যেকটা কথাই মুগ্ধ হয়ে শুনতাম আমি। দিন দুনিয়া ভুলে তাঁর সাথে কথা বলতাম। সে খুব অল্প সময় দিলেও ফোন কাটার পর তাঁর সাথে যে কয়মিনিট যা যা কথা বলতাম সব আবার নিজে নিজেই আওরাতাম।

আমাদের প্রথম একমাস অল্প সময়ের কথা গুলো ছিলো “কেমন আছো” কি করো”তিনবেলা ঠিকঠাক খাওয়া হয়েছে কিনা। খোঁজ খবড় নিতাম দুজন দুজনের। তারপরের টপিক সেই আনতো এই যেমন- “জানো আজ বাসায় এই হয়েছে। ছোট ভাই এই করেছে, সেই করেছে। জানো আজ আমায় আম্মু বকেছে।
.
আমি তাঁর কথা শুনতাম সুখের কথা বললে সুখ পেতাম। বুকে সুখ সুখ অনুভূতি হতো। তাঁর হাসিতে আমার ঠোঁটে অটোমেটিক হাসি চলে আসতো।

দুঃখের কথা বললে দুঃখ পেতাম। তাঁর কষ্ট পাওয়ার কথা শুনে বুকে কষ্ট লাগতো। কি জানি পনেরো বছর বয়সে এতো ফিলিংস কই থেকে আসতো।

আমি তেমন কিছু বলতে পারতাম না আমার শুনতে ভালো লাগতো। জিগ্যাস করার মধ্যে ভালো আছে কিনা,কি করে,কি খেয়েছে, রাতে ঘুম কেমন হয়েছে,
কি রঙের জামা পড়েছে এগুলাই করতাম। সে এতেই খুশি হতো খুবব। খুশি হওয়ার জন্য তাঁর এটুকুই যথেষ্ট ছিলো।
.
সময়গুলো ভালোই কাটতে লাগলো। ফোনে দুজন বেশ কথা বললেও সামনাসামনি তখন কেমন জানি কথা বলতে পারতাম না । যদি বলি প্রেম, যদি বলি ভালোবাসা তাঁর শুরুটা তখন থেকেই হয়ে গেছিলো।
.
আশ্চর্য জনক হলেও সত্যি আমাদের দুজনের মাঝে বেশ পরিবর্তন আসলো।সে মেয়ে তাই তাঁর লজ্জা পাওয়া টা স্বাভাবিক ছিলো কিন্তু লজ্জা নামক আজিব এক অনুভূতি আমার ওপর এসেও ভর করলো। ইশ কি যন্ত্রনা তাসমিয়া সামনে এলেই আমার পাগল,পাগল লাগতো। সব কিছু উলটপালট লাগতে শুরু করতো। আগে ওর সামনে গড়গড় করে কথা বলতে অসুবিধা হতো না।
কিন্তু যেদিন থেকে ওর সাথে আমার ফোন আলাপন শুরু হলো সেদিন থেকে আমি যেনো কেমন হয়ে গেলাম। ও আমার চোখের দিকে তাকাতে পারতো না। কিন্তু আমি আমিও সেই একি অনুভূতির স্বীকার হলাম।
.
মানবজাতির মধ্যে প্রায়ই একটা স্বভাব খুব বেশী লক্ষ করা যায়,, যা আমি আমার নিজের মাঝে ঠিক সময় লক্ষ করতে না পারলেও দেরীতে করেছিলাম। যেমন নতুন বই হাতে পেলে প্রথম কয়েক মাস সেই বইয়ের খুব যত্ন নিতাম। টেবিলে বই রাখতে গেলেও এমন ভাবে রাখতাম যেনো একটু জোরে রাখলেই বইটা ব্যাথা পাবে। অথচ কয়েকমাস পেরিয়ে গেলে নিজেই সেই বইয়ে কলম দিয়ে হুদাই দাগ কাটটাম। ফাইনাল পরীক্ষা না দিতেই বই কেটে কুটে ক্ষতবিক্ষত করতাম।মানে ছিঁড়ে ফেলতাম,, কখনো নকল করার জন্য পৃষ্ঠা গুলো কেটেকুটে নিয়ে যেতাম পরীক্ষার হলে। স্টুডেন্ট হিসেবে বইয়ের প্রতি যে একটা দরদ থাকা লাগে সেটা আমার ছিলো না।
যার কারনে সফল স্টুডেন্টও হতে পারিনি। আমার এই বিশ্রি স্বভাব টা শুধু বইয়ের প্রতি ছিলো না। সব বিষয়েই ছিলো। নতুন থাকা অবস্থায় বেশ কদর দিতাম পুরোনো হলেই ছুঁড়ে ফেলে দিতাম।
কখনো বুঝতেই পারিনি “পুরোনো হলে সব জিনিস ছুঁড়ে ফেলতে হয় না। কিছু জিনিস যতো পুরোনো হয় ততোই মহামূল্যবান এবং খাঁটি হয়” ঠিক সোনার মতো যেমন সোনা যতো পুরোনো ততোই খাঁটি।
.

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here